“যেদিন আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিল, তখন চারদিকে কানাকানি, গুনগুন হচ্ছে। তখন আমি বুঝতে পারছি, কী একটি ঘটনা ঘটছে কিন্তু আমাকে কেউ আর প্রকাশ করে না। তখন আমি খুব অস্থির হয়ে গেছি জানার জন্য- ‘তোমরা বলো না কেন? কী হয়েছে?’ কেউ বলতে চায় না। আমি মামার বাড়ির দালানে ছিলাম। কাউকে না বলে লুকিয়ে আমি ছাদের উপর গিয়েছি। যেয়ে দেখি ছাদ থেকে—নৌকা দিয়ে মিলিটারিরা আমার বিছানা, আমার বালিশ, আমার তোষক, আমার কোল বালিশ, আমার বেড কাভার— আমি এগুলো দেখে চিনে ফেলেছি। ওরা নৌকায় আরাম করে শুয়ে। আমি তখন চিৎকার করছি। আমার বান্ধবীরা— খালাতো, মামাতো বোনরা ছিল। ওরা দৌড়ে গিয়েছে আমাকে থামানোর জন্য। তখন তো জেনেই ফেলেছি যে আমার শ্বশুড় বাড়িতে আগুন দিয়েছে।...” ... ...
লিলিয়ানার মুখে জার্মানে ‘আমি চঞ্চল হে’ শুনে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। একটি ইয়ুগোস্লাভিয়ান মেয়ে তার আপন ভাষায় ‘আমি চঞ্চল হে’ পড়ে সেটি সে এক বাঙালিকে শোনালো জার্মান তর্জমায়! দেশ ছাড়ার আগেই শুনে এসেছি - পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে ‘আওয়ারা’ ছবির কল্যাণে রাজ কাপুর একটি সুপরিচিত নাম। পারিবারিক সূত্রেও তার সত্যতা উপলদ্ধি করেছি – শুধু রাশিয়া, ইউক্রেনে নয় - রোমানিয়াতেও রাজ কাপুরের নাম কিছু লোক এখনও মনে রেখেছেন। কিন্তু লিলিয়ানার ভারত রাজ কাপুরের নয়, রবীন্দ্রনাথের। বলকানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়লে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির আরও সন্ধান পেয়েছি – এমনকি ভয়ভোদিনার (সার্বিয়া) রাজধানী নোভি সাদ শহরে দেখেছি জাতীয় থিয়েটারের সামনের ফুটপাথে (হলিউডের স্টার ওয়াকের মতন) মার্বেলে খোদিত আছে ‘১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সেখানে পদার্পণ করেছিলেন’। ... ...
স্বাধীনতার পর আমি রোকেয়া হলে ফিরে আসি। এক রুমে আমরা তিনজন থাকতাম। রুমে এসে দেখি আমাদের ডেস্ক উলটাপালটা, বইপত্র ছড়ানো ছিটানো, আমার বিছানা বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত বিছানা, বড় বড় রক্তের ছোপ, ততদিনে কালো হয়ে গেছে। এখানে কোনো মেয়েকে ধরে এনে ধর্ষণ করে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সারা ঘরে রক্তের পচা গন্ধ। এখনো মনে হয়—কোন মেয়ে ছিল সে? পাকিস্তান আর্মির যে মেজর ছিল, সে নাকি মন্ত্রী হয়েছিল পাকিস্তানের। তাদের কোনো বিচার হয়নি এখন পর্যন্ত। ... ...
এবারের অধিবেশন দুব্রভনিক। ক্রোয়েশিয়ায় আমার যাতায়াত আছে, জাগ্রেবের সঙ্গে মোলাকাত হলো কয়েকবার। তবে দুব্রভনিক একবারে আলাদা। এক অসামান্য শহর যাকে ভূমধ্যসাগরের মুক্তো বলা হয়—পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। লাল টালির ছাত! প্রথমবার ছবি দেখেই মনে হয়েছিল সমুদ্রের ভেতরে গিয়ে শহর ও কেল্লা বানানোর কি প্রয়োজন ছিল? ডাঙ্গায় জমিজমা কি অপ্রতুল? অনেক ঝড় ঝাপটা বিশেষ করে সাড়ে চারশো বছর আগের বিধ্বংসী ভূমিকম্প, ১৯৯২-১৯৯৫ সালের গৃহযুদ্ধ – এই সব সামলেও দুব্রভনিক একবারে পিকচার পোস্টকার্ডের শহর। কাশীকে হার মানানো সরু সরু গলি। সেখানে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। চলমান জনতার স্রোত। সকল ইউরোপীয় ভাষা শোনা যায়! স্ত্রাদুন নামক ৩০০ মিটারের সদর পথে হাঁটলে মনে হয় একটা রূপকথার ভেতরে ঢুকে পড়েছি স্বপ্নে। ঘুম ভাঙলেই হয়তো দেখব লন্ডন টিউবে বসে আছি! ... ...
এই আমলক, কলস, উল্টোনো পদ্মফুল- হিন্দু শিল্পরীতির প্রভাবগুলো কিন্তু মুঘল আমলের অনেক আগে থেকেই ভারতীয় মুসলিম শিল্পে দেখা যায়। সৈয়দ ও লোদী বংশের সমাধিসৌধগুলোতে এদের দেখা পাওয়া যায়। বরং সেইযুগের কিছু হিন্দু প্রভাব, যেমন মকরতোরণ তাজমহলে নেই। মকরতোরণ হল দরজার উপরে দুদিকে মকরের মত দেখতে ভাস্কর্য যা হিন্দু মন্দিরে বহুপ্রচলিত। ভারতীয় গম্বুজের সূচনা ত্রয়োদশ শতকে বলবনের সমাধির মাধ্যমে। প্রথমে অর্ধগোলক আকৃতি থেকে শুরু করে, ইউরোপীয় গম্বুজগুলি একটু সঙ্কুচিত হয়ে মোচার আকৃতি নেয়, কিন্তু ভারতীয় এবং রাশিয়ান গম্বুজগুলি তাদের মধ্যদেশকে কিছুটা স্ফীত করে পেঁয়াজের আকার ধারণ করে । হয়তো এই পেঁয়াজের আকারটা আসলে পদ্মের আকৃতি। মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলানো পাথরের বা পোড়ামাটির তৈরি উল্টানো পদ্ম এর অনুপ্রেরণা হতে পারে। তাজমহলকে শুধু শাহজাহানের সৃষ্টি বললে এর সঙ্গে যুক্ত ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ারদের অবজ্ঞা করা হবে। তাঁদের ব্যাপারেও জানা যাক। সব মিলিয়ে ৩৭ জন ডিজাইনার এবং আর্কিটেক্টের নাম মুঘল সরকারি নথি থেকে পাওয়া যায় যাঁরা তাজমহলের প্রধান স্থপতিদের মধ্যে ছিলেন। ... ...
ব্যাপারটা নিছক ব্যক্তিগত হলে দরকারই ছিল না এত কথার। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে কবিতার নামে কী দেখছি আমরা? স্বকাম-মর্ষকাম কিম্বা ভঙ্গিসর্বস্বতা। একটু অন্যরকম ভাবেন যাঁরা, তাঁদেরও, যোগ থাকলেও আত্মীয়তা নেই জনগণের সাথে। অথচ, সমস্যার কি অন্ত আছে দেশে? কোথায় সেই ক্রোধ ও ফরিয়াদ? কঠিন কঠিন কথায় কীসব নিদান দেন মনীষী কবিরা! আর ক্লীব হলে যা হয়, প্রকৃত প্রেম, নির্মল আনন্দ থেকেও বঞ্চিত আধুনিক কবিকুল। প্রেমের কথা উঠলই যখন – বেশি ফেনিয়ে-গেঁজিয়ে না ভেবে, নরনারীর প্রেমকে যদি স্বাভাবিক চোখে দেখি, গানে-কবিতায় অদ্বিতীয় নজরুল। ... ...
ঈর্ষান্বিত হলেন কিছু মানুষ। নজরুলের উল্কার মত উত্থান তাঁরা মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। কোথাকার কোন ভুঁইফোঁড় ছোকরা, পল্টন থেকে ফিরেই সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে জনপ্রিয় কবি হয়ে গেল? প্রতিষ্ঠিত কবি মোহিতলাল মজুমদার বললেন, নজরুল নাকি তাঁর 'আমি' নামে একটি লেখার ভাব চুরি করেছেন। একবছর আগে ‘মানসী’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় বেরিয়েছিল তাঁর 'আমি' লেখাটি। সে যুক্তি ধোপে টিঁকল না। লোকে হেসেই উড়িয়ে দিল, মোহিতলাল কি 'আমি' কথাটার পেটেন্ট নিয়েছেন? আর কেউ 'আমি' ব্যবহার করে কিছু লিখতে পারবে না? হাস্যকর দাবি সন্দেহ নেই। 'ভবকুমার প্রধান' ছদ্মনামে সজনীকান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি লিখলেন কামস্কাটকীয় ছন্দে।'ব্যাঙ' কবিতাটি ভূমিকাসহ শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হল এবং বেশ জনপ্রিয়ও হল। বিশেষ করে কবি মোহিতলাল মজুমদার ‘ব্যাঙ’ কবিতাটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন এবং জনে জনে শুনিয়ে বেড়াতে লাগলেন। ঈর্ষার কী বিচিত্র রূপ! ষড়রিপুর ষষ্ঠ রিপুটি অনেককেই জ্বালাতন করেছিল, সন্দেহ নেই। ... ...
নূতন সোভিয়েত সরকারের জাতি-উচ্ছেদ নীতি কিন্তু পুরোনো জার শাসিত রুশ সাম্রাজ্যেরই ধারাবাহিকতা। ঊনবিংশ শতকেই পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন উচ্ছেদের সূচনা হয়। সেই যুগে রাশিয়ার সামরিক পরিসংখ্যানবিদরা রীতিমত এই নিয়ে গবেষণা করে স্ট্রাটেজি বানাতেন – কোথা থেকে কাকে সরানো উচিত! যেটা পাওয়া যায়, সেটা হল “অবিশ্বাসযোগ্যতার ভৌগোলিক অভিমুখ”। এই কাজের জন্য মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় – স্লাভিক (রুশ এবং সমজাতীয় ভাষাগোষ্ঠীগুলি) ও অ-স্লাভিক (পশ্চিম ইউরোপীয়, মধ্য এশীয়, ইহুদি, ও ককেশাস পর্বতীয় জাতিগুলি)। তারপর কোন ভৌগোলিক অঞ্চলে কাদের অনুপাত কীরকম – তার ভিত্তিতে অঞ্চলগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য ও অবিশ্বাসযোগ্য বলে চিহ্নিত করা হয়। তারপর হত অবিশ্বাসযোগ্য অঞ্চলগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য বানানোর প্রক্রিয়া – মূলত রুশিকরণের মাধ্যমে। ... ...