অরণ্যর কথার পিঠে বৃষ্টি বলে তার অনুভুতি প্রেম নিয়ে - “প্রেম হচ্ছে আবেগ আর তার অভিব্যক্তি ভাষার মাধ্যমে। ভাষার মধ্যে দিয়েই ভাবের প্রকাশ হয়। এর বড় দৃষ্টান্ত আমাদের বৈষ্ণব পদাবলী। মনে কর বিদ্যাপতির সেই পদাবলী –
জনম অবধি ভাবি নিরবধি
না জানিয়ে রাতিদিন।।
পিরিতি পিরিতি সব জনা কহে
পিরিতি কেমন রীত।।
বৃষ্টি বলে চলে, “কি চমৎকার ভাবের প্রকাশ ভাষার মধ্যে দিয়ে এই সব পদাবলীতে। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দ্বাপর যুগের দৃশ্য, রাধা প্রেমে পাগলিনী হয়ে ছুটে যাচ্ছেন কৃষ্ণের কাছে। আবার কখনো কৃষ্ণের বিরহে কাতর রাধা, যার কথা মনে পড়িয়ে দেয় এই পদটি –
কানুর পিরিতি চন্দনের রীতি
ঘষিতে সৌরভময়
ঘষিয়া আনিয়া হিয়ায় লইতে
দহন দ্বিগুন হয়।।
অরণ্য বলে, “আমার মতে প্রেম চিরন্তন। প্রেমের ভাষা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ভাব রয়ে গেছে একইরকম। প্রেম আবেগের প্রকাশ। এই যে সাহেবরা কথায় কথায় প্রেমিকাকে বলে “আই লাভ ইউ”, তাতে ভাবের আবেগটা প্রকাশ পায়। এদেশে আমরা হয়ত এরকম বলি না সবসময়, তাতেও আবেগ প্রকাশের ঘাটতি হয় না কোনও। তাই দেশ-কাল ভেদে প্রেমের ভাষা ভিন্ন। যেমন ধরো স্প্যানিশরা বলে প্রেমের আবেগে “তে ক্যুয়েরও”। এটা একটা বিশেষ ভাবে রোম্যান্টিক আবেগের প্রকাশ। এটা এদেশে কেউ বললে কোনও বিশেষ অনুভূতি হয়ত হবে না। কিন্তু স্প্যানিশদের কাছে এটা একটা ম্যাজিকের মত কাজ করবে। আবার লন্ডনের কোনও সাহেবের কাছে এটার আক্ষরিক অর্থ “আই ওয়ান্ট ইউ“, যেটা সর্বদা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু স্প্যানিশে এই কথাটার মধ্যে ভালবাসা ও যত্নের সংমিশ্রণ আছে। আবার বেশি রোম্যান্টিক হলে ওরা বলবে “তে অ্যামও”।
অরণ্য বলতে থাকে, “তাই আবেগের প্রকাশ সামাজিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সামাজিক পরিস্থিতি বলে দেয় আবেগের প্রকাশ কেমন হবে বাস্তবে”।
এরকম আলোচনায় মশগুল হয়ে ওঠে দুজনে নানা বিষয়ে। সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় টের পায় না তারা। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে যায় খুব তাড়াতাড়ি। প্রচুর ফিসফ্রাই, চিকেন পকোড়া, কফির সদব্যবহার করে ইউনিভার্সিটি শেষ করল দুজনে। এম এ পাশ করে দুজনে কলেজে চাকরি নিল। অরণ্য পেল কলকাতার একটা কলেজে আর বৃষ্টি পেল হাওড়ার একটা কলেজে। যথাসময়ে তাদের বিয়ে হল। বিয়েটা একটু অন্যরকম করে হল। বিয়ের দিন বৃষ্টি গলায়, মাথায় পরল চাঁপা ফুলের মালা আর একটা জামদানি শাড়ি। অরণ্য প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে এল বিয়ে করতে। মাথায় নেই কোনও টোপর, গলায় নেই কোনও মালা, কপালে নেই চন্দনের ফোঁটা। চিরদিনের বাউণ্ডুলে অরণ্য বিয়ে করল বৃষ্টিকে কোনও মন্ত্রপাঠ ছাড়াই। সরোদে বাজল দরবারি কানাড়া। কাগজে কলমে সইসাবুদ হল আর হল কাছের আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া।
বিয়ের পরে দুজনে একটা বাড়ি ভাড়া নিল। দিন কাটে আনন্দে দুজনের। দুজনের আগ্রহের বিষয় আলাদা হলেও কোথাও একটা দুজনের গভীর মিল। ছুটির দিনে কথা বলে বলেই দুজনের সময় কেটে যায়। বয়স বাড়ে দুজনের, কিন্তু সংসারে জনসংখ্যা বাড়ে না। ওরা চায়নি আর কেউ আসুক ওদের দুজনের মধ্যে। একটা স্বপ্নের জগতে যেন বাস করে দুজনে।
“কে আগে পৃথিবী ছেড়ে যাবে বলো তো?“ বৃষ্টি বলে।
“আমিই আগে যাব। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না”, অরণ্য বলে।
“না, আমি আগে যাব”।
“না, দুজনেই এক সঙ্গে যাব। তাহলে আর কাউকে একা থাকতে হবে না”।
“একজন চলে গেলে, আরেকজন টুপ করে নদীতে ডুবে যাব”।
এরকম কত কথা হয় দুজনের মাঝে মাঝে। কৌটোর ঢাকা যেমন আঁট করে লেগে যায়, ওদের সম্পর্কটাও তেমনি বন্ধ কৌটোর মত, ঠিক খাপে খাপে লেগে গেছে। একচুলও ফাঁক নেই যেন ওদের সম্পর্কে।
