এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভারত পাক  - ৬৫ 

    Sudip Gupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ জানুয়ারি ২০২১ | ২৮৪২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • তখন ভারত .......

    ১৯৬২তেই চীনের কাছে বেদম অসন্মান হয়েছে। একতরফা জিতে চীনই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ফিরে গেছে নিজের দেশে। রেখে গেছে তিক্ততা ও লজ্জা। দু বছর পরেই ভগ্নহৃদয় নেহেরু মারা গেলেন আর প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলেন প্রায় অখ্যাত লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।

    খাদ্য সংকট তখনো চরমে ওঠে নি কিন্তু ভাঁড়ার শুণ্যই। ভুখা মিছিল চলছে রাস্তায়। দক্ষিণ ভারতে ভাষা দাংগা চলছে - ভারত ছাড়বার হুমকী। আর পাঞ্জাবেও গন্ডগোল। অর্থনীতি নিতান্ত ধুঁকিয়ে চলছে। র‌্যাশন শপ থেকেই খাবার কিনতে হচ্ছে, তার মধ্যে বাজার থেকে প্রায়ই উধাও হয়ে যাচ্ছে দরকারী পণ্য। এবং মুদ্রাস্ফীতি।

    ভারত, ভালো নেই।

    আর পাকিস্তান………

    পাকিস্তানের জন্ম থেকেই সিংহাসন নিয়ে টলোমলো অবস্থা। এর মধ্যে আইয়ুব খান, মিলিটারীর সর্বাধিনায়ক থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন। হ্যাঁ, একটা "আস্থাভোট" হয়েছিলো, তাতে প্রায় ৯৬% মানুষই আইয়ুবের উপর আস্থা রেখেছিলেন তবে এ ভোটের সততা নিয়ে বলার কিছু নেই !!

    তারপর অসাড়েই উনি নিজেই নিজেকে জেনেরাল থেকে ফীল্ড মার্শালের পদে উন্নীত করে দিলেন। ওনার স্তাবকেরাও খুব খুসী। আমেরিকার সাথে সম্পর্ক খুব জোরদার, চীনের সাথেও সম্পর্ক আরো জোড়ালো হচ্ছে।

    দেশের নানান শিল্প বেসরকারি হাতে দিয়ে পাকিস্তানের অর্থনীতিও দুড়দাড় এগোচ্ছে। এশিয়ার সফলতম দেশ তখন পাকিস্তান। সমগ্র এশিয়ার মধ্যে "ফাস্টেস্ট গ্রোইং ইকোনমি"। সেই দশক ছিলো পাকিস্তানের এক "সোনার দশক"।

    বেসুরের মধ্যে, এই বছরের শুরুতেই একটা গনভোট হয়ে গিয়েছে। আইয়ুবের বিপক্ষে ফতিমা জিন্না। খোদ কায়েদ এ আজমের ছোটো বোন এবং পাকিস্তানের অন্যতম রূপকার। প্রচন্ড রিগিং করে কোনো রকমে মান বাঁচালেন আইয়ুব কিন্তু টের পাচ্ছিলেন পায়ের তলার মাটী নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে ।

    এই পর্যন্ত্য তো ঠিক আছে। কিন্তু আদতে তো মিলিটারী র লোক। একটু যুদ্ধ টুদ্ধ না হলে কি আর মন ভালো থাকে ? কিন্তু UNOতে কাশ্মীর আর প্রাসংগিক নয়। কেমন একটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। পাকিস্তান তাই, ভুট্টোর ভাষায়, কাশ্মীর প্রসংগকে "defreeze" করতে চাইছিলো।

    তারপরে ধরুন অস্ত্র শস্ত্রের কথা।

    ভারতের হাতে বিমানের সংখ্যা অনেক বেশী থাকলেও ,অল্প কিছু MIG 21 ছাড়া সবই লজঝরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমান। বম্বারের মধ্যে ক্যানবেরা, আর ফাইটারের মধ্যে মিগ ২১ বাদ দিলে ভারতে তৈরী ন্যাট আর দুই দশকের পুরোনো হকার হান্টারআর ভ্যাম্পায়ার।

    পাকিস্তানের কাছে সর্বাধুনিক F-86 স্যাবার জেট আর F 104 স্টার ফাইটার। সেই সব বিমানে আছে রাত্রি বেলা যুদ্ধের প্রযুক্তি আর আছে মোক্ষোম এয়ার টু এয়ার মিসাইল। ভারতের হাতে এইসব নেই।

    ট্যাংকেও পাকিস্তানের হাতে আছে সর্বাধুনিক M 48 বা প্যাটন ট্যাংক। তাছাড়া M 36 জ্যাকসন ট্যাংক ডেস্ট্রয়ার। ভারতের হাতে সেই আদ্দিকালের শেরম্যান আর সেঞ্চুরিয়ান ট্যাংক। কোনো তুলনাই হয় না।সংখ্যাতেও দু পক্ষই সমান , কিন্তু ভারতের সীমানা প্রচুর বড়। শত্রুর বিপদ তো তিন দিক থেকেই। তাই ট্যাংক গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে হয়।

    ফীল্ড আর্টিলারীতেও পাকিস্তানের হাতে অনেক আধুনিক প্রযুক্তির ও দূর পাল্লার কামান। আর্টিলারীতে পাকিস্তান ভারতের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। ভারত পাকিস্তানের শুরুর দিন থেকে ধরলে এই একবারই পাকিস্তান সামরিক দিয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলো। আইয়ুব এটা জানতেন, তাই তার কাছে কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়ার "নাউ অর নেভার" এতো গুরুত্বপুর্ণ ছিলো। ভুট্টো, (তখনপ্রতিরক্ষা মন্ত্রী) তার জীবনীকার সলমান তাসীরকে বলেছিলেন, তিনি তাঁর এক চিঠিতে আইয়ুব খানকে জানিয়েছিলেন , "that if he wanted to pursue a policy of confrontation with India, time was running out. We had to act now or it was too late"।

    আরেকটাও আপাত তুচ্ছ ঘটনা ঘটেছিলো - সেই সময়েই করাচি বিমান বন্দরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আর আইয়ুব খানের এক স্বল্পক্ষণের সাক্ষাত হয়। আইয়ুব খানের বোধহয় মনে হয়েছিলো এই নিতান্ত বেঁটে খাটো , নম্রভাষী মানুষ - সে কি আর সাহস করে পাকিস্তানের হামলার মোকাবিলা করতে চাইবে?

    চীন তো তখন থেকেই পাকিস্তানের প্রহরী ও বন্ধু, অন্যান্য ইসলামিক দেশও হজির। এই যুদ্ধের সময়েই ইরাণ আর তুরষ্ক গোলা বারুদ পাঠিয়েছিলো পাকিস্তানকে, ইন্দোনেশিয়া পাঠিয়েছিলো দুটি সাবমেরিন আর চারটি মিসাইল বোট।

    আসলে দুই পক্ষই জানতো, একবার একটি সিরিয়াস সংঘর্ষ বেঁধে গেলেই কোনো না কোনো বড়দা এসে দু পক্ষকে আলাদা করে দেবে। তার মধ্যে যতোটুকু ফায়দা তোলা যায়।

    সেই মতন একটা "ড্রেস রিহ্যারস্যাল" হলো কচ্ছের রানে। সময়টা এপ্রিল,১৯৬৫।

    Rann of Kutch

    যায়গাটা বড়োই। ভারতের গুজরাট আর পাকিস্তানের সিন্দের মাঝে।প্রায় দশ হাজার স্কোয়ার মাইল জুড়ে এক জনবসতিহীন জলাভূমি। রাস্তা ঘাটের বালাই নেই। মনসুনের সময়, বিশেষতঃ ভারতের দিকটা জলে ডুবে থাকে। আরেকটা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট, এই জলাভূমির মাঝে মাঝেই কিছু ঢিপি (মাটী থেকে তিন চার ফুট উঁচু) আছে, কয়েকটি তো বেশ বড়ো, বর্ষা কালের ভরসা। প্রায় দ্বীপের মতন, কিছুটা শুকনো যায়গা। স্থানীয় ভাষায় বলে 'বেট' (BET)।

    পাকিস্তানের দিকে জমি কিন্তু শুকনো। আর পাশ দিয়েই গেছে রেল লাইন আর বাঁধানো রাস্তা। লজিস্টিকের দিক দিয়ে অ্যাডভান্টেজ পাকিস্তান।

    কারুরই সেনা বাহিনী এখানে মজুত নয়। পুলিশ দিয়েই সীমান্তে নজর রাখা হয়।

    পাকিস্তান ক্রমাগতঃই ভারতকে উত্যক্ত করে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে গুলো ছিলো নেহাৎই আঁচড় কাটা। ক্রমেই ,পরিকল্পিত ভাবেই ঘটনা গুরুতর হয়ে উঠলো । দু পক্ষই আর্টিলারী দাগাতে শুরু করে দিলো। অবশেষে পাকিস্তান ট্যাংক নিয়ে হাজির। ভারত একেবারেই অপ্রস্তুত। ফলাফল প্রত্যাশিত। প্রচুর গোলা বারুদ ঐ সব বেটে ফেলে রেখেই ভারতীয় সেনা রাতারাতি পিছু হঠলো,বা সোজা ভাষায় পালিয়ে গেলো । পাকিস্তান অতি সাড়ম্বরে দেশি ও বিদেশী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করে সেই পরাজয়ের দৃশ্য দেখালো। বেশ অনেকটা জমিও দখল করে নিয়েছিলো পাকিস্তান।

    যেমন ভাবা গেছিলো, ব্রিটেইনের প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন এসে ধমক ধামক দিয়ে দুই পক্ষকেই সড়িয়ে দিলেন। আমেরিকাও দু পক্ষকেই জানিয়ে দিলো আমাদের দেওয়া অস্ত্র নিয়ে তোমাদের মারপিট চলবে না (এই হুঁসিয়ারি মূলতঃ পাকিস্তানকেই)। জমির দখলদারী নিয়ে মামলা গেলো তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে।স্বদেশেও আইয়ুব খান পেলেন প্রচুর সমর্থন ও প্রশংসা। এই পথেই, আন্তর্জাতিক মঞ্চে,কচ্ছ থেকে পৌঁছে যাবে কাশ্মীর। সবাই তাই ভাবছেন। আর ভারতে বিরোধীরা তো বটেই, কংগ্রেসের ভিতরেও প্রচুর অসন্তোষ। কেউই খুসী নয়। শাস্ত্রীজী নাজেহাল। কিন্তু আইয়ুব খুশ হুয়া।

