
Moumita Mitra লেখকের গ্রাহক হোনএই ফেটিশ ডিপার্চারটারটাই ইরফানীয় সিগনেচার
ঠিক এটাই।
মানে আপনি যখন স্থিতাবস্থায় আছেন। স্থিতাবস্থা.. সে ভালো মন্দ মাঝারি ছ্যাঁচড়ামথিত - যে অবস্থাই হোক না কেন, আপনি মেনে নিয়েছেন।
যেমন আপনি বহুদিন করোনা আপডেট দেখা ছেড়ে দিয়েছেন। বা দেখলেও প্রাতঃকৃত্যের মতো নিরাসক্তভাবে দেখেন।চৌকো বক্সে আপডেট্রা অবিরত ব্লিঙ্ক করলেও সুজির হালুয়ায় কখন ক',চামচ ঘি আর এলাচ দানা দিতে হবে, হালুয়ার বর্ণ ঠিক কেমন মোহনবাহার হলে গ্যাসের নবটা মুলে দিতে হবে নইলে গ্রিলড বিটার হালুয়া খেতে আপনার এবং আপনার পরিবারের একটু মোটেই কিছুমাত্র ভাল্লাগবে না, এই মর্মে গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছেন রেসিপি..
ঠিক এমন সময়ে.. মানে ঠিক তখনই ইরফান খান তার ষষ্ঠবৈদিক চোখদুটো ভাসিয়ে অল্প হেসে ক্যামেরার দিকে পিছন করে গটগট করে চলে গেলেন... কাট...
হ্যাঁ। ষষ্ঠবৈদিক চোখ। সংসারে চারটে বেদ আছে। ঋক, সাম, যজু, অথর্ব। মহাভারতকে অনেকে বলে পঞ্চম বেদ আর ষষ্ঠবেদ..
ইরফানের চোখ..নির্বেদ। এ চোখদুটো কারোর গলা কেটে নলিতে চুমু খেয়ে পাউডার মাখিয়ে ফেভিকল কা মজবুত জোড় দিয়ে আবার জ্যান্ত করে দিতে পারে।
কিংবা তারকোভস্কি'র মায়ের মতো চোখ। মনে আছে 'মিরর' এর প্রথম সিন? মা দিগন্তে চোখ ভাসিয়ে রেখেছেন, যেমন রাখেন, যেমন রাখার কথা ছিল চিরলীন সংসারে, তেমন করে বিছিয়ে রেখেছিলেন চোখ, মা তখনও জানতেন না যে তার ঘরের মানুষটা সেই যে সাবান কাচা ধবধবে সকালে বেরিয়ে গেল, আর কোনদিনও বাড়ি ফিরবে না। ইরফানের চোখ- সেই কিছুই না জানা বা সব জানার ওপারে ভাসিয়ে দেওয়া চোখ...
