পুণ্যার্থী, পর্যটক, পরিবেশ এবং…..
ঠাকুমার ঘোষণা
এক ছোট্ট ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সেবার বাড়িতে একেবারে হুলুস্থুল বেঁধে গেল। কী সেই ঘোষণা? আর কেইবা করলেন এই ঘোষণাটি? ঘোষিকা স্বয়ং আমাদের ঠাকুমা। তাঁর ইচ্ছে এবার তিনি তীর্থ ভ্রমণে যাবেন। তা হঠাৎ এমন ঘোষণা কেন? সকলের মনেই উঁকি দিতে থাকে নানান প্রশ্ন। কী এমন ঘটলো যে ভরা সংসার ছেড়ে তিনি তীর্থ দর্শনে যাবেন? তাঁর তীর্থযাত্রার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আলোচনা যখন একেবারে তুঙ্গে তখন একদিন ঠাকুমা ছোটখাটো একটা ঘরোয়া সভায় ঘোষণা করলেন – “তোমরা যা ভাবছো তেমন কিছু নয়। একটা সময়ের পর একটু ভগবানের কথা ভাবতে হয়। এমনটাই নিয়ম । এতে চিত্ত শুদ্ধি হয়। এমনটাই তো হাজার হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে। আমিতো তার বাইরে নই । আর তাছাড়া আমার এক গ্রাম সম্পর্কের বোন থাকে কাশীতে । অনেকদিন অবশ্য যোগাযোগ নেই । এখনও তো কিছু সময় আছে।ও ওখানে বাড়ি ভাড়া করে আছে । তাই ভাবছি কিছুদিনের জন্য বাবা বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণার আশ্রয়ে গিয়ে থাকবো।”
এরপরের কয়েকটা দিন ঠাকুমার কেটে গেল অন্যরকম এক ব্যস্ততায়। তীর্থযাত্রার জন্য নিজেকে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত করে নেওয়া। তীর্থ ভ্রমণের জন্য এরকম প্রস্তুতি নেওয়াটাই নাকি দস্তুর। তীর্থ ভ্রমণ তো আর দলবেঁধে পর্যটন অথবা পিকনিকে যাওয়া নয়।এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অন্যরকম এক আকুতি, অন্যরকম এক অনুভুতি। আমার যে বয়সে ঠাকুমা তীর্থ করতে গেলেন সেই বয়সে অবশ্য এমন সব গভীর বিষয়ে ভাববার মতো করে মন পেকে ওঠেনি। তবে চাওয়া পাওয়ার আবদারের হিসাবটা একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি। তাই ঠাকুরমার রওনা হবার আগের দিন তাঁর কোল ঘেঁষে শুয়ে আমাদের প্রশ্ন – আমাদের জন্য তুমি কী আনবে, ঠাকুমা?
