এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ছোট গল্প - উভচর

    Sagarmay Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৪০ বার পঠিত
  • উভচর
    সাগরময় মণ্ডল



    পুকুরঘাটে একগাদা এঁটো বাসন ঝনঝন করে নামিয়ে রেখে, উবু হয়ে বসে, ঘাটের পাশ থেকে এক খাবলা বালি তুলে, সঙ্গে নিয়ে আসা ঘুঁটের ছাইয়ের সঙ্গে বালি মিশিয়ে নিয়ে কমলার মা বাসন মাজতে বসলো। এটা নিত্য দিনের কাজ। সকাল, বিকেল, রাত্রি তিন বেলা এই পুকুর ঘাটে আসতে হয়। হয় বাসন মাজতে, নয় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। কারণ সেকালে গ্রামের কোনো বাড়িতেই শৌচালয়ের ব্যবস্থা ছিল না। একমাত্র ভরসাস্থল ওই পুকুর পাড় আর পুকুর ঘাট। শুধু সে নয়, পাড়ার অন্য মেয়ে বউরাও আসে। ঘাটে বসে বাসন মাজে, সুখ দুঃখের গল্প করে। সারা পাড়ার হাঁড়ির খবরের আদানপ্রদান ঘটে। যা পরে পল্লবিত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে। তবে একটা শর্ত থাকে, কানে কানে বলা কথা যেন পাঁচ কান না হয়। তা সে কথা যতবারই কানে কানে বলা হোক না কেন।

    কমলার মা দেখলো কুসুমের মা রমা মাথায় ঘোমটা দিয়ে এক মনে বাসন মাজছে। থালা বাটি মাজা হয়ে গেছে, এখন গোড়ালি দিয়ে চেপে চেপে পোড়া কড়াই এর কালি তুলছে আর গভীর ভাবে কিছু ভাবছে। সেটা বুঝতে পেরে ভেতরের খবর আদায় করতে, গলা খেঁকারী দিয়ে কুসুমের মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো-
    -- কি লো কুসুমের মা, অত কি ভাবছিস?
    মুখ তুলে ঘোমটাটা একটু ছোটো করে কুসুমের মা উত্তর দিল -
    -- ভাবনার কি আর শেষ আছে দিদি, ভাবতে ভাবতেই তো জীবন কেটে যাচ্ছে গো।
    -- কি আর করবি বল। মানুষটা কত আশা নিয়ে পশ্চিমে খাটতে গেছিল।
    -- হ্যাঁ গো দিদি, বলতো - “দেখিস বৌ, বাইরে গিয়ে খেটে খেটে অনেক টাকা উপায় করে তোকে আর তোর ওই মেয়ের জন্য একটা সুন্দর পাকা বাড়ি বানাবো আর দু’ বিঘে জমি কিনবো। তারপর আর যাবো না, এখানেই খেটে খুটে খাবো। তিনটে পেট ঠিক চলে যাবে। তারপর মেয়ের বিয়ে দেব”। কিন্তু তা আর হলো না।
    কুসুমের মার চোখ প্রথমে ছলছল করে উঠে পরে তা ঝর ঝর করে বর্ষাতে শুরু করলো।
    -- কাঁদিস না রে। কপালে সুখ লেখা না থাকলে সুখ হয় না। তা না হলে সুস্থ মানুষ হাসতে হাসতে কাজের জন্য বাইরে গেল আর একমাস পরে ফিরলো লাশ হয়ে।

    এখানে পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই, কুসুম যখন দু বছরের তখন তার বাবা গ্রামের আরও কিছু ছেলের সঙ্গে মহারাষ্ট্র যায় কাজের খোঁজে। সেখানে নির্মাণ সংস্থার অধীনে কাজ পাওয়া যায়, মজুরি গ্রামের থেকে অনেক বেশি। সব থেকে বড় কথা বেশি সময় কাজ করলে ওভারটাইম পাওয়া যায়। ফলে গ্রামের ছেলেরা ঘর সংসার ফেলে সেখানে ছুটে যায়। দিনরাত মেহনত করে পয়সা কামায়। কেউ মিস্ত্রি, কেউ জোগাড়ে আবার কেউ ক্রেন চালক। কুসুমের বাবা ক্রেন চালাত। মজুরি অন্যান্যদের থেকে বেশি।

    একদিন খবর এলো বহুতলের উপরে ক্রেন চালাতে গিয়ে ক্রেন থেকে পড়ে গিয়ে কুসুমের বাবা প্রাণ হারিয়েছে। তিন দিন পরে কফিন বন্দি দেহ গ্রামে পৌঁছলে সারা গ্রাম শোকে নিথর হয়ে গেছিল। কুসুম অবাক হয়ে দেখছিল এতো লোক তার বাবাকে ঘিরে ধরে কি করছে? সে শুধু বাবার মুখটা দেখেছে। একবার কোলে উঠবে বলে এগিয়ে যেতে চাইলে অন্য কেউ তাকে কোলে তুলে নিয়ে অন্য বাড়িতে চলে গেছিল। শুধু মাকে দেখেছিল বাবার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হাত মাথা নেড়ে কি সব বলছিল আর খুব খুব কাঁদছিল। তারপর আর দেখেনি। কারা যেন বাবাকে কোথায় নিয়ে চলে গেল। শুধু পুকুর ঘাটে মাকে নিয়ে গিয়ে মায়ের হাতের শাঁখা চুড়ি ভেঙে দিয়ে, সিঁথির সিঁদুর ঘষে তুলে দিয়ে, এক খানা সাদা থান পরিয়ে দিল।

