এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ডাইনি

    আফতাব হোসেন লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ জুন ২০২৪ | ১৫৯ বার পঠিত
  • আমাদের গ্রামে আজও বুধবার হাট বসে। গ্রামের হাট। বড় হাট। হাটের ঠিক পাশেই যেখানে বাঁশ ডালের ঝুড়ি গুলো নিয়ে কালো কালো পাথরের মত মেয়েগুলো বসে থাকে 20 টাকা জোড়া ঝুড়ি বিক্রি করার জন্য তার ঠিক পাশেই সালকু বসেছিল। দুটো মুরগি নিয়ে। দেশি মুরগি।খুব টেস্ট। চোখ গুলো পাথরের মত করে একের পর এক খদ্দের কে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। কয়েকজন খদ্দেরকে তো বলেও দিল ‘বিক্রি করবোক নাই, মোর মর্জি’।

    এই নিয়ে তিনদিন।

    ⁂⁂⁂⁂

    ‘‘ভাদু আমার গরবিনী,
    ওগো আমার ভাদুমনি,
    মাথায় দিবো সোনার মুকুট,
    শাড়ি দিবো জামদানী........।’’

    নিজের মনেই গাইছিল বিহু। বিহু সরেন। সালকুর মেয়ে। ওই যে পুরুলিয়া শহর থেকে ট্রেনে চেপে মেদিনীপুরের আগের যে ছোট্ট একখানি স্টেশন, সরকার নাম দিয়েছে জঙ্গলমহল। আসল নামটা অবশ্য ভাদুতলা। কেউ বলে ভাদুরানী এখানেই জন্মেছিল আবার কেউ বলে ভাদুঠাকুরের আশীর্বাদ আছে জায়গাটার। ওই খানেই একটু দুরেই মোস্তাক চাচাদের যে পাথর খাদান টা যেখান থেকে জঙ্গল শুরু ঠিক সেখানেই বিহুদের ঘর। ঘরে থাকলে রোদটা যখন মাথায় ওঠে তখন সালকু হাঁক পাড়ে

    — ‘‘বিহু বুড্ডি ঘরে আই লো,কুছু খ্যাইয়ে লে’’।

    বাবার ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে পালাতে গিয়েও ‘লতা’আর ‘পাতার’ দিকে তাকিয়ে একবার চোখ নাচিয়ে ধমকে দেয় বিহু —

    ‘ দেখ লতা পাতা মোর মাথা খাবিক নাই, ফিরে আইস্যে যদি দেখতে পাই পুরাটা খাস নাই তালে কিন্তু খারাপ হুবে ’।

    ⁂⁂⁂⁂

    অনিতা বুড়ি চোখে খুব একটা দেখেনা আজকাল। শীতের শুরুটাতেই যখন কুয়াশার দাপট শুরু হয় তখনই বুড়ির হাঁপানির কাশি টা বড্ড জ্বালায়। ঘ্যানর ঘ্যানর আওয়াজে সালকুর বউ এর ঘুমটা মাঝরাতে যখন চটকে যায় ঠিক তখনই সালকুর সোহাগ জাগে। সিংহের হাতে পিষতে দিয়ে হরিণ হয়ে যখন সালকুর সিংহাসনের রানী হয় বিহুর মা তখন কানের সামনে এসে ফিসফিস করে বলে

    ‘‘বুড়ির একটো বডিস কিইনা দিস, উদোম গায়ে বুড়ি এই সালের ঠান্ডাটা পেরোতে লারবেক’’।

    ⁂⁂⁂⁂

    সুবল কে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে সালকু বলে 'ইবার একখান কাম দে সুবল, কুনু কাজ পাইনাই তো, তুই পঞ্চদের একজন বটে, বউ মেয়া নিয়া কি না খ্যায়ে মরবক '

    সুবল মাঝিও দামড়ে উত্তর দেয় —
    ‘‘তোরা মারলি কেনে ম্যায়াটাকে ?
    তোদের কে সরকার বাড়ি দিল। কাম দিল। ফ্রি রেশন দিল তাও মারলি কেনে ম্যায়াটাকে।’’

    সুবল তোতলিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে বলে, ‘‘বুরাবাবার কসম,তুই বিশ্বাস কর উহাকে আমরা মারি নাই, উকে ডাইনি খ্যায়েছে, পুরা পাড়া জানে উটাও ডাইনি ছিল বটে, লখখির ম্যায়াটাকে উটাই খ্যায়েছিল, সুনীল এর সোমত্ত বউ টাকেও উই খ্যায়েছিল। আমরা কুছু বলার আগেই উ নিজেই পুড়েছে।’’

    ‘ওসব বলে কুছু হবে নারে, বিডিও বাবু নিজে কেস দেখছে। সব না মিটা মিটি হলে তোর গ্রামের কেউ কাজ পাবেক নাই’, সুবল বলে।

    ⁂⁂⁂⁂

    মোস্তাক চাচার নজর খানি বাদ দিলে লোকটা সালকুদের কাছে ভগবান। সালকুদের পুরা পাড়ার মেয়েরা চাচার পাথর খাদানে কাজ করে। বুড়োর বিয়ে থা হয়নি। উপোষী চোখে মেয়েগুলোকে গিললেও টাকা পয়সার ব্যাপারে ফাঁকি দেয় না। বলে, ‘আমাগো হল গিয়া মুসল্লিম ঈমান, বুঝলা, এখন চুরি করল্যা আল্লাগো কি মুখ দেখাবু’। সালকুর বউ কে আবার মাঝে মাঝে দু চার পয়সা বেশি দেয়। বলে, ‘বুকা এগুলা আমাগো যাকাত বলে, নে নে আমার নেকি হবে বলে চোখটা একবার বুকে বুলিয়ে নেয়’।

    ⁂⁂⁂⁂

    সকালের পান্তা আর লঙ্কা খাওয়ার পর কাজে যাবার আগে বিহুকে পই পই করে সংসারের সব খুঁটিনাটি বুঝিয়ে যায় সালকুর বউ।

    পুকুর পাড়ে স্নান করার সময় যেদিন নিজের শরীরে রক্ত দেখেছিল বিহু সেদিন থেকেই ও আর বাচ্চা নেই। সংসারে কত্ত কাজ। ঝাঁটা দেওয়া,উঠোনে গোবর লেপা, তারপর বুড়িকে খাওয়ানো, বাসন ধোয়া, মায়ের জন্য খাবার পৌঁছান, বাপ রে বাপ। চাট্টিখানি কাজ। ভাগ্যিস লতা পাতা আছে। সব কাজেই পায়ে পায়ে ঘোরে ওরা। বিহু মাঝে মাঝে বকুনিও দেয় —

    — ‘ কই রে লতা পাতা এই ঝাঁট দিলাম আর লংরা করিস নি রে তালে তোদের কেটে খাবো ’।

    — ‘ লতা পাতা খ্যাইলি ’।

    — ‘ লতা পাতা দেখতো বুড়ি কি করে ’।

    — ‘ লতা পাতা ঝগড়া করবিক নাই নিজেদের মাঝে তোরা দু বোন না। এইটুকুনি থ্যেকে তুদের পালছি। লড়বিনা একবারে ’।

    ⁂⁂⁂⁂

    আগের বুধবার থেকে মোস্তাক চাচার খাদান বন্ধ। চাচার নাকি করুণা হয়েছে। সবাই বলাবলি করছিল বুড়া আর বাঁচবেনি। আগের সপ্তাহ এর বেতন ও বাকি। কেউ আর ওমুখো হতে সাহস করছেনা। সব্বাই বলছে কাছে যে যাবে সেও মরবে।

    রাতে সালকুর বুকের ওম নিতে নিতে বিহুর মা ই বললো ' হ্যাগো পূজাই কুছু দিবেন না ম্যায়াটাকে, বড় হুছে, একখান বডিস ওর ল্যাগেও লাগবেক, কত্ত আশ কইরে আছে পূজায় লিবে '। সালকু বলে ' পয়সা কুথায় বউ, মোর তো কামই নাই, চাচাও তো দিল নাই কুছু, তবে তোর চিন্তা নাই,কাল হাট বার, যেমন কইরে হোক সব লিয়ে আসবো '।

    ⁂⁂⁂⁂

    তিনদিন চেষ্টা করেও সালকু বিক্রি করতে পারেনি লতা পাতাকে, শুধু বিহুর কথা মনে হয়েছে। আজ জোড়া 600 টাকার লোভ আর ছাড়েনি।

    সব কিনেছে হাট থেকে। সওওব।

    বিহুটা বড্ড খুশি হবে।

    ⁂⁂⁂⁂

    বাইরে থেকে সুবল মাঝি জোরে জোরে ডাকাডাকি করছে —

    ‘ কি রে সালকু আছিস নাকি, বি ডি ও বাবু নিজে এসেছে, বিহু কে দেখতে, কই রে, অনেক রিপোর্ট গেছে তোর পাড়ার, বের কর বিহুকে, তোদের কুনু চিন্তা নাই, সাহেবরা নিজে আইসেছে ’।

    ⁂⁂⁂⁂

    বিহুর আজ রক্তস্নানের দিন। এক নাগাড়ে রক্ত গঙ্গা বইছে দু পায়ের ফাঁকে। সাথে অনেক দিন না ঘুমানো লাল চোখ খুলে একনাগাড়ে বলেই চলেছে —

    “ কই রে লতা পাতা খ্যাইলি, লতা পাতা দেখ তো বুড়ি কি করে, লতা পাতা লংরা করবিনা, তালে তোদের কেটে খাবো ”

    ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে সালকুর বউ —

    “ মোদের ম্যায়াটা ডাইনি হয়ে গেল গো ”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন