ভালোবাসার অনেক রঙ : ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিক
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯৩৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
আমি বললাম, “এই বাচ্চা গ্রামীণ হাসপাতালে রেখে কী করবে। কান্দিতে রেফার করে দাও।”
“বাড়ির লোককে কান্দি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু ওরা নিয়ে যাবে না।
বাচ্চাটির বাবার বক্তব্য এই সন্তান জোর করে বাঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। ও কোনও দিনই সুস্থ জীবন পাবে না। তার থেকে এ বাচ্চা মরে যাওয়াই ভাল। ওরা তো বাচ্চা হাসপাতালে রেখেই মাকে নিয়ে চলে যাবে বলছিল। কোনও রকমে আটকেছি।”
আমি বললাম, “তাহলে আর কি। এখানেই থাকুক বাচ্চা। বাড়ির লোককে ভালো করে বুঝিয়ে সই করিয়ে রাখো। তারপর যা হওয়ার হবে।”
কিন্তু যা হ’ল তাকে খুব ভাল বলা যায় না । পরের দিন আমার ২৪ ঘণ্টা অনকল ডিউটি। সকাল সাড়ে সাতটার সময় হাসপাতালে ঢুকতে গিয়ে দেখি প্রায় সমস্ত গ্রামের লোক জড় হয়েছে হাসপাতালের সামনে। আশেপাশের গ্রাম থেকেও ভ্যানে করে, হেঁটে অনেক লোক এসেছে। সবাই বাচ্চাটাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। যারা ইতিমধ্যে দেখার সুযোগ পেয়েছে তারা অন্যদের কাছে গল্প করছে। এবং তাদের গল্পের গরু মাঝে মাঝেই গাছে উঠে যাচ্ছে। একজন বলছে, ‘দেখে এলুম রাক্ষস বাচ্চাটা জন্মানোর পর পরেই হামা দিতে শুরু করেছে।’
আরেকজন বলছে, ‘রাক্ষসটা ঘন্টায় ঘণ্টায় লম্বায় বাড়ছে। জন্মের পরে যা দৈর্ঘ্য ছিল ইতিমধ্যে তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’
যারা এতক্ষণেও বাচ্চাটার দর্শন পায়নি তারা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সবাই দল বেঁধে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢোকার চেষ্টা করছে।
আমি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলাম। ওয়ার্ড ফাঁকা করতে চাইলাম। লোকজনকে বোঝাতে চাইলাম এটা মোটেই রাক্ষস নয়।
সাগর দত্ত হাসপাতাল - একটি অপরিবর্তনের ছবি : ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিক
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০২ মে ২০২০ | ৩১৯২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
এই মধ্যমগ্রামও যেন আগের শহর নয়। আজ বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা পুরো শুনশান। চৌমাথা থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে একটাও গাড়ি চোখে পড়ল না। ওভারব্রিজের মাঝামাঝি প্রতিদিনই দাঁড়াই। প্লাটফর্মের প্রত্যেকটা সিগন্যাল লাল হয়ে আছে। এই সময় যে হাজার হাজার লোক স্টেশনে ভিড় করে থাকত, আপ ট্রেন একগাদা ক্লান্ত লোককে কলকাতা থেকে বয়ে এনে প্লাটফর্মে উগড়ে দিত, তারা কোথায় গেল? তারা আর আদৌ কোনও দিন প্লাটফর্মে ভিড় করবে তো?সবকিছু বদলে গেছে, ভেবেছিলাম হাসপাতালও বদলে গেছে। অনেকদিন হাসপাতাল ভাঙচুরের খবর নেই, ডাক্তারের মাথা ফাটছে না। বিষ্ঠা মাখতে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কর্মীদের কয়েক জায়গায় পাড়া ছাড়া করা হয়েছে, মাঝ রাতে সিস্টারকে ভাড়া বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অসংখ্য মানুষ সেই সব ঘটনার সমালোচনা করে স্বাস্থ্য কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
করোনার দিনগুলি - ত্রয়োদশ কিস্তি : ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ৩১ জুলাই ২০২০ | ৪২৪১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৯
অনেক রোগী খুপরিতে ঢুকে প্রথমেই স্যানিটাইজারের বোতল থেকে দু-চার ফোঁটা তরল বসার চেয়ার, আমার টেবিলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আজ এক ভদ্রমহিলা গঙ্গাজল এর মত আমার গায়ে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিলেন। মানে চেয়ার-টেবিলের সাথে তিনি ডাক্তারকেও স্যানিটাইজ করে নিলেন। ওদিকে রোগীর সংখ্যা রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। জ্বর আসলেই এখন অনেকে গন্ধ শুঁকছেন। একজন বললেন, 'ডাক্তারবাবু, খাবার-দাবারের গন্ধ পাচ্ছি না। কিন্তু ডেটলের গন্ধ, ডেনড্রাইটের গন্ধ এগুলো দিব্যি পাচ্ছি।'
একজন রোগী দুদিন আগেই দেখিয়ে গেছেন। জ্বর কমছে না। আবার এসেছেন। তার পুরোনো প্রেসক্রিপশন পুরো সাদা। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'এ কি? আমি কোন ওষুধপত্র লিখিনি নাকি?'