    ভারতের নাকটা পাকিস্তান ভালোই ঘষে দিয়েছিলো । একবার দুই দেশে সংঘর্ষ লাগলেই হোলো। পাড়ার দাদারা অমনি ছুটে এসে সালিশী সভা বসাবেন, ব্যাস, কাশ্মীর আবার সবার চোখের সামনে।এ একেবারে চেনা ছক। আইয়ুব খানের সংকল্প আরো দৃঢ় হলো।

    এবং কাশ্মীর

    সেই ১৯৬৪ সাল থেকেই কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়ার একটা পরিকল্পনা চলছিলো। গভীর ,গভীরতম গোপনে। "কাশ্মীর পাবলিসিটি কমিটি" নামে একটি খুব ছোটো গ্রুপ, যাতে আছেন অবশ্যই আইয়ুব আর ভুট্টো, এছাড়া পাক সেনার সর্বাধিনায়ক মুসা। ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান আজিজ আহমেদ এই কমিটির চেয়ারম্যান। অদ্ভুত কথা এই যে ,এমন কি পাক নৌ সেনা ও বিমান বাহিনীর এক্জনও প্রতিনিধি এই কমিটিতে ছিলেন না।

    কাশ্মীরে হাঙ্গামার শেষ নেই। শেখ আবদুল্লা অন্তরীণ। বছর দেড়েক আগেই, কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদের নবীর দাড়ির এক গাছি "চুরি" হয়। সারা উপত্যকা জুড়ে বিক্ষোভ আর হরতাল। আগুন লাগানো হোলো সরকারী দপ্তরগুলিতে।দাংগা লাগলো দুই বাংলা তেই। পুর্ব বঙ্গ থেকে আবার ঢল নামলো হিন্দু শরণার্থীদের। কাশ্মীর জুড়ে দারুন বিক্ষোভ।

    আইয়ুব খানএর, বিশেষতঃ ভুট্টোর ধারনা ছিলো ,কাশ্মীর যেনো পাকা ফলটি। গাছের থেকে ঝুলেই রয়েছে। একটু ধাক্কা মারলেই টুপ করে খসে পড়বে। আর তখন লুটের মাল। যতক্ষনে বিদেশ থেকে বড়দারা এসে পৌঁছে আবার দু দলকে সড়িয়ে দেবে ততক্ষণে কাশ্মীর পাকিস্তানের পকেটে। হা হা হা। আসলে পাকিস্তান নিজেদের প্রোপাগান্ডাতেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, যেমনটি হিটলার করেছিলেন রাশিয়া আক্রমনের সময়, "ওটা একট পচে যাওয়া আস্তানা। এক লাথিতেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে"। "হিন্দুরা লড়তেই পারে না", এটা পকিস্তানের শুধু বিশ্বাসই নয়, বরং একটা মিলিটারি তত্ত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

    তো, সেই মতন শুরু হলো "অপারেশন জিব্রাল্টার"। বারোশো বছর আগে ঐ জিব্রাল্টার থেকেই স্পেইন ও পর্তুগালে সফল মুসলিম অভিযান হয়। সেই স্মরণেই এই নামকরণ।

    পাকিস্তানি সেনারা কাশ্মীরের উপজাতির ছদ্মবেশে অল্প অল্প করে সীমান্ত পার হয়ে উপত্যকায় ঢুকবে। কাশ্মীরি জোব্বার নীচেই লুকোনো থাকবে দুটো রাইফেল, গ্রেনেড ও প্রচুর কার্ত্তুজ। দুটো রাইফেল আর অতিরিক্ত গুলি বারুদ কেনো? কারণ, পকিস্তানীরা কাশ্মীরের ঢুকেই স্থানীয়দের হাতে তুলে দেবেন ঐ বয়ে আনা এক্স্ট্রা রাইফেল আর বুলেট। তারপরে কাশ্মিরীদের সাথে কাঁধ কাঁধ মিলিয়ে একসাথে লড়াই। সিম্পল।

    ৮ই অগাস্ট, পীর দস্তগীর সাহিব এর মসজিদে বিরাট উৎসব। হাজারে হাজারে তীর্থ যাত্রী আসবে শ্রীনগরে। সেই ভীড় ভাট্টায় মিশে যাবে পাকিস্তানি সেনারা। দখল করে নেবে রেডিও স্টেশন। সারা উপত্যকা জুড়েই চলবে সাবোতাজ।

    কিন্তু বাস্তবে তেমন হোলো কই? কাশ্মীরে ঢুকে পাক গেরিলারা কোনো সাহায্যই পেলেন না। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়রাই তাদেরকে ধরে বেঁধে ভারতীয় আর্মির হাতে ধরিয়ে দিলেন। "Far from rising up in arms, the local population denied any support and, in many instances handed over the infiltrators to Indian troops' -পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার শউকত কাদির জানালেন একটি লেখায়।

    জুলাইএর শেষ বা অগাস্টের একেবারে প্রথমস্য দিবস থেকেই দশ ভাগে ভাগ হয়ে এই বাহিনী কাশ্মীরে ঢোকে। এতে অংশ নিয়েছিলো মূলতঃ পাখতুনী রেগুলার আর্মি, স্পেশাল ফোর্সের কম্যান্ডো, আজাদ কাশ্মীরের সেনা আর অল্প কিছু বেসামরিক মানুষ যাদের মধ্যে নিতান্ত বালকও ছিলো।

    খোদ রাওয়ালপিন্ডিতে একটি "গোপন" রেডিও স্টেশন চালু হোলো আজাদ কাশ্মীরের কন্ঠস্বর বলে, যদিও রেডিও সিগন্যাল track করে ওদের হদীশ পাওয়া আদৌ মুশকিল হয় নি।সেই রেডিও থেকে কাশ্মীরি জনতা ছাড়াও দক্ষিণ ভারতীয়, শিখ ও রাজপুতদের উদ্দেশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচার চলছিলো।

    প্রচন্ড কো অর্ডিনেশনের অভাব। পাকিস্তানী এয়ার ফোর্স এই ব্যাপারে কিছুই জানতো না। ঘটনাটা টের পাওয়ার পর, এয়ার মর্শাল নুর খান কম্যান্ডার ইন চীফ মুসা খানকে চেপে ধরতে তিনি বলেন, আরে ধুর, ভারতের কি আর প্রতি আক্রমনের ক্ষমতা আছে? আমাদের বিমান বাহিনীর কোনো প্রয়োজনই নেই। তাই তো আপনাকে জানানো হয় নি।একেবারে অবিশ্বাস্য ঘটনা !!!

    অপারেশনের দ্বিতীয় দিনেই পাক বাহিনীর গোলা বারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। লুকিয়ে চুরিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে গোলা বারুদের একটানা যোগান বজায় রাখা তো আর সম্ভব নয়।পাকিস্তানের এই অনুপ্রবেশের প্ল্যানের পুরোটাই দাঁড়িয়েছিলো কাশ্মীরে স্থানীয় লোকেদের সাপোর্ট পাওয়া যাবে,এই বিশ্বাসের উপর। বাস্তবে সেটা আদৌ ঘটে নি। পুরোটাই ঘেঁটে ঘ।

    কতজন ঢুকেছিলো ভারতে? নিশ্চিত বলা যায় না। পরবর্তী কালে পাকিস্তানের অনেক বাঘা বাঘা লোকও বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন, ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তাদের মতে পাঁচ থেকে সাত হাজার, আর ভারতীয় দাবী ছিলো প্রায় তিরিশ হাজার। তবে ফিরে দেখলে, এবং যতোটুকু তথ্য প্রমান আছে তাতে পাকিস্তানের দেওয়া হিসেবই সঠিক মনে হয়। আর তখন ভারতের হাতে বন্দী হওয়া পাক সেনাদের স্বীকারোক্তি ফলাও করে প্রচার করছে ভারত, রেডিও ও অন্যান্য মিডিয়ায় , সাংবাদিকদেরকে দেখানো হচ্ছে ঐ আক্রমনের প্ল্যান আর অন্যান্য নথি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তান খুবই বেকায়দায়।

    ভারতীয় সেনারা কিন্তু খুব দ্রুতই পৌঁছে যায় সীমান্তে। পাকিস্তানের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো ,ভারত আর যাই হোক সীজফায়ার লাইন মোটেই অতিক্রম করবে না। কিন্তু সে রকম হোলো কই? ভারতীয় সেনারা সীমান্ত পেরিয়ে কারগিলের কয়েকটা নজরদারী পাহাড় চুড়া আর সামরিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপুর্ণ হাজি পির পাস ভারতীয় আর্মির কবজায় নিয়ে এলো। ২৬শে অগাস্টের রাতের থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী হাজি পির দখল করে নিলো। তেমন লড়াইও হয় নি। পাকিস্তানের রক্ষী সেনারা বোধহয় ভাবতেও পারে নি ভারতীয় সেনারা এতোটা বাড়াবাড়ি করবে।হাজিপির পাস ভারতের দখলের ফলে, আর নতুন করে পাক অনুপ্রবেশ সহজ হবে না, গোলা বারুদের যোগানও নয়। এমন কী যারা ভারতে ঢুকেছেন তাদের ঘরে ফেরাও মুশকিল।

    আইয়ুবের সিংহাসন তো টলোমলো।

    তো শুরু হোলো অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম ।

    অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম

    এটার একটা প্রেক্ষিত আছে। মূলতঃ মুসা ছিলেন সর্বাত্মক যুদ্ধের বিরুদ্ধে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবও। কিন্তু ভুট্টো আর আজিজ নিশ্চিত ছিলেন কাশ্মীরে একটু খোঁচা মারলেই হোলো। বাকীটা কাশ্মীরের সাধারন মানুষেই করে ফেলবে। আসলে নিজেদের প্রোপাগান্ডা নিজেরাই বিশ্বাস করতে শুরু করলে এই সমস্যাই হয়।

    জম্মুর থেকে কাশ্মীরের ঘাড়ের কাছে চেনাব নদীর উপরে আখনুর সেতু। নেহাৎই হাবলা দুবলা। ভারী ট্যাংক যেতে পারে না। আইয়ুব খানের টেরেইন নিয়ে তেমন ভালো ধারনা ছিলো না। তিনি ভেবেছিলেন এই ব্রীজটা দখল করে নিলেই জম্মুর থেকে কাশ্মীর একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। এটা খুব জরুরী সেতু হলেও , ঠিক কাশ্মীরের "জুগুলার ভেইন" নয়, যেমনটা আইয়ুব ভেবেছিলেন। জম্মু থেকে কাশ্মীরে গতায়াতের পথ ছিলো NH1A । আখনুর ব্রীজ দখল নিলে কাশ্মীরে লজিস্টিকের অসুবিধা হতো ঠিকই, কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যেতো না। কিন্তু আইয়ুবকে কে বোঝাবে?

    যদিও এই প্ল্যানের মুসাবিদা আগেই হয়েছিলো। সেই এপ্রিল মাসেই প্ল্যান ছকা হয়েছিলো। অপারেশন জিব্রালটারে কাশ্মীরকে একেবারে পর্য্যুদস্ত করে, সেটারই একটা extension প্ল্যান এই অপারেশন গ্র‌্যান্ড স্ল্যাম। সেই সীমান্ত পেরিয়েই হিন্দুস্তানে ঢুকতে হবে, কিন্তু উপায় কী? পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে তো সামান্যই দূরে এই ব্রীজ। তারপর দুনিয়ার মোড়োলেরা এসে আবার মিটমাট করলেও কাশ্মীর আর ফিরৎ যাচ্ছে না হিন্দুস্তানে। ব্যাস।

    UN'এর পর্যবেক্ষকেরা নিয়মিত টহলদারী করেন। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো পক্ষই বেশী সেনা বা ট্যাংক জড়ো করতে পারেন না সীমান্ত ঘেঁষে। আইয়ুব খানেরও খুব একটা জোড়ালো সন্মতি ছিলো না আন্তর্জাতিক সীমা পেরিয়ে ভারতে হামলা করতে। কাশ্মীরে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ, সে পর্যন্ত্য ঠিক আছে। এর বেশী এগোতে চান নি আইয়ুব খান।

    জেনারেল আখ্তার মালিক, পাকিস্তানের সবথেকে রণপটু সেনানায়ক ছিলেন অপারেশন জিব্রাল্টারের দায়িত্বে। সেটির সমূহ পতন দেখে উনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হাজি পীর পাস ভারতের দখলে মানে কাশ্মীরে আটকে থাকা পাক ফৌজের পকিস্তানে ফেরত আসাও খুব মুশকিল । হয় বন্দী নয় মৃত্যু। ভারত যদি হাজি পীর দখল করতে পারে তবে পকিস্তানেরই বা কীসের সমস্যা ভারতের ভিতর ঢুকে আখনুর সেতু কবজা করতে?

    তিনি খুবই চাপ দিচ্ছিলেন অপারেশন গ্র‌্যান্ড স্ল্যাম শুরু করার জন্য। আইয়ুব তখন ছুটি কাটাচ্ছেন পাকিস্তানের পশচিমে। সেই ভুট্টোকেই ধরলেন নাছোড়বান্দা আখতার মালিক। অবশেষে আইয়ুব রাজী হলেন ,যদিও সতর্ক করে, লিখিত নির্দেশে জানালেন "Take such action that will defreeze the Kashmir problem, weaken Indian resolve, and bring her to the conference table without provoking a general war"। একটু রয়ে সয়েই যুদ্ধ কোরো বাপু। সংক্ষিপ্ত লিখিত বয়ানে এটাও ছিলো,"as a general rule Hindu moral would not stand more than a couple of hard blows"।

    এবং যুদ্ধ হোলো শুরু.....

    সীমান্তে মোতায়েন UNএর পর্যবেক্ষকেরা ভারতকে আগেই জানিয়েছেন যে যুদ্ধবিরতি রেখার কাছেই চুক্তি ভেঙে পাকিস্তান কিন্তু সেনা, ট্যাংক, আর্টিলারি মজুত করছে কিন্তু ভারতের টনক নড়ে নি।

    তো,পয়লা সেপ্টেম্বরের ভোর রাতে, সাড়ে তিনটের সময় প্রচন্ড আর্টিলারি দাগিয়ে ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তান ছাম্বে হামলা শুরু করলো। ভারত অপ্রস্তুত। তায় প্যাটনের সামনে ভারতের হাল্কা AMX 13 ট্যাংক, এক পাক সেনানায়কের ভাষায় 'দেশলাইএর বাক্স'র মতন উড়ে গেলো। পাকিস্তানের আট ইন্চির কামানের তোপ সামলানো বা প্রত্যুত্তর দেওয়ার ক্ষমতাও ভারতের ছিলো না। শুধু কি উন্নত মানের অস্ত্র? সংখ্যাতেও বিপুল এগিয়ে পাকিস্তান। ঐ সেকটরে ট্যাংক আর আর্টিলারী ভারতের থেকে কোথাও পাঁচগুন ,কোথাও ছয় গুন বেশী। প্রথম ধাক্কাতেই পাকিস্তানী সেনারা অনেকটা এগিয়ে দুপুর বেলাতেই ছাম্ব শহরকে ঘিড়ে ফেলে তাওয়াই নদীর পারে পৌঁছে গেলো। ঐ নদী পার হলেই আর কোনো প্রাকৃতিক বাধা নেই। আখনুর শহর ও সেতু হাতের মুঠোয় এসে যাবে।

    জেনারেল জে এন চৌধুরী দিল্লীতে অনুমতি চাইলেন বিমান বাহিনীর। অবশেষে, বড্ডো দেরী করে, সেই বিকেল পাঁচটায় ভারতীয় বিমান (ভ্যাম্পেয়ার ফাইটার) উড়ে এলো আর বেশ কিছু পাকিস্তানি ট্যাংক ও যান ধ্বংশ করলো। পাকিস্তানও তার বিমান হাজির করলো। আকাশ যুদ্ধে ভারতের হার।

    প্রথম দিনেই পাক সেনা ১৪ মাইল ফ্রন্ট জুড়ে একটানা এগিয়ে গেলো। রাত্রি বেলায় তাওয়াই নদীর পশ্চিম পাড়ে মোতায়েন হোলো তাদের সাঁজোয়া বাহিনী। সে রাতেই ছাম্ব শহর পরিত্যাগ করে ভারতীয় সেনারা আখনুর সেতুর কাছে চলে এলো।এ ছাড়া উপায় নেই। জম্মু শহরেরও ৬ মাইলের মধ্যে পৌঁছে গেছে তারা।প্রথম দিনে, পাকিস্তান যেরকম আশা করেছিলো, সে রকমই তাদের প্রগ্রেস রিপোর্ট।

    পরের দিন মানে ২রা সেপ্টেম্বরে যখন ভারতীয় সেনারা তটস্থ হয়ে আছে তখনই এক অত্যাশ্চর্য্য ঘটনা ঘটলো যার যুক্তিযুক্ত ব্যখ্যা এখনো পাওয়া যায় না।

    দুপুরের আগেই সর্বাধিনায়ক মুসা জরুরী তলব পাঠালেন কমান্ডার আখতার মালিককে, পেশোয়ারে ইয়াহিয়া খানের সদর দপ্তরে। হেলিকপ্টারে উড়ে, মালিক পৌঁছালে তাকে স্রেফ জানানো হোলো অবিলম্বে সব দায়িত্ব ইয়াহিয়া খানের হাতে ছেড়ে দিন। মালিককে বদলী করে দেওয়া হোলো করাচীতে এক গৌন দয়িত্বে।

    না, দুনিয়ার সামরিক ইতিহাসে এরকম ঘটনা কেউ স্মরণ করতে পারেন না, যেখানে বিজয়ী এক সেনানায়ককে এরকম ভাবে সড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। কোথাও না।

    কেনো ? কেনো ? কেনো ?

    কী ছিলো আইয়ুবের মনে? কোনো লিখিত দলিল নেই, তাই শুধু ভেবে নেওয়া যেতে পারে এই অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্তের কারণ।

    এক , এই ইয়াহিয়া খান ছিলেন আইয়ুবের জিগরি দোস্ত। জম্মুতে একেবারে সফলতার মুখোমুখী হয়ে আইয়ুব চেয়েছিলেন এই বিজয়ের ফায়দা তুলুক তারই পেয়ারের বন্ধু।

    কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই ইয়াহিয়া একেবারে ঝিমিয়ে পড়লেন। প্রথম দিনেই ,যেরকম ঝড়ের গতিতে পাকিস্তান ভারতকে একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছিলো ,তার আর "ফলো থ্রু" কিছুই ঘটলো না। ভারতীয়রাও ঝটপট করে তাদের সেনাদের অন্যান্য যায়গা থেকে নিয়ে এসে প্রতিরক্ষা মজবুত করে নিলো।

    যুদ্ধের প্রথম দিনেই সমুদ্রের তুফানের মতন গতিতে ছুটে এসে কেনো পাকিস্তান তার গতিতে টান দিলেন?

    সেটাই হয়তো দ্বিতীয় কারন। ইয়াহিয়া, হাতের কাছে পেয়েও আখনুর সেতু দখল করার চেষ্টা করলেন না।টলমলে প্রায় অরক্ষিত জম্মু শহরও না। বোধহয় ভেবেছিলেন জম্মু দখল করলে ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করবে - করবেই , আর সেটা হজম করার মতন ক্ষমতা ছিলো না আইয়ুবের।

    এই যুদ্ধের অনেকদিন পরে ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো কেনো তিনি থমকে গেছিলেন অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যামে? ইয়াহিয়া এক লাইনেরই উত্তর দিয়েছিলেন "আমার উপর ঐ রকমই নির্দেশ ছিলো"।হয়তো, আখতার মালিক মানতেন না সেই নির্দেশ। আইয়ুব সে কারনেই সড়িয়ে দিলেন তাকে।

    কিন্তু মালিক সম্পুর্ণ পেশাদার ছিলেন। পরবর্তী কালে পাকিস্তানের সব বড় নেতারাই মেময়ের্স লিখেছেন, বা প্রবন্ধ বা ইন্টারভিউ এবং একে অন্যকে দোষারোপ করেছেন, তখনো মালিক ছিলেন সম্পুর্ণ নিশ্চুপ। তার ভাইকে এই বিষয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন , 'আমি যদি আমার কথা লিখি এবং সত্য ঘটনা প্রকাশ করি তাহলে তো সেটা একটা দেশবিরোধী কাজ হবে। আমাদের সেনাদের মরাল বিপর্য্যস্ত হবে।লোকের চোখে তারা হেয় হবেন এবং আমার বই পাকিস্তানে ব্যান আর ইন্ডিয়াতে' অবশ্যপাঠ্য হয়ে যাবে।'। যাই হোক, আইয়ুবের কোনো নির্দেশ, তা সে যতোই অপছন্দের হোক, সেটা অমান্য করার মতন মনোবৃত্তি মালিকের ছিলো না।

    তৃতীয় কারন, যেটি সব থেকে প্রচলিত, সেটি হচ্ছে আখতার মালিক আহেমেদিয়া ধর্মের লোক। আইয়ুব আদৌ চান নি পাকিস্তানের "হীরো" কোনো দলছুট ধর্মের মানুষ হোন। বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক এইটিকেই মুখ্য কারন মনে করেন।

    ভারতের পাল্টা :

    পুন্চের রাজাঔরি শহরও ছেড়ে পিছু হঠলেন ভারতীয় সেনারা, আখনুর দখল না করলেও জম্মু শহরের বেশ কাছে এসে গেছে পাক সেনারা। জম্মু হাতছাড়া মানে ভারতের মূল ভুখন্ডের থেকে কাশ্মীর সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সমূহ বিপদ। পাকিস্তানও ইতঃস্তত লড়াই চালাচ্ছে - সেই উদ্দম আর নেই। যেটি খুব লজ্জার ব্যাপার, ভারতীয় সেনাদের মধ্যে পরাজিতের মনোভাব বেশ ব্যাপক ছিলো। একজন দুজন করে পালিয়ে যাওয়া তো ছিলোই ,একই সাথে দল বেঁধে ,এমন কি সব অস্ত্র শস্ত্র ফেলেই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাই ঘটছিলো। আর এটা শুধু এই সেকটরেই নয়। পরের দিকে পাঞ্জাবেও।

    এই সময়ে ভারত যা করলো সেটার জন্য পাকিস্তান আদৌ প্রস্তুত ছিলো না। ৬ই সেপ্টেম্বর, মানে কাশ্মীর পাক হামলার পাঁচদিন পরেই ভারত ঝাঁপিয়ে পড়লো তার নিজের পছন্দের রণাংগনে - লাহোরের দিকে। আখনুর বা জম্মুর প্রতিরক্ষাই শুধু নয়, এ একেবারে পাল্টা আক্রমন। পাকিস্তানের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর তায় পাকিস্তানের সবথেকে ক্ষমতাশালী রাজ্য, খোদ পাঞ্জাবের নয়নমণি। কিন্তু ভারতের সীমান্তের বড্ডো কাছে যে ! এটাই প্রধান দুর্বলতা।

    আর দু দিন পরেই ,মানে আটই সেপ্টেম্বরে জম্মুর কোল ঘেঁষে সিয়ালকোট সেকটরে আর একটা বড়ো আক্রমন। ভারতের সব সেরা ডিভিশন (বারো থেকে চোদ্দ হাজার সেনা) ছিলো ফার্স্ট আর্মারড ডিভিশন। সবথেকে রণদক্ষ, অভিজ্ঞ সেনা ও প্রচুর সাঁজোয়া গাড়ী,ট্যাংক, লরী তে একেবারে ডিভিশন নাম্বার ওয়ান। সিয়ালকোট সেক্টরে তারাই হাজির ছিলেন।

    দুই সেক্টরেই প্রথম্টায় ভারত এক ঝটকায় অনেকটা এগিয়ে গেছিলো। লাহোর সেক্টরে এই দুর্বার গতি ছিলো মাত্র একদিনের। ত্রিমুখী ভারতীয় আক্রমনের তিনটি অক্ষই পরের দিন থেকেই পিছু হঠতে শুরু করে। খেমকরন সেক্টরে তো অবস্থা সঙীনই হয়ে পড়েছিলো।

    এক তো উঁচু মহলে কো অর্ডিনেশনের অভাব। পাকিস্তানের এয়ার ফোর্সের নূর খানকে যেরকম বাদ দিয়েই অপারেশন জিব্রাল্টার প্ল্যান করা হয়েছিলো, ভারতে সে রকম না হলেও সর্বাধিনায়ক জয়ন্ত চৌধুরীর "দাদাগিরি"তে বিরক্ত ছিলেন এয়ার ফোর্সের অর্জুন সিং।

    মূল সমস্যা - সে পাকিস্তান বা ভারত - কোনো পক্ষেরই কোনো নিদৃষ্ট লক্ষ্য ছিলো না। কোনো দেশই অন্য দেশকে সম্পুর্ণ ভাবে হারিয়ে,তাদের শহর আর রাজধানী দখল করে প্রচন্ড রক্তাক্ত যুদ্ধে সামিল নন। দুই পক্ষই জানে - এ এক 'লিমিটেড ওয়ার'। দুই কি তিন সপ্তাহের তো ব্যাপার। তাতে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি সামলে সুমলে যতোটা পারা যায় জমি দখল করে নেওয়া। সেটাও নেহাৎই সিম্বলিক।

    অপারেশন রিডল

    লাহোরের সামনেই ইচোগিল ক্যানাল, গড়ে ১২০ফিট চওড়া, তিরিশ ফিট গভীর (সেই সময়ে প্রায় কুরি ফিট পর্যন্ত্য জল ছিলো)। তিনটি পথে লাহোরে আক্রমন চালিয়ে একদল ভারতীয় সেনা অপর পারেও পৌঁছে গেছিলো। পাক সেনারা বাকী সেতু ভেঙে দিলো। ব্যাস। কাশ্মীরেও পাক সেনারা যেরকম এক ঝটকায় অনেকটা এগিয়ে তারপর খুব স্লথগতি হয়ে গেলো, এখানেও তাই।

    ওয়েস্টার্ন কমান্ডের মুখ্য সেনাপতি হরবক্স সিং, যার বই War despatches, এই যুদ্ধের এক খুবই প্রামান্য দলিল, নিতান্ত বিরক্ত হয়ে পড়তেন তার অধস্তন অফিসারদের ওরকম গাজোয়ারী ভাব দেখে। "inexplicably lethargic to command", "depressing and deplorable", "throwing away a cheap victory" - এই রকম নানান কমেন্টে ভরপুর তার বই।

    মেজর জেনারেল নিরন্জন প্রসাদ তো তার কমান্ড জীপ ছেড়ে পালালেন, নিজের ব্রীফকেস ফেলে। অন্যান্য নথির সাথে সেইখানে প্রসাদের গোপন চিঠি পত্র - তার বস, হরবক্স সিংএর বিরুদ্ধে কটু কথাও ছিলো। পাক সেনারা সেটি দখল করে নিয়ে রেডিওতে ফলাও করে প্রচার চালালো। নিরন্জন প্রসাদ, তখুনি তো অপসারিত হলেনই, পরে তিনি তার চাকরীটাও খোয়াবেন।

    প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও পাকিস্তান এক দিন পরেই কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করে দিলো। তিনটি পথে ভারতীয় সেনা লাহোরের দিকে অভিযান চালিয়েছিলো - অর্থাৎ দক্ষিনে অমৃতসর হয়ে, মধ্যে খালরা বুর্কি হয়ে ও ,ডানদিকে খেমকরন কেসুর হয়ে ।

    বিরাট যুদ্ধ হয়েছিলো একেবারে ডানদিক ঘেঁষে খেমকারন সেক্টরে। প্রতিপক্ষে পাকিস্তানি সেনাপতি, কুয়াম শেখ ছিলেন জবরদস্ত লড়িয়ে। তার নির্দেশে পাক সেনারা পন্টুন সেতু বানিয়ে ইচোগিল ক্যানাল পার হয়ে পাল্টা হামলা শুরু করলে অনেক যায়গাতেই ভারতীয় সেনারা তাদের যায়গা ছেড়ে বিশৃংখল ভাবে পালিয়ে গেলেন। সেই ধাক্কাতেই পাক সেনারা ১০ সেপ্টেম্বরে ভারতের পাঁচ মাইল ভিতরে খেমকারন শহর দখল করে নিলো। সে একেবারে জি টি রোডের পাশেই। অমৃতসর শহর একেবারে হাতের মুঠোয়।

    ভারতের সব সেরা ১থম আরমার্ড ডিভিশনের মতন পাকিস্তানের সব সেরা ডিভিশনের নামও ছিলো একই - ১থম আরমার্ড ডিভিসন। আর সেটিই হাজির ছিলো এই সেক্টরে।

    খেমকরন দখলের পরেই পাকিস্তান কিন্তু আরো আগ্রাসী হয়ে উঠলো। তারা তিন ভাগে ভাগ হয়ে অমৃতসর এর দিকে নিশানা রাখলেন। আর একবার কবজায় আসলে অমৃতসর থেকে হাইওয়ে ধরে দিল্লী তো রানাঘাট থেকে তিব্বতের মতন যাস্ট একদিনের পথ !! এই ত্রিমুখী হামলার দুটি অক্ষই কিন্তু আসল উত্তরের উপর দিয়ে যাবে। হ্যাঁ, সত্যিই যায়গাটার নাম 'আসল উত্তর'। খেমকরন শহর থেকে সামান্য দূরেই।

