এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ছোট গল্পঃ ভেবলি

    Sagarmay Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩৩৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ভেবলি
    সাগরময় মণ্ডল



    গুরুচরন কবিরাজের ডিসপেনসারির মাটির দাওয়ায় বসে গদাই বায়েন একমনে বিড়ি টানছিল। ঘরের ভিতরে জনা দুই রুগী, কবিরাজমশায়, সহকারী বিলাস আর কবিরাজকন্যা ভেবলি। তারা রুগী আর রোগ নিয়ে কথাবার্তা বলছে। বিড়ি টানতে টানতে গদাই বায়েন হঠাৎ করে কাসতে শুরু করে। সে এমন কাসি যে থামতেই চায় না। কাসির চোটে তার মুখ-চোখ লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। কাশতে কাশতে গদাই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ব্যাপারটা ঘর থেকে দেখতে পেয়ে ভেবলি তাড়াতাড়ি ডিসপেনসারির জলের জাগটা নিয়ে গদাইএর চোখে মুখে দিতে গেলে পিছন থেকে বিলাস তাকে নিরস্ত্র করে। জলের জাগটা কেড়ে নিয়ে তাকে ধমক দেয়-
    - এই ভেবলি, তুই থাম। তুই ওর কাছে যাবি না। ঘরে যা, আমি দেখছি। যা বলছি।
    ভেবলি যেতে না চাইলে, তাকে প্রায় জোর করে ডিসপেনসারির ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বিলাস জাগের জল গদাইএর মাথা, চোখ, মুখে ছিটিয়ে দিল। গদাইএর হাতে খানিকটা জল ঢেলে দিতে সে সেটা খেয়ে নিল। জল পেয়ে গদাই কিছুটা শান্ত হোল, মনে হোল জীবন ফিরে পেল।
    - আর একটুকুন হলি পেরাণটাই  চলি যেত গো বাবু। বড় বাঁচান বাঁচালে।
    ততক্ষণে কবিরাজমশায়ও বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি গদাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন
    -গদাই তুই আবার এসেছিস? তোকে তো বলেছিলাম বাবা, শহরে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে। তা না গিয়ে আবার এখানে মরতে এলি! বলেছিতো তোর রোগ সারানো আমার মতো কবিরাজের পক্ষে সম্ভব নয়। এখনও বলছি, বাঁচতে চাইলে শহরের হাসপাতালে যা। সেখানে যক্ষ্মা রগের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
    - সি তো জানিগো কোবরেজ মশায়। আমার রাজরোগ হইছে। লোকগুলান বুলছিল, ই রোগ সারে না। তাই যত দিন পারেন আপনিই আমারে বাঁচায়ে রাখেন।
    গদাই কবিরাজের পায়ে ধরতে গিয়েও থেমে যায়। সে বলে-
    - না, থাক, পা ছোঁবু নি। আমার ছুঁয়া লেগি যদি আপনার ক্ষেতি হয়। আমি দূর থেকি মিনতি করছি, আমারে ফিরায়েন না বাবুরা।
    বিলাস কবিরাজ মশায়ের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে গদাইকে আশ্বস্ত করে বলে
    - তুমি চিন্তা করো না গদাইকাকা, আমি নিজে গিয়ে তোমাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসবো। সেখানে বিনিপয়সায় তোমার চিকিৎসা হবে, দুবেলা পেটপুরে খেতে পাবে। তুমি ভালো হয়ে যাবে।
    - বুলছিস বাপ! আমি ভালো হয়ে যাবু!
