কাবুল থেকে ফিরেছেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। ইশকুলে পড়াতেন। ফিরে আসার পর টিভিতে অনেক কিছু বলেছেন। এক কথায় যার মর্মার্থ হল তালিবান জমানা যতটা ভয়াবহ ভাবা হচ্ছে তা নয়। এ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। হবারই কথা। কারণ আমরা কেউই কদাচ কাবুল যাইনি। আমাদের ভাই-বেরাদর-ছোটোমেসো-বড়পিসি কেউ আফগানিস্তানে থাকেনা। আমরা মূলত পরের মুখে ঝাল খাচ্ছি, আর দূর থেকে লিংক ছোঁড়াছুঁড়ি করে বিপ্লব কিংবা সলিডারিটি দেখাচ্ছি। আমি তো ব্যক্তিগতভাবে মুজতবা আলি বা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর এই প্রথম একজন বঙ্গসন্তানের নাম শুনলাম যিনি আফগানিস্তান গেছেন। ফলে উত্তেজনা স্বাভাবিক।
সমস্যা হচ্ছে, ভদ্রলোকের যে ভঙ্গীতে সমালোচনা হচ্ছে, সেটা নিয়ে। ওঁর বক্তব্যে কী আছে? উনি বলেছেন, উনি কাবুলে বিশেষ কোনো সমস্যায় পড়েননি। তালিবান কম্যান্ডাররা বস্তুত সাহায্য করেছেন। গুলি চালিয়েছে মার্কিন সৈন্যরা। ওঁদের ইশকুলও চালু আছে। মহিলারা কাজকম্মোও করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও করছেন। যদিও তালিবানরা হিজাব বাধ্যতামূলক করেছে। সব মিলিয়ে কাবুল শান্তিপূর্ণই আছে। উনি কাবাব বেশি ভালো খেয়েছেন তালিবান রাজত্বে,মাংসের পরিমান বেশি, কারণ শরিয়া আইনে ঠকানো নিষেধ। হ্যাঁ, তালিবানরা অবশ্যই শরিয়া আইন চালু করেছে। তারা প্রচণ্ড প্রতিশোধপরায়ন, আমেরিকানদের হয়ে যারা কাজ করেছে, তাদের উপর প্রতিশোধ নেবেই। এবং তালিবানদের মধ্যে অবশ্যই উনি কোনো মহিলা দেখেননি, কারণ তারা গোঁড়া, মহিলা থাকার কোনো প্রশ্নই নেই।
তো, এইসব বক্তব্যে তালিবানরা ঈশ্বরপ্রেরিত ফরিশতা, এরকম দাবী কোথাও নেই। হিজাব, শরিয়া আইন সবেরই উল্লেখ আছে। কিন্তু তালিবান ভয়াবহতার যে দুনিয়াজোড়া ন্যারেটিভ, সেসব অল্প হলেও ধাক্কা খাচ্ছে। এবং সেই ন্যারেটিভের স্পর্শকাতরতা এত বেশি, যে, পান থেকে চুন খসলেই আহত হয়ে কামড়ে দেয়। ফলে গুচ্ছের সমালোচনা হচ্ছে। তার একটা ভঙ্গী সহজবোধ্য। "রোজ সকাল থেকে রাত অবধি টিভিতে দেখছি আফগানিস্তানে বর্বরের রাজত্ব নেমে এসেছে, ধরছে, পাথর মারছে, পারলে মানুষ মেরে খেয়ে নেয়, আর আপনি বলছেন আপনার ইশকুলে মেয়েরা আসছে? ইয়ার্কি হচ্ছে?" -- এইটা হল একটা ভঙ্গী। এটা হল সরাসরি অবিশ্বাস।
দ্বিতীয় যে ভঙ্গীটা, সেটা আরও বিপজ্জনক। সেটা হল, ছকে ফেলে দেওয়া। কোনো আফগানিস্তান ফেরত বাঙালি মুসলমান এই কথা বললে তাকে কী ছকে ফেলা হত, আপনারাও জানেন, আমিও জানি। মুজতবা আলির জমানা আর নেই। সে কারণেই সেইসব কণ্ঠ শোনা যাবার কোনো প্রশ্নই নেই। এই ভদ্রলোক হিন্দুসন্তান, তাঁকে এই ছকে ফেলা যাবেনা, যা প্রাণে চায় বলেছেন। সেটা ঠিক বা ভুল যা খুশি হতে পারে। একই সঙ্গে ঠিক এবং ভুল দুইই হতে পারে, কারণ উনি সারা আফগানিস্তান দেখে আসেননি, অনেক কিছু ঘটছে হয়তো যা উনি জানেননা, উনি শুধু নিজের দেখা কাবুলটুকুই বলেছেন। কিন্তু মজা হচ্ছে, এসব নিয়ে কোনো কথার আগেই ওঁকে অন্য একটা ছকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। মুসলমান নয়, ফলে মোল্লাতন্ত্রের মুখ বলা যাচ্ছেনা। ফলে 'প্রগতিশীল' ঘরানার একটা ছক তৈরি হচ্ছে। ছকটা মজার এবং বিপজ্জনক। ভদ্রলোক জন্মসূত্রে হিন্দু, পদবী ভট্টাচার্য। ফলত, "বামুনের পো" এবং "পুরুষ", অর্থাৎ "প্রিভিলেজড"। এবং এসব হল "ম্যানসপ্লেনিং"।
এটা একেবারেই হাসির কথা নয়। কারণ ইতরজনেরা কারো বক্তব্যের বিরোধিতা করার আগে ব্যক্তিটিকে প্রোফাইলিং করে, এবং ব্যক্তিপরিচয়কে আক্রমণ করে। যেমন, "মোল্লারা তো আফগানিস্তানকে ভালো বলবেই"। বা, "মেয়েমানুষের আবার কথা"। কিংবা "কাফেরের কথায় বিশ্বাস কোরোনা"। এখানেও পদ্ধতিটা একদম এক। জাত এবং লিঙ্গ বেছে নিয়ে "ব্যাটা বামুনের পোর আবার কথা"। কোনো মহিলার কথার উল্টোদিকে কোনো পুরুষ মতামত দিলেই সেটা কীকরে ম্যানপ্লেনিং হয়, এসব ন্যূনতম সাধারণজ্ঞানের প্রশ্নে নাহয় নাই যাওয়া হল। কিন্তু ব্যক্তি নয়, বিরোধিতাটা হওয়া দরকার বক্তব্যের, কারো বক্তব্যের বিরোধিতায় "ছিছি উনি তো জাতিতে অমুক" বা " ওনার তো দু পায়ের ফাঁকে তমুক চিহ্ন" বলাটা অসৌজন্য বা অসভ্যতাই শুধু নয়, মৌলবাদ, এটুকু না মানলে তো বিশ্বসংসারে কে তালিবান আর কে নয়, ফারাক করাই অসম্ভব।
স্ট্যাম্প লাগিয়ে নিদান হাঁকাটা এ সময়ের যুগলক্ষণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী ভাগ্যিস মুজতবা এ যুগে জন্মাননি। নইলে মেয়েদের মুখ ঢাকার যাথার্থ নিয়ে আফগানের বক্তব্যের প্রশংসার জন্য নির্ঘাত "সৈয়দের ব্যাটা, প্রিভিলেজড মৌলবাদী" শুনতে হত। তাঁর সময়ে সেটা তাঁকে শুনতে হয়নি। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর জীবিত নেই। তাঁকেও "বামুনের বেটি, মেয়েমানুষ" বলে কেউ নস্যাৎ করেছে বলে শোনা যায়নি। করলে সেটা নিন্দনীয়ই হত। যে ভদ্রলোকের কথা পছন্দ হচ্ছেনা, দুটো বাক্যেই ন্যারেটিভের তাসের ঘর ভেঙে যাবে বলে মনে হচ্ছে, তাঁকে "বামুনের ব্যাটা, পুরুষমানুষ" বলে নস্যাৎ করার চেষ্টাও একই কারণে নিন্দনীয়।