    একটা উল্টানো ফানেলের মতন - সামনেটা সরু, মাত্র ৭ কিলোমিটার চওড়া। দুই পাশে ইরিগেশনের ক্যানাল আর প্রচুর আখের ক্ষেত, প্রায় সাত আট ফীট উঁচু ঘন আখের দংগল। কয়েক কিলোমিটার এগোলেই মধ্যখানে প্রায় ১৫ কিলোমিটার চওড়া আর তার পরে তো কথাই নেই। উন্মূক্ত মাঠ, ট্যাংক আর সাঁজোয়া গাড়ীর জন্য আরামের যায়গা। সামনেই জিটি রোড।

    পাকিস্তানের বিরাট অ্যাডভান্টেজ ছিলো তার আর্টিলারি। ভারতীয় কামানের তুলনায় দূর পাল্লার তো বটেই, তা ছাড়াও ছিলো সেই সময়ের খুব আধুনিক নিশানা (weapon locating equipment) ঠিক রাখার ক্ষমতা। ফলে পাকিস্তান তাদের কামানগুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে পারতো। আর ছিলো Time fuse। আগের থেকেই ঠিক করে রাখতো কতোটা পরে বিস্ফোরণ হবে। ফলে নানান যায়গা থেকে কামান দাগালেও নিশানার উপর একই সংগে গোলা ফাটতো - শত্রু পক্ষের কাছে ছিলো এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।

    ভারতীয় বাহিনী ,দুই পাশের সেচের বাঁধ ভেঙে জল ঢুকিয়ে ঐ ব্যুহতে ঢুকবার মুখ - ট্যাংকের পক্ষে খুব দুর্গম করে রেখেছিলো । দুই পাশের আখের ক্ষেতে লুকিয়ে রেখেছিলো তাদের সেন্চুরিয়ন ট্যাংক।আর আখের খেতের মধ্যে তৈরী করেছিলো এক “U” আকৃতির ব্যুহ। একেবারে টেক্সবুক ডিফেন্স।

    ৮ তারিখ সকাল থেকেই পাক আক্রমন শুরু হলো, দফায় দফায়। কিন্তু বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত্য কোনো ফয়সালা হোলো না। ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদ তখন পিছু হটে খেমকরনের ক্যাম্পে ফিরে গেলেন তার বাহিনী নিয়ে। এটা উচিৎ ছিলো কি না সেটা বিতর্কের বিষয়।অনেকেই মনে করেন এই লড়াইতে ওটাই "টার্নিং পয়েন্ট"। এই সিদ্ধান্তের ফলেই পাকিস্তান তাদের প্রাথমিক সাফল্যকে আর কাজে লাগাতে পারে নি। আবার রাত দুটোয় পাক ট্যাংক হামলা শুরু করলো - তাদের কাছে ইনফ্রা রেড নাইট ভিশন আছে কিন্তু তা সত্ত্বেও খুব কাজে দিলো না। ঘন্টা খানেক চেষ্টা করে আবার তারা পিছু হঠলেন।।

    পরের দিন, ৯ তারিখে দু পক্ষই তাদের বিমান ব্যবহার করেছিলো - কোনো পক্ষই তেমন সুবিধে করতে পারে নি, তবে ভারতীয় হানায় একটি পাকিস্তানী ammunition ট্রেন ধ্বংশ হলে পাকিস্তান বেকায়দায় পড়ে - প্যাটন ট্যাংক পিছু ৩০টা গোলা রেশন করে দেওয়া হোলো। দিনভর যুদ্ধের পক্ষে খুবই কম। পূর্বদিক দিয়ে আসল উত্তরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও বিফলে গেলো কারন ভারতীয়রা আগেই সেচের জল ঢুকিয়ে মাটী নরম করে রেখেছিলো। কয়েকটি পাক ট্যাংক ঐ কাদায় বসে যায়। অনেক পাকিস্তানী ট্যাংক নষ্ট হলো আর ভারতের পক্ষে ইনফ্যান্ট্রী সেনাও অনেক হতাহত হলো।

    ১০ই সেপ্টেম্বরে হোলো ফাইনাল রাউন্ড।

    আসল উত্তরে, মুখোমুখী আক্রমন করে লাভ নেই, এটা পাকিস্তান বুঝেছে। পুর্ব দিকেও সেচের জল ঢুকিয়ে এতো কাদা হয়ে আছে যে ট্যাংক চলতেই পারছে না। তার মানে পশ্চিম দিক দিয়েই ফ্ল্যাংকিং করতে হবে। একটাই পথ।

    ভারতীয় সেনারা সেটা জেনেই পশ্চিম দিকে পরপর দুটি concentric U চেহারার ব্যুহ তৈরী করে রাখলো যাতে পরপর দুই সাড়ির আর্টিলারি একসাথে শত্রুপক্ষের উপর আছড়ে পড়তে পারে। সকাল থেকেই আক্রমন শুরু হলে খুব অল্প সময়েই পাকিস্তানি ট্যাংক বাহিনী একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। তাদের পেট্রোল আর গোলা বারুদ, দুটোই কমতির দিকে। আর ভারতীয় গোলার দাপটে পাক ইনফ্যান্ট্রি কাছেই ঘেঁষতে পারছে না।

    একেবারে একতরফা ফলাফল। প্রচুর ট্যংক ছাড়াও নিহত হলেন পাকিস্তানের আর্টিলারি কমান্ডার শাম্মি, এবং কমান্ডার নাসির আহেদ খান'ও দারুন আহত হলেন। নেতৃত্বহীন পাক বাহিনী, যারা পারলো পিছু হঠলো, বাকীরা তাদের সম্পুর্ণ অক্ষত ট্যাংক ফেলেই স্রেফ পালালেন।

    ফিরে দেখলে বোঝা যায় প্যাটনের আসল দক্ষতা ছিলো তার পুরু বর্ম (যেটা খুব কাছের থেকে লড়াইতে কাজে দেয় না),এবং সেই সময়ের সবথেকে আধুনিক প্রযুক্তির কামান ও রেঞ্জ ফাইন্ডার। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা,প্রশিক্ষনের অভাবে ঐ প্রযুক্তিতে তেমন সড়গড় ছিলো না। আর খুব কাছাকাছি লড়াই হলে ঐ দূর পাল্লার কামান নিয়েই বা কী হবে?

    ভারতের সেঞ্চুরিয়ন ট্যাংকের ছিলো খুব দ্রুত কামান চালানোর ক্ষমতা। দক্ষ হাতে ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে তিনটি গোলা ছুঁড়তে পারতো। অল্প রেঞ্জের লড়াইতে ওরকম গোলার ঝাঁকের মধ্যে অন্ততঃ একটির লক্ষ্যভেদের প্রোবাবিলিটি ছিলো খুবই বেশী।

    পাকিস্তানের ট্যাংকের বিস্তার বা deployment'ও ছিলো ত্রুটিপুর্ণ। তারা বারবারে অল্প অল্প করে ট্যাংক পাঠাচ্ছিলেন, ফলে ভারতীয় নিশানাদারদের সহজ শিকার হয়ে পড়ছিলেন। এবং পাকিস্তানি ইনফ্যান্ট্রি আদৌ কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেয় নি।

    ট্যাংক বনাম বিমানের লড়াইতে বিমান সততই অনেক বেশী সফল। সেটা সেই দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের সময়ে থেকেই একেবারে পরিষ্কার - যেখানে মিত্রপক্ষ তাদের গ্রাউন্ড সাপোর্ট বিমানদের flying artillery হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই বিশাল ট্যাংক যুদ্ধে, দুই পক্ষেরই বিমান বাহিনী বেশ নিষ্ক্রিয় ছিলো।

    ভারতীয়রা সপ্তাহ খানেক পরেই প্রতিআক্রমনে বুর্কি দখল করে আবার লাহোরের খুব কাছে পৌঁছে গেছিলো। লাহোরের শহরতলী তখন ভারতীয় ট্যাংকের রেঞ্জের মধ্যে। লাহোরের এয়ারপোর্টও আর সুরক্ষিত ছিলো না। কিন্তু সেটা সেপ্টেম্বরের কুরি তারিখ নাগাদ আর বাইশ তারিখেই যুদ্ধ বিরতি হবে। ভারতীয় সেনারা তাই আর শহরের মাঝে গোলাবর্ষণ করে নি।

    এবং সিয়ালকোট : অপারেশন নেপাল

    জম্মুর সাথে সারা দেশের যোগাযোগের একটিই বড় রাস্তা । আর আন্তর্জাতিক সীমার থেকে জম্মু শহর মাত্র ২৮ কিমি আর অন্য পাড়ে সিয়ালকোট শহর ১৪ কিমি দূরে। সিয়ালকোট থেকে লাহোর পর্যন্ত্য রেললাইন। ওটা কবজা করতে পারলে পুরো ছাম্ব এলাকাতেই পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ভারতের লক্ষ্য চাইন্দা শহর - সেই রেল লাইনের উপর এক স্ট্র‌্যাটেজিক শহর।

    প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো লাহোর আর সিয়ালকোট- দুটি সেক্টরেই, একই দিনে মানে ৬ সেপ্টেম্বরে লড়াই শুরু হবে, কিন্তু লজিস্টিকের নানান ঝামেলায় সিয়ালকোট "অপারেশন নেপাল" দু দিন পরে শুরু হোলো।

    এবং গল্পটা হুবহু এক। আখনুরের কাছে আর খেমকরনে পাক সেনারা, বা লাহোরের কাছে ভারতীয় সেনারা - প্রথম দিকে এক ঝটকায় দারুন এগিয়েই ঝিমিয়ে পড়েন। ততোদিনে শত্রুপক্ষ regroup করে প্রতিরক্ষা দৃঢ় করে নেন। প্রাথমিক সাফল্য আর ধরে রাখা যায় নি। এখানেও একই ঘটনা।

    ভারতীয় সেনাপতি হরবক্স সিং যেমনই খোলাখুলি গালি দিয়েছেন, সেরকমই পাকিস্তানী মেজর আঘা আমিন এই লড়াইকে বলেছিলেন "Comedy of Higher Command Errors" ! জেনারেল মুসা বললেন ,এ সবই হচ্ছে "fogs of war"।

    দশ তারিখে একেবারে অপ্রস্তুত পাকিস্তানকে চমকে দিয়ে ভারত অনেকটা এগিয়েই আবার প্রায় দুই দিন কিছুই করলো না। পাকিস্তানও তড়িঘড়ি খেমকরন সেক্টর থেকে তাদের এলিট প্রথম আরমার্ড ব্রিগেডকে এই সিয়ালকোট সেকটরে পাঠিয়ে দিলেন।

    দুটি রণাংগনে জবরদস্ত ট্যাংক বনাম ট্যাংকের লড়াই হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কার্স্কের লড়াইএর পরে এটিই বৃহত্তম ট্যাংকের লড়াই ছিলো। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীও বেশ সক্রিয় ছিলো। পাঞ্জাবের terrain থেকে ভারতীয় বাহিনী যে সুবিধা পেয়েছিলো, সেগুলো এই সেক্টরে নেই।বিস্তীর্ণ রুক্ষ মালভূমিতে দূরপাল্লার ও দ্রুতগামী প্যাটনের সুবিধা ষোলো আনা। তাছাড়া কোনো আচমকা আক্রমন করাও সম্ভব নয়। দূর থেকে খালি চোখেই দেখা যায় প্রচন্ড ধুলো উড়িয়ে সাঁজোয়া গাড়ী আসছে।

    আমেরিকান হিসাব মতে এই সিয়ালকোট সেক্টরের লড়াইতে পাকিস্তানের দুশোটি ট্যাংক ধ্বংস হয়, ক্ষতিগ্রস্থ হয় হয় ১৫০। ভারতের ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তানের থেকে সানান্য কম। দু পক্ষেই হাজার চারেক সেনা হতাহত।

    এই সেক্টর ছাড়াও একটা ছোটো লড়াই হয় রাজস্থান অঞ্চলে বারমের জেলায়। দুই দেশই এই মরুযুদ্ধে বিপক্ষের কতকগুলি গ্রাম দখল করে- যাদের আদৌ কোনো স্ট্র‌্যাটেজিক গুরুত্ব নই।

    ইস্ট পাকিস্তানেও ভারত কোনো হামলা করে নি। সেটা অঘোষিত নির্দেশ ছিলো। যদিও পাকিস্তান খড়গপুরের কাছে কলাইকুন্ডায় হঠাৎ করে একটা বিমান হানা চালায় ও রানওয়েতে অপেক্ষমান কয়েকটি ভারতীয় বিমানকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ।

    এই বাইশ দিনের যুদ্ধে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়েছিলো, ভারত আর পাকিস্তান, কেউই আগ্রাসী যুদ্ধে পটু নয়। দুই সেনাই ডিফেনসিভ যুদ্ধই বেশী পছন্দ করে। দু পক্ষেরই উঁচু মহলে যোগ্যতার অভাব প্রকট ছিলো। আর সবথেকে বড় খামতি ছিলো এই লড়াইগুলির কোনো নিদৃষ্ট লক্ষ্য ছিলো না।

    কীসের জন্য এই লড়াই?

    শহর দখলের?তা তো নয়। জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরী পরে বলেছিলেন উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তানকে আহত করার। তার সাঁজোয়া বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্থ করা। আইয়ুব খানও চেয়েছিলেন ভারতকে একটু "সমঝে দেওয়া"। General war - সেটা কেউই চায় না।

    এই রকম খুব সীমিত লক্ষ্য থাকলে সেনা বাহিনীর মরালও খুব শক্তিশালী হয় না। ঠিক কথাই, বাইশ দিনের যুদ্ধের পরেই পাকিস্তানের ৮০% গোলা বারুদই ফুরিয়ে গেছিলো। যেহেতু বিদেশ থেকে আর নতুন করে অস্ত্র আসছিলো না, তাই অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল হয়ে পড়েছিলো। আর বড়ো জোর এক সপ্তাহ পাকিস্তান লড়াই চালিয়ে যেতে পারতো। সে তুলনায় ভারত অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো। তাদের নিজেদের অর্ডনান্স ফ্যাকটরী আছে, আর গোলাবারুদের রিজার্ভও যথেষ্ট মজুত ছিলো।

    মোড়োল, পাড়ার দাদারা এবং জ্যাঠামশাই

    দুনিয়ার বড়দাদের চোখে কিন্তু একটা স্পষ্ট তফাৎ ছিলো ভারত ও পাকিস্তানের আগ্রাসনের। পাকিস্তানের কাশ্মীর আর জম্মুতে বেনামে বা স্বমুর্ত্তিতে আক্রমন নিয়ে একটা দোনোমনা ছিলো বাকী দুনিয়ার। আফটার অল, জম্মু কাশ্মীরের মালিকানা একটা বিতর্কিত ব্যাপার। তায় সেখানে কোনো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সীমারেখাও নেই - যা আছে তা হচ্ছে যুদ্ধ বিরতি রেখা। ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত্য একটা সাময়িক সীমানা। কাশ্মীরে পাক হানা নিয়ে তাই সারা দুনিয়াই মোটামুটি নিশ্চুপ ছিলো।এমন কি আমেরিকাও। কাশ্মীরে ভারতের অবস্থান নিয়ে কেউই খুব স্বস্তিতে ছিলো না কোনোদিন।

    কিন্তু লাহোরের কাছে তেমন তো নয়। এ একেবারে ছাপ্পামারা আন্তর্জাতিক সীমানা। ব্যাস। ৬ই সেপ্টেম্বরের পরে ইংলন্ড, আমেরিকা সবাই রে রে করে উঠলো। ব্রিটীশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, ভারতকে দুষে হুমকী দিয়ে পরপর দুটি কড়া ভাষার টেলেগ্রাম পাঠালেন,পরে উনি স্বীকার করেছিলেন, আসলে ব্রিটেইনের এক পাকিস্তানি লবীর কুমতলবেই ঐ বয়ান তৈরী হয়েছিলো। নাঃ, ভাষাটা ঠিক ডিপ্লোম্যাটিক হয় নি।

    পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, ওয়ালটার ম্যাককনঘি (Walter McConaughy) তার বার্ত্তায় লিখলেন কাশ্মীরে, পাকিস্তানের বকলমে হামলার ভারত সরাসরি কোনো সশস্ত্র প্রত্যুত্তর দেবে না - এটা ভাবাটা "greatest mistake” হয়েছিলো।

    ৬ সেপ্টেম্বরে আমেরিকা যুযুধান দুই পক্ষকেই জানিয়ে দিলেন এই লড়াই না থামা পর্যন্ত্য, দুই পক্ষকেই, সব রকমের ,আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখা হবে। সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষ হলেও ফাঁসলো পাকিস্তানই। তার যে পুরো সমর ভান্ডার ,সে তো আমেরিকানই। তুলনায় ভারতের অস্ত্র আমদানী ইউরোপ ও রাশা থেকে। ভারতের নিজস্ব কারখানাও আছে।

    ৮ সেপ্টেম্বর থেকেই চীন সরাসরি পাকিস্তানের সমর্থনে হাজির। ভারতকে হুমকিও চললো।অন্য মোড়োলদের একটা নিরপেক্ষ ভাবে ছিলো, কিন্তু চীনের কোনো রাখঢাক ছিলো না।

    10'ই সেপ্টেম্বরে PAF'র আসগর খান পৌঁছালেন চীনে, সাক্ষাত করলেন চৌ এন লাইএর সাথে। খান চাইলেন বিমানের জন্য স্পেয়ার পার্ট্স, গোলা বারুদ আর বিমান বিধ্বংসী কামান। তবে সরাসরি নয়। চীন থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ঘুড়পথে।তা না হলে যে আমেরিকার গোঁসা হবে। চৌ এন লাই বললেন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তান রাজী কি না। তা না হলে চীনের পক্ষে এই যুদ্ধে সামিল হওয়াও মুশকিল। আরো জানালেন পাকিস্তান কতোটা এই যুদ্ধের দায় নেবেন সেটা তারা একমাত্র আইয়ুবের মুখ থেকেই শুনতে চান। অতএব বুলাও আইয়ুব খানকে বেজিংএ।চীন অবশ্য নাগাড়েই ভারতকে হুমকি দিয়ে যাবে।

    ১১'ই সেপ্টেম্বরে ইরাণের শাহ, ব্রিটিশ ও আমেরিকান রাষ্ট্রদূতদের জানিয়ে দিলেন, ভারতের এই ব্যবহারে তারা খুবই ক্ষুব্ধ এবং তুরষ্কের সাথে হাত মিলিয়ে তারা এখনই পাকিস্তানকে সাহায্যে প্রস্তুত। আমেরিকা কিন্তু জানিয়ে দিলো পাকিস্তানকে কোনোরকম অস্ত্র সাহায্য আমেরিকা বরদাস্ত করবে না।তুরস্ক কিন্তু পাকিস্তানকে গোলা বারুদ, এমন কি নিজের ভাঁড়ার থেকে F 86 স্যাবার জেট ,(PAFর রং করে) পাঠাতে শুরু করে দিয়েছে।

    ১৩ই সেপ্টেম্বরে CIA গোপন বার্ত্তায় জানালেন, পাকিস্তানের 'যুদ্ধং দেহি' মনোভাব বদলাচ্ছে। তারা এখন শান্তি প্রস্তাবে নিমরাজি। একই সাথে লাহোর ও সিয়ালকোটে যুদ্ধ সামলাতে তারা নাজেহাল আর গোলাবারুদ, যন্ত্রাংশ ও তেলের ঘাটতিও ক্রমশঃই বাড়ছে।