এখন ওদের বয়স ৫৫। চুলে পাক ধরেছে দুজনেরই। হঠাৎ সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নামতে গিয়ে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয় বৃষ্টির আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। অরণ্য তখন কলেজে। খবরটা পেয়ে নির্বাক হয়ে পড়ে অরণ্য। মেনে নিতে পারে না কিছুতেই বৃষ্টির মৃত্যুকে। স্বপ্নের খেলাঘর কেউ যেন ওলট পালট করে দিল।
তারপর থেকে অরণ্যর কলেজে যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়ল। গভীর অবসাদে ডুবে যেতে থাকল সে। জীবনের মানেটা যেন হারিয়ে গেছে হঠাৎ। আবার সে এলোমেলো। সারাক্ষণ পড়ে ইন্ডিয়ান ফিলসফির বই। কখনও পড়ে শঙ্করভাষ্য, কখনও বা বেদান্ত কিংবা গীতা। ঠিকমতো খায় না, ঘুমোয় না। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায় বন্ধুরা। কিছু ওষুধ দেন ডাক্তার। একটু একটু করে সেরে ওঠে অরণ্য। তবু গভীর বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে তাকে। ইন্ডিয়ান ফিলসফি পড়তে পড়তে অরণ্য ডুবে যায় মনের গভীরে।
নিজেকে প্রশ্ন করে অরণ্য নানাভাবে। জীবনের মানে কী? উদ্ধেশ্যই বা কী? সুখে থাকা নয়, আনন্দে থাকা। উত্তর মেলে শাস্ত্রে। এই আনন্দের উৎস কোথায়? আনন্দের উৎস লুকিয়ে আছে নিজের মধ্যেই। মনের গভীরে ডুব দিয়ে আনন্দস্বরূপকে জানতে হবে ।
এই আনন্দস্বরূপ কে? তিনি কি ঈশ্বর? তিনি কি সর্বনিয়ন্তা? আমাকে কেন এই দুঃখের সাগরে ঠেলে ফেলে দিলে, হে ঈশ্বর? তোমার কী উদ্দেশ্য? সবই নশ্বর এই পৃথিবীতে। শুধু চিরন্তন সত্য সেই আনন্দস্বরূপ, যিনি সর্বব্যাপী। তাঁকে খোঁজো মনের গভীরে। মনের মধ্যে উত্তর আসে।
অরণ্য ছুটে ছুটে যায় নানা সাধুসন্ন্যাসীর কাছে। খোঁজার চেষ্টা করে তার দুঃখের সান্ত্বনা। সবাই একই কথা বলেন, “মনের গভীরে গিয়ে সেই পরমপুরুষকে খোঁজো”।
অরণ্য অভ্যাস করতে থাকে যোগসাধনা। মনকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। এভাবে কাটে আরও এক বছর। ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন তীর্থে – কাশী, পুরী, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, হরিদ্বার, কনখল। মনের নিঃসঙ্গতা তবু কাটে না। বাইরের লোকজন ভাল লাগে না। সারাক্ষণ মনে পড়ে বৃষ্টি নেই কাছে। মনে মনে বলে অরণ্য, “বৃষ্টি, তুমিই আমার ঈশ্বর। তুমি ছাড়া আমার অস্তিত্বের কোন অর্থ নেই। আমাকে নিয়ে চলো তোমার কাছে। আমি যে আর এই একাকিত্বের বোঝা বইতে পারছি না। দেখো, ঠিক চলে যাব তোমার কাছে একদিন”।
কেউ যেন ভেতর থেকে বলে, “আমি আছি পাশেই তোমার। একবার ভেতর দিকে চোখ মেলে দেখো। দেখতে পাবে আমাকে”। অরণ্য খুঁজে পায় না বৃষ্টিকে। অরণ্য মনে মনে বলে, “বৃষ্টি, আমি তোমার আপেক্ষায় বসে আছি, কারণ আমি যে তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। যে প্রেমে পড়ে, সেই তো অপেক্ষায় থাকে!”
অরণ্য মাঝে মাঝে আবৃত্তি করে –
সেহ মধু বোল শবনহি শুনল
শ্রুতিপথ পরশ না ভেল।
কত মধু যামিনী রভসে গমাওন
ন বুঝল কৈসন গেল।।
অরণ্য স্বপ্ন দেখে বৃষ্টিকে প্রায়। অনেক কথা হয় তাদের স্বপ্নে। অরণ্য অস্থির হয়ে ওঠে দিনে দিনে। সেদিন বৃষ্টির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। হঠাৎ দুপুরে একটা ফোন আসে পুলিশের থেকে অরণ্যর কলেজে। কলেজের বন্ধু অমিত থানায় গিয়ে শোনে অরণ্য সুইসাইড করেছে দুঘণ্টা আগে, হাওড়া ব্রিজ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো যায়নি। অরণ্য ফিরে গেছে বৃষ্টির কাছে। অমিত স্বগতোক্তি করে –
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে...।।
ভাবে, অরণ্য আর বৃষ্টি নন্দনকাননে হাত ধরাধরি করে হয়ত ঘুরছে এখন গভীর প্রেমে।