এই চোখ দেখেছিলাম নগর বিজয়গড় কা রাজকুমার.. যো চন্দ্রকান্তা সে করতা হ্যায় পেয়ার... সেই রাজকুমারের রাজত্বে হানা দিতাম যখন, সেই তখন.. প্রথমবার। কতই বা বয়স তখন, টেপজামার দীঘিতে নীল হেম জলে কমলা হেম হাঁস। কি বিচ্ছিরি লাগত। একটা কেলে লোক, ( তখন ফরসা বাতিক ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে, দিদির ফরসা হাতে ছাড়া ভাত খেতাম না, ফরসা মানুষদের ছাড়া ভালবাসতাম না, অবিশ্যি বাবা জ্যাঠাদের বেলায় ছাড় ছিল) কেমন নিগ্রো নিগ্রো দেখতে, তার উপর চুলটাও কেমন কোঁকড়ানো, ড্যাবা ড্যাবা চোখ। শুধু একটাই মজা লাগত। ইরফানের চরিত্রের নামও ইরফানই ছিল।
তারপর কতদিন সে চোখ এড়িয়ে গেছি। 'সালাম বম্বে' র সেই ভেলভেলে ছেলেটা যখন 'চিঠি লিখিয়ে' লোকটার কাছে চিঠি লেখাতে আসে, বয়ান লেখা শেষ করে লোকটা যখন ঠিকানা জানতে চায়, তখন সে দুড়দাড় পালাতে শুরু করে। আসলে অলক্ষ্যে ছুটতে শুরু করে। তার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম.. সবেতেই ফোর হান্ড্রেড ব্লোজের চাপ চাপ জীবনকিমা কিনা, তাই সে ছোটে, বম্বের অগণিত ভীড়ের বমিতে মিশে যায়, কিন্তু তার পিছনে সেই চিঠি লিখিয়ে',র বিরক্ত বিব্রত অথচ নির্বিন্ন চোখদুটো আর ঈষদুষ্ণ মাথা নাড়া ভাসতে থাকে, ভাসতেই থাকে।
লাইফ ইন আ মেট্রোয় চোখদুটো থমকে যায়। ক্ষণিক দৃকপাত। তারপর চলতে থাকে, বিশ্বস্ততার এক বিকেলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় অনন্ত উচ্চতায়, বলে, শরীরের সব শক্তি জড়ো করে চেঁচাও, তার মধ্যে দিয়েই ওয়্যাক থু করে দাও জীবনের সমস্ত রাগ বিরক্ত কষ্ট দেখে সে ঘৃণা আর না পাওয়াকে। ঐ বৈদিক চোখই তো পারে অন্যদের ঐ মহেন্দ্র উচ্চতায় নিয়ে যেতে।
'নেমসেকে' দুঃস্বপ্নের তাড়া খেয়ে ঘেমে নেয়ে মধ্যরাতে জেগে উঠে ঘুমন্ত বৌয়ের বুকে পাখির নীড়ের মতো মাথা গুঁজে দেয় যে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা পথিক , যে স্ত্রী অন্ধকারে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই বুক থেকে আঁচলের গন্ধ মুছে ফেলে স্বামীর মাথা টেনে আয় আয় চাঁদমামা করে চাপড়ে দিতে থাকে, সে স্ত্রী'র মধ্যে জনৈক আমিও কি ছিলাম না, মুখোমুখি বসিবার তরে, কোন এক দারুচিনি দ্বীপের ভিতরদিক ?
নেমসেকের অসীমার মতোই স্থানুবত আজ। অসীমা যেমন একটু আগেই স্বামীর গলা পেল ফোনে, চেকাপ হয়ে গেছে। সব নর্ম্যাল। পরক্ষণেই নার্সিং হোম থেকে ফোন পেল। সব শেষ। সেই অসীমা'র মতোই আমারও অসীমে দাঁড়িয়ে আছি আমি - প্রাণমন লয়ে।
যেমন দাঁড়িয়েছিল বৈঠাধর 'পাই'। ২২/৭ জীবন নিয়ে মৃত্যু, ভয় ক্ষুধার সমুদ্রে অনন্ত টাল খেতে খেতে। দূর থেকে বিল্লুর বর্বর চোখের আর কাঁচির পসার জমে উঠছে। এই তো জীবন। লাইফ অফ পাই। যেটুকু পাই, তাই লাইফ। বাকি সব ক্যাঁচক্যাঁচ কাটা শালা।
ঋতুপর্ণ'র সময়ে সারাটা দিন খাইনি। চান করিনি। সে ছিল পলকারাণী । আজকের গিন্নী পেটপুরে খেয়েছি। তারপর বাসন মাজছি। আর মাজছি। আর ভাবছি, হে করোনামাঈ, আজ যেন প্রতিটি বাসনে লেগে থাকে হলুদের দাগ, প্রতিটি হাতা খুন্তির ঠোঁটে শুকনো সকড়ি, প্রতিটি কাজে যেন ভুল হতে থাকে, কিছু যেন হয় মা লকডাউনমাঈ, কোন একটা বিচ্যুতি, শুধুমাত্র ইরফানের জন্যে, তার সম্মানে, তার দুঃখে- স্মরণে - মননে.. পাঁচটা পরোটা দুরকমের তরকারি একবাটি ডাল একটু আচার আর একটা চিরকুট দিয়ে তার জন্য লাঞ্চবক্স যদি সাজাতে পারতাম..
