ভয়েজ অফ স্টুডেন্টস: নম্বরহীন এক জগৎ (ব্যঙ্গাত্মক গল্প)
কলমে : শংকর হালদার শৈলবালা
গল্পের শ্রেণী : ব্যঙ্গাত্মক বা স্যাটায়ার (Satire), সামাজিক সমস্যাভিত্তিক গল্প (Social Commentary) ও উপদেশমূলক বা নীতিগল্প (Moral Tale)
আমাদের ক্লাস এইটের বন্ধু অরুণ হঠাৎ করে পড়া ছেড়ে দিল। আগে যে ছেলেটা অঙ্কের ভয়ে রাতে ঘুমাত না, ভূগোলের ম্যাপ মুখস্থ করতে করতে ঘেমে উঠত, এখন সে দিব্যি হাসিখুশি। কারণ, সরকার ঘোষণা করেছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আর ‘পাশ-ফেল’ থাকবে না। শিক্ষামন্ত্রী মশাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, “শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর থেকে নম্বর নামক ভয়ঙ্কর রাক্ষসটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এখন থেকে আমাদের ছাত্ররা আনন্দের সঙ্গে শিখবে, আর রেজাল্ট কার্ডে থাকবে শুধু ভালোবাসার প্রতীক!” সাংবাদিকরা হাততালি দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর এই মহান উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেন।
অরুণের বাবা-মা প্রথমে খুব খুশি হলেন। তাদের ছেলে আর ফেল করার দুশ্চিন্তা করবে না। স্কুল থেকে কোনো চাপ নেই, তাই অরুণ সারাদিন ক্রিকেট খেলে, মোবাইলের স্ক্রিনে 'পাবজি'র মতো কিছু গেম খেলে আর ইউটিউবে 'হাউ টু ইগনোর স্টাডিজ' ভিডিও দেখে সময় কাটায়। তার মনে কোনো ভয় নেই। সে তার বন্ধু শুভকে বলছিল, "কষ্ট করে পড়ার কী দরকার?
এমনিতেই তো পরের ক্লাসে উঠে যাব! দেখবি, এখন থেকে আমাদের স্কুলগুলো হলো এক একটা ট্র্যাভেলার্স হাব, যেখানে কোনো টিকিট ছাড়াই এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যাওয়া যায়।"
শুভ ছিল তার উল্টো। সে মন দিয়ে পড়াশোনা করত। সে দেখছিল, ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময় অনেকেই মনোযোগ দিচ্ছে না। শিক্ষকরাও যেন আগের মতো কঠিন প্রশ্ন করেন না। কারণ, তারা জানেন, সব ছাত্রছাত্রীই পাশ করবে, তাই তাদের ওপর ফল ভালো করার চাপ কমে গেছে। কোনো শিক্ষক যদি ভুল করে কঠিন প্রশ্ন করে ফেলতেন, তাহলে হেড স্যার এসে বলতেন, “কী করছেন মশাই? নম্বর দিতে এসেছেন না ভবিষ্যতের নাগরিক গড়তে এসেছেন?” এতে করে, ক্লাসে একটা ঢিলেঢালা পরিবেশ তৈরি হলো। অনেক ছাত্রছাত্রীই পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তারা ক্লাসে বসে স্মার্টফোনে চ্যাট করত, শিক্ষক কোনো প্রশ্ন করলে গুগলে উত্তর খুঁজত, আর শিক্ষকরা হাসিমুখে তাদের এই ডিজিটাল প্রজ্ঞা দেখতেন।
এরকম করতে করতে বছর শেষ হলো। সবাই নবম শ্রেণিতে উঠল। নবম শ্রেণির প্রথম দিনেই তাদের সামনে এলো নতুন চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক কঠিন একটি বিজ্ঞান পরীক্ষার ঘোষণা দিলেন। আর বললেন, এখানে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি আরও জানালেন, “তোমাদের এতদিন ফ্রি ডেটা দেওয়া হচ্ছিল। এখন থেকে তোমাদের নিজেদের ডেটা জেনারেট করতে হবে!”
শুভ খুব ভালো ফল করল, কিন্তু অরুণসহ আরও অনেকেই কিছুই লিখতে পারল না। কারণ, ক্লাস এইটে তারা যা পড়া ছেড়ে এসেছিল, নবম শ্রেণির সিলেবাস তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
অরুণ খুব ভয় পেল। সে দেখল, ক্লাস এইটে সে যে বিষয়গুলো সহজ ভেবে এড়িয়ে গিয়েছিল, এখন নবম শ্রেণিতে সেগুলোই তার কাছে পাহাড়ের মতো লাগছে। অঙ্কে তার ভিত এতটাই দুর্বল যে, সে বীজগণিতের সাধারণ সূত্রও বুঝতে পারছে না। সে বলল, “আট বছর ধরে পাশ-ফেল না থাকায়, আমরা কেবল ক্লাস পার করে এসেছি, কিন্তু জ্ঞান অর্জন করিনি। একটা পরীক্ষা বা ফেল করার ভয় ছিল বলেই আমরা কিছুটা হলেও পড়তাম। এখন মনে হচ্ছে, আমরা যেন একটা ফাঁপা বাঁশের মতো। বাইরে থেকে দেখতে বেশ ভালো, কিন্তু ভেতরে সব ফাঁকা।”
শুভর বাবা একজন শিক্ষক। তিনি তাদের দু'জনের কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, "তোমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটা কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। পাশ-ফেল প্রথা উঠিয়ে দেওয়ায় সুবিধা হয়েছে যে, ছাত্রছাত্রীরা আর ফেল করার মানসিক চাপ অনুভব করছে না। এতে তারা আনন্দ নিয়ে শিখতে পারছে, এবং যারা দুর্বল, তারা শিক্ষকের কাছে আরও বেশি সাহায্য চাইতে সাহস পাচ্ছে। কিন্তু এর অসুবিধাও আছে। যখন কোনো লক্ষ্য বা চ্যালেঞ্জ থাকে না, তখন অনেক শিক্ষার্থীই পরিশ্রম করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শিক্ষার মান কমে যায়, কারণ ভালো ছাত্র আর খারাপ ছাত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। ফলস্বরূপ, তোমরা যখন দশম শ্রেণিতে উঠবে, তখন দেখবে তোমাদের মধ্যে জ্ঞানের এক বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে।"
অরুণ এবার বুঝতে পারল, পাশ-ফেল না থাকলেও নিজের ভেতরের দুর্বলতাগুলো তার জীবনে একদিন সমস্যার সৃষ্টি করবে। সে সিদ্ধান্ত নিল, এখন থেকে সে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করবে, যাতে সে তার ফাঁকা জ্ঞানের গোডাউনকে ভরিয়ে তুলতে পারে।
শিক্ষার মান, সুবিধা-অসুবিধা, সবশেষে সবটাই নির্ভর করে শিক্ষার্থীর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি ও সচেতনতার ওপর। পাশ-ফেল থাকুক বা না থাকুক, নিজেকে জানতে হবে, কেন জ্ঞান অর্জন করা জরুরি।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।