    ভারত কিন্তু ১৪ই সেপ্টেম্বরেই যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে শর্তাধীন সন্মতি জানিয়েছিলো। এবং দু দিন পরেই সেক্রেটরী জেনারেল ইউ থান্টের আবেদনে কোনো শর্ত্ত ছাড়াই যুদ্ধবিরতিতে রাজী হওয়ার কথা জানায়।

    আমেরিকা সেইদিনই তুরস্ক ও ইরাণকে জানালেন, আমেরিকান embargo স্বত্তেও ভারত আরো তিরিশ দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। IAF পারবে আরো দুই মাস, তবে পাকিস্তান এর কমদিনই টানতে পারবে।

    ১৫ তারিখে আর্মির সাথে বৈঠক সেরে আইয়ুবের প্রেস কনফেরেন্সে উল্টো সুর। এতোদিন নাগাড়ে নিজের দেশকে জানিয়ে এসেছেন পাকিস্তান যুদ্ধে জিতেই চলেছে, জিতেই চলেছে, হঠাৎ করে কেমন করে জানাবেন যুদ্ধ বিরতির কথা? সেই 'মার মার কাট কাট' আওয়াজ নেই, আইয়ুব জানালেন তিনি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জনসনকে আবেদন জানাবেন এই যুদ্ধে মধ্যস্ততা করতে। সে কী কথা ! ভুট্টো তখনই চাইলেন এই বক্তব্য যেনো সম্প্রচার না করা হয়। আইয়ুব শেষ পর্যন্ত্য এটা বোঝালেন, এখন এটা সেন্সর করলে ফল আরো খারাপ হবে।

    পরের দিন ওয়াশিংটনের এক মিলিটারি রিপোর্টে বলা হোলো ভারত ক্রমশঃই বিজয়ীর পরিস্থিতিতে যেতে চলেছে -এ ভাবে চললে ভারত কি আর শান্তি প্রস্তাবে রাজী হবে? যদি বা যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়ও, ভারত কাশ্মীর প্রসংগকে ঐ চুক্তির আওতাতে আদৌ আনবে না। বাস্তবিকই, জেনারেল জে এন চৌধুরী যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর ধারনা আর যুদ্ধ একটু ধরে রাখলেই পাকিস্তান আর সামলাতে পারবে না।

    আর চীন? সে দিনই (১৬ তারিখে) তিনদিনের আল্টিমেটাম দিলো ভারতকে। সরাসরি যুদ্ধের হুমকি। ভারত তখন বেশ উদ্দীপ্ত - মোটেই পাত্তা দিলো না চীনকে।

    আমেরিকা খুবই চিন্তিত। চীন ভারত সংঘর্ষ শুরু হলে রাশিয়া যে ভারতকে পুর্ণ সমর্থন দেবে সেটা আমেরিকাও বিশ্বাস করতো। এর ফলে ভারত আরেকটি রাশিয়ান স্যাটেলাইট দেশে পরিণত হবে।

    ১৮ তারিখে আমেরিকা আইয়ুবকে জানালো,চীন যদি নাক গলায় তাহলে পাকিস্তান পশ্চিমের সমর্থন পুরোই হারাবে। আর আইয়ুব এই সুযোগে, "বৃহত্তর শান্তি"র পক্ষ নিয়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজী হলে তার কোনো অসম্মান হবে না। হ্যাঁ কাশ্মীরও প্রাসংগিক থাকবে, তবে এই যুদ্ধবিরতির সাথে সেটাকে পুর্বসর্ত করে জড়ানো চলবে না।

    ১৯শে সেপ্টেম্বর, চীন, ভারতকে যে তিনদিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলো সেটিও আরো তিনদিনের জন্য বাড়িয়ে দিলো। নিজেরাই। পাকিস্তানের হাতে আর কোনো তাস নেই। অগত্যা প্রচন্ড গোপনে ও বেশ অনিচ্ছাতেই আইয়ুব চীনে গিয়ে দেখা করলেন চৌ এন লাই ও মার্শাল চেন ঈ'র সাথে। তারা প্রচুর জ্ঞান দিলেন। "জন সংখ্যা নয়, মানুষের ইচ্ছা শক্তিই যুদ্ধের নিয়ামক' - বললেন তারা।স্পষ্টাস্পষ্টি জানতে চাইলেন পাকিস্তান কতোটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ প্রয়োজনে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালাতে? তাতে যদি কিছু পাকিস্তানি বড় শহরের পতনও হয়, তাহলেও কি লড়াই চালাবার ধক থাকবে পাকিস্তানের? এই মনোভাব না থাকলে চীন এই যুদ্ধে সড়াসড়ি জড়িয়ে পড়বে না।'নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বাঁধলে রাওয়ালপিন্ডি নয়. বোমাটা কিন্তু বেজিং'এই পড়বে ' - চীন জানালেন। আর এটাও জানালেন আইয়ুব যদি শান্তি চুক্তি মেনেও নেয়, তাহলেও চীনের আপত্তি নেই।

    স্বখাত সলিলে ডুবে মরে পাকিস্তান, তার আর কোনো পথ খোলা নেই।

    কুরি তারিখে ইউ এন ও'র রেসোলিউশন পেশ হলো। পাঁচটি ছোটো প্যারাগ্রাফ, তাতে কাশ্মীরের উল্লেখও নেই। চতুর্থ প্যারায় "...steps could be taken to assist towards a settlement of the political problem underlying the present conflict....", ঐ, ঐ টুকুই যা ইংগিত আছে।

    যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়ে গেলো। দুই পক্ষের বন্দুক নিস্তব্ধ হোলো খাতায় কলমে ২৩ তারিখ বেলা সাড়ে তিনটের সময়।

    ইউ এন ও'র প্রস্তাবিত এই যুদ্ধ বিরতি চুক্তি কিন্তু পাকিস্তানে আদৌ সমর্থন পায় নি। আসগর খানের ভাষায় - লক্ষ মানুষ এই ঘোষণা শুনলেন বিস্ময় আর ক্রোধের সাথে। সেনা বাহিনীর অনেকেই ক্ষোভে কেঁদে ফেলেছিলেন।

    এরমাস চারেক পরে,রাশিয়ার তাসকন্থে শান্তি চুক্তি হবে।যদিও পাকিস্তান এখনো পর্যন্ত্য তাসকন্তে কোনো চুক্তি (agreement) হয়েছে সেটা স্বীকার করে না। তাদের মতে ওটি একটি ঘোষণা (Declaration) মাত্র।

    ফলাফল

    এই যুদ্ধবিরতির পরে পাকিস্তান খোলাখুলি ভাবেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলো - একপক্ষে আমেরিকা ও শান্তিপন্থী ক্যাম্প, যাতে আইয়ুব আছেন - তার উল্টোদিকের ক্যাম্পে ভুট্টো ও চীনপন্থী আরো কয়েকজন। ১৫ই ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট জনসন আইয়ুব খানকে স্পষ্টই বলেন ভুট্টোকে বিশ্বাস করবেন না।"this man is damn dangerous as far as you are concerned"। ভুট্টোবিরোধীরা এটাও বলতেন, যুদ্ধে মরবে যতো পাঠান আর পাঞ্জাবীরা আর নাম হবে সিন্ধ্রীটার (ভুট্টো)।ভুট্টোর সম্বন্ধে এটাও বলা হতো যে উনি কাশ্মীরের জন্য পুরো পাকিস্তানকেই ডুবিয়ে দিলেন।

    আইয়ুবের সাথে ভুট্টোর সংঘাত ক্রমশঃই প্রকাশ্যে আসে,অবশেষে ভুট্টো ১৯৬৬ জুন মাসে পদত্যাগ করে বাম দলগুলি নিয়ে নিজের পার্টি PPP গঠন করেন।

    যুদ্ধবিরতির প্রায় চারমাস পরে তাসকন্তে গিয়ে -কাশ্মীর নিয়ে কোনো রকম ফায়দা আদায় না হয়ে শান্তি চুক্তি করলে যে তার শেষের শুরু হয়ে যাবে এটা আইয়ুব তো জানতেনই। তাসকান্তেও আইয়ুব আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন অন্ততঃ মুখ বাঁচানোর জন্য কাশ্মীর নিয়ে যদি কোনো কথা হয়। প্রায় পাঁচদিন ধরে তিনি তার আপত্তি জানিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন কি ছেলেমানুষের মতন শাস্ত্রীর সাথে করমর্দনেও প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাকে মদত দেওয়ার জন্য, সম্পুর্ণ বিনা প্ররোচনায় চীন, ৮ জানুয়ারী ঘোষণা করে ভারত যদি তার আগ্রাসী মনোভাব না ত্যাগ করে তাহলে চীন বাধ্য হবে প্রতিশোধ নিতে। কোন "আগ্রাসী মনোভাব"? সেই নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই, শুধুই ভারতের উপর চাপ দেওয়া।

    তাসকেন্ত চুক্তিতে স্থির হয় দুই পক্ষই তাদের সংঘর্ষের আগের যায়গায় ফিরে যাবে। মোটামুটি ভাবে ভারত ফেরৎ দেবে প্রায় ১৮০০ স্কোয়ার কিলোমিটার আর পাকিস্তান ৫৪০ স্কোয়ার কিমি। ভারতের পক্ষে বড় ক্ষতি হচ্ছে হাজি পির পাসের মতন গুরুত্বপুর্ণ অঞ্চল আবার পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দেওয়া। ভারতে এ নিয়ে ক্ষোভ আর অসন্তোষ থাকলেও পাকিস্তানের মতন প্রচন্ড প্রতিবাদ, মিছিল,রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ - এ সব কিছু হয় নি।তাসকন্ত থেকে ফিরে আইয়ুবও টিভি তে কোনো জাতীয় ঘোষণা করেন নি। আর প্রকাশ্যে না এসে যেনো পালিয়েই গেলেন।