    প্রথম প্রথম বাবাকে দেখার জন্য কুসুমের খুব মন খারাপ করতো। কান্নাকাটি করলে মা এসে কোলে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে অঝোরে কাঁদতো। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা এসে মাকে সান্ত্বনা দিত, কুসুমকে নিয়ে আদর করতো। তাদের কথায় কুসুম বুঝেছিল, তার বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছে, কবে আসবে কেউ জানে না। সে দেখেছিল, আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের আনাগোনা কমে গেছিল। তবে পাড়া-বেপাড়ার কয়েকজন কাকু ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করেছিল। তারা তার মায়ের সঙ্গে কি সব কথা বলতো, কত কিছু দিয়ে সাহায্য করতে চাইত, কিন্তু মা কিছু বলতো না, কিছু নিত না। কাকুরা চলে গেলে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদত। কুসুম কাছে গেলে তাকে কাছ-ছাড়া করতে চাইত না।

    একদিন রাতে পাড়ার দুজন যুবক মদ খেয়ে, বাড়ির বেড়ার দরজা ভেঙে কুসুমদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়লে কুসুমের মা তাদের দুজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে কুসুমকে বগলদাবা করে এক কাপড়ে মোড়লদের বাড়িতে উঠেছিল। রাতটা কোনোমতে সেখানে কাটিয়ে, সকালবেলা কুসুমের মা মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।

    কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারে নি। বিধবা যুবতী বোনকে ঘরে রেখে তারা নিজেদের বিপদ বাড়াতে চায় নি। তা ছাড়া, কোন ভাজ নিজেদের অন্নের ভাগ, বিয়ের পরে পর হয়ে যাওয়া ননদকে দিতে চায়? তাও আবার মেয়ে সহ ! তারাও চায় নি। সাত তাড়াতাড়ি আপদ বিদেয় করে দিয়েছে। ফলে কুসুমের মা কুসুমকে নিয়ে আবার স্বামীর ভিটেতে ফিরতে বাধ্য হয়েছিল।



    তারপর শুরু হলো দাঁতে দাঁতে চেপে লড়াই। শত ভয়, সহস্র প্রলোভনকে জয় করে কাটিয়ে দিল বেশ কয়েকটা বছর। কি সহ্য করতে হয় নি ! জ্ঞাতিগুষ্ঠির কাছে গঞ্জনা, কথায় কথায় প্রতিবেশীদের হাতে লাঞ্ছনা, সমবয়সী, বিষম বয়সী পুরুষের ইঙ্গিতপূর্ণ চাউনি, চাষের জমির ফসল চুরি, অপয়া অলক্ষী বলে দেগে দেওয়া। তবু সে দমে যায় নি, মেয়েকে বড় করে সৎপাত্রে দান করতে না পারা পর্যন্ত তার বিশ্রাম নাই।

    এই কয়েকটা বছর তাকে পোড়খাওয়া মানুষে পরিণত করেছে। টানাটানির সংসারে নিজের সখ আহ্লাদ কে বাক্সবন্দি করে রেখে মেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে। তবে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পর আর পড়াতে পারে নি। পড়াতে পারে নি মানে দূর গ্রামের হাই স্কুলে পাঠানোর ঝুঁকি সে নিতে চায় নি। কে জানে মায়ের উপরের আক্রোশ মেয়ের উপর এসে পড়বে কিনা ! তারপর মেয়ে বেশি পড়াশোনা জানলে পাত্র জোগাড় করা মুস্কিল। গ্রামের বা আশেপাশের গ্রামের ছেলেদের বেশির ভাগের মুরোদ তো ওই প্রাইমারি। হাতে গোনা কয়েকজন হাই স্কুলের গন্ডি পার করতে পারে।

    সে তক্কে তক্কে থাকে, সে রকম ছেলের খোঁজ পেলে কুসুমের বিয়ে দিয়ে দেবে। দেখতে দেখতে তার বয়স তো তের পার হয়ে গেল। লেখাপড়া নাই, সংসারের কাজকর্ম মা নিজেই সব করে নেয়। ধিঙ্গি মেয়ে শুধু পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, আর বন্ধুদের সঙ্গে খেলে। বন্ধু বান্ধবও আজকাল কমে গেছে, কারণ অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। এবার একটা ভালো ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে।

    গ্রামের মোড়লবাড়ি গিয়ে কুসুমের মা একটা ছেলের খবর পেল। ছেলে না বলে লোক বলাই ভালো। বয়স কুসুমের মায়ের কাছাকাছি। আগে একবার বিয়ে করেছিল, বৌ টেকেনি। টিকবে কি করে ? সে তো ভোলেভালা। নামেও ভোলা, কাজেও ভোলা। ভীষণ সাধাসিধে লোক। সবাইকে বিশ্বাস করে আগে পিছে না ভেবে। লোকের অভিসন্ধি বুঝতে পারে না। বিষয় সম্পত্তি বেশ ভালোই আছে। তাকে ঠকানোর লোকও কম নাই। এমনকি তার বিয়ে করা বৌও তাকে ঠকাতে ছাড়ে নি। তার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে, বেশ কিছু টাকা পয়সা গয়নাগাঁথি হাতিয়ে নিয়ে অন্য একজনের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। সঙ্গে এক বছর বয়সের মেয়েটাকেও নিয়ে গেছে। আর ফেরে নি। সে প্রায় বার বছর হোল।

    ঘটনাটা ভোলার সাদা মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, বিশেষ করে তার ছোট্ট মেয়েটাকে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। সে ঠিক করেছিল আর বিয়ে থা করবে না। কিন্তু আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় সে মত পাল্টেছে। ঠিকই তো, তার এত জমিজমা, পুকুর, বাড়ি। উত্তরাধিকার কোথায় ? বিয়েতে মত দিলেও সে শর্ত বেঁধে দিল। ভালো মেয়ে হতে হবে। পণ নেবে না। একটু লেখাপড়া জানলে ভালো।

    কুসুমের মা খবরটা শুনে প্রথমে উৎসাহিত বোধ করলেও, একটু চিন্তান্বিত হলো। পাত্রের এত বয়স, প্রায় কুসুমের বাবার বয়সী। মেয়ে মানিয়ে নিতে পারবে তো ! আবার ভাবে, বিয়েটা হলে কুসুমের অন্নবস্ত্রের অভাব থাকবে না। বয়সে বড় হওয়ার কারণে তার বর তাকে নিজের মত করে গড়ে নিতে পারবে। তাছাড়া মেয়ে তো; কোথাও না কোথাও বিয়েতো দিতেই হবে। এক্ষেত্রে আরও একটা সুবিধা আছে, ছেলেটা একা, মা বাবা আগেই গত হয়েছে, ভাইবোন কেউ নেই। দরকার হলে সে নিজে গিয়েও মেয়ের সংসার গুছিয়ে দিতে পারবে।

    এরপর আর দু’বার ভাবে নি। গ্রামের মোড়লকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে গেছিল পাত্রের বাড়ি। পাত্র ভোলানাথ মেয়ের কম বয়স শুনে আপত্তি তুললেও পরে রাজি হয়ে যায়। বাপ হারানো মেয়ে, গরিব ঘর, দেখতে শুনতে মন্দ নয়। তবে তাকে সব থেকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল কুসুমের মায়ের জীবন সংগ্রামের কাহিনী।

    পাঠককে নিয়ে আবার আমরা সেই পুকুরঘাটে যাবো, যেখানে কুসুমের মা পাড়ার অন্যান্য বৌদের সঙ্গে ঘাটে বসে বাসন মাজছিল। কথায় কথায় অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। বাসন মাজা শেষ। এবার বাসন জলে ধুয়ে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হবে। দেখলো কুসুম তার ফ্রকের আঁচলে বেশ কিছু কুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখেও একটা আছে, সেটা চিবোচ্ছে। তাকে এ অবস্থায় দেখে মা বেশ জোরে বকা দিয়ে বললো -
    -- ধিঙ্গি মেয়ে, আজ বাদে কাল বিয়ে। আর মহারানী কিনা লোকের গাছের কুল পেড়ে এনে ঘাটে দাঁড়িয়ে চিবোচ্ছে। কবে যে বড় হবে।
    -- বকিসনে লো! কত দিন আর এরকম করবে। বিয়ের পর তো সেই শ্বশুরবাড়ি, হেঁশেল ঠেলা, গোয়াল পরিষ্কার করা, ঘুঁটে দেওয়া আর ভাতারের কাছে শোয়া… এইতো জীবন । দু’দিন সখ আহ্লাদ করে নিতে দে।
    -- তোমাদের আস্কারা পেয়েই তো ও ধিঙ্গিপনার সাহস পায় গো দিদি। তোমরা না থাকলে ওকে তো মানুষ করতে পারতাম না।
    -- সে তো বুঝলাম, কিন্তু ওই ছোটো মেয়ে, দোজবরের সঙ্গে ঘর করতে পারবে তো?
    -- তোমরা আশীর্বাদ করো দিদি, ও যেন সুখী হয়।
    -- সে তো করবো, কিন্তু... চল সন্ধ্যে হয়ে আসছে। ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে তুলসীতলায় সাঁঝ প্রদীপ জ্বালাতে হবে।

    তারা বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। কুসুম তার আগেই সেখানে থেকে ছুটে চলে গিয়েছিল তার বন্ধুদের কাছে। কাঁচা কুল বঁটিতে কেটে নুনলংকা মিশিয়ে "উলুসুলু" বানিয়ে খাবে বলে। খাওয়া তো নয়, খেতে খেতে চোখের জলে নাকের জলে একাকার। তবু কত আনন্দ।



    এক শুভলগ্নে কুসুম আর ভোলানাথের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো। খুব জাঁকজমক কিছু নয়। কয়েকজন আত্মীয় কুসুমের মায়ের তরফে এবং আরও কয়েকজন ভোলানাথের তরফে। কাপড়, শাড়ি, গয়না সব ভোলানাথ এনেছিল। তবে মেয়ের বিয়েতে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেনি কুসুমের মা। গ্রামের মোড়ল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে। কেউ কোন রকম অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে নি।

    বিয়ের পর কুসুম শ্বশুর বাড়ি গেল। প্রথম কিছুদিন হৈ-হট্টগোলে কেটে গেল। মেয়ে জামাইয়ের দ্বিরাগমনের পরে কুসুমের মা ওদের সঙ্গে কুসুমের শ্বশুরবাড়ি গেল। ইচ্ছে ছিল মেয়ের নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে। ছোটো মেয়ে একা সামলাতে পারবে না। আগেই বলা হয়েছে কুসুমের শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-জা কেউ তো নাই। তাই মাকেই যেতে হলো।

    ভোলানাথের অগোছালো সংসার। তার মধ্যে আবার বাড়িতে কোনো স্ত্রীলোক নেই। ফলে কোনো জিনিসই প্রায় নিজের জায়গায় নেই। কুসুমের মা দিন কয়েক অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘরদোরের শ্রী ফিরিয়ে আনলো। এখন বাড়িটাকে বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। ভোলানাথও খুব খুশি এরকম একটা সুন্দর সাজানো সংসার পেয়ে। যখন যা দরকার নির্দিষ্ট জায়গাতেই পেয়ে যায়। আগের মত একটা জিনিস খুঁজতে গিয়ে দশটা জিনিস ওলোটপালোট করতে হয় না। তার উপর ভোলানাথকে পাশে বসিয়ে জমি জমার, চাষবাসের হিসেবে বুঝিয়ে দেয়। ভোলানাথ বোঝে কম তাকিয়ে দেখে বেশি। কুসুমের মার কত বুদ্ধি, কত সুন্দর করে সব বুঝিয়ে দেয়।

    এতে ভোলানাথের সুবিধা যেমন হোল, তেমনি অসুবিধাও কম হোল না। এত দিন ভোলানাথের ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে যারা তাকে ঠকাতো তারা একটু বেকায়দায় পড়ে গেল। এখন ক্ষেতের ধান ভাগিদারের বাড়িতে না উঠে ভোলানাথের বাড়িতে ওঠে। পুকুরের মাছ বেহাত না হয়ে সোজা বাড়িতে আসে। সৃষ্টি হোল শত্রুতার। শাশুড়ি চলে গেলে তারা ভোলানাথকে দেখে নেবে বলে শাসাতে লাগলো।

    কুসুমের মা ভাবল আরও কিছু দিন থেকে যাওয়া দরকার। নইলে ভোলানাথ একা সামলাতে পারবে না। সে যা পারে, কুসুম তো তা পারবে না।
    কুসুম পারবে কি, তার তো সংসার করার বয়সই হয় নি। সে শুধু খেলে বেড়াবার সুযোগ খোঁজে। শ্বশুরবাড়ি বলে বেশি বেরোতে পারে না, তবে সুযোগ পেলেই আশেপাশের ছেলেমানুষ বৌ-মেয়েদের সঙ্গে খেলে। মা কিছু করতে বললে বলে -
    -- ও তুমি সামলে নাও। আমি বাপু পারবো না। এসব ঘরকন্না আমার ভালো লাগে না। শুধু কাজ আর কাজ। একটু খেলবার জো নাই গো।
    ভোলানাথ কিছু বললে উত্তর দেয়
    -- ও সব, মা জানে। মাকে জিগ্যেস করুন সব পেয়ে যাবেন। মা তো বলে আমি উড়নচন্ডী।
    কথা গুলো কুসুমের মায়ের কানে পৌঁছলে সে একদিন কুসুমকে ডেকে জিগ্যেস করে-
    -- হ্যাঁরে, কতকগুলো কথা তুই আমাকে বলতো। যদিও মা হয়ে এগুলো আমার জিগ্যেস করার কথা নয়। কিন্তু এখানে দ্বিতীয় কেউতো নেই, তাই আমাকেই বোলতে হচ্ছে। জামাই তোকে ভালোবাসে? আদর করে?
    কথা গুলো শুনে কুসুম কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। সংক্ষেপে মাথা নাড়িয়ে বলে
    -- না।
    -- তুই কিছু বলিস নি?
    -- এই দেখো, অত বড় মানুষটাকে আমি কি বলবো? একদিন আমাকে খাটের উপরে তার পাশে বসতে বলল। আমি গিয়ে বসলুম। সোয়ামির কথা তো আর ফেলা যায় না।
    -- তারপর?
    -- তারপর উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। হাতটা আস্তে আস্তে মাথা থেকে আমার থুতনির কাছে নেমে এলো। তখন আমার খুব ভয় করছিল। কিন্তু কিছু বলিনি। হাজার হোক সোয়ামি তো। এবার উনি উনার মুখটাকে আমার মুখের খুব কাছে এনে ভালো করে দেখলেন। অ-নে-ক ক্ষণ। তারপর বললেন। যাও কুসুম, ঘুমিয়ে পড়গে, তুমি খুব ভালো।
    -- আর কিছু?
    -- আবার কি? আর কিছু নেই। শুধু সবাই বলেছিল যে বিয়ের পর বর-বউকে এক ঘরে শুতে হয়, তাই আমি এক ঘরে থাকি। উনি থাকেন খাটে আর আমি নীচে বিছানা পেতে ঘুমোই।
    কথাগুলো শুনে কুসুমের মায়ের পায়ের তলার মাটি নড়ে গেল। একি হল! তবে ভোলানাথ তো কুসুমকে স্ত্রী বলে মেনে নিতে পারে নি! তা না হলে সে এরকম করবে কেন? হে ভগবান! সে এ কি করলো!



    বিয়ের পর স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক যে এ রকম হবে, তা কুসুমের মা স্বপ্নেও ভাবে নি। কুসুমের সংসারে প্রতি উদাসীনতা, ভোলানাথের পরনির্ভরতা আর কুসুমের মায়ের হিসেবি চলা, সংসারের রসায়নটাকে একেবারে ঘেঁটে দিল। কুসুমের উদাসীনতা ভোলানাথকে আরও বেশি করে তার মায়ের উপর নির্ভরশীল করে তুলল। কুসুম যেটা বোঝেনা, তার মা খুব সহজেই সেটা বুঝে ফেলে। মা মেয়েকে কত বোঝায়, কিন্তু সব কিছু বোঝার মত মেয়ের বয়স হয় নি। মেয়েকে সব কথা বলতে বা বোঝাতে কুসুমের মায়ের অস্বস্তি হয়। ভোলানাথ দেখে আর হাসে। কুসুমের মা লজ্জা পায়।

    দিনদিন কুসুমের মায়ের উপর ভোলানাথের নির্ভরতা বেড়েই যেতে থাকলো। কোনো কাজ সে তাকে জিগ্যেস না করে করতে পারে না। লোকের চোখে সেটা ধরাও পড়ে যায়। তাতে ভোলানাথের কোনো হেলদোল নেই। সে শুধু কুসুমের মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। জিনিসটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে বুঝে কুসুমের মা তার নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। কিন্তু সেখানেও শান্তি নাই, দুএকদিনের মধ্যে কুসুমকে নিয়ে ভোলানাথও সেখানে হাজির হয়ে যায়। কুসুম বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে বেড়ালে ভোলানাথ কুসুমের মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করে। ঘনিষ্ঠ হয়ে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারে না।

    কুসুমের মা নিজেকে শক্ত করে রাখার চেষ্টা করে। ভোলানাথকে দূরে সরিয়ে রাখে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। ভোলানাথের তাতেও কিছু যায় আসে না। সে মোহগ্রস্তের ন্যায় কুসুমের মায়ের পিছুপিছু ঘুরে বেড়ায়। সে ছাড়া তার জগৎ অন্ধকার। কুসুমের মা কি করবে ভেবে পায় না। মেয়ের উড়নচন্ডী ভাব কমলেও এখনও আছে। তার উপর বয়সের ফারাক ভোলানাথকে কুসুমের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে উৎসাহিত করে না। সে যত সাবলীল সব ওই কুসুমের মায়ের কাছে। তার আচার আচরণ দৃষ্টিকটু ভাবে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যায়। কিন্তু সে কি করবে ? একদিকে মেয়ের সংসার, আর অন্যদিকে ভোলানাথের শর্তহীন নির্ভরতা এবং আনুগত্য! সে চোখে অন্ধকার দেখে।



    আগুন যেমন ছাই চাপা থাকে না, তেমনি ভোলানাথের শাশুড়ির প্রতি আসক্তির কথাও বেশিদিন চাপা থাকলো না। গুজবের ধোঁয়া শাখায় প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে বিস্তার লাভ করলো, ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। গ্রামের মাতব্বররা প্রমাদ গুনল। এ জিনিস চলতে দিলে সমাজ ভেঙ্গে যাবে। এর যথা শীঘ্র বিহিত করতে হবে। তারা ভোলানাথকে বোঝাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হোল না। ভোলানাথ বারবার বলতে থাকে, সে কিছু জানে না। যা জানে সব কুসুমের মা। এতে পড়শিদের রাগ আরও বেড়ে যায়। তারা ভোলানাথের জমির ধানগাছ গরুকে খাইয়ে নষ্ট করে দেয়। ফসল ঘরে ওঠে না। পুকুরের মাছ ধরে খেয়ে নেয়। ভোলানাথের বাড়িতে মাছ পৌঁছয় না। একদিন ভোরের দিকে গ্রামের কয়েকজন ছেলে ভোলানাথের পুকুরে কীটনাশক ঢেলে দিল। ভোলানাথ খবর পেয়ে দৌড়ে যায় পুকুর পাড়ে। দেখে সারা পুকুর জুড়ে মাছেরা দাপাদাপি করছে। বিষের জ্বালায় শ্বাসরুদ্ধ মাছগুলো একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য জল ছেড়ে ডাঙায় লাফ মারছে। দেখতে দেখতে পুকুরের সব মাছ মরে গিয়ে জলের উপরে ভেসে উঠলো। এত মাছ যে জল দেখা যায় না। পুরো পুকুর যেন রুপোলী চাদর দিয়ে ঢাকা। সব কিছু দেখে ভোলানাথ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে থাকা দুজন ছেলের উপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’হাত দিয়ে কিল ঘুসি মারতে শুরু করলো। ছেলে দুটোও চুপ করে থাকে নি। তারা ভোলানাথকে প্রতি আক্রমণ করল। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ।
    - শালা! নিজেকে খুব মাতব্বর ভেবেছ না। শালা , দিনের বেলা বউ আর রাতের বেলা শাশুড়ির সঙ্গে ফুর্তি করবে আর গ্রামের লোক তা মেনে নেবে ভেবেছ ! ব্যাঙের মত জলেও থাকবে আবার ডাঙাতেও চড়বে, তা হতে দেব না। তোকে মেরে আজ পুকুরের ওই বিষজলে মাছের সঙ্গে ভাসিয়ে দেব।
    এই বলে তারা ভোলানাথকে মারতে মারতে সত্যি সত্যিই পুকুরের জলে ফেলে দিল।

    ততক্ষণে কুসুম আর কুসুমের মা পুকুর পাড়ে চলে এসেছে। তারা কোন রকমে তাকে পুকুর থেকে তুলে ডাঙায় নিয়ে আসে। ভোলানাথ কিছুটা বিষ মেশানো জল খেয়ে আর মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কুসুমের মা গ্রামের কয়েকজনের হাতে পায়ে ধরে ভোলানাথকে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে গেল।

    সারাদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার পর সন্ধ্যাবেলা ভোলানাথ চোখের পাতা মেলল। ডাক্তারবাবুও রুগি দেখে জানায় যে ভোলানাথ এখন বিপন্মুক্ত। তবে সেদিনের রাতটা হাসপাতালে থাকতে হবে। জ্ঞান ফিরে এলে ভোলানাথ কুসুমের মাকে কুসুমের কথা জিগ্যেস করে। কুসুম পাশেই ছিল। সে সামনে এলে ভোলানাথ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে বাড়ি যেতে। আরও কিছু কথাবার্তার পরে কুসুম আর তার মা বাড়ি যাবার কথা বললে ভোলানাথ কুসুমের মায়ের হাতটা খপ করে চেপে ধরে। কুসুম সামনে থাকায় সে একটু অপ্রস্তুতও হয়ে পড়ে। ভোলানাথ বলে-
    -- আজ একটা কথা আমি বলবো। আমি যদি বাড়ি ফিরতে না পারি, আমার কুসুমকে তুমি দেখো। কুসুমকে দেখলে আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা মনে পরে। সেও হয়তো এতদিনে কুসুমের মত বড় হয়েছে। তারও ঘর সংসার হয়ে থাকবে।
    বলতে বলতে ভোলানাথের চোখের কোণা চিকচিক করে উঠছে, গলা বুজে আসছে। কে যেন গলা চেপে ধরে তার কণ্ঠরোধ করতে চাইছে। এক চুমুক জল খেয়ে, একটু দম নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে, আবার বলে -
    -- আমি জানি কুসুমকে বিয়ে করে আমি অন্যায় করেছি, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো কুসুমকে আমি কোনদিন আমার মেয়ে ছাড়া ভাবতে পারিনি।
    -- সে কথা আর কেউ না জানলেও আমি জানি।
    কুসুমের মা বলে উঠলো।
    ভোলানাথ আবার বলে উঠলো,
    -- আমি জানি আমার কৃতকর্মের ফল আমাকেই ভুগতে হবে। এতে গ্রামের লোকের কোন দোষ নাই। আমি ওদেরকে বোলতে পারিনি, বোঝাতেও পারি নি। তোমাকেও অনেকবার বলবো বলবো করেও বলার সুযোগ করতে পারিনি। আমিতো বোকা।

    কথাগুলো শুনে কুসুমের মা এবার বুঝতে পারলো কেন ভোলানাথ তার পিছুপিছু ঘুরত, কিছু বলার চেষ্টা করত। সে যেটাকে আসক্তি বলে ভেবেছিল, সেটা আসলে মনের ভিতরের পাষাণচাপা কথাগুলো বলে নিজেকে হালকা করার প্রচেষ্টা। ছিঃ, ছিঃ। আর পাঁচজনের মতো সেও তো তাকে কত খারাপ ভেবেছে। কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দূরে দূরে থেকেছে। না, না। একটা ভালোমানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়া তার উচিত হয় নি। তারও চোখে জল এলো। চোখের জল মুছে ভোলানাথের দিকে তাকাতে ভোলানাথ বলল -
    -- পারলে তুমি কুসুমের আবার বিয়ে দিও, আমার সব সম্পত্তি আমি কুসুমকে দিয়ে যাব। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। তুমি আমাকে ফিরিও না। আমাকে ক্ষমা করো।
    কথাগুলো বলে কুসুমে মায়ের হাত ধরে ভোলানাথ বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে শুরু করলো।
    ভোলানাথের কথাগুলো তীক্ষ্ণ বানের মত কুসুমের মার বুকে বিঁধছিল। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। কুসুমও বিছানার একপাশে স্থানুর মত বসে। তার মা কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল -
    -- আগে সুস্থ হয়ে ওঠো, তারপর সেসব ভাবা যাবে।
    ভোলানাথের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, কুসুমকে হাত ধরে টানতে টানতে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এলো কুসুমের মা। বেরিয়ে এসে মা মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল। কুসুমের মার মাথা দপদপ করছে। সে কিছু ভাবতে পাড়ছে না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় সে কোন কথা বলতে পারলো না। সে বুঝতে পারছে না এ কিরকম পরিস্থিতি! কি করে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়!

    সে এবার কি করবে? তবে কি তার এতদিনের সংযম শিথিল হয়ে এবার ভেঙে পড়বে? ভোলানাথের ডাকে সাড়া দিয়ে তার বাক্স-বন্দী দীর্ঘ উপোসি শরীর-মন বাইরে বেড়িয়ে এসে আবার নিঃশেষে শুষে নেবে ক্ষুধার্ত যৌবনের মাধুর্য! জমাট বাঁধা ঘি, আগুনের সংস্পর্শে এসে গলতে গলতে দপ করে জ্বলে উঠে আগুনে মিশে আগুন হয়ে যাবে! পুড়িয়ে দেবে তার মেয়ের সংসার! মা হয়ে সে তার মেয়ের সুখ, মেয়ের সংসার নিজের হাতে শেষ করে দেবে!

    কিন্তু সে তো এসেছিল মেয়ের সংসার পেতে দিতে, ভাঙতে নয়। হে ভগবান! এবার সে কেমন করে লোকসমাজে মুখ দেখাবে।

    হাজারও ভাবনার ভিড়ে সে রাতে ঘুমতে পারলো না।



    পরদিন সকালবেলা গ্রামের কাউকে কিছু না বলে কুসুমের মা কুসুমকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সোজা হাসপাতাল। সেখান থেকে ভোলানাথকে ছাড়িয়ে নিয়ে তারা গ্রামে না ফিরে শহরের দিকে পা বাড়াল।

    একদিন যায় দুদিন যায়, তারা আর ফেরে না। বাড়ি খালি পড়ে আছে। কাউকে পাহারাতেও রেখে যায় নি! তবে কি ভোলানাথের ভাল মন্দ কিছু ঘটে গেল। তাহলে তো ভোলানাথের শাশুড়ি কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। গ্রামের সবাই যেন একটু ঘাবড়ে গেল। কি কি ঘটে থাকতে পারে আর তার ফলশ্রুতি কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হোল।

    দিন দশেক এরকম চলার পর একদিন গ্রামের লোকেরা দেখল ভোলানাথ আর কুসুমের মা গ্রামে ফিরে এসেছে। কিন্তু কুসুম সঙ্গে নেই।
    শুরু হল কানাঘুষো। কুসুম কোথায়? তাহলে কি ভোলানাথ শাশুড়ির সঙ্গে থাকবে বলে নিজের বিয়ে করা বউ কুসুমকে বেচে দিয়ে এলো, নাকি মেরেই ফেললো মেয়েটাকে ! কেউ আবার বলল -
    -- দ্যাখগে, কুসুমকে হয় তো শহরের বেশ্যাপল্লিতে রেখে এসেছে। মেয়েকে দিয়ে টাকা কামাবে বলে। আর অই পোড়ারমুখী মাগী, জামাই এর সঙ্গে ফুর্তি করবে। ও মাগো! কি কালই না এলো। ছিঃ! ছিঃ! একথা শুনলেও পাপ।

    ভোলানাথকে জিগ্যেস করে কোন উত্তর পাওয়া যায় নি। সে শুধু হেসেছে আর আঙুল দেখিয়ে বলেছে ‘ও জানে’, মানে কুসুমের মা জানে। কিন্তু কুসুমের মাকে জিগ্যেস করার সাহস কেউ দেখায় নি। তবে সবাই চোখ কান খোলা রেখে চলে। যদি কিছু জানা যায়। ঘরে ঘরে ফিসফাস আলোচনা শুরু হোল।

    হপ্তা খানেক পড়ে একদিন গ্রামের ঠাকুরমশায় কে হন্তদন্ত হয়ে ভোলানাথের বাড়ি থেকে বেরতে দেখে সবাই তাকে পাকড়াও করলে।
    -- কি ব্যাপার ঠাকুরমশায়, ওদিক থেকে এলেন যে। কোন খবর পেলেন?
    -- হেঃ, হেঃ, হেঃ! খবর পাই নি আবার। খবর শুনলে তাক লেগে যাবে হে।
    -- মানে?
    -- মানে, আমাদের ভোলানাথের আবার বিয়ে গো।
    -- বিয়ে! কোথায়? কার সাথে?
    এক সাথে গ্রামবাসীদের তরফ থেকে এক গুচ্ছ প্রশ্ন ধেয়ে এল ঠাকুরমশায়ের দিকে।
    -- আরে, আর বোলো না। ভোলানাথ তার শাশুড়িকে বিয়ে করবে গো। ছিঃ ছিঃ! কি নক্কারজনক ব্যাপার বলতো।
    -- তা আপনি কি বললেন?
    -- হেঃ, হেঃ, হেঃ! আমি আর কি বলবো, ওরা আমার যজমান, না করতে তো আর পারি না। তাছাড়া সময়ে অসময়ে ভোলানাথ কিছু কম তো দেয় না আমাকে। তাই মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করার বিধান দিয়ে এসেছি । আগামীকালই বিয়ে।
    খবর দিয়ে ঠাকুর মশায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। পিছন ফিরে দেখে নিল , ভোলানাথ বা কুসুমের মা তাকে দেখে ফেলেছে কিনা।

    সন্ধ্যা বেলা গ্রামে সালিশিসভা বসলো । না না, গ্রামে থেকে এ অনাচার সহ্য করা যায় না। এর প্রতিবাদ না করলে সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে। তারা নিজেরাই হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে বলে সিদ্ধান্ত হোল।
    সেই মতো পরদিন সকালবেলা গ্রামের লোক একত্রিত হয়ে ঠাকুরমশায়কে সঙ্গে নিয়ে ভোলানাথের বাড়িতে হাজির হোল। তারা প্রথমে কুসুমকে ডাকতে থাকে। সাড়া না পেয়ে ভোলানাথকে ডাকে । কিন্তু তাতেও কোনো সাড়া না পেয়ে বাড়ির খিড়কি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে তারা ভোলানাথের ঘরে চড়াও হয়।
    ঘরে ঢুকে তাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। ঘরে বিয়ের দ্রব্যাদি থরে থরে সাজান। ভোলানাথ ধুতি পাঞ্জাবি পরে খাটের উপরে বসে পা দোলাছে আর কুসুমের মা লাল বেনারসি শাড়ি পরে কনের সাজে সেজে বিয়ের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সেখানেও কুসুমকে পাওয়া গেল না।
    -- এসব কি অনাচার হচ্ছে? এ সব এ গ্রামে চলবে না। জামাই-শাশুড়ির বিয়ে। ছিঃ! ছিঃ! সমাজ বলে কিছু থাকবে না।
    ভোলানাথকে জিজ্ঞাসা করে-
    -- বৌ কোথায়?
    কোন উত্তর না পেয়ে কুসুমের মা কে জিজ্ঞাসা করে-
    -- মেয়েকে কোথায় বেচে দিয়ে এসেছ?
    কোন উত্তর নাই। এবার মোড়লমশায় ক্ষেপে গিয়ে সেখানে জড়ো হওয়া ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে-
    -- এই, তোরা সবাই মিলে এই বিয়ের আয়োজন সব ভণ্ডুল করে দে। দেখি কে কি করে।
    মোড়লমশায়ের নির্দেশ পেয়ে কিছু অত্যুতসাহী ছোকরা ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করতে উদ্যত হলে, কুসুমের মা বেনারসির আঁচল কোমরে জড়িয়ে দরজার সামনে রুখে দাঁড়ালো।
    -- খবরদার! কেউ এক পাও এগোবেন না। আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব আমি দেব। তবে তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব আপনাদেরকে দিতে হবে।
    মোড়লমশায় বললেন-
    -- কি জানতে চাও তুমি? বল, আমারা জবাব দেব। কিরে, পারবি তো জবাব দিতে।
    মোড়লমশায় তার সাঙ্গপাঙ্গ দের উদ্দেশ্যে বলেন।
    -- হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি যা বলবেন তাই ঠিক।
    সমবেত উত্তর এলো।
    -- তাহলে শুরু করি। আমার প্রথম প্রশ্ন, একজন সদ্য বিধবা তার দুধের শিশুকে নিয়ে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, তখন তার ঘরে লম্পট, মাতাল ঢুকে তার ইজ্জৎ হরণের চেষ্টা করলে, আপনারা কোথায় থাকেন? তখন আপনাদের সম্মান নষ্ট হয় না? বলুন –
    কোন উত্তর আসে না।
    -- প্রশ্ন নম্বর দুই, আপনারা মাতব্বরি করেন দুর্বলের উপরে। তাদের সহায় হতে পারেন না। যদি সহায় হতে পারতেন, তাহলে নিজের সম্মান, মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য আমার ওই অল্প বয়সি মেয়ের বিয়ে ওই পিতৃতুল্য লোকের সঙ্গে দিতে হতো না। ওরা কেউ নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে নি, সে খবর রাখেন?
    সবাই এ ওর মুখের দিকে চায়। কার মুখে কথা সরে না।
    -- আর ওই ভালো মানুষটাকে আপনারা ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে এসেছেন, শোষণ করে এসেছেন। আজকের এই ঘটনার দায় আপনাদের, আপনাদের সমাজের।
    সবাই চুপ। কি বলবে ভেবে পায় না। হঠাৎ কুসুমের মা বাড়ির সদর দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে-
    -- ওই তো! আপনারা পিছন ফিরে দেখুন, এতক্ষণ যার খোঁজ করছিলেন সে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আপনাদের সব প্রশ্নের ‘উত্তর’।
    সবাই পিছন ফিরে দেখে কুসুম ! নতুন শাড়ি, হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর পড়ে একটি অল্প বয়সী ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। কুসুমের মা বলে -
    -- ওই ছেলেটি আপনাদের ভোলানাথবাবুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নে। শহরে কাজ করে। সব জেনেশুনে ও কুসুমকে বিয়ে করতে রাজি হয়। গত সপ্তাহে আমরা উকিলের বাড়িতে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে ওদের বিয়ে দিয়েছি। ওরা আজ সুখী। আর আজ আমাদের বিয়ে, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য। ওরা দুজন এসেছে আমাদের বিয়ে দিতে।
    ঠাকুর মশায় কে ইশারায় ডেকে বলল -
    -- চলুন ঠাকুরমশায়, আর ভয় নেই তো? আপনারাও চলুন, বিয়ের শেষে মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা আছে, মিষ্টি মুখ করে যাবেন।

    না, গ্রামের মাতব্বররা বা তাদের সাগরেদরা কেউ মিষ্টিমুখ করতে মন্দিরে যায় নি। তবে তারা গভীর রাতে মশাল হাতে পৌঁছে গেছিল ভোলানাথের বাড়িতে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরলে তারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ভোলানাথের বাড়িতে। আর পরেরদিন সকাল বেলায় উদ্ধার হয়েছিল দুটি ঝলসানো দেহ।

    ---xxx---
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন