উত্তর :
১) মাস্ক ব্যবহার করলে কি কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানো সম্ভব? - হ্যাঁ সম্ভব, প্রমাণ আছে। নিচের রিসার্চ পেপার গুলো প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে পরীক্ষা করে এই দাবি করেছে।
২০২০ সালে বিখ্যাত নেচার মেডিসিন পত্রিকায় তিনটি করোনা ভাইরাস (Coronavirus NL63, OC43, HKU1) মানুষের মধ্যে কিভাবে সংক্রমণ ঘটায় এবং মাস্ক কিভাবে এই সংক্রমণ আটকাতে সাহায্য করে সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয়। তথ্যসহ দেখানো হয় যে মাস্ক ব্যবহার করলে তিনটি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
২০২০ সালে বেজিং শহরে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় দেখানো হয় যে মাস্কের ব্যবহারে ফলে সংক্রমণের হার কমানো সম্ভব। এক হিসাব অনুযায়ী সংক্রমণের প্রকোপ কমাতে মাস্ক ৭৯% কার্যকর। http://dx.doi.org/10.1136/bmjgh-2020-002794
World Health Organization এর এক স্টাডিতে ঐ একি সময় বেজিং শহরে মাস্কের ব্যবহার যে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে সেটা দেখানো হয়। এই পরীক্ষায় দাবী করা হয় যে মাস্কের ব্যবহার কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমাতে প্রায় ৭০% কার্যকর। https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)31142-9
২০০৮ সালের এক randomized, controlled clinical trial থেকে দেখানো হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে মাস্ক প্রায় ৮০% কার্যকর। https://doi.org/10.1016/j.ijid.2008.05.877
২০১১ সালের একটা স্টাডিতে বলা হয়েছিল যে ভাইরাল সংক্রমণ ঠেকাতে শুধু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ও ভ্যাক্সিন যথেষ্ট নয়, এই দুইয়ের সাথে সামাজিক দূরত্ব এবং মাস্কের ব্যবহার অপরিহার্য। https://doi.org/10.1002/14651858.CD006207.pub4
গত বছর কোভিড মহামারী শুরু হবার পর এডিনবরা ইউনিভার্সিটির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সামান্য ঘরে বানানো মাস্কও যদি আক্রান্ত ব্যক্তি পরে থাকে তাহলে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমে যায়।https://www.ed.ac.uk/files/atoms/files/uncover_003-03_summary_-_facemasks_community_anon.pdf
২০০৯-১০ সালে জার্মানিতে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণ হয়, সেই সময় এক randomized, controlled clinical trial থেকে জানা যায় যে ক্রমাগত মাস্ক পরলে এবং হাত পরিষ্কার রাখলে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। https://doi.org/10.1186/1471-2334-12-26
২০২০ সালে কোভিড সংক্রমণ ঠেকাতে যেসব দেশ মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিল সেসব দেশের তুলনায় যেখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ছিল না সেখানে ৭.৫ গুন বেশি সংক্রমণ হয়েছিল। https://doi.org/10.4269/ajtmh.20-1015
উপরের এই আটখানা রিসার্চ পেপার দেওয়ার একটাই কারণ - এই পেপার গুলো হয় সরাসরি কোভিড সংক্রমণ কে ঠেকাতে মাস্কের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছে, অথবা তারা কোনও কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় মাস্কের কার্যকারিতাকে প্রমাণ করেছে। এছাড়াও আরও অনেক সার্ভে, পরীক্ষা আছে তবে মাস্কের কার্যকারিতা নিয়ে অবান্তর প্রশ্নের বিরুদ্ধে এই কয়েকটাই যথেষ্ট।
২) কোন মাস্ক ব্যবহার করবো?
তবে এই প্রশ্নের আগে, আরও একটা উপপ্রশ্ন করতে হয় - মাস্ক কিভাবে ভাইরাসের মতো এতো ছোট একটা কণাকে ফিল্টার করতে পারে?
একটা মাস্ক কতটা ভালো সেটা তার ফেব্রিক, সেই ফেব্রিকের বুনন এবং কখানা লেয়ারের ফেব্রিক দিয়ে সেই মাস্কটা তৈরি হয়েছে তার উপর নির্ভর করে। এই পোস্টের সাথে দেওয়া ছবিতে (ক) একটা সার্জিকাল মাস্কের ফেব্রিককে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখানো হয়েছে এবং ছবিটা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ফেব্রিক গুলো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে একটা ছাঁকনি তৈরি করে। প্রতিটা মাস্কের গঠন মাইক্রোস্কোপি লেভেলে মোটামুটি এরকমই হয়। শুধু ফেব্রিক, তার বুনন এবং কখানা লেয়ার আছে সেটার ভিত্তি করে মাস্কের মধ্যে পার্থক্য হয়ে থাকে। অসংখ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এই ফুটোগুলোর মধ্যে দিয়ে বাতাস খুব সহজেই আনাগোনা করতে পারে, কিন্তু তারমধ্যে ভাসমান কণা সরাসরি ফেব্রিকের ফাঁক দিয়ে অপর প্রান্তে পৌছুতে পারে না। এই কণাগুলি ফেব্রিকের মধ্যে দিয়ে গলে না যাওয়ার প্রধান চারটি কারণ আছে, এবং সেই কারণ গুলো বোঝার জন্য (খ) ছবিটা দেখুন। ছবিতে “flow line” দিয়ে খুব সহজ ভাবে হাওয়ার প্রবাহ কে দেখানো হয়েছে, আর এই flow line লাইনের উপর ভর করেই মাস্ক বিহীন অবস্থায় ভাইরাস বা অন্যান্য অ্যারোসোল আমাদের নাক বা মুখ দিয়ে শরীরের মধ্যে চলে আসে। মাস্ক নিচের চারটে উপায়ে এই অ্যারোসোলের চলাচলকে বন্ধ করে দেয় -
Gravitational settling ঃ বড় আকারের (১ মাইক্রন বা তার থেকেও বড়, এখানে বলে রাখা উচিত যে কোভিড-১৯ এর সাইজ ~ ০.১ মাইক্রন এবং অক্সিজেন মলিকুলের সাইজ ~০.০০১ মাইক্রন) অ্যারোসোল গ্রেভিটির প্রভাবে ফেব্রিকের উপর থিতিয়ে পরে।
Inertial impaction ঃ মাঝারি আকারের অ্যারোসোল গুলি সরাসরি ফেব্রিকে ধাক্কা পেয়ে মাস্কের গায়ে আটকা পরে যায়।
Diffusion ঃ এই ধরনের ফিল্ট্রেশন মূলত ছোট আকারের (০.১ মাইক্রন বা তার চেয়ে ছোট) অ্যারোসলের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কোভিড-১৯ আটকাতে সাহায্য করে। হাওয়ার random movement এর ফলে এই সাইজের অ্যারোসোলের মধ্যে Brownian motion দেখা যায় ফলে কণাগুলি ফেব্রিকে আটকে যায়।
Electrostatic attraction ঃ অনেক ধরনের ফেব্রিক (যেমন সিল্ক) electrostatically charged থাকে, এবং অ্যারোসোলের মধ্যে বিপরীত চার্জ থাকলে তারা অনায়াসে মাস্কের ফেব্রিকে আটকে যেতে পারে।
মাস্ক সম্বন্ধে সবারই একটা ভুল ধারণা আছে যে অ্যারোসোলের আকার ছোট হলে (< ০.১ মাইক্রন) মাস্ক হয়তো ভালো করে ফিল্টার করতে পারবে না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা একেবারে উল্টো কথা বলছে। বহুদিনের রিসার্চ এটাই প্রমাণ করে যে উপরে ঐ চারটি ফিল্ট্রেশন পদ্ধতির জন্যে মাস্কের filtering efficiency (কতো শতাংশ অ্যারোসল কে মাস্ক আটকাতে পারছে) ০.০১-০.১ মাইক্রন অ্যারোসোলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হয়, তারপর ০.৬-১ মাইক্রন এবং সবশেষে ০.১-০.৬ মাইক্রন অ্যারোসোলের হয়ে থাকে। https://multimedia.3m.com/mws/media/410364O/filtration-mechanisms-for-particulate-respirators.pdf
গত বছর এক রিসার্চে বিভিন্ন ধরনের মাস্কের filtering efficiency (< ০.৩ মাইক্রন) এর একটা হিসাব কষা হয়েছিল। যেহেতু কোভিড-১৯ এর আকার ~০.১ মাইক্রন তাই এই হিসাব থেকে কোন ধরনের মাস্ক কোভিড-১৯ কে ঠেকাতে কার্যকর তার একটা ধারণা করতেই পারি। আমি এই লিস্টটা সবচেয়ে ভালো থেকে খারাপ মাস্ক অনুসারে সাজালাম -
1) cotton + chiffon (Filtering efficiency 97%)
2) cotton quilt (96%)
3) cotton + flannel (95%)
4) cotton + silk (94%, no gap)
5) natural silk, 4 layer (86%)
6) N95 (85%, no gap)
7) chiffon, 2 layers (83%)
8) cotton, 600 TPI, 2 layer (82%)
9) cotton, 600 TPI, 1 layer (79%)
10) surgical mask (76%, no gap)
11) chiffon, 1 layer (67%)
12) natural silk, 2 layer (65%)
13) flannel (57%)
14) natural silk, 1 layer (54%)
15) surgical mask (50%, with gap)
16) cotton + silk (37%, with gap)
17) N95 (34%, with gap)
ঐ একি রিসার্চ পেপারে (https://doi.org/10.1021/acsnano.0c03252) এই filtering efficiency এর উপর ভিত্তি করে কিছু গাইডলাইন দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়েছে -
“Fabric with tight weaves and low porosity, such as those found in cotton sheets with high thread count, are preferable.”
“Materials such as natural silk, a chiffon weave (we tested a 90% polyester−10% Spandex fabric), and flannel (we tested a 65% cotton−35% polyester blend) can likely provide good electrostatic filtering of particles.”
“We found that four layers of silk (as maybe the case for a wrapped scarf) provided good protection across the 10 nm to 6 μm range of particulates.”
“Leakage can significantly reduce mask effectiveness and are a reason why properly worn N95 masks and masks with elastomeric fittings work so well”
প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর থেকে এটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে মাস্ক অনেকাংশে অ্যারোসোল বিশেষ করে কোভিড-১৯ সাইজের অ্যারোসোল ঠেকাতে সক্ষম। এবার শেষ প্রশ্ন -
৩) মাস্ক ব্যবহার করলে সামগ্রিকভাবে কি সংক্রমণ কমবে?
এপিডেমিওলজিতে এক ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া কতটা সংক্রামক সেটা বোঝাতে R0 (basic reproductive number) ব্যবহার করা হয়। R0 যদি ১ হয়, তবে বুঝতে হবে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি গড়ে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে সংক্রামিত করতে পারে, এই R0 যদি ১ থেকে অনেক বেশি হয় তবে সেটা মহামারী তে পরিণত হবে এবং ১ থেকে কম হলে সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমে আসবে। বিভিন্ন কারণে R0 কে সঠিকভাবে হিসাব করা খুব অসুবিধাজনক তবে একটা অংক কষে একটা আনুমানিক হিসাব করা সম্ভব। সেইরকম এক হিসাব অনুযায়ী গত বছর লক ডাউনের আগে ভারতের R0 ১.৮৩ থেকে ২.০১ এর মধ্যে ছিল, বর্তমানে কোভিড-১৯ যে হারে বাড়ছে সেটা দেখে আন্দাজ করা যায় যে এখনকার R0 এর মান ১.৮৩ এর নিচে হবেনা বরং তার থেকে বেশিই হবে। শুধু মাস্কের ব্যবহার কিভাবে এই R0 কে কমাতে পারে সেটা নিয়েও কাজ হয়েছে। গত বছরের এক রিসার্চে একটি অত্যন্ত সহজ সমীকরণের সাহায্যে মাস্কের ব্যবহারের সাথে R0 সম্পর্ক কে বোঝানো হয়েছে। সমীকরণটি এরকম -
Re = R0 X (1 - mp)2
এখানে Re হচ্ছে effective reproduction number, R0 হচ্ছে basic reproductive number, m হচ্ছে মাস্কের filtering efficiency এবং p হচ্ছে কত শতাংশ লোক মাস্ক পরছে। একটা উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক, যদি ধরি বর্তমানে R0 = ২ এবং ৫০% লোক ৫০% filtering efficient মাস্ক পরছে তবে কিছু সময় বাদে Re দাঁড়াবে
Re = 2 X (1 - 0.5*0.5)2 = 2 X 0.56 = 1.12
অর্থাৎ, ৫০% লোক শুধুমাত্র ৫০% filtering efficient মাস্ক পরার ফলে R0 নাম্বার ২ থেকে ১.১২ তে নামিয়ে আনল। আমাদের উদ্দেশ্য R0 কে ১ এর নিচে নিয়ে আসা, এবার ঐ ৫০% লোক যদি > ৫০% বা তার থেকেও বেশি efficient মাস্ক পরা শুরু করে অথবা > ৫০% লোক যদি অন্তত ৫০% efficient মাস্ক পরা শুরু করে তবে এই থিউরি অনুযায়ী R0 কে ১ এর নিচে নিয়ে আসা সম্ভব। পোস্টে দেওয়া (ঘ) ছবিতে সেই কথায় বলা হচ্ছে। https://doi.org/10.1073/pnas.2014564118
তবে থিউরি অনুযায়ী সবাই মাস্ক পরছে ধরলেও বাস্তবে সেটা সবসময় হয়ে উঠে না, তাই আরও protection measures দরকার। এই multiple protection measure এর ধারণা থেকে এপিডেমিওলজিতে “Swiss cheese model of safety” এর জন্ম। পোস্টের ছবিতে (ঙ) কিভাবে বিভিন্ন লেয়ার আমাদের কোভিড-১৯ থেকে বাঁচাতে পারে তার একটা ছক দেখানো হয়েছে। লক্ষ্য করবেন “Swiss cheese model of safety” তে প্রথম লেয়ার হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব, তারপর মাস্ক, এবং সবশেষে ভ্যাক্সিন। ভারতের মতো জনবহুল দেশে সব লেয়ার মানা হয়তো সবসময় সম্ভব না, কিন্তু মাস্ক, ভ্যাক্সিন, হাত পরিষ্কার করার মতো ব্যাপার গুলো খুব সহজেই মানা যায়।
অনেক ধোঁয়াশা কাটলো।
করোনাকালে গুরুচন্ডালী অসম্ভব ভালো কাজ করছে এই আর্টিকেলগুলো প্রকাশ করে।