অথচ হল যেটা,
কড়ার হ্যান্ডেলে যুগ - যুগান্তর ধরে জমে থাকা গাঢ় লাল তেলচিটে ময়লাটা ঘষটানি খেতে খেতে খেতে খেতে রূপো অথবা রূপকথার মতো চকচক করে উঠল। কি করে হল এ মীরাক্কেল? না, আমার হঠাৎ মনে হল, ইরফান যেমন করে অভিনয় করতেন, তেমন করেই যদি বাসন মাজতেন? তাহলে কেমন হোত? অবচেতনের এই কলকাঠিতেই বুঝি মুহুর্তের মধ্যে লিকুইড মন পারফেকশনিস্ট ভীম হয়ে উঠল। আহ! এত সুন্দর, এত অনুপম এমন ঝকঝকে বাসন মাজিনি কোনদিন..
মেজেটেজে জামা ভিজিয়ে ঘুম পাড়াতে ট্যাঁকেশ্বরকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়লুম।
এসো হে বৈশাখ, আজ এই মুহুর্ত থেকে করোনামাঈ বন্দিদশাবাপ, মাস্কঠাকুরাণী, পারম্যাঙ্গানেটেশ্বর, ডেটলনাথ, হ্যান্ডওয়াশেন্দ্রাণীর সঙ্গে ইরফানহীন কাটাব জীবন। তোমার সঙ্গলীন জীবন কাটাব।
তামিমৌ ত্রমি
রাজকুমার | 172.69.***.*** | ৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:১৯730967অন্য আঙ্গিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। ভাল লেখা
Moumita Mitra | ৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৫:০৯730970ধন্যবাদ। কিন্তু এ লেখা কোনদিন লিখতে চাইনি। এত তাড়াতাড়ি লিখতে হবে ভাবিনি। সাবধানে থাকবেন।
তামিমৌ,
উল্টে গেল সিগনেচার। ছবিতে ছবিতে উজ্জ্বল কীর্তিময় ছায়া । এই রকম জাদুকরী শ্রদ্ধার্ঘ্যে তার প্রস্থান নাই, কেবল সিনেমাটিক "কাট"।
গুরুতে স্বাগতম। আরও লিখুন। শুভ
Moumita Mitra | ০১ মে ২০২০ ০৭:৩৮730984অসংখ্য ধন্যবাদ। গুরুতে এসে এক অভূতপূর্ব আত্মীয়তা অনুভব করছি। সত্যিই এ মানুষকে বড় শ্রদ্ধা করতাম। বড় বেজেছে বুকে। আপনার শুভকামনা নিলাম। মিলে আর মিশে গেলাম আজ এই মুহুর্ত থেকে, যেটুকু আড়ষ্টতা ছিল, সরে গেল, তা- ও।
dc | 162.158.***.*** | ০১ মে ২০২০ ০৯:০৩730985
সুকি | 162.158.***.*** | ০২ মে ২০২০ ১০:২৭731008dc, আপনি একা নন, আমিও বুঝতে পারি নি এখনো যে 'ফেটিশ ডিপার্চার' ঠিক কি জিনিস! এটা জানা উচিত ছিল কিনা সেটা নিয়েই ভাবতে গিয়ে একটা সন্ধ্যে নষ্ট হয়েছে অলরেডি।
প্রশ্ন | 172.68.***.*** | ০২ মে ২০২০ ১৫:৩৪731010