    ভারত আর পাকিস্তান - দুই দেশই "আমরাই জিতেছি" খুব ফলাও করে প্রচার করে। এখনো অবধি দুই দেশেই, বিশেষ করে পাকিস্তানে - সেপ্টেম্বরে মাসে প্রচুর ঢক্কানিনাদ করে "বিজয় দিবস" পালন করা হয় ।মোটামুটি ভাবে এটা স্বীকৃত, ৭১'র যুদ্ধের মতন নিঃসংশয় জয় না হলেও এই যুদ্ধেও ভারতই বিজয়ী । CIA'র এক রিপোর্টে বলা হয়েছিলো "In finite terms India won the September war with Pakistan"। পাকিস্তানের আরো বড় ও দীর্ঘস্থায়ী পরাজয় হোলো তার অর্থনীতিতে। এই যুদ্ধের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে ও ভারতের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিরক্ষায় ক্রমাগত আরো বেশী বেশী করে খরচা করতে থাকায় তার অর্থনীতি ভীষণ ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

    যেটা ভালো কথা, দুই দেশের সেনা নায়কেরাই (কয়েকজন বাদে)খুবই খোলামেলা বই লিখেছেন। বা প্রবন্ধ ও সাক্ষাতকার। বেশ কিছু গোপন নথি,দুই দেশেই অবাধে প্রকাশিত হয়েছিলো। ব্রিটেইন আর আমেরিকা , নিতান্ত একাডেমিক কারণে এই যুদ্ধ নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন। তাদের নিরপেক্ষ ও পেশাদার বেশ কিছু রিপোর্টও এখন নেটেই পাওয়া যায়। সুতরাং তথ্য নিয়ে খুব বড় একটা ফারাক পাওয়া যায় না। ISIর প্রাক্তন মুখ্য অধিকর্ত্তা মেহমুদ আহমেদ ২০০৬ সালে একটি বই লিখেছিলেন 1965 war - the myth of victory নামে। সে সময়ের প্রেসিডেন্ট মুসারফের নির্দেশে বইটির প্রত্যেকটি কপি পাকিস্তান আর্মি কিনে নেয়।অল্প দু একটা কপি বিদেশের লাইব্রেরীতে এখনো আছে।শুনেছিলাম ভারতে Lancer publication থেকে ওটির কপি বার হবে, কিন্তু এখনো খুঁজে পাই নি।

    দেশ জুড়ে লাগাতার অশান্তির মধ্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন আইয়ুব। অবশেষ ১৯৬৯ সালে পদ্ত্যাগ করে নিভৃতবাস শুরু করেন তার মৃত্যু (১৯৭৪) পর্যন্ত্য।। ৭১'র বাংলাদেশ যুদ্ধ নিয়েও কোনো কথা বলেন নি তিনি। শেষ কথা হয়তো আইয়ুবই লিখেছিলেন। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত তার ডায়রীতে তার স্বীকারোক্তি ছিলো ,'আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছিলো'। এর পরে আর কথা হয় না।

    **************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sudip Gupta | ২৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৩৫102029
  • আরে ছ্যা ছ্যা । নিজের নাম দীপ্তেন/ ডিডি লেখকের নামে লিখতেই পারলাম না। 

  • এফিডেভিটের উকিল | 49.206.***.*** | ২৫ জানুয়ারি ২০২১ ২০:১৭102030
  • আমিও তাই ভাবি, হঠাত করে সই বদল কেন!

    কোন নামটা চান, ডিডি না দীপ্তেন?

  • সম্বিৎ | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০২:২৬102047
  • দুর্ধর্ষ দুশমন। আরও দুর্ধর্ষ এই লেখা। এই এদ্দিনে 1965-র যুদ্ধ নিয়ে প্রাইমার পড়লাম। আমার পাকিস্তানী রুমমেটের সঙ্গে প্রায়ই তক্ক হত কে জিতেছে এই নিয়ে।

  • i | 61.68.***.*** | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০২:৩৫102048
  • খুব ভালো লাগল। অনেক কিছুই জানলাম তো বটেই। এত বিশদ লেখা, জমাট লেখা। এতটুকু ফাঁক ফোকর নেই।

  • &/ | 151.14.***.*** | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৬:২৯102050
  • লেখা চমৎকার। অনেক কিছু জানতে পারলাম। আগে এসবের প্রায় কিছুই জানতাম না। এই ধরণের লেখা আরও আসা খুবই দরকার।

  • Sudip Gupta | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:৫৯102053
  • বহু ইংরেজি কথা দেখছি বাদ পড়ে গেছে। ফর এগজাম্পল ঃ 

    অপারেশন রিডল দেখুন।

     কী করে জানি না, দুটো মোক্ষোম ইংরেজী শব্দ বাদ পড়ে গেছে। পুরোটা দিলাম । তাহলে বুঝতে পারবেন।  এই যুদ্ধে গেম চেঞ্জার ছিলো ঐ পাকিস্তানের আর্টিলারিই। 

    পাকিস্তানের বিরাট অ্যাডভান্টেজ ছিলো তার আর্টিলারি। ভারতীয় কামানের তুলনায় দূর পাল্লার তো বটেই, তা ছাড়াও ছিলো সেই সময়ের খুব আধুনিক নিশানা (<weapon locating equipment>) ঠিক রাখার ক্ষমতা। ফলে পাকিস্তান তাদের কামানগুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে পারতো। আর ছিলো <Time fuse>। আগের থেকেই ঠিক করে রাখতো কতোটা পরে বিস্ফোরণ হবে। ফলে নানান যায়গা থেকে কামান দাগালেও নিশানার উপর একই সংগে গোলা ফাটতো - শত্রু পক্ষের কাছে ছিলো এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।

  • Sudip Gupta | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:০৪102054
  • আরেক যায়্গায়  - এই অপারেশন রিডলেএই


    ওয়েস্টার্ন কমান্ডের মুখ্য সেনাপতি হরবক্স সিং, যার বই War despatches, এই যুদ্ধের এক খুবই প্রামান্য দলিল, নিতান্ত বিরক্ত হয়ে পড়তেন তার অধস্তন  অফিসারদের ওরকম গাজোয়ারী ভাব দেখে।"inexplicably lethargic to command", "depressing and deplorable", "throwing away a cheap victory" -  

  • r2h | 49.206.***.*** | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:২৫102055
  • প্রথমবার পড়ার সময় এই ইংরেজিকথাগুলো ছিলো তো

  • lcm | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:৩৩102056
  • এখন ঠিক হওয়া উচিত, ইংরেজিগুলো আছে, কিন্তু ঐ ব্রাকেটের মধ্যে ছিল বলে দেখাচ্ছিল না। আরও কয়েক জায়্গায় ছিল।

  • r2h | 49.206.***.*** | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:৪৫102057
  • আমি নিরঞ্জন প্রসাদের কথা ভাবি, বেচারার হয়তো সৈন্য হওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না, বাড়ি থেকে মেরেধরে পাঠিয়েছিল, কে জানে। উনি তো বোধয় আগেও কোথায় কোথায় পালিয়ে গেছিলেন।

    আর লেখাটা তো ভয়ানক ভালো।

  • উজ্জ্বল | ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:৫০102058
  • রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম, অনেক কিছু নতুন করে জানলাম। কিন্তু এত বানান ভুল কেন? 

  • &/ | 151.14.***.*** | ২৭ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:১১102087
  • বেচারা নিরঞ্জন প্রসাদ! এত পালিয়ে পালিয়েও রক্ষা নেই, ধরেবেঁধে মেজর জেনারেল করে দিয়েছে। কী অবস্থা! এইরকম এত উঁচু র‌্যাংক হয় কী করে এরকম এত পালানোর রেকর্ড থাকা সৈন্যের?

  • Sri Shambo | 76.176.***.*** | ২৭ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:৩২102088

  • খুব সুন্দর লেখার স্টাইল

  • &/ | 151.14.***.*** | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৫৬102188
  • ডিডি, আরও শুনতে ইচ্ছে করছে। কী  হল তারপর ?

  • Sudip Gupta | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:২৮102190
  • তার আবার পর কী?

    ঐ সীমান্তে খুচখাচ। দূর থেকে রক্তচক্ষু প্রদর্শন। গালি গালাজ। যদ্দিন না ৭১এ বাংলাদেশ হচ্ছে।
    বরং নিরন্জন প্রসাদের উপর এই ছোটো লেখাটা পড়ো। সুন্দর PNPC।

    http://www.indiandefencereview.com/spotlights/the-1965-war-with-pakistan-i/4/

    @ LCM , পুরোনো গুরুতে grand, Stategy এইসব যুক্তাক্ষর বাংলা হরফে আসছে না। আরো কতকগুলো যুক্তাক্ষরও ভেঙে ভেঙে আসছে। এই রকম চললে লোকশিক্ষে হবে কী করে?

  • lcm | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১০:১৬102191
  • ডিডিদা,
    পুরোনো গুরু তে 
    grJaanD = গ্র্যান্ড
    sTrJaaTeji = স্ট্র্যাটেজি 
    যদি Y দিয়ে য-ফলা না আসে, তাহলে J দিয়ে ট্রাই করুন
    (এটা সৈকতের ডিপার্টমেন্ট - সৈকত, দেখো সময় পেলে)

  • ar | 96.23.***.*** | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ২২:২০102216

  • "র" এর পরে য-্ফলা থাকলে পুরোনো গুরু এডিটারে এই ভাবে লিখতে হবেঃ
    "brJaanD = = "ব্র্যান্ড"
    grJAnD বা grJaanD = = গ্র্যান্ড
    drJaa == দ্র্যা
    phrJaakashan = = ফ্র্যাকশন
    frJAkashan = = ফ্র্যাকশন
    sTrJaaTeji = = স্ট্র্যাটেজি
    sTrJATeji = = স্ট্র্যাটেজি

  • b | 14.139.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২১ ১৪:১৮104508
  • বানানভুল গুলো একটু ঠিক করে নেওয়া যায় না? 

  • Kaushik Saha | ০৯ এপ্রিল ২০২১ ১৭:২৮104559
  • Asal Uttar উচ্চারণ "আসল উত্তর" নয়। গুরুমুখী লিপিতে ਆਸਲ ਉਤਾੜ, হিন্দীতে आसल उत्ताड़, বাংলায় লিখলে  "আসল ( স এর উচ্চারণ   s হবে,    sh নয় ) উত্তাড়"।  

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন