গরম পড়ল এবছর - দুম করেই । সোশ্যাল মিডিয়ায় বছরকার চর্বিতচর্বন শুরু - ব্যক্তিগত স্তরে বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করুন, চান কম করুন, এসির ব্যবহার কমান, গাড়ির ব্যবহার কমান ইত্যাদি । এগুলোর কোনোটা নিয়েই আলাদা করে আমার আপত্তি নেই। আমার এই ধরণের বক্তব্য নিয়ে আপত্তির জায়গাটা অন্য। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে বক্তব্যগুলো তৈরি হচ্ছে মূলতঃ বড় কর্পোরেট সংস্থার পক্ষ থেকে । সেখান থেকে হয়তো চুঁইয়ে আসছে এনজিওতে, আবাসনে, স্কুলপাঠ্যে। "কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি" নামের এক বকচ্ছপ জিনিসে ধোঁয়া দেওয়া হচ্ছে ।
"ব্যক্তি" হিসেবে আপনার দায় , সাথে কিছুটা অপরাধবোধ সুক্ষ্মভাবে চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু "ব্যক্তি" আপনি ঠিক কতটা কী করতে পারবেন? সোজা উত্তর কিস্যু না ।
বহুজাতিক ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম ২০০০ সাল নাগাদ অধুনা বহুশ্রুত "কার্বন ফুটপ্রিন্ট" ব্যাপারটা জনপ্রিয় করে (আরও নির্দিষ্ট করে বললে আম্রিকার এক অ্যাড এজেন্সি বিপির তরফে বরাত পেয়েছিল) । এটি একটি মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এর অংশ ছিল। সেখানে আপনি নিজের ফুটপ্রিন্ট নিজে মাপুন - এই ছুতোয় সূক্ষ্ম ভাবে কর্পোরেট এর দায় ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
আরও একটা মজার উদাহরণ দিই। এয়ারলাইন সংস্থাগুলি (আরও অনেক সংস্থা করে, স্রেফ একটা উদাহরণ এটি) কার্বন অফসেট বলে একটি বস্তু নিয়ে প্রচুর প্রচার করে । জিনিসটার মূল ব্যাপার কী? কার্বন ক্রেডিট । একই সংস্থার হয়তো চারটে গাছ লাগলো (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি হিসেবে ট্যাক্স কাট ক্লেম করাও যাবে) , বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করলো। ব্যাস এসে গ্যালো কার্বন ক্রেডিট। ব্যবসাকে ব্যবসা , দূষণও ধামাচাপা পড়লো, দিব্যি পিআর ও হলো । বন্ড বাজারের মতো এই ক্রেডিটের ও বাজার আছে । সে মাল কেনাবেচা হয়। তার এথিক্স নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় । কিন্তু মূল যেটা প্রশ্ন - বিমানের কার্বন নিঃসরণ কমবে কীভাবে? এ নিয়ে কেউ কুটোটাও নাড়ল না কিন্তু।
রাক্ষুসে ডেটা সেন্টার চালাতে কেমন শক্তি খরচ হয় এই নিয়ে লিবারেল চিন্তাভাবনার হদ্দমুদ্দ করা টেক কোম্পানিগুলো কোনো প্রচার চালায়? ডেটাসেন্টার ব্যাপারটাই তো আন সাস্টেনেবেল বস্তু, সে জিনিসের আপনি ঘেমো শরীরে চান না করে কিছু করতে পারবেন?
বিখ্যাত ইলন কুমার মাস্কের পরিবেশ বান্ধব গাড়ি টেসলার ব্যাটারির লিথিয়াম কীভাবে আসে আর লিখলাম না। জানা না থাকলে নেটে এখনও কিছু তথ্য পেয়ে যাবেন । স্টারলিংক পুরো গিলে নিলে আর পাবেন কিনা আমি জানি না ।
পৃথিবীর মোট কার্বন নিঃসরণের খুব বড় অংশ (হ্যাঁ সেই বিখ্যাত ৮০/২০ রুল) হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির দায়। আবার ব্যক্তিগত স্তরেও মজার ডেটা আছে । অক্সফাম এর ২০২০ র তথ্য বলছে পৃথিবীর ওপরের ১ শতাংশ বড়লোক নিচের ৫০ শতাংশের তুলনায় বেশি কার্বন নিঃসরণ করে।
তাহলে এই ন্যারেটিভ এভাবে চলছে কেনো?
মানুষ কী খায় সে বোঝা ভারি শক্ত । তবে কর্পোরেটকে দায়বদ্ধ করা যে কোনো দেশের সরকারের পক্ষেই কঠিন কাজ। কর্পোরেট এ চালু কথা - সাধারণ মানুষ হলো সেই নিচের ডালে ঝোলা ফল..
তাহলে সাধারণ মানুষের করণীয় কিছুই নেই? আছে হয় তো, কিন্তু সেটা কল বন্ধ করা বা এসি না চালানো নয়। এই যে কর্পোরেট নিজের ঘাড় থেকে দায় ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে দিনের পর দিন, এ নিয়ে পড়াশোনা করুন, আলোচনা করুন । চিৎকার করুন -
ও মন্ত্রী মশাই
ষড়যন্ত্রী মাশাই থেমে থাক্।
যত চালাকি তোমার
জানতে নাইকো বাকি আর
যত কেরদানি শয়তানি সবই ফাঁক
চীচিং ফাঁক থেমে থাক্!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।