    - বলছি গো বলছি। কাল তোমাকে আমি নিজে শহরে নিয়ে যাবো। আজ বাড়ি যাও।
    - কষ্ট করে আসলাম, দুটো বড়ি দিবিনা বাপ? খাবো। তোদের বড়ি খেলি আমি ভালো থাকি।
    কবিরাজ মশায় ইশারায় বিলাসকে কিছু বললেন। বিলাস ডিসপেনসারির ভিতরে গিয়ে দুটো ওষুধের পুরিয়া এনে গদাইএর হাতে দেয়। বলে-
    - একটা পুরিয়া দুপুরে ভাত খেয়ে খাবে আর একটা রাতে খাবার পর।
    - আচ্ছা।
    গদাই তার ময়লা, হাঁটু অবধি পড়া ধুতির খুঁট খুলে টাকা বের করতে গেলে বিলাস বলে টাকা লাগবে না কাকা। তুমি যাও।
     - খুঁটে টাকা তো নাইরে বাপ। তা এই নে একটো মুরগির ডিম আছে, এইটো লে।
    গদাই তার হাতের ঝোলা থেকে ডিম বের করতে গেলে বিলাস বলে-
    - না না, ডিম দিতে হবে না। তুমি ওটা বাড়ি গিয়ে খেও। তোমার ভালো মন্দ খাওয়া খুব দরকার।
    - তা বেশ। ভালো থাকিস বাপ। এই বলে গদাই চলে গেল।
    বিলাস ডিসপেনসারির ভিতরে গিয়ে দেখে কবিরাজমশায় ওষুধ বানাচ্ছেন আর ভেবলি বেঞ্চে বসে গুমরে গুমরে কাঁদছে। টুকটুকে ফর্সা মুখখানা অভিমানে ফুলে ফুলে উঠছে আর চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। বিলাসকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে বেঞ্চের একপাশে সরে গেল।
    - এই ভেবলি কাঁদছিস কেন রে? বিলাস জিজ্ঞাসা করে।
    ভেবলি কোন উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে।
    - তাহলে তুই আমাকে বলবি না?
    - না, বলবো না, বলবো না। তুমি আমাকে গদাইকাকাকে জল দিতে দিলে না কেন, হ্যাঁ?
    - এইতো ভেবলি, এই জন্যই লোকে তোকে ভেবলি বলে। তু জানিস না, গদাই কাকার যক্ষ্মারোগ হয়েছে। বড় ছোঁয়াচে রোগ। তুই তো দূর থেকে তার চোখে মুখে জল দিতিস না। তাকে হাতে করে জল খাওয়াতিস, আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতিস। তাই তো?
    - বা রে, তা দেব না। অসুস্থ লোক তার সেবা করবো না! তুমিই তো এখানে আসার সময় কি সব বলে ছিলে। বিএ এম এ পাশ করে দিদিদের-দাদাদের ঝাণ্ডা না পতাকা কি বলে, তাই ধরে, তাদের পিছুপিছু ঘুরতে পারবো নি। ওরা গরীব-গুব্বো লোকের রক্ত চুষে খায়। তার থেকে এখানে বসে অসুস্থ লোকের সেবা করা অনেক পুণ্যির। মানুষের সেবা করলে পুণ্যি হয়। কি বলো নি?
    - সে পুণ্যি করার অনেক সুযোগ পাবি। একটা পুণ্যি হাত ছাড়া হলে ক্ষতি নেই। তবে নিজেকে বাঁচিয়ে পুণ্যি করিস, বুঝলি।
    - দেখলে তো, এইবেলা তুমি আমাকে ঠকালে।  আমাকে পুণ্যি না করতে দিয়ে নিজেই পুণ্যি করে নিলে। বেশ করেছো। আমাকে ভালো মানুষ পেয়ে সব্বাই ঠকায়, তুমিও।
    - আরে বাবা, তা নয়। তুই অন্য রুগির সেবা করিস, ওই গদাইকে বাদ দিয়ে। তুই দেখিস ওই ব্যাটাকে আমি কালকেই শহরের হাসপাতালে রেখে আসবো। নইলে ও আবার এখানে আসবে। আর তর পুণ্যি করতে ইচ্ছে করবে।
    - হু, করবো তো। একশো বার করবো।
    - এই মেয়েটা কবে যে মানুষ হবে, কে জানে।



    ভেবলি ওর আসল নাম নয়, ওর নাম প্রণতি। কবিরাজমশায়ের একমাত্র সন্তান। খুব সরল মনের। সবাই যেটা চটপট বুঝে ফেলে বা করে ফেলে, প্রণতি সেটা পারে না। আর সব কিছুতেই ও প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তাই লোকে ওকে ভেবলি বলে। বয়সের তুলনায় ওর মানসিক বিকাশ একটু হলেও কম। সবেতেই ছেলেমানুষি। বাঁকা কথা ও বোঝে না, বলতেও পারে না। তার বাবা সব জানে, কিন্তু কি করা যাবে। সবার মনের বিকাশ শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এই আঠারো বছর বয়সেও সে বারো-চৌদ্দ বছরের কিশোরীর মতো আচরণ করে। তার শরীরের সঙ্গে বেমানান আধোআধো আদুরে কথা শুনে আগে লোকে ফিরে ফিরে দেখতো। এখন গা সওয়া হোয়ে গেছে। সবাই  জানে ও ভেবলি। ভেবলি হলেও সে সংসারের কাজকর্ম বেশ ভালোই করতে পারে। তবে তার সব থেকে ভালো লাগে বাবার ডিসপেনসারিতে রুগীদের দেখাশোনা করতে, তাদেরকে ওষুধ খাইয়ে দিতে। সে খলে (চীনে মাটির বাটির মতো পাত্র) ফেলে মুগুর দিয়ে পিশে বাবার নির্দেশ মতো বিভিন্ন ওষুধ মিশিয়ে মিক্সচার বানাতেও পারে। আজকাল অবশ্য ওষুধের কাজগুলো বিলাস করে। বিলাস বিএ পাস করে চাকরি বাকরি না পেয়ে এই পেশায় জুটেছে। তবে ছেলে ভালো। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঔষধি সংগ্রহ করা থেকে বড়ি বানানো সব বিলাসের দায়িত্ব। সেখানে ভেবলি বিলাসের হেল্পার।

    বিলাসের সঙ্গে কাজ করার সময় বিলাস ভেবলিকে অনেক উল্টো পাল্টা কথা বলে। ইচ্ছে করে তাকে উতক্ত করে। ভেবলি রেগে গেলে বড়বড় চোখ করে বিলাসের দিকে তাকায়। বিলাস সেটা উপভোগ করে। বিলাস হাসতে থাকলে সে বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বাবাও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে শান্ত করে।
    - বিলাসের কথায় রাগ করিস কেন, ও তো তোকে ক্ষ্যাপায়।
    - ক্ষ্যাপাবে  কেন? তুমি তো ক্ষেপাও না। তুমিই তো একমাত্র আমাকে প্রণতি বলে ডাকো, আর তো কেউ ডাকেও না। তাহলে ও ক্ষ্যাপাবে কেন?
    - আচ্ছা, আমি বিলাসকে বকে দেব। আর কেঁদো না।
    ভেবলি চুপ করে।
    গুরুচরন এ কথা একদিন বিলাসকে বলেও ছিল। উত্তরে বিলাস বলেছিল
    - কাকাবাবু, বয়সের তুলনায় প্রনতির ম্যাচুরিটি একটু কম। ওকে নানা লোকে নানা কথা বলে, পেঁচিয়ে খারাপ কথা বললেও ও হাসে। বোঝে না। আমার খুব খারাপ লাগে। তাই আমি মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলে ফেলি যেটা ওর ইগোতে গিয়ে আঘাত করবে। ও বুঝতে শিখবে। আমি যদি ভুল করে থাকি আমায় মাফ করবেন। আর কখনও বলবো না।
    - না না, আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না বিলাস। বুঝতেই তো পারছো, আমার একমাত্র সন্তান। ও ‘এজ রিগ্রেসনে’র শিকার। তুমি হয়তো জানো এদের ব্রেনের সামনের অংশ মানে ‘ফ্রন্টাল লোব’ এর সঠিক বিকাশ ঘটে নি, বিশেষ করে ‘প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স’ এর। অনেক সময় বয়স পঁচিশ বছরে পৌঁছলে এটা ঠিক হয়ে যায়। প্রনতির ক্ষেত্রে কি হবে তা জানি না। ঈশ্বর যেমন চাইবেন, তেমনি হবে। তবে বাবা, তুমি এমন কিছু বল না বা করো না, যাতে হিতে বিপরীত হয়।
    - না না। সে রকম কিছু হবে না কাকাবাবু। তা ছাড়া ও তো কাজের ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। আপনি ওষুধের ভাগ বলে দিলে ও নিক্তি মাপে ওষুধ মেশায়। একটু কম বা বেশি হতে দেবে না। ওষুধের শিশির গায়ের লেবেলটাও ও নিখুঁত করে লাগায়।
    - তা হলেই বোঝো। মেয়ের আমার এলেম আছে বলো। হা হা হা।
    গুরুচরন হেসে উঠে পরিবেশ টাকে হালকা করে দেয়। হয়তো নিজেও কিছুটা হালকা হন।
    - এলেম থাকবে না, সে তো আপনারই মেয়ে।
    বিলাসও  হো হো করে হেসে ওঠে।
    এমন সময় ভেবলি চুপি চুপি ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করে-
    - তোমরা আমার নামে কি বলছো কি গো? ভেবেছো আমি কিচ্ছুটি টের পাবো না।
    - না মা অন্য কিছু নয়, তুমি কত যত্ন নিয়ে রুগীর দেখভাল করো, তাদের বোঝাও, ওষুধ বানাও এই সব আর কি।
    - তা যত্ন নিতে হবে না, বলো ! ওষুধ মানে তো মানুষের জীবন মরণের ব্যাপার, না বাবা?
