সকাল থেকে টেনশনটা হচ্ছিল। অনেকদিন পর নিজের ছোটবেলার ছোঁয়া পাবে, এ কি কম? হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে বার-দুই ঘর-বাহির করে তোর্সা। মা-ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, কী রে অনেকটা পথ তো, জামাইয়ের এত দেরি হচ্ছে কেন?
তোর্সা আবার মোবাইলে আবিরকে ধরার চেষ্টা করে। আবার পরিষেবা সীমার বাইরে। মায়ের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে থমথমে মুখে ঘরে ঢুকে যায়। একটা ফোন তো করা উচিত। একটা পোলিও মেয়েকে নিয়ে দু-আড়াই ঘন্টা রাস্তা তো কম নয়। শোকেস আলমারির সামনে এসে দাঁড়ায় চেয়ারটা। তোর্সা মুখ তোলে, যেখানে উজ্জ্বল হয়ে হাসছে আবিরের মুখ। ছবিটা এতটাই সজীব।
মানুষটার দিকে তাকিয়ে তোর্সা নিজের চোখদুটো বোজে। এই লোকটা কোনোদিন তার কল্পনায় ছিল না। সেই ছোটবেলায় ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিল তার সঙ্গে। একই মাস্টারমশাইয়ের কাছে। এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত আবির। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিল না। স্কুল করে মাস্টারমশাই তাদের বাড়িতে আসার কুড়ি পঁচিশ মিনিট পরে সে ঢুকত। আসলে স্কুল থেকে ফিরে পাশের বাগানে গুলি নিয়ে চলে যেত। তার মা অর্থাৎ তোর্সার বর্তমান শাশুড়ি ডেকে ডেকে ছেলেকে খুঁজে এনে ঘাড় ধরে দিয়ে যেতেন তাদের বাড়িতে। একা অংকে কাঁচা ছিল, তার উপর দেরিতে আসার জন্য দুটো সাদা পায়ে ছপছপিয়ে পড়ত কঞ্চির বাড়ি। কিশোরী তোর্সা কঁকিয়ে উঠত সে দৃশ্যে। জীবনের একমাত্র অনাত্মীয় এক গোঁয়ার কিশোর। যাকে সে এভাবে দেখেছিল। যে চোখ বুজে মাস্টারমশাইয়ের প্রহার হজম করত, মা'র শত মুখ নাড়াতে রা কাড়ত না। ছটির দিনে ভরদুপুরবেলা লাইব্রেরী থেকে ছোটদের পত্রপত্রিকা এনে জানলা থেকে ফেলে দিত বিছানায়। আর নিরুদ্দেশ হওয়ার মুহূর্তে বলত, ভালো লাগলে বলিস, তাহলে পড়ব।
তারপর তোর্সারা চলে এল কলকাতা লাগোয়া শহরতলিতে। দুটো দাদা পড়াশোনা করে যাতে ভবিষ্যতে গ্রামে না পচে কলকাতা এসে করে-কম্মে খায়, তাই বাবা রিটায়ার করার অনেক আগে এখানে জমি কিনেছিলেন। তোর্সা প্রাইভেট টিউটরকে সম্বল করে পড়াশোনা চালিয়ে গেল। ওর তো অর্ধেক শরীর নিয়ে হুইলচেয়ারে ভর করে জীবনে স্কুলে যাওয়া হলো না। মুখে বুলি ফোটার আগে সেই যে পোলিও কেড়ে নিল কোমরের নীচ থেকে পুরোটা, তারপর জ্ঞান হতে চারপাশে ভাসমান স্বপ্নদের দূর-ছাই করতে করতে অনেক দূরে নিজেকে সরিয়ে নিল। বাবা অনেক টাকা খরচ করেও যখন পারলেন না, তখন একটা সরকারি চাকরি পাওয়াকে স্বপ্নধ্বজা করে মেয়ের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া অন্য কোনোভাবে মেয়ের জন্য স্বাবলম্বনের ব্যাকরণ ছোঁয়ার দিশা তাঁর ছিল না। কিন্তু তেমন বুদ্ধি বা জেদ তোর্সার বা ছিল কোথায়? বহিরাগত হিসাবে মাধ্যমিকটা দেওয়ার পর সে একটা সাময়িক মুক্তির শ্বাস ছেড়েছিল। প্রায় তিন মাসের অবসর কাটানোর জন্য বাবাকে লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই এনে দিতে বলত। বাবা লাইব্রেরিয়ান হওয়ার দৌলতে পছন্দের লেখকের বই পেত তোর্সা। সে-সব নিয়ে সে ভেসে যেত। শ্রাবণ দুই চোখ কখনো কখনো হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে বুজে থাকত। তার প্রত্যেকটা নায়েকের মুখে নিজের অজান্তে লেপে যেত আবিরের মুখ। সেই মানুষটা আজ তার স্বামী। তার চতুর্বলয়।
টেনশনটা চাপতে পারে না তোর্সা। যে-সময়ে আসার কথা, সে-সময়ে মানুষটা না এলে বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে। মাথায় আসে কুচিন্তা। তার মধ্যে সবচেয়ে বিকট— আবির হারিয়ে যাবে না তো? নিজেকে সে সব সময় পৃথিবীর অন্য বিকলাঙ্গদের তুলনায় ভাগ্যবতী ভাবে। তার সেই ভাগ্যটা হঠাৎ চুরমার হওয়ার আশঙ্কায় তোর্সা কাঁদে। কোন পাপে অর্ধেক অহল্যা জীবন তার? এর চেয়ে সে পুরোটাই যদি অহল্যা হত! পাথরের চোখ দেখে কারও বোঝার উপায় থাকত না, কত যন্ত্রণা তার।
তোর্সা ওড়নায় চোখ মুছে ছবিটার দিকে চেয়ে থাকে। লোকটা ধূমকেতুর মতো ফেরত এসেছিল তার জীবনে। সেদিন কালবৈশাখী রাত। এক পশলা বৃষ্টি শেষে আকাশটা থমথমে। বড়দা সবাইকে চমকে দিয়ে ওকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে, দেখো কে এসেছে!
মা অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন, ছোটদাও।
আবির তখন বিধ্বস্ত চেহারায় নত। মা ওকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেন। ঝড়ো কাকের মতো আবির নিজেকে এলিয়ে দেয়।
বড়দা সব খুলে বলে। লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট না থাকা সত্ত্বেও বাপের পয়সায় পরীক্ষায় বসে বারবার অকৃতকার্য হওয়াটা কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের কর্ম নয়। তার চেয়ে খুব তাড়াতাড়ি কোনো কাজ খুঁজে নেওয়া যুক্তিযুক্ত। নচেৎ গৃহত্যাগ শ্রেয়। এটাই ওর বাবার মদ্দা কথা। সেই অভিমানে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে কলকাতায় আসা আবিরের। এবং সেই অভিমানে প্ল্যাটফর্মে রাত কাটানোর প্রতিজ্ঞা।
বড়দার দিকে সবাই চেয়ে থাকে। বড়দা বলে, ভাগ্যিস আমার নজরটা পড়েছিল প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে। তারপর হাসে, তুই বরং এক কাজ কর, আমার দোকানে একজনের দরকার। আপাতত তুই থেকে যা। তারপর ভালো কাজ পেলে চলে যাস।
হুইল চেয়ারে বসে তোর্সা দেখছিল আবিরকে। মাঝে মাঝে চোখে চোখে মিলেও যাচ্ছিল। একটু হাসি পাচ্ছিল তার। লেখাপড়া শেষ হলে আবিরদের মতো কমবয়সি বকাটে মাথারা গ্রামের অঢেল আড়াল-আবডালে তাস কিংবা আড্ডায় মেতে যায়। বাড়ির লোকজন চিৎকার করে ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না। বাপ-মা'র রাগ হবে না তো কী? তার নিজের দাদারাও তো গ্রামীণ আড্ডাকে জুয়া করে নিয়েছিল প্রায়। তাই বাবা বুদ্ধি করে দুই ছেলেকে সরিয়ে আনলেন শহরে। এখানে তো আর ফ্রি জল-হাওয়া আর খোলা মাঠ নেই, যে পেটে কিল মেরেও পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা যাবে।
বাবা বড়দার মতে মত দিলেন। কলকাতার মতো অচেনা-অজানা জায়গায় তো সহজে কাজ মেলে না বাবা, সৌরেন যা বলছে তাই করো।
বাথরুমে যাওয়ার আগে তিনি বড় ছেলের উদ্দেশে বললেন, ওর বাড়ির লোক চিন্তা করবে, একটা ফোন করে দে।
বড়দা আবিরের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করল। কিন্তু ওর বাবা-মা ওকে এভাবে খুঁজে পাওয়া বা ওদের বাড়িতে তোলাতে একটুও খুশি হলেন না, বা বাহবা দিলেন না।
আবির দাদার বই দোকানের কর্মচারী হয়ে থেকে গেল। রাতে থাকার জায়গা পেল দাদারই ঘরে মেঝেতে। পাড়াতুতো ছেলে বলে দাদা অবশ্য ওকে পাশে নিতে চেয়েছিল কিন্তু ও স্পষ্ট জানিয়ে দিল মেঝেতে ওর অভ্যাস। ও মেঝেতেই স্বস্তি বোধ করে।
হুইল চেয়ারে বসে নিশ্চিন্তে তোর্সা দেখছিল অগোছালো ছেলেটার একটু একটু করে বসন্ত হওয়া। সেই বিবর্ণ জামাপ্যান্ট, উস্কোখুস্কো চুল বা রং-চটা শরীরে একটু একটু করে বাকল ধরছিল। বিশেষ কাছে আসত না, সামান্য সময় হয়তো কথা বলার সুযোগ পেত, তারই মধ্যে বলে যেত অনেক। যেমন— তোমাকে দেখেই লজ্জা পেলুম সেদিন, কিংবা তুমি এখন বদলে গেছ বা তুমি কি কোনোদিন যাবে না গ্রামে? অর্থাৎ তুমি, তুমি, তুমিতে পত্রে-পুষ্পে পল্লবিত। তুই-তোকারির সেই বছরগুলো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাসন নিয়েছে। রাতে বিছানায় শুয়ে যখন মায়ের স্পর্শ নিত তোর্সা, টের পেত সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মা ঘুমের অতলে। তখনো ওর ঘুম হত না। অর্ধেক অবশ শরীর জুড়ে প্রাণের মহড়া। মেঠো আড়বাঁশির সুরেলা আওয়াজ। রাতের অন্ধকারে কোনো গাছতলা বা মন্দিরের দাওয়া থেকে এই আওয়াজ একদিন আবির প্রাণ ফিরিয়ে দিত সমস্ত পাড়াটার।
হঠাৎ একদিন দুপুরে বাবার ঘর থেকে স্পষ্ট ভেসে এলো মায়ের কথা, কিন্তু একটু ভেবে দেখো, ওর বাবা কি মেনে নেবে?
তোর্সা কানকে ভয়েস-রেকর্ডারের পজিশনে রাখল। দেওয়ালে সেঁটে থাকল। মা বিস্ময়ের ঘোরে বললেন, কিন্তু তুমি কি আবিরকে নিজের মুখে বলবে?
কী করব? আমার মতো বাবারা তো বাধ্য হয়ে সেটা করে। আর ছেলেটা তো খারাপ নয়। অমন সৎ, বাধ্য ছেলে আছে ক'টা? তাছাড়া ওকে তো চাপিয়ে দিচ্ছি না। সম্পত্তি পাবে, দোকান করে দেব, জীবনে অভাব থাকবে না। এটাই সময় সৌরেনের মা। কোনো বাবা-মা তো চিরকাল মেয়েকে দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না।
দেখো। কিন্তু আবিরের বাবা-মাকে ভয়।
নিভৃতে অনেকদিন কেঁদেছিল তোর্সা। দুপুর আর রাতে খাবার সময়টুকু ছাড়া দেখা যেত না আবিরের মুখ। যখন দেখা হত লালিমায় ঘিরে যেত ও, মুখটা ফিরিয়ে নিত। তারপর মা সময় করে এক রাতের বিছানায় অকস্মাৎ ওকে বুকে টেনে বলেছিল পরম আকাঙ্ক্ষার সেই কথাটা, তোর বাবা আবিরের সঙ্গে তোর বিয়েটা ঠিক করল।
অনেকক্ষণ মুখ উঁচিয়ে মায়ের চোখে চেয়েছিল তোর্সা। দেখছিল, একটা ঘুড়ি সুদূরে তার ছোটবেলার গ্রাম থেকে সুতো কেটে এলোমেলো উড়তে উড়তে তার কাঁধে এসে ঠেকল। এই ছেলেটা সারা জীবন তার হুইল চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। তাকে ফেলে কোনোদিন বাপ-ঠাকুরদার ভিটেয় ফিরে যাবে না। প্রায় সব ঠিকঠাক হলো যেদিন, বাতাসে ভাসছে দধিকর্মার ফর্দ, লজ্জাবতীর রং চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তোর্সার সর্বাঙ্গে, একদিন সাহসে ভর করে মাকে দিয়ে আবিরকে ডাকল ও। ইলেকট্রিক ল্যাম্পের দুধসাদা আলোয় তোর্সার ঘরে এসে ঢুকল আবির। ওর আজ্ঞার প্রতীক্ষা না করে খাটের উপর বসল। তোর্সা হুইল চেয়ারটা জানলা থেকে ঘুরিয়ে ওর মুখোমুখি হলো। আয়ত চোখে তাকাল, এই বিয়েতে তুমি রাজি তো?
লুকিয়ে থাকা হাসিটা আস্তে আস্তে আবিরের সমস্ত মুখ আলো করল, হ্যাঁ।
তোমার বাবা-মা জানে তো?
আমি বাবা-মাকে জানাতে বারণ করেছি। একটু থামে আবির।
ছেলে বাঁচল না মরল, যে বাবা-মা খোঁজ রাখে না, একটা বেকার ছেলেকে যথেষ্ট সুযোগ না দিয়ে যখন বোঝা বলে দাগিয়ে দেয়, আর পাঁচটা ছেলের মতো যেভাবে হোক বাঁচলেই হলো বলে ঝড়ের মুখে ঠেলে দেয়, সেই বাবা-মা'র কাছে এই খবরটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার একটু থামল ও।
আর তোমার খেয়াল তারা রাখবে না, সে দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে সারা জীবন, অতএব নিছক তাদের মতামতের অপেক্ষায় থেকে অমঙ্গল ডেকে আনার দরকার আছে বলে মনে করি না। যখন সময় হবে আমিই জানাব।
ব্রতকথার মতো নাগাড়ে কথাগুলো শুনিয়ে আবির এই প্রথম তোর্সার মুখের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সারা শরীরে তোর্সা অসহায় তিতিরের মতো কাঁপতে থাকে। তার বাবা মেয়ের ভালোর জন্য এই ছেলেটাকে সাধ্যাতীত দেবে। দিক। সব বাবাই দেয়। দেওয়া-নেওয়ার এসব ছোটখাটো ব্যাপারগুলো গ্রামে বড় হওয়া অল্পশিক্ষিত মেয়েদের জীবনে যেমন তুচ্ছ, তার মতো চৌবন্দি এক মেয়ের কাছেও তাই। তাছাড়া অর্ধেক শরীর নিয়ে সে বা পণ্য হলো কবে? এসব ভাবনা কেন তার? এ বাজারে কোনো বিকলাঙ্গের বাপ কি আবিরের মতো জামাই পাবেন? আর ঘরজামাই হিসেবে পাওয়া তো মহাভাগ্য!
উপর থেকে নেমে কাছে এসেছিল আবির, তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
তোর্সা নির্বাক চেয়ে ছিল। সব সংকোচ ছেড়ে জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের হাত স্পর্শ করেছিল। আবির একটুক্ষণের জন্য সেই হাত ওর তালুতে রেখে বলেছিল, তোমার মতো মেয়েরা যেমন অভাগা, আমার মতো ছেলেরাও। তাই আমি তোমার জন্য এবং তুমি আমার, সব বিধির লিখন।
দুটো চোখ ছলছল করে তোর্সার। রূঢ় এই বাস্তব কথাগুলো ভালোবাসা নামক আবেগে বড় কাঁটা। আর যেন কখনো এসব পুনরুত্থাপন না করে।
তুমি আমাকে ভালোবাসবে তো?
এই মুহূর্তে তো ইচ্ছে করছে। এই যে তোমরা সবাই আমাকে বরণ করলে কিংবা তুমি আমাকে চাও, এগুলো তো জীবনে প্রথম পেলাম। এসবকে উপেক্ষা করতে পারব না।
পৌনে একটা বাজে। খাওয়া-দাওয়া করে একটু আড়-গোড় দেওয়ার আছে। তারপর সেজে তবেই বেরোনো। অতদূরে তার মতো একজন মেয়েকে নিয়ে যাওয়া অনেক ঝক্কির। গ্রামে এখন যতই ইলেকট্রিক ঢুকুক, ছোটখাটো অনেক অসুবিধা। আবির কি জানে না সন্ধ্যা হতে পারে! তোর্সা ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। মা এসে বলেন, আর একবার ফোন করে দেখ, কখনো তো এত দেরি করে না।
মোবাইলে কল করে তোর্সা। অনেকক্ষণ রিং হয়। শেষ পর্যন্ত লোকটা ধরে। তোর্সার বুক থেকে গুমোট হাওয়া উধাও হয়ে যায়।
আর বোলো না অনেকদিন পরে যাচ্ছি, কিছু কেনাকাটা করতে দেরি হয়ে গেল। প্লিজ পনেরো মিনিট। বলেই কেটে দিল।
মা তাকালেন, কী বলল?
কেনাকাটা করতে দেরি হচ্ছে, পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরবে।
আগে ফোন করে জানাতে তো পারত। মা অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যান।
তোর্সা ছবিটার দিকে চেয়ে থাকে। কী এত কিনছে আবির! অনেকদিন পর অভিমান ভেঙে গ্রামে ফিরবে অসুস্থ মাকে দেখতে। সঙ্গে নিয়ে যাবে নতুন বউকে। যে সেই পাড়ার মেয়ে ছিল একদিন। তার জন্যও কি কিছু কিনছে? এতদিন তো বাবা আর মা তার প্রিয় সব কিছু এনে দিয়েছেন।
হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। বড় সুন্দর তার মুখ। আবির এই মুখকে অনেকক্ষণ দেখে। নাইটল্যাম্পের সোনালি আলোয়। দেখতে দেখতে সে তার ঠাকমাকে নিরীক্ষণ করে। নাকছাবি পরা সোনা মুখ। তোর্সার পড়ে সেই মানুষটিই তার প্রিয়। তার ছোটবেলায় সব দুষ্টুমিকে যিনি একটা লাঠির আঘাতে সামাল দিতেন।
অথচ এই মানুষটাকে সে কিছুই দিতে পারেনি। মাঝে মাঝে নিজেকে সামলাতে না পেরে তার অবশ অর্ধাঙ্গকে যখন রোবটের মতো গ্রহণ করে আবির, তার নিষ্প্রাণ শরীরটাকে খুঁড়তে খুঁড়তে সীমান্তের উপোসি সৈনিক হয়ে ওঠে, তখন ওর পিঠে হাত রাখে তোর্সা। যাদের সব আছে তারা হয়তো এ সময়ে স্বামীকে ধর্ষক ভাবে, কিন্তু ও স্বামীর না পাওয়ার বঞ্চনায় সব আঘাত সয়। ব্যথাতুর হয়।
যে শরীরে এত জোয়ার, শরীর পেলে স্রোত হয়ে সমুদ্রে মেশে, সেই আবির তাকে অনায়াসে বিছানায় নেয়। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী! দুর্নিবার মাদকতা কেটে গেলে সে হাঁটু মুড়ে অনায়াসে বলে, ক্ষমা কোরো। দুচোখে জল নিয়ে তোর্সা তার হাতদুটো ছোঁয়।
হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে আবির। জামাকাপড় আর খাবারে ঠাসাঠাসি ব্যাগগুলো খাটে রেখে বলে, আর বোলো না, বয়স অনুপাতে বাচ্চাদের জামা-প্যান্টগুলোর ম্যাচিং বুঝতে আর তোমার কাপড়ের কালার চয়েজ করতে যত্ত সময় চলে গেল।
প্রথম সকালের পুবালি আকাশের মতো চেয়ে থাকে তোর্সা।
কী দেখছ হাঁ করে?
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তোর্সা বলে, তাহলে তোমাকে বুঝতে আজকাল ভুল হয় না, আমি চাইছিলাম আমার জন্য কিছু একটা আনো, কিছু একটা।
দেখো কাপড়টা পছন্দ হয়েছে কি? আবির কমলা রঙের কাপড়টা ওর দিকে এগিয়ে দেয়।
তোর্সা দেখে, মুগ্ধ হয়ে দেখে। বিড়বিড় করে বলে, দুজনের চোখ তো একই, পছন্দ না হয়ে পারে!
আবির হাসে। অনেকদিন পরে যাচ্ছি, ভাইপো-ভাইজিরা কাঁদবে, তাই ওদের জন্য এক সেট করে জামা-প্যান্ট নিলাম। বাবা-মা'র জন্য নিইনি।
তোর্সা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, সে কী! কেন?
আবির আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে, দাদারা সেদিক থেকে অনেক যোগ্য। ওরাই তো ভরিয়ে রেখেছে এতদিন। ক্লান্ত দেখায় ওকে। একটু থেমে বলে, গিয়ে যদি মনে হয় আমার কাছ থেকে তাঁদের নেওয়ার আছে বা আমার কিছু দেওয়ার আছে, তাহলে দ্বিতীয়বার যাওয়ার সময় ভাবব।
এখনো বাবা-মা'র প্রতি অভিমান এত জমাট আছে দেখে তোর্সা বেশ অসন্তুষ্ট হয়, এ তোমার অন্যায়, ভীষণ অন্যায়। একজন অসুস্থ মানুষকে তো দেখতে যাচ্ছ, এসব বলা কেন?
জীবনে কোনো আদিখ্যেতা আমার সহ্য হয় না তোর্সা। বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে টয়লেটের দিকে যায়।
মানুষটার রাগ দেখে তোর্সা নির্বাক চেয়ে থাকে। এই রাগে পড়ে তোর্সা তাকে বিয়ে করেনি তো? চোখ দিয়ে তার জল নামে।
বিকেলে বেরোনোর সময় কমলা রঙের শাড়িটা তোর্সাকে এক লক্ষ্মীশ্রী এনে দেয়। এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে পা বাড়ানোর জন্য তার প্রাণটা আনচান করে। টাটাসুমোতে হুইলচেয়ার সমেত সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে মায়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসে। আবির ডাইভারের পাশে। গাড়িটা গলি ছাড়িয়ে মেন রাস্তায় পড়তে সাঁ-সাঁ বেগ নেয়। মা পাশে থাকলেও সদ্য কনে-বউয়ের মতো তোর্সা ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকে। মনে সংশয় জাগে, কীভাবে গ্রহণ করবে তার চেনা অথবা অচেনা মানুষেরা? কীভাবে গ্রহণ করবে তার হারানো ছোটবেলা? শ্বশুরমশাই অবশ্য ফোনে বলেছেন, ভুল করেছি মা, তোমার শাশুড়ির সারা অঙ্গ পড়ে যাওয়ায় বুঝেছি তোমাদের সকলের কাছে আমাদের অনেক অন্যায় জমে আছে। তোমার শাশুড়ি তো আর কথা বলতে পারে না, চিনতে পারবে কিনা তা-ও জানি না। বুড়ো মানুষটা ভেঙে পড়েছিলেন।
তোর্সা ফোনটা পেয়ে প্রথমে কিছু বলতে পারেনি, এত দুঃখের মধ্যেও এক অব্যক্ত আনন্দ লুকোচুরি খেলছিল। জীবনে পুত্রবধূ হওয়ার স্বীকৃতিটুকু সে পেতে চাইছিল আবিরের বাবা-মা'র কাছ থেকে। তবু সেই মানুষগুলোর উপর কেন যে এতদিন রাগটা ধরে রেখেছে আবির! মনটা বড় খারাপ হয়।
চেনা বাসমোড়ের কাছাকাছি আসতেই তোর্সার প্রতিটা রোমকূপ খাড়া হয়। বুক ঢিবঢিব করে। কাঁচের জানলা দিয়ে দেখে মেন রাস্তা দিয়ে নেমে গাড়িটা ইটের রাস্তা ধরে আঁকাবাঁকা পথে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে। ড্রাইভার আবিরের গাইডলাইন ফলো করে একেবারে পাড়ার ভিতরে বাঁশ বাগানের পাশ দিয়ে বেঁকে আবিরদের উঠানের সামনে এসে ব্রেক কষে। গাড়ির আওয়াজে পাড়ার কচিকাঁচারা এসে জোটে। আবির নেমে পড়ে। সেজবৌদি আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে আসে। শ্বশুরমশাই মাটির দাওয়াতে বসে আছেন। ঘর-বারান্দা থেকে নেমে পাড়ার বৌ-ঝিরা প্রত্যেকে নিজেদের সদর চৌকাঠে, কঞ্চির বেড়ার ধারে। দু-একজন এগিয়ে আসে। সেজবৌদিকে দেখে আবির হাসে, তোমরা সব ভালো আছো তো?
লাজুক মেয়েটিও হাসে। এর বিয়ের কয়েকদিন পর তোর্সারা গ্রাম ছেড়েছিল, ফলে চেনাও হয়নি।
মেয়েটি আবিরের চোখে চোখ রেখে বলে, রাগ করে গেলে আর একেবারে বউ নিয়ে ফিরলে। যা হোক ভালো আছো তো?
আছি। বলেই গাড়ির গা ঘেঁসে দাঁড়ানো বড়দার ছেলে আর সেজদার মেয়েদুটোর মাথা নেড়ে দেয়।
ড্রাইভার নেমে এসে হুইলচেয়ার আর ব্যাগগুলো নামাতে সাহায্য করে। আবির কয়েকটা ব্যাগ আলাদা রেখে বাকিগুলো ভাইপো-ভাইঝিদের কাছে দেয়। মা নেমে গ্রামের পরিচিতদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। তোর্সার ব্যাগ নিজের কাছে রাখেন।
হুইলচেয়ারটা দরজার কাছে আনে আবির। কালো কাঁচের জানলার উপর এতক্ষণ ভেঙে পড়েছিল কৌতূহলী মুখেরা। এবার দরজার কাছাকাছি জড়ো হয়। সেজবৌদি বিরক্ত হয়, আগে বের হতে দে মানুষটাকে।
আবির তোর্সাকে পাঁজাকোলা করে নামায়। খোলা আকাশের নিচে এত মানুষের ভিড়ে এই প্রথম। তীব্র লজ্জায় শরীরটা তার নুয়ে পড়ে। চোখদুটো লাল হয়, তবু সে বোজে না।
সবাই চেয়ে থাকে। সবার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। চেনা মানুষের কেউ কি কখনো ভেবেছিল তোর্সার ক্ষুদ্র কপালটা লাল সিঁদুরে এতটা চওড়া দেখাবে কোনোদিন!
একটা চাপা গুঞ্জনের মধ্যে হুইল চেয়ারে বসে তোর্সা। পিছনে কালপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সুস্থ, সবল পুরুষ হয়েও একজন প্রতিবন্ধীকে বিয়ে করার জন্য সমাজের কাছে যে কোনো কৈফিয়ৎ দিতে রাজি নয়।
আবিরের দুটো সবল হাত চেপে আছে হুইল চেয়ারের পিছনে। সবাই চেয়ে আছে। চেয়ারটা গড়গড়িয়ে চলে। ভিড়টা দু'দিকে বিভক্ত হয়ে তোর্সার পথ করে দেয়। শ্বশুরমশাই বারান্দা থেকে নেমে আসেন উঠানে। কৌতূহলী যারা ভিড় জমাতে পিছনে পিছনে আসছিল তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। হুইলচেয়ার থামিয়ে আবির বাবাকে প্রণাম করে। তার দেখাদেখি তোর্সাও মাথা ঝুঁকিয়ে নামার জন্য অস্থির হয়। বাবা তার কুণ্ঠা দূর করেন, বাড়ি চলো মা।
তোর্সা দু'হাত জোড় করে নমস্কার করে। হুইলচেয়ার নামক যান্ত্রিক যানটা আবার চলতে থাকে। প্রকৃত সারথীর মতো রথ ঠেলে আবির তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পাশে নিশ্চিন্তে হাঁটতে থাকেন তোর্সার মা।
খুব সরল গল্প, ঢাকাই ছবির মতোন। শিরোনামে বেটাগিরি প্রকট