পরদিন ঠাকুমা আর বাবা রওনা হলেন কাশীধামের উদ্দেশ্যে, তীর্থ যাত্রায়।
তীর্থ যাত্রার দর্শন
তীর্থ যাত্রাকে কীভাবে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি ? তীর্থ যাত্রাকে আমরা এক আধ্যাত্মিক যাত্রা বলে চিহ্নিত করতে পারি। মানুষের আন্তর সত্ত্বায় বিরাজমান ভক্তিভাবের এক বিনম্র অনুশীলন হলো তীর্থযাত্রা। এমন যাত্রায় উদ্দাম উল্লাস নেই, আছে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে পরমাত্মার নিবিড় আনন্দদায়ক সান্নিধ্য লাভ করা। তীর্থযাত্রীর শরীর ও মন এক ঐশী অনুভবে একীভূত হয়ে ওঠে। এক অনির্বচনীয় ভালোলাগায় ভরে ওঠে তীর্থযাত্রী শ্রদ্ধালু মানুষের মন।
তীর্থ যাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে নিগূঢ় ধর্মীয় ভাবাবেগ। এইদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, যে মানুষ যেদিন তার নিজের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে ওঠা কোনো প্রাকৃতিক শক্তির কাছে বশ মানতে বাধ্য হয়েছে সেদিন থেকেই মানুষের কাছে সেই শক্তি বিশেষ মান্যতা পেয়েছে। প্রথমে ভয়, তারপর ভক্তি এবং সবশেষে হয়তো ভালোবাসার অনুভূতিতে জারিত হয়েছে মানুষের মন। আর তাই একান্ত অবসরে মানুষ বেড়িয়ে পড়েছে তীর্থ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ঐ ধর্মীয় অনুষঙ্গের কারণেই সাধারণ ভ্রমণের থেকে তীর্থ ভ্রমণ যেন কিছুটা স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দাবি করে।
মন সুদূরের পিয়াসী
মানুষের মধ্যে যে ভ্রমণ পিয়াসী সহজাত সত্ত্বাটি
বিরাজমান তাকে উসকে দিতেই বুঝি তীর্থ ভ্রমণের আয়োজন। অমরনাথের হিমগুহার আবিষ্কার ভ্রমণের সূত্র ধরেই। পরে তার সাথে যুক্ত হলো ধর্মীয় ভাবাবেগ। পৃথিবীর সমস্ত প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসই এই তীর্থ যাত্রাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে তীর্থ সন্দর্শনে যাবার জন্য। একালে সরকারের তরফেও প্রোৎসাহিত করা হচ্ছে তীর্থ যাত্রাকে। কিন্তু কখনও কখনও বহিরাগত মানুষজনের দলবেঁধে এমন তীর্থ ভ্রমণে যাওয়া স্থানীয় মানুষদের জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিষয়টিকে নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে কাটাছেঁড়া করা যাক্।
চারধাম মাহাত্ম্য
ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে ঐতিহ্যবাহী সাবেকি চারধাম হলো যথাক্রমে বদ্রীনাথ, রামেশ্বরম, দ্বারকা এবং পুরী। আদি শঙ্করাচার্যের মতে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত এই চারটি তীর্থ স্থল হিন্দু শাস্ত্র দ্বারা নিরূপিত চারটি যুগের প্রতিনিধি স্বরূপ। যেমন বর্তমান উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত বদ্রীনাথ হলো সত্য যুগের স্মারক, তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম হলো ত্রেতা যুগের প্রতিভূ, গুজরাটের দ্বারকা ধাম দ্বাপর যুগের এবং ওড়িশা রাজ্যের পুরী ধাম কলি যুগের স্মারক। হিন্দুদের বিশ্বাস কোনো শ্রদ্ধালু ভক্ত মানুষ যদি ইহজন্মে এই পরস্পর বিচ্ছিন্ন চার চারটি তীর্থক্ষেত্র দর্শন করেন তাহলে তিনি মোক্ষ বা মুক্তি লাভ করবেন। এই বিশ্বাসেই এতোদিন স্থিতধী ছিলাম আমরা। এখনও যে নেই সেকথা একেবারে হলফ করে বলতে পারি না। তবে হালফিলের মিনি চারধাম সম্ভবত শঙ্করাচার্যের আদি চার ধামের কৌলীন্য খানিকটা খর্ব করেছে। কুড়ি ওভারের মারকাটারি ক্রিকেটের কারণে সাবেকি টেস্ট ক্রিকেট যেমন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তেমন আর কি!
এই যুগটা নাকি তুড়ন্ত কাজ হাসিলের যুগ। ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগ পিছু হটছে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার কাছে। সবকিছু চটজলদি দেখে নেবার তাগিদ থেকে বাড়ছে তথাকথিত সার্কিট ট্যুরিজম। আর ভ্রামণিক মানসিকতার এমন চমকপ্রদ পরিবর্তনের সূত্র ধরেই এই গরমে প্রায় একই হাতায় অবস্থিত চার চারটি জায়গায় - যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী,কেদারনাথ আর বদ্রীনাথ - হৈ হৈ করে ঢু মারছেন লাখো হাজারো পর্যটক থুরি তীর্থযাত্রী। এতে সুবিধা অনেক। সময় লাগছে কম
খরচের বহর কম, এক ধকলে চার চারটি ধাম দর্শনের পুণ্য অর্জন তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয় বাপু! ব্যস্ততার কালে লোকজনের কাছে এতো সময় কোথায় দেশের চার প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চারধাম দর্শনের? তারচেয়ে এই ভালো – দলবেঁধে পর্যটক হয়ে যাওয়া আর দিন দশেকের মধ্যে পুণ্যের পুঁটুলি বেঁধে ঘরে ফিরে আসা। গেলুম দেখলুম ফিরে এলুম। টেইলর মেড ইটিরিনারি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা।
এককালে এই চার মন্দির পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাতেই পরম আনন্দ আর তৃপ্তি পেতেন সংস্কারপন্থী পর্যটক তথা পুণ্যার্থীরা। দুর্গম পর্বতসঙ্কুল পথে চলার ঝুঁকি ছিল ভরপুর। সেই সব বাধা অতিক্রম করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর পুণ্যার্থী হৃদয় অপার আনন্দে ভরে উঠতো। সাধারণ পর্যটকদেরও প্রাপ্তি কম হতো না। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পর্বতের শোভা হৃদয় মন ভরিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করতো না।
এখন জমানা বিলকুল বদলে গিয়েছে। সরকারের উচ্চাভিলাষী পাহাড় জোড়ো পরিকল্পনা কেবল পাহাড়ের পরিবেশকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়নি, সঙ্গে সঙ্গে ঐ অঞ্চলের মানুষের জীবনেও নামিয়ে এনেছে উন্নয়নের সংকট। জীবন ও জীবিকার ছন্দোময় শৃঙ্খলায় আজ টানাটানির বিশৃঙ্খলা। বিগত বছরগুলোর ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা বিস্মৃত হয়ে যে ভাবে কংক্রিট, অ্যাসফল্ট আর জেসিবি মেশিনের দাপাদাপি চলছে তথাকথিত দেবভূমে তাতে পদে পদে আশঙ্কা জাগে মনে। প্রায় স্বঘোষিত দেবভূমি সার্কিট ট্যুরের জোয়ারে একেবারে ওষ্ঠাগত প্রাণ ঐ অঞ্চলের মানুষের।
কেমন আছেন দেবভূমের দেবতারা ? ভালো নেই,
মোটেই ভালো নেই। কেন বলছি এমন কথা? আসুন একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরে আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি। এই সাংখ্য তথ্য একটি দৈনিক সংবাদপত্রের বদান্যতায় সংগ্রহ করা।
বছর তীর্থ যাত্রীর সংখ্যা
২০১৯ ৩৪,১০,০৩৫
২০২১ ৪৬,২৭,২৯২
২০২৩ ৫৬,১৮,৪৯৭
২০২৪ ১২,২৭,৭৪৮ ( ১০ –২৭ মে সময়কালে)
মাত্র এক পক্ষ কালের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষাধিক মানুষের ‘হড়পা’ জোয়ার গিয়ে আছড়ে পড়েছে ঐ