    - সে তো বটেই মা।
    - কিন্তু দেখ, বিলাসদাদা আমাকে শুধু ক্ষ্যাপায়। ভেবলি বলে ডাকে।
    - এই ভেবলি-
    - দেখলে তো তোমার সামনেও ভেবলি বলছে। আমার নামটাই ভুলেই গেছে মনে হয়।
    - আচ্ছা থাক, থাক। বিলাস তুমি এবার থেকে ওকে ওর আসল নাম ধরেই ডেকো, ভেবলি বোলো না কেমন। লোকে যা বলে বলুক গে। তুমি তো আমাদের ঘরের লোক।
    ভেবলির দিকে ফিরে বলেন
    - ঠিক আছে মা। এবার আমি আসি, একটু হাটের দিকে যেতে হবে। তোমরা গল্প করো আর নতুন রুগী এলে বা অসুবিধা হলে আমাকে ডেকো, কেমন।
    এই বলে গুরুচরন ডিসপেনসারি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
    বিলাস কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকে। ভেবলিও এদিক ওদিক ঘুরে ধপ করে বিলাসের পাশে বসে পরে। বিলাসকে শুনিয়ে বলে
    - কারো রাগ হলে আমি কি করতে পারি? বেশি রাগাতাগি করলে খেলব না, হ্যাঁ।
    বিলাস তবুও চুপ করে থাকে।
    - না না, বিলাসদাদা আমার তোমার যা ভালো লাগে তাতেই আমাকে ডেকো, আমি রাগ করবো না। আচ্ছা দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।
    ভেবলি উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা ছোট শিশি নামিয়ে এনে সেটা বিলাসের সামনে রাখে। বিলাস এবারেও কিছু বলে না। ভেবলি ছিপি খুলে টকটকে লাল-কালো রঙের কিছু দানাজাতীয় ফল বের করে জিজ্ঞেস করে
    - এ গুলো কি ওষুধ গো?
    - এ গুলো চিনিস না? এ হোল কুচফল। ওষুধে লাগে। আর ফলগুলোকে ভালো করে দেখ, সব গুলোই একই রকম। কোন ছোট বড় নেই। আগেকার দিনে শ্যাকরারা সোনা ওজনের জন্য এই ফল ব্যবহার করতো। একটা ফলের ওজনের সমান সোনা মানে, এক রতি। তাই একে রতি ফলও বলে।
    - কি সুন্দর না?
    - হ্যাঁ। ঠাকুরমার ঝুলি পড়িস নি? কুচ বরণ কন্যা, তার মেঘ বরণ চুল। এই কুচফল দেখেই তো লিখেছিল। গাটা টকটকে লাল আর মাথাটা কুচকুচে কালো।
    - হ্যাঁ, পড়েছি তো। তারপর রাজপুত্তুর আসবে। এসে রাজকন্যাকে বে করে নিয়ে চলে যাবে। বা, বা, কি মজা।
    ভেবিলি হাততালি দিয়ে ওঠে।
    - মজা তো বটেই। তবে কি জানিস, এটা দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন, আসলে এটা বিষাক্ত ফল। পরিমান বেশি হলে রুগী পটল তুলবে।
    - ও মা গো ! আমার তো ভয় করছে। তুমি আমাকে ভয় দেখাবে না, বলে দিলুম হ্যাঁ।
    - ভয় করছে তো যেখানে ছিল সেখানে রেখে আয় যা, এসব জিনিস নিয়ে বেশি পাকামি করিস না।
    - বেশ বাবা বেশ তাই রাখছি। শুধু বকা। বকা ছাড়া কথা নেই।
    ভেবলি কুচের শিশিটা আলমারিতে আগের জায়গায় রেখে আসে।
    তাদের কথোপকথনের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখা গেল বারান্দা পেরিয়ে ঘরের দিকে আসতে। আর তাকে দেখেই বিলাস তাড়াতাড়ি বাইরে গেল।
    - আরে মিতালি, কখন এলি?
    - এইতো কিছুক্ষণ আগে। এসে শুনলাম তুমি নাকি কবিরাজি শিখছো, তাই দেখতে চলে এলাম।
    - বেশ করেছিস, আয় ঘরে এসে বোস।
    - তুমি কি ব্যস্ত আছো? 
    - না না, এখন তো কোন রুগী নেই।
    - তাহলে চলো, ওপাড়া থেকে ঘুরে আসি।
    - যাবি, চল। ভেবলি-এই যা-
    বলে জীভ কেটে বলে
    - সরি। প্রণতি, তুই তাহলে ঘর বন্ধ করে বাড়ি যাস, আমি একটু ওপাড়া থেকে আসছি।
    বিলাস মিতালিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ভেবলি অবাক হয়ে দেখল। মেয়েটি কে? তার সঙ্গে আলাপ করানোর প্রয়োজনীয়তাও বোধ করলো না! যাকগে, মরুক গে, পরে জেনে নিলেই হবে। ভেবলি ডিসপেনসারি বন্ধ করে বাড়ি চলে গেল।



    পরের দিন বিলাস ডিসপেনসারিতে এলো না। ভেবলি  বাবার কাছ থেকে শুনলো সে মিতালিদের সঙ্গে তারাপীঠ বেড়াতে গেছে। দু তিন দিন পরে ফিরবে। খবরটা শোনার পর থেকে ভেবলি যেন কেমন হয়ে গেল। সে কোন কাজে মন বসাতে পারছে না। সব সময় তার বিলাসদাদার কথা মনে আসছে। ভেবলির তো কোন বন্ধু নেই। যা দুএকজন ছিল তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কালেভদ্রে দেখা হয়। দেখা হলেই তারা ভেবলিকে নানা বিদ্রূপপূর্ণ কথা বলে। কোনটা ভেবলি বোঝে, কোনটা বোঝে না। বিয়ের পর মেয়েদের হাসি ঠাট্টা করার ধরন এবং ভাষা দুটোই যে পাল্টে যায়। ভেবলির কাছে কিছু কথা হেঁয়ালি মনে হয়। তাই আর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তার মন ভরে না। বরং মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার এই বুন্ধুত্বহীন জীবনের মরুভুমিতে বিলাসদাদা মরুদ্যান হয়ে উঠেছিল। সেও দুদিন আসছে না। মিতালি কে? বিলাসদাদা কি মিতালির ভালোবাসা্র লোক! অস্বাভাবিক নয়। সে এক ঝলকে যেটুকু দেখেছে তাতে মনে হয় মিতালি শিক্ষিতা, সুন্দর কথা বলে, তার মতো ভ্যাবলায় না। মেয়ে হিসেবে সে ভেবলির থাকে অনেক ভালো। ভেবলির হঠাৎ মনে পড়লো, বিলাসদাদা যাবার সময় তাকে আদর করে ভেবলি বলে ‘সরি’ বলল। তারপর আবার প্রণতি বলে ডাকল। তবে কি সে দূরে সরে গেল। সে তার ভেবলিকে ভালবাসে না! তাহলে তার কি হবে? তার যে বাবা আর বিলাসদাদা ছাড়া কেউ নেই। ওরা তারাপীঠে গিয়ে যদি বে করে ফেলে! তার বন্ধু সুষমা, সরস্বতী, টগর এরা তো ওই তারাপীঠে গিয়েই বিয়ে করেছিল। ভেবলি চোখে অন্ধকার দেখে। সে স্থির থাকতে পারে না। গুরুচরনের অনুপস্থিতে সে ডিসপেনসারি থেকে কুচফল ভর্তি শিশিটা বাড়ি নিয়ে চলে যায়।

    পরের দিন গুরুচরন আগেই ডিসপেনসারিতে চলে এসেছে। অনেক বেলে হয়ে যাওয়া সত্বেও ভেবলি ডিসপেনসারিতে আসছে না দেখে গুরুচরন বাড়িতে যায় তাকে ডেকে আনতে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখে তার সরল সাধাসিধে মেয়েটা ঘরের মেঝেয় পরে গোঙাচ্ছে আর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। গুরুচরনের কবিরাজের চোখ, সে প্রমাদ গোনে। এতো বিষক্রিয়া। চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজন ডেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তারবাবুও দেখে বললেন এতো বিষ খাওয়া কেস। তিনি তাড়াতাড়ি ওয়াস করে পাকস্থলী থেকে সব বিষ বের করে দেন। গুরুচরন দেখেন ভেবলির পেট থেকে বের করা বমির মধ্যে লাল-কালো রঙের কিছু জিনিস ভাসছে। তিনি কালক্ষেপ না করে সোজা ডিসপেনসারিতে চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন , যা ভেবেছিলেন তাই। আলমারিতে থেকে কুচফলের শিশি উধাও। তার আর বুঝতে দেরি হোল না যে ভেবলি কুচফল বাড়ি নিয়ে গিয়ে বেঁটে খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। দুদিনের চেষ্টায় ডাক্তারবাবু ভেবলিকে সুস্থ করে তোলেন। কাল সকালে তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেবে। বিকেল বেলা বিলাস আর মিতালি হাসপাতালে দেখা করতে গেলে ভেবলি বলে
    - তুমি আবার আমায় ঠকালে বিলাসদাদা?
    - ঠকালাম মানে?
    - তুমি তো বলেছিলে কুচফল বেশি খেলে মানুষ মরে যায়। আমি তো শিশির সব কুচফল বেঁটে খেয়েছি। কই আমি তো মরলাম না। তুমি আমায় মিথ্যে বলে ঠকিয়েছ। কেন, কেন ?
    ভেবলি বিলাসের জামা ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে মেরে জিজ্ঞাসা করে।
    -  চুপ কর ভেবলি, অমন কথা বলিস না। তোকে আমি ঠকাই নি রে।
    - ঠকিয়েছো তো , একশবার ঠকিয়েছো। তুমি তো আমাকে একবার বলো নি তুমি মিতালিদিদিকে ভালবাসো। তোমরা তারাপীঠে বে করবে।
    - এই জন্য তুই শুধু শুধু ওই বিষফলগুলো খেলি?
    - বেশ করেছি। তুমি মিতালিদিদিকে বে করবে, আর আমি বসে বসে দেখবো, কিছু বলবো না, না? তাই আমি বিষ খেয়ে মরবো। একবার মরি নি আবার মরবো। তোমার কি ? তুমি আমার কে?
    - ভেবলি, চুপ কর! ও! এই মেয়েটিকে নিয়ে পাড়া যায় না। এই দেখ মিতালিও এসেছে। ওকে জিগ্যেস কর।
    মিতালি সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেবলি তাকে খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। জিজ্ঞাসা করে
    - তোমরা বে করনি তারাপীঠে? তোমার কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই কেন?
    বিলাস বলে
    - ধুর পাগলি! মিতালি আমার মাসতুতো বোন রে । তুই মিথ্যে সন্দেহ করেছিস। তোকে ঠকানোর কোন কারণ নেই।
    কথাটা শুনেই ভেবলি হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর দম নিয়ে বলে
    - এই দেখো, এবার আমি নিজেই নিজেকে ঠকাচ্ছিলাম! তোমাদের পরিচয় না জেনে, না শুনে, আমি মরতে যাচ্ছিলাম! ভাগ্যিস মরি নি।
    - ভেবলি! তোকে মিতালির পরিচয় না জানিয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে রে। আর কোনদিন তোর বিলাসদাদা এই ভুল করবে না দেখিস। তোকে কথা দিলাম।
    বিলাস ভেবলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। ভেবলিও চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ে।

    ##############
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Mira Bijuli | ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩৪540405
  • দারুণ! দারুণ! 
  • Ranjan Roy | ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪০540406
  • এই গল্পটা বেশ ভালো লাগলো l আপনার গল্প অন্য জাতের l আমাদের না  দেখা জগত l
     
    চলুক l
  • swapan kumar mondal | ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৪৬540409
  • গুড়ুক গুড়ুক শব্দ উঠুক। গ্রামের দাওয়ায় তামাক পুড়ুক আর সাগরবাবু গল্প জুড়ুক।
    একদম মেঠো গল্প, মাটির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
  • Somnath Bhattacharyya | ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৩০540410
  • মাটির খুব কাছের। লেখককে জানাই কুর্নিশ ।
  • Ranjan | 2409:4060:207:1bbf:c340:3f13:af16:***:*** | ০২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:১৫540436
  • ভালো  লাগলো 
  • | 2409:40e0:1006:1912:8000::***:*** | ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:১৪540462
  • খুব ভালো লাগলো। এই ধরনের চরিত্র আজকাল দ্রুত কমে যাচ্ছে। 
  • Kuntala | ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:২৬540500
  • বেশ বিশুদ্ধ প্রেমের গল্প 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন