বছরে বেশ কয়েকবার দূরপাল্লার মেল বা এক্সপ্রেসের যাত্রী হওয়ার সুযোগ আমার হয়েই থাকে। ট্রেনে সবসময়ই আমার বড় পছন্দের জালনার ধার। নির্দিষ্ট সীটটি বেশ কিছু ঘন্টার জন্য আমার নিজস্ব পৃথিবীর মতো হয়ে যায়। একই পথে বহুবার আসা যাওয়া করলেও জালনার বাইরের পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রতিবারই আমাকে নতুনভাবে আকর্ষণ করে থাকে। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ঋতুতে সেই বিশেষ যাত্রাপথটি বিভিন্ন রূপ, রসে আমার চোখে ধরা দেয়। যত বয়স বাড়ছে, ঐ পরিচিত রূপ রসের দুনিয়ার বহু গোপন রহস্য অন্তরে উন্মোচিত হচ্ছে। বুঝতে পারি এই পাঠশালার পাঠ্যক্রমের কিছুই বিশেষ পড়া হল না আজও। তাই বারেবারে ইচ্ছে হয় অমনভাবে জালনার পাশে বসে সৃষ্টিকর্তার অতি যত্নে রচিত প্রকৃতিকে দু চোখ ভরে দেখতে, মনের পরতে পরতে অনুভব করতে। যাত্রাপথের এই বাঁধা সময়টিতে মনকে বেঁধে রাখি এই অনুভবের সঙ্গেই।
এমনই কোনোও একবারের কথা লিখছি। [©মৌসুমী ব্যানার্জী]
গরমের দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে সময়। খাল, বিল, সবুজ ক্ষেত, বড় গাছপালা --- সব পার করে ট্রেন ছুটছে। জালনার বাইরের দৃশ্য সমান তালে বদলাচ্ছে। আকাশ ধীরে ধীরে বেলাশেষের গোলাপী আলোয় সাজাচ্ছে নিজেকে। আরও কিছু পরে গোলাপী রং গাঢ় হল। ক্ষেত, নদী, খাল--- সর্বত্র সেই নরম গোলাপী আলোর পোশাকে মায়াময় হয়ে উঠল। এরই মধ্যে চা-ওয়ালার 'চায় --চায়-- চায়' রব মনকে ট্রেনের কামরার মধ্যে ফিরিয়ে আনল। ট্রেন চলছে। জালনার বাইরে অন্য ছবি। দূরের পাহারশ্রেণী এবার আমার দৃষ্টিপথে। ততক্ষণে আকাশের রঙে কত বৈচিত্র্য! দিনমণি পাড়ি দিচ্ছেন অন্য পৃথিবীর আকাশে। বিদায়বেলার উৎসবে মেতেছে প্রকৃতি। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, আকাশ আবীর খেলায় মেতে উঠেছে যেন। সেই রঙের ছোঁওয়া জালনার ভিতরে আমার মনেও লাগল। আহা! মনপ্রাণ কি এক আনন্দে ভরে উঠল।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নামতে শুরু করল। একটি স্টেশন আসতে ট্রেন থামল। নানারকম শব্দ, হট্টোগোল, লোকজনের নামাওঠার শেষে ট্রেন চলতে শুরু করল। দূরের সেই পাহাড় এখন অনেক কাছে। কালচে ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছি। রেললাইনের ধার ঘেঁষে কিছু মাটির কুঁড়ে ঘর দেখা যাচ্ছে। আবছা আলো আঁধারিতে দেখলাম সেই কুঁড়েঘরগুলির উঠোনে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে রান্নার তোড়জোড় চলছে। আমার পরিচিত জগতের বাইরে এ আর এক জগৎ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কাঠের আগুনের শিখা এক অদ্ভুত রহস্যময়তা তৈরী করেছে যেন! এক আদিম পৃথিবীর পরশ পেলাম যেন!
কিছু পরেই আকাশ নতুন রূপে ধরা দিল। পরিষ্কার দূষণমুক্ত আকাশ রাশি রাশি মণি মুক্তোর সাজে সেজে উঠেছে। অজস্র গ্ৰহ, নক্ষত্রের সমাবেশ। যেটুকু দেখা যায় জালনা দিয়ে তাতেই বিভোর হয়ে রইলাম।
এক জায়গায় কোনোও কারণে ট্রেন থামল। ঝিঁ ঝিঁ পোকার নানারকমের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আকাশের হীরে, মণি, মুক্তোর সম্ভার রেললাইনের পাশেই! অনেকটা জায়গা জুড়ে! জোনাকী!! মনে তখন রবিঠাকুরের গান ---
'ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ। আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ।'
মনে মনে ওদের সঙ্গে নিজেও ছোটাছুটি করছি। ট্রেন চলতে শুরু করল। জোনাকীর ঝাঁক অদৃশ্য হয়ে গেল কিন্তু মনের মধ্যে ক্যামেরাবন্দী হয়ে রইল তারা। রবিঠাকুরের গানের লাইন মনে বাজছে তখন ---"তুমি ছোট হয়ে নও গো ছোটো"---
রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে আবছা অন্ধকার । চাঁদের আবছা আলো বড় বড় গাছপালার মধ্যে দিয়ে থেকে থেকেই দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় খাওয়া সেরে শোবার আয়োজন চলছে পুরো কামরাতেই। নানারকম কথাবার্তা কামরার মধ্যে। একটি ছোট বাচ্চা থেকে থেকেই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। এরই মধ্যে প্যান্ট্রি থেকে বিভিন্ন খাবারের চলমান পসরা, ওদিকে পানি বটল.... অদ্ভুত এক গতিময় জগৎ কামরার ভিতরে। যাই হোক, লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে লোকজন। আমিও নিজের বেডিং গোছগাছ করে লাইট নিভিয়ে জালনার বাইরে চোখ রাখলাম। আকাশে তখন শুক্লা একাদশীর চাঁদ। মেঘমুক্ত আকাশ। জ্যোৎস্নায় মাঠ প্রান্তর হাসছে। অপূর্ব!! এমন মায়াবী রাত! না শুয়ে বসেই রইলাম। থেকে থেকেই পাহাড়ের সারি। অজানা কারণে ট্রেন থেমে গেল। জালনার বাইরে কিছু দূরেই বেশ উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় গ্ৰহ, নক্ষত্রের মুকুট। মুকুটের মাঝখানে চাঁদ উজ্জ্বল মণির মতো জ্বলজ্বল করছে। পাহাড়ের অঙ্গে জ্যোৎস্নার উত্তরীয়। অদূরেই দেখা যাচ্ছিল একটি নদীর কিছু অংশ। মন তখন কল্পনার জগতে দিশাহারা হয়ে পাড়ি জমাল সেই ছোটবেলার মতো। ঐ তো! ঐ নদীর বাঁকে যেন পরীদের দল ভীড় করেছে ! জ্যোৎস্নার পোশাক তাদেরও অঙ্গে! তাহলে কি নিছক রূপকথার গল্পেই নয়? বাস্তবেও? এমন নিরিবিলি রাতেই এরা মর্ত্যে অবতরণ করে? কি আনন্দ! আমারও যে ওদের সঙ্গী হতে ইচ্ছে করছে!
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। আমারও কল্পনার জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল। একটু পরেই ঝমঝম করে এল নদীর উপরের ব্রীজ। দেখলাম সেই নদীকে। আকাশ, চাঁদ, পাহাড় সকলেই নদীর জলের আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখছে। তবে নদীর কি তাতে কিছু এল গেলো? কিসের এত সাজগোজ! জনবসতিহীন এমন সব এলাকায় প্রকৃতি নিশ্চিন্তে নিজের রূপ মেলে ধরে! কার জন্য?
কিছু পরেই বড় গাছপালার জঙ্গল শুরু হল। প্রকৃতি যেন মুখ লুকালো ঘন গাছপালার আড়ালে। আমিও শুয়ে পড়লাম।
কোনও স্টেশন এলেই ঘুম ভেঙে দেখা আমার অভ্যাস। গভীর রাতে জনশূন্য স্টেশন চত্বর বেশ লাগে দেখতে। প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া বেঞ্চে হয়তো কেউ ঘুমিয়ে আছে। কিছু দূরে খান কয়েক কুকুরও এলোমেলো ভাবে গভীর নিদ্রায়। নিরিবিলি পরিবেশকে খানখান করে সিগন্যাল বেজে উঠে ট্রেন চলল।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙল। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে যাওয়ায় নামবার প্রস্তুতি শুরু হল। এরই মধ্যে আবার আকাশে রঙের খেলা। ধীরে ধীরে সূর্যোদয় হচ্ছে। আগের দিনের শেষে গোলাপী আবীর খেলে যাওয়ার সময় সূর্যদেব প্রকৃতিকে দিয়ে গিয়েছিলেন রাত পোহালেই ফিরে আসবার আশ্বাস। বীরশ্রেষ্ঠকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রকৃতির ঝুলিতে তখন মুঠো মুঠো কমলা রঙের সম্ভার। শুরু হল রঙের খেলা।
আরও একটি নতুন দিনের সূচনা হল। [©মৌসুমী ব্যানার্জী]
Khub bhalo laglo. Ami o train bromon er somoy janlar dhare boshe bairer jagat ta ke dekhte khub bhalobashi.... andhokar hoye jaoyar pore o. Thik lekhika Mousumi r moto!
Tobe lekhika r moto ashadharon bhasaye bornona kora ami bhabtei pari na
অসাধারণ লেখা
বাহ খুব ভালো লাগলো
খুব সুন্দর লেখা I পড়তে পড়তে মনে হলো আমিও যাত্রী হয়ে চলেছি I লেখা সব ছবি হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠেছে I
খুব ভালো লাগল। আরও লিখুন।
বার বার তোমার লেখা পড়তে মন চায়। খুব সুন্দর লেখা। এমন আরো লেখো।
অপূর্ব গতিশীল লেখনি। গ্রাহক হলাম