উনি বিব্রত মুখে জানালেন, 'হ্যাঁ লিখেছিলেন। কিন্তু বাড়ি গিয়ে প্রেসক্রিপশন স্যানিটাইজ করতেই সব লেখা উবে গেছে।'
করোনার দিনগুলি - ঊনবিংশ কিস্তি : ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্বাস্থ্য | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩০২৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
কোভিড ১৯ পরীক্ষা করানো এখন অনেক সহজ হয়েছে। কয়েকদিন আগেও আমরা যারা বেসরকারি চিকিৎসক, চাইলেই করোনা পরীক্ষা করাতে পারতাম না। পরীক্ষা হতো খুব অল্প জায়গায়। আর খরচও লাগতো প্রায় আড়াই হাজার টাকা। লকডাউনের মধ্যে অধিকাংশ মানুষেরই সঞ্চয় তলানিতে। তাই আড়াই হাজার টাকার পরীক্ষা লেখার আগে অনেক ভাবনা চিন্তা করতে হতো।
চারদিকে কি বিপুল অপচয়। রাস্তাঘাট, বাড়ি- ঘর স্যানিটাইজেশনের নামে জল, অর্থ ও লোকবলের অপচয় হচ্ছে। মাঝে মধ্যে আকস্মিক লকডাউন করে করোনাকে কতদূর ঠেকানো যাবে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বরঞ্চ স্বাভাবিক জীবনে যত দ্রুত সম্ভব ফেরার চেষ্টা করা উচিত। মানুষদের কিভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, সেটা প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে মাস্ক।
একটা থ্রি লেয়ার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা গেলে মহামারী ছড়ানোর গতিকে আমরা অনেক শ্লথ করে দিতে পারব। কিন্তু সেটুকু করার বদলে বাদবাকি যাবতীয় কিছু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। লোকজন করোনার ভয়ে স্বাস্থ্যকর্মীকে আবাসন ছাড়া করছেন। আর নিজে মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে ভিড়ের মধ্যে চা- সিগারেট খাচ্ছেন।
করোনার দিনগুলি - বিংশতিতম কিস্তি : ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্বাস্থ্য | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩৬৫২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
এই পরিস্থিতির সাথে আমি আগেও পরিচিত। আমাদের আর একজন গৃহ সহায়িকা অঞ্জুদিকে পাশের পাড়ার এক বাড়িতে বলেছিল, 'তুমি ডাক্তারবাবুর বাড়িতে কাজ করো। ডাক্তারবাবু রোজ জ্বরের রোগী দেখছেন। ওই বাড়িতে কাজ না ছাড়লে আমাদের বাড়ি আর কাজ করতে পারবে না।' অঞ্জুদি আমাকে হেসে বলেছিলেন, 'বললুম, আপনাদের কাজটাই তাহলে ছেড়ে দিই। তবে আপনারা জ্বর হলে কোথায় যাবেন? ডাক্তার কি দেখাবেন না?’