এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভ্যালেন্টাইন্স ডে গল্প কথা - আজকের পর্ব ২ - চকলেট ডে আর নলেন গুড়ের পায়েস -- কলমে সহেলি বন্দ্যোপাধ্যায়

    Saheli Bandyopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২৭৭ বার পঠিত

  •  
    কাঁপা কাঁপা হাতে দুটো গ্রীনটি ব্যাগ দুটো কাপে রেখে তার ভিতরে দু প্যাকেট সুগার ফ্রি ছিঁড়ে দিলো মিসেস রিনিতা হালদার। সামনের ইলেকট্রিক কেটলিতে জল ফুটছে টগবগ করে। বয়স প্রায় পয়ষট্টি পেরোলো, এই বয়সে সারাক্ষন ক্লান্ত লাগে শরীর, গায়ে হাত পা যন্ত্রনা করে, তবু সারাক্ষণ কাজ না করে উপায় কি? আমেরিকার একটি নাম না জানা শহরে এখন বাস করেন রিনিতা। আমেরিকায় এরকম কত শহর আছে বাইরে থেকে তার নাম জানা যায় না। এই শহরগুলিতে প্রধানতঃ সাদা লোকেদের বাস, এরা চাষবাস করে, বন্দুক ছোঁড়ে, অন্য লোকেদের বিশেষ পছন্দ করে না। কিন্তু মিস্টার হালদারের ব্যাপার আলাদা। ইনি এদেরকে চিকিৎসা করেন, কম বেশি বহু লোকই ওনার দ্বারস্থ হয় শরীর খারাপ হলে। রিটাযার করার পর ইনি নিজেই এখানে একটা ডাক্তারখানা খুলে বসেছেন। কিচেনের জানালা দিয়ে এখানে দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখা যায়। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর মিস্টার হালদার বলেছিলেন, "ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে, বিয়ে থা করে করে নিজের সংসারে নিজের কাজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, তোমার দায়িত্ব শেষ, চলো এবারে কোথাও একটা দূরে গিয়ে থাকি। " মিস্টার হালদার এর বরাবরই প্রকৃতি খুব ভালো লাগে। তাই তিনি আগের বাড়িটা বিক্রি করে এই একটা পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় ছোট্ট বাড়ি করে ফেললেন। রিনিতার কিন্তু প্রথমে প্রথমে খুব আপত্তি ছিল, এই একটা ছোট জায়গায় সে কিছুতেই আসতে চাই নি প্রথমে। আসলে সে চিরকালই খুব সংসারী মানুষ। ছেলে মেয়ে ছেড়ে সে তো আগে কিছুতেই থাকতে পারতো না। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে তো সবই ছেড়ে দিতে হয়, এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। এই নিয়ম ভেঙে ফেলার সাধ্য কারোর নেই, আস্তে আস্তে সব বন্ধন আলগা করতে হয়, সমস্ত সাংসারিক জগতের সাথে একটু একটু করে বন্ধন মুক্ত হতে পারলে সেই মহাসংসারের পথে যা চরম সত্য সেই পথে আস্তে আস্তে হাঁটা যায়।

    এতো সকালে দরজায় কে যেন বেল মারলো। এখনো বেশ ঠান্ডা পড়ে সকালের দিকে। বাড়িতে সারাক্ষন হিট চলছে এখনো, তারপর আকাশ কালো করে মেঘ করেছে, ঠান্ডা যেন আর যাচ্ছেই না। এই বুড়ো বয়সে এই ঠান্ডা আর ভালো লাগে না। সকালের দিকে এখনো হালকা হালকা বরফ পড়ে, গাড়ির কাঁচের জানালা গুলো সাদা হয়ে থাকে। ঘাস গুলো সেই কবেই মরে হলুদ হয়ে গেছে, সে গুলোও এখন সকল বেলায় জমে আইস হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে পরের বাড়িটা বেশ খানিকটা দূরে আর রাস্তার ওপারে কোণের দিকে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসব দিকে স্কুল এর স্ট্যান্ডার্ড খুব একটা ভালো নয়, আমরা যে অর্থে আমেরিকার স্কুল কলেজ ভাবি সে রকম নয়। স্কুল ভালো করে চালানোর জন্য যে সব পয়সা কড়ি দরকার তা সত্যিই এখানে নেই। মিস্টার হালদার এই স্কুলটিকে মাঝে মাঝেই সাহায্য করে থাকেন। রিনিতা ভাবে, উনি হয়তো ঠিকই করেন, এখানেও কত গরিব অনাথ ছেলেমেয়ে আছে। মিস্টার হালদার সারা জীবনে তো ডাক্তারি করে কম পয়সা রোজগার করেন নি, কিন্তু আমেরিকায় এসে দাঁড়াতে প্রথম জীবনে তাঁকে কম ঝক্কি পোয়াতে হয় নি, তিনি মাঝে মাঝেই ডলার পাঠিয়ে দেন দেশেও নানা সংস্থাকে। নিজের ছেলে মেয়ে দূরে থাকে, প্রতিষ্ঠিত, তাদের টাকা দরকার নেই। কিন্তু, তবুও, রিনিতার মাঝে মাঝেই বুকের ভিতরটা হুহু করতে থাকে। নিজের লোক, নিজের জন বলে তার কাছে এখন আর কেউ নেই। দেশে ও এখন নিজের লোক বলে কেউ থাকে না। নাতি নাতনি গুলোও তো কেউ বাংলা ভাষায় কথা বলে না। নিজের ছেলেমেয়েকে বাংলা শিখিয়েছিলেন রিনিতা, ছোটজন লিখতে পড়তে সবই পারতো। তারপর নিজের নিজের কাজের জায়গাতে সব ভিড়ে গেলো। সংসার কি বিচিত্র। নাতি নাতনি গুলো অবশ্য তার সাথে কথা বলবে বলে মুখিয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে চলতে থাকে কথা বার্তা, ক্যামেরা তে দেখাশোনা হয় অবশ্য। ছেলে মেয়ে অবশ্য বহুবার বলেছিলো তোমরা আমাদের কাছে এসে থেকো। মিস্টার হালদারের পরিষ্কার জবাব ছিল, " হাঁ বাবা মাঝে মাঝে বেড়াতে যাবো নিশ্চয়ই। "

    আবার বেল টা জোরে বেজে উঠলো, কি জ্বালা, এত সকালে কে ব।র বার বেল বাজাচ্ছে রে বাবা? অনেক সময়ে চার্চ থেকেও লোক আসে, বাইবেল খুলে বোঝায় খ্রিষ্টধর্ম কত মহান, তারা কেনো চার্চ যায় না? রিনিতা হাসি মুখে জবাব দেয়, “we respect Christianity, but we are hindu.” রিনিতার এ বাড়িতে সুন্দর একটা ঠাকুর ঘর আছে। “coming, coming who is there? “ দরজা খুলতে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে লাগলো। স্কুল থেকে এসেছে এক গুচ্ছ বাচ্চা ছেলে মেয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে যেটা ছোট তার হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ আর একটা চকোলেট এর প্যাকেট। মেয়েটার মাথায় সোনালি চুল দুপাশে বিনুনি করে বাঁধা, চোখটা পুরো নীল, কতই বা বয়স হবে বোধহয় ছয় কি সাত। হাত উঁচু করে তুলে সে হাসি হাসি মুখে বললো “ Mrs. Halder, Happy choco।ate day and Valentines day in advance. “ এবার ভ্যালেন্টাইন ডে সপ্তাহ শেষে পড়েছে, তাই এরা এখন এসেছে। পিছনের বড় মেয়েটি র হাতেও একটা প্লাস্টিকের টিফিন বক্স। এখন এগিয়ে দিয়ে বললো, “ Mrs. Halder, please taste it, it is rice pudding. My grandma made this“ এখানে তো আবার কাকিমা, দিদিমা এসবের প্রথা নেই, সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকারই চল। কিন্তু এই সকাল বেলাতে এক গুচ্ছ ছেলে মেয়ের সতেজ হাসি রিনিতার মন ভালো করে দিলো।

    এখন টেবিল এর ওপর একটা ফুলদানীতে শোভা পাচ্ছে গোলাপগুলো। পাশে খানিকটা যেন অবহেলায় চকোলেট গুলো পড়ে আছে। আমেরিকায় চকোলেট খুবই সহজ লভ্য। তাই সেদিকে খুব একটা মন না দিয়ে টিফিন বক্সটা খুললেন রিনিতা। ভিতর থেকে আসছে সুন্দর একটা গন্ধ। Rice pudding মানে আমরা যাকে পায়েস বলি। অনেক দিন আগের একটা কথা মনে পড়ছে রিনিতার। এরকম শীতের দিনে ছোটবেলায় বাবা নিয়ে আসতো খেজুর গুড় আর মা বানাত পায়েস। এখনো মনে আছে সে পায়েস কখনো একটা টিফিন বক্স এ ভরে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিলি করতে যেতো সে। বাবার সে কি প্রিয় ছিল পায়েস। তখন তো চকোলেট ডে, ভ্যালেন্টাইন ডে ছিল না, ছিল নলেন গুড়, পায়েস আর ভালোবাসার অনেক মানুষ জন। দিনগুলো অনেক দূরে চলে গেছে, ফিরে আসবে না কখনো, শুধু মনের কোণে খোঁচা দিয়ে মাঝে মাঝেই পুরোনো স্মৃতিগুলোকে উসকে দেবে, ভিতর থেকে হু হু করে জানান দেবে আছে, আছে, অতীত …. কিন্তু বর্তমানের সাথে কিছুটা হলেও মিল খুঁজে বলবে, আমি দিব্যি আছি, চিরকাল ছিলাম তোমার অতলে, গভীরে, তুমি শুধু আমাকে আর নিজেকেও ভুলেছিলে। রিনিতা দুটো ছোট ছোট বাটিতে পায়েস সাজাতে বললো, একটু অন্যরকম খেতে, তবু পায়েসটা দেখতে লাল, বোধহয় ব্রাউন সুগার মিশিয়েছে, আজকে এটা দিয়েই করবে আজকের ব্রেকফাস্ট তারা।

    Copyright: Saheli Bandyopadhyay, 10th February, 2025
    (রিনিতা আমার গল্পে একটি নাম যে বারবার করে নানা গল্পের চরিত্রে ফিরে আসে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন