ঘোটকাসুর বধ : কৌশিক দত্ত
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ১৫ এপ্রিল ২০১৬ | ১১৩৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ২০
ষোলো তারিখ বুধবার রোজকার মতো সকাল ন’টার মধ্যে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গেল পিনাকী। দুপুরে বাড়ি আসে না, সকালেই খাওয়া সেরে নেয়। প্রথমে একবার যাবে যাদবপুর। সেখান থেকে নির্মলের দোকান। একবার দাঁড়াতে হবে মুখোমুখি হুল উঁচিয়ে। ইলিয়াস বা মদনকে বললে অবশ্য দু-চারটে মোষ নিঃশ্বব্দে গায়েব হয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। কেমন ভাবে আস্ত মোষ অদৃশ্য হয়, ম্যাজিশিয়ানরা বলে না। কিন্তু মোষ খ্যাদানো বড় কথা নয়। বড় কথা হল অপমানিত পরাজিত লিঙ্গের পুনরুত্থান। হেরো পুরুষ বলে কিছু হয় না। হেরে যাবার পর আর পুরুষ থাকে না। তার কুন্ডলিনী অনন্ত শয্যায় শায়িত হয় মূলাধারের চৌবাচ্চায় জিলিপির মতো বেবাক পেঁচিয়ে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে, মণিপুর চক্রে দশ পাপড়ি নীল পদ্মের ওপর দাপাদাপি করছে এক কৃষ্ণকায় মোষ। কী বলিষ্ঠ তার গড়ন! মোষ নাচছে, পদ্মের পাপড়ি দুলে উঠছে। শ্বাস ফেলছে আর মেঘের মতো জেগে উঠছে দু’গাছা মেয়েলি চুল। ঘুমের মধ্যে সে কঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু বাধা দিতে পারে না।
পারিবারিক : কৌশিক দত্ত
বুলবুলভাজা | গপ্পো | ১৮ অক্টোবর ২০১৬ | ২৬৮০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪৮
সকাল সকাল দুজন উঠোনে শুয়ে। এক বৃদ্ধ, এক কিশোরী। পুবদিক থেকে এক টুকরো এবড়ো-খেবড়ো বাঁজা জমি বিপুল উৎসাহে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু এক গাঁ মানুষের কাঁধ ছাড়িয়ে মাথা তুলতে পারেনি। অবশ্য নতুন করে দেখার কী বা আছে তার? দেখা ছাড়া তার জীবনে আছেই বা কী? বর্ষা যায়, শরৎ যায়, তার শরীরে কেউ লাঙল দেয় না। আগাছা বুকে নিয়ে সারা দিনমান সে হাউ হাউ চেয়ে থাকে দূরের ধানক্ষেত সর্ষে ক্ষেতের দিকে। ক্রমশ গরু-বাছুর ফিরে গেলে তার বুক মাড়িয়ে সন্ধ্যা হেঁটে যায়। কাঁটা উঁচিয়ে রাত্রির বাড়ি ফেরা দেখে একমাত্র বামন খেজুর গাছটা। তারপর সেও ঘুমিয়ে পড়ে। মাঠ জেগে থাকে। সারারাত দেখে আর শোনে। পাশের বাড়িতে সবুজ কপাটওয়ালা দরজা বন্ধ করে রাত ফিসফিস করে।
অসন্তোষের কারণ : কৌশিক দত্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ১২ জুলাই ২০১৭ | ১২৭৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২৪
নিদারুণ অবিশ্বাসের পরিবেশে ভালো কাজ হয় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, জটিল রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ভূমিকা বিরাট। রোগী দেখার সময় পূর্ণ মনোযোগ রোগীর দিকে দিতে পারলে তবেই মনের সবটা, ষষ্ঠেন্দ্রিয় সমেত, কাজ করে। যদি অর্ধেকটা মন পড়ে থাকে নিজের পিঠ বাঁচানোর দিকে, রোগী দেখার সময় যদি ভাবতে হয় “এই রোগী নিয়ে কী ধরণের কেস খেতে পারি” বা “এর বাড়ির লোক ঝামেলা করতে পারে কিনা”, তাহলে মনের সেই আশ্চর্য রত্নভাণ্ডারে তালা পড়ে যায়, বদলে সামনে আসে কৈকেয়ীর গোঁসাঘর আর মন্থরার ফিসফাস। রোগীকে ভালোবেসে দেখা, তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে “কিচ্ছু হবে না, আমি তো আছি” বলা, বা হাল ছেড়ে দেবার আগে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে নিয়মের বেড়া ডিঙিয়ে শেষ চেষ্টা করার বদলে এখন অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি শব্দ খাতায় লিখে রাখা, আত্মীয়দের কটার সময় কী জানানো হয়েছে তা নথিবদ্ধ করে সই করিয়ে নেওয়া, বইতে যেটুকু লেখা আছে তার বাইরে যাবার চেষ্টা না করা, দায়িত্ব নিজের কাঁধে না রেখে অন্যান্য স্পেশালিস্টদের রেফার করে দেওয়া, ইত্যাদি। যেন রোগীকে নয়, নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসা করছি। এভাবে আর যাই হোক, সুচিকিৎসা হয় না। যাঁদের প্রতি সমানুভূতি লাভ করার কথা, তাঁদেরকেই সম্ভাব্য আক্রমণকারী বা আদালতের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে হবে বলে যদি জানতাম, তাহলে আমরা অনেকেই হয়ত অন্য পেশা বেছে নিতাম, যেখানে এর চেয়ে কম পরিশ্রমে এর চেয়ে বেশি উপার্জন করতে পারতাম। চিকিৎসা পেশার একটা নেশা আছে, যেটা চলে গেলে আমাদের অনেকের জন্যেই কাজটি অর্থহীন হয়ে যায়।
কোথায় বা যাব তোকে ফেলে? : কৌশিক দত্ত
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ১২ মার্চ ২০১৫ | ২৯৭৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪৬
জ্যোতি মারা যাবার পর এক দরদী রাজনৈতিক ব্যাক্তি এরকম বলেছিলেন... ভালই হয়েছে, মেয়েটা মরে বেঁচেছে। নইলে জ্যান্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকত। যদি সমাজের কোনো একটা মানসিক বিকার নিয়ে আমার সত্যিকারের বিবমিষা থাকে, তাহলে এটা। মেয়েটির বেঁচে থাকার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় এই মনোভাব। শুধু অন্য লোকে এ কথা বিশ্বাস করলে সমস্যা ছিল না; অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েটি নিজেও তাই বিশ্বাস করে। সমষ্টি এবং ব্যষ্টির নিঃশ্বাসে মিশে যাওয়া এই বিষাক্ত বিশ্বাসকে আক্রমণ করা ধর্ষককে হত্যা করার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
মেয়েটিকে আর তার পরিবারকে “কিচ্ছু হয়নি” বলে দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। আপাত দৃষ্টিতে একথা বলা অন্যায়। কিচ্ছু হয়নি মানে? এত বড় সর্বনাশের পর এই কথা? এই আরেকজন পুরুষতান্ত্রিক শূকর। সংবেদনশীলতার কণামাত্র নেই। এই সব অভিযোগ শুনেও আমি এই কথাটা বলতে চাই এবং বলে থাকি। যাঁদের বলেছি, তাঁরা প্রায় সকলেই আমাকে মার্জনা করেছেন। ব্যক্তিগত স্তরে যাঁদের সে কথা বলার প্রয়োজন হয়নি, কিন্তু যাঁদের এই কথাটা শোনা এবং বিশ্বাস করা প্রয়োজন, তাঁদের জন্য এখানে বলছি। “কিচ্ছু হয়নি।” অপরাধ নিতে পারেন। মার্জনা না করলেও চলবে। কিন্তু এই যে আপনার চরম অভিজ্ঞতাকে একরকম ট্রিভিয়ালাইজ করলাম, সেই অপরাধে আমাকে রোজ সকাল-বিকাল গালি দেবার ফাঁকে এই কথাটা নিজেকেও শোনান। শেষে যদি একদিন এটা বিশ্বাস করতে পারেন, দেখবেন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। পাশের বাড়ির মেয়েটি যদি এসে গোপনে কাঁদে আপনার কাছে, তার কানে কানেও এই কথাটাই বলুন, “কিচ্ছু হয়নি। কোথাকার কে লম্পট কী করল, তার জন্য তোর জীবন যাবে? জীবন বুঝি এতই ফেলনা?”