ছোট ছোট পাহাড়ি জনপদের ওপর। এরফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ঐ সব অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রা। এমনটা যে খুব স্বাভাবিক পরিণতি তা বোঝার জন্য পণ্ডিত হতে হয়না। এই পার্বত্য তীর্থস্থানগুলোর সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো যে সারা বছর জুড়ে এই স্থানগুলোতে যাওয়া যায় না। শীতের সময় এই তীর্থ স্থানগুলো সব বরফে ঢাকা থাকে। মন্দিরের বিগ্রহদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। এপ্রিল মাস থেকে যাত্রীদের পদসঞ্চারের ফলে নতুন করে গমগম করতে থাকে সমগ্র পাহাড়তলি। এমন প্রথা বহুদিনের।
তীর্থ স্থান মানেতো শুধু মন্দির নয়, মন্দিরকে ঘিরে গড়ে ওঠে অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য নানান পরিষেবা ব্যবস্থা – ফুলের দোকান, প্রসাদের ডালি, নানান ধর্মীয় ক্রিয়া কর্মের জন্য প্রয়োজনীয় উপাচারের দোকান, জলখাবার থেকে মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজ বিক্রির হোটেল, ধর্মশালা,লজ , আশ্রম ,ট্যুর অপারেটরদের অফিস মায় হেলিপ্যাড ইত্যাদি। এই সব আয়োজিত ব্যবস্থাপনা তথা পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেই বলতে পারি এসব হলো মন্দির কেন্দ্রিক এক পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্যাকেজ -ইকোনমিক ইনসেনটিভ। প্রশ্ন হলো এসব কি আগে ছিলনা? নিশ্চয়ই ছিল। তবে তার আয়োজনের বহর একালের মতো মোটেই বাঁধনহারা ছিল না। স্থানীয় মানুষজনের কথায় ২০০০ সালের পর থেকে এই সব তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের দাপাদাপি বহুগুণ বেড়ে চলেছে যা এককথায় বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে গোটা অঞ্চলটিকে। এই সত্যকে তো আড়াল করা যাবেনা যে এই নবঘোষিত চারধাম যাত্রা সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থ বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
বেড়ানোর বেওসা
বিগত বিজেপি সরকারের আমলে ঘোষিত চারধাম সড়ক সংযুক্তি প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। উত্তরাখণ্ডের চার প্রধান তীর্থক্ষেত্র বা ধামকে একটিমাত্র প্রধান সড়কপথের মাধ্যমে যুক্ত করার
কথা ঘোষণা করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নপ্রকল্প রুপায়ণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১২০০০ কোটি টাকা। প্রধান সড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে অসংখ্য বাইপাস, সেতু, ভায়াডাক্ট, পিট স্টপ, পার্কিং লট, হেলিপ্যাডের মতো অত্যাধুনিক সহযোগী পথ-পরিষেবা ব্যবস্থা। ৭১৯ কিমি দীর্ঘ ১০ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই মূল সড়কপথটি যুক্ত করবে একাধারে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথধামকে। এমন একটা সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ যে উত্তরপ্রদেশের নদীবিধৌত সমতলপৃষ্ঠবিশিষ্ট সমভূমিতে হচ্ছে না সে কথা বুঝবে কে? হিমালয়ের মতো অতি সংবেদনশীল, ভঙ্গুর পীঠভূমির উপর যে কোনও নির্মাণই অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল, বিপজ্জনক; কিন্তু সে কথা শুনছে কে? মানছে কে? ‘বিকাশ পুরুষে’র স্বপ্নকে সাকার করে তুলতে গিয়ে আগামী দিনে আরও কত বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে মানুষকে কে জানে ?
আগেই বলেছি ২০০০ সালে সাবেক উত্তরপ্রদেশ রাজ্য ভেঙে উত্তরাখণ্ডের সৃষ্টি হবার পর থেকেই এই পর্যটনের হুজুগ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। তাই প্রশাসন ভেবেছিল পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লে স্থানীয় মানুষদের কিছু আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এমন ভাবনায় কিছু ইতিবাচক দিক নিহিত থাকলেও বাস্তবে তা বুমেরাং হয়ে যায়। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন নি যে এখন যারা পাহাড়ে যাবে তাঁরা কেউই সাবেক আমলের শ্রদ্ধাবনত তীর্থযাত্রী নন, এরা প্রত্যেকেই হচ্ছেন বিলাসী ট্যুরিস্ট। এদের কাছে দলবেঁধে মস্তি আগে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের বাসনা গৌণ।
এই বছর চারধাম যাত্রা নিয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগ উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেকেই এমন হুপুইয়ের পেছনে বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রচারকে দায়ি করেছেন। অলক্ষ্যে এমন মন্তব্যও করছেন কেউ কেউ যে, “ইসিবার চারশো পার” হলে আর দেখতে হতো না! ২০১২ সালের মতো পাহাড়গুলোকেই তাহলে সাবড়ে দিতে কসুর করতো না ওরা। অভিযোগ কেবল নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তিথি নক্ষত্রের পরোয়া না করে এগিয়ে আনা হয়েছে মন্দির খোলার সময়। ১২ মে তারিখে যখন বদ্রীনাথ মন্দির খোলা হয় তখনই মন্দির প্রাঙ্গণে হাজির ২০০০০ মানুষ, যেখানে সর্বাধিক ৫০০ জন উপস্থিত থাকতে পারে। এই ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্তাদের নাজেহাল অবস্থা। বারবার ঘোষণা করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মন্দিরে দর্শনের সুযোগ আছে। আপনারা অযথা ভিড় বাড়াবেন না। কলকাতায় দুর্গাষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেবার জন্য যেমন হামলে পড়া অবস্থা হয় এও যেন ঠিক তাই। কে আগে ভিড় ঠেলে দেবতাদের অনুগ্রহ লাভ করবে , তার লাগি কাড়াকাড়ি। এমন সব মানুষদের কাছে দেখনদারিই সব , ভক্তি শ্রদ্ধা ত্যাগ তিতিক্ষা এসব এদের কাছে অসার।
চলো নিয়ম ভেঙে
মানুষজনের হাতে এখন দুটো বাড়তি পয়সা এসেছে, তাই এখন ধরাকে সরা জ্ঞান করতে লেগেছে লোকজন। এই মানসিক পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে বিলকুল ওয়াকিবহাল ট্যুর অপারেটর থেকে শুরু করে হোটেল ও লজের মালিকরা, গাড়ির মালিকরা, ছোটখাটো দোকানি থেকে শুরু করে পাণ্ডা পূজারী সকলে। অবাক হবার কিছু নেই। যেকালের যেমন নিয়ম । সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। যে পথ একদিন সহিষ্ণু পদক্ষেপে পাড়ি দিয়েছেন পুণ্যার্থীরা, আজ সেই পথেই চলছে শ’য়ে ,শ’য়ে হাজারে হাজারে গাড়ি। পাহাড়ি এলাকায় যন্ত্র যানের এমন সরব, স্পর্ধিত গতায়াতের ফলে মাঝেমাঝেই সৃষ্টি হচ্ছে ধস, বা ভূমি স্খলন। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে পুরোদমে। এতেই শেষ নয়। রাস্তার ওপর যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ কমানোর অজুহাতে পাহাড় কেটে সমতল করে তৈরি করা হয়েছে হেলিকপ্টার ওঠানামার জন্য হেলিপ্যাড। এ সবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ঐ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের ওপর। এই মুহূর্তে পর্যটনের প্রসারে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের উদ্যোগ বা তৎপরতা বেড়েছে। পর্যটনের স্বার্থে আপোষ করা হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের সঙ্গে।
এই মুহূর্তে দাবানলের শিকার হিমাচল ও উত্তরাখণ্ডের বিস্তির্ণ অঞ্চল। স্থানীয় মানুষদের জীবনে নেমে এসেছে গভীর অশনি সংকেত। নিজেদের জান মালের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যস্ত মানুষজন। এই অবস্থায় বিপুল সংখ্যক পর্যটকদের আনাগোনা গোটা বিষয়টিকেই আরও ঘোরালো, অসহনীয় করে তুলেছে। রাস্তায় রাস্তায় বেড়েছে যানজট যার জেরে ব্যাহত হচ্ছে দৈনন্দিন সাধারণ নাগরিক পরিষেবার কাজ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন পৃথিবীর পর্বতগুলো হলো মিঠা জলের ট্যাঙ্ক, তাদের পরিবেশের শুদ্ধতার ওপর নির্ভর করে দেশের মানুষজনের জন্য প্রয়োজনীয় পেয় জলের জোগান। আজ পর্যটন অথবা উন্নয়ন প্রকল্পের দাপাদাপিতে সেই জলের ভাণ্ডারগুলো যদি চিরকালের মতো হারিয়ে যায় তাহলে আগামীতে কী হবে? এসব কথা আজ আর নিছক আশঙ্কায় সীমাবদ্ধ নেই, সাম্প্রতিক কালে তার প্রমাণ পাচ্ছে মানুষ। হিমালয়ের এই সব অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষজনের জীবনে বস্তু সম্পদের বাহুল্য ছিলনা, ছিল আনন্দ, সরলতা, বিশ্বাস, ভালোবাসা। আজ বহিরাগত মানুষজনের দর্পিত অভিঘাতে একে একে ভেঙে পড়ছে মানবিকতার বহু দিনের স্তম্ভগুলো।
আজ গোটা দুনিয়া জুড়েই প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন স্থানীয় আবাসিক মানুষজন। পর্যটনের স্বার্থে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, কোনো অঞ্চলে যথেচ্ছ ভাবে পর্যটকদের দাপাদাপি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কেননা সাবেক আমলের পুণ্যার্থীদের তুলনায় একালের পর্যটকদের মনোভাবের গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। এঁরা বাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়েও বাড়ির ঊণকোটি চৌষট্টি স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করতে চান । এইসব হুজুগে পর্যটকদের অধিকাংশেরই স্থানীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, লোকজীবন সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা নেই, জানার আগ্রহও নেই। এমনসব মানুষদের ছেড়ে যাওয়া বর্জ্য পদার্থের স্তূপে ভরে উঠছে পাহাড়তলির রাস্তা ঘাট, মাঠ ময়দান সব। ফলে এমন হুজুগে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লে স্থানীয় মানুষদের সুবিধার থেকে অসুবিধাই বেশি। তাই সমবেত কণ্ঠে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে দিকে দিকে। দাবি উঠেছে দায়িত্বশীল পর্যটকদের আলাদা করে চিহ্নিত করার। ভারতের মতো দেশে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন সুদূর পরাহত।
আরও একটি বিষয় নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে তা হলো পর্যটনের প্রসারে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, প্রত্যেক অঞ্চলেরই একটা নির্দিষ্ট জন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। বিশেষতঃ পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত জনপদগুলো কোন সময়েই অনেক অনেক মানুষের চাপ সামলাতে সক্ষম নয়। প্রকৃতিগতভাবেই এই সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। রাতারাতি এর ব্যবস্থা করতে হলে গোটা ব্যবস্থাপনা নেড়েচেড়ে নষ্ট করে ফেলা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাময়িক লাভের লোভে পড়ে আমরা তিলতিল করে গড়ে ওঠা সুস্থিত টেকসই ব্যবস্থাপনাকেই বিলকুল সাবড়ে দিতে কসুর করছি না। হালফিলের হোম স্টে ব্যবস্থার যথেচ্ছ সম্প্রসারণ এরই উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
কি আছে উপায়?
এই বছরের প্রচণ্ড তাপদাহের শিকার সমগ্র বিশ্ব।
এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে আমাদের দেশের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তীয় রাজ্যগুলোতে। গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই দলে দলে মানুষ একটু স্বস্তির আশায় ভিড় করেছে শৈল শহরের আশ্রয়ে। এমন চিন্তায় কোনো ভুল নেই। প্রশ্ন হলো, এতো মানুষ যদি একটু মজা লুটতে এক জায়গায় ভিড় করে তাহলে তা ভ্রমণের আনন্দকেই মাটি করে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে প্রথম মানুষ পৌঁছে ছিল কত কৃচ্ছ সাধনের পর। আর এ বছর শৃঙ্গে পা দেবার জন্য প্রতীক্ষু মানুষের লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছিল। সার্কিট ট্যুরিজমের এমন দাপাদাপিতে বিনম্র পুণ্যার্থীদের সাথে সাথে পরিবেশ পরিমণ্ডলেরও যে নাভিশ্বাস উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কি!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।