এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সরস্বতী পূজো এবং ভ্যালেন্টাইনস ডে

    Himadrisekhar Datta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৮৯ বার পঠিত
  • আজকে সরস্বতী পূজো। বসন্তের পঞ্চমী তিথি। মাঘি শুক্লা। ছোটবেলায়, দুর্গাপূজার পরে, যে দেবীর পূজো মনের একেবারে গভীরে জায়গা পেয়েছিল, তা এই পূজা। বাড়িতে মা ফ্রেমে বাঁধানো ফটো নামিয়ে, আসনে বসিয়ে, নানা উপাচারে, নিজেই পূজো করতেন। মা'য়েরা ছিলেন চক্রবর্তী ব্রাক্ষ্মণ।  সেদিক থেকে হয়ত তার বিবাহ পশ্চাতেও পূজো আচ্চা (আচরণের ছোট রূপ) করাটা তেমন অধর্মের কিছু ছিল না। আর আজকের যুগে তো নয়ই। এখন তো যে কোন জাতের লোক মন্দির বা পূজার সংকল্প করতে পারেন। আমি অবশ্য এসব মানি না, তবে সনাতন প্রথা অনুসারে কারটা সিদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হবে, তা কে বলতে পারে?  সনাতনের মানে খোঁজার চেষ্টায় আছি - কিছু কিছু জ্ঞান লাভ হয়েছে, তবে পরিপূর্ণ হয় নি। অনেক ধন্ধ মেটানোর এখনও বাকি। যাই হোক ছোট বেলায় বাড়িতেই সরস্বতীর আসনের দু-পাশে, আমাদের দুই ভাইয়ের বইপত্র জমা হয়ে যেত। আমার জমার তাকে প্রথমেই থাকত, অঙ্কের বই, তারপরে ফিজিক্স। এদুটোই আমার জন্যে লোহার চানা চেবানোর মত কঠিন ছিল। আজও স্বপ্নে,পরীক্ষার হলে,অঙ্কের পেপার হাতে নিয়ে ঘামতে থাকি। ঘন্টা পড়ে যায়, সাদা খাতা জমা দিয়ে চলে আসি।
    একটু আলোচনা থেকে সরে যাচ্ছি-এই দুচার লাইন, তারপরে আজকের মোদ্দায় না'কি মুদ্দায় ফিরব। মুদ্দা আসলে ঊর্দূ কথা,বাঙালিরা,সিলেটিরা ছাড়া, সাধারণ শব্দে উ-লাগায় না। তাই মুদ্দা আমাদের জন্য মোদ্দা। মোদ্দা কথাটা বোঝা গেল আশা করি। এই যে অঙ্কের প্রতি ভয়, সেটা আমার বিগত কোন জন্ম থেকে,আমার মধ্যে ঢুকেছে,আজকাল তা বেশ সহজেই জানা যাচ্ছে। তার জন্য পি এল আর এক্সপার্টের কাছে যেতে হবে। পি এল আর কথাটার পুরো অর্থ হল *"পাস্ট লাইফ রিগ্রেশন"*।
    এতে আপনার সমস্যা, যা এই জীবনে চলছে, তার কারণ এবং নিদান দুটোই জানতে পেরে যাবেন। এটা এখন হিপনোসিসের মতই, মেডিকেল সায়েন্সে গ্রাহ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে। আমার আপনার সাব কনশাস মাইন্ডের ভেতরে ভ্রমণ করায়, রি পি এল আর। যা আমরা রোজই দেখি রাতে বা দিনে ঘুমের মধ্যে - স্বপ্ন। তফাত একটাই, স্বপ্ন নিজের মত চলতে থাকে, পি এল আর নির্দেশ মেনে চলে।
    যাই হোক, আগের কথায় ফিরি। আরোও একটু যখন বড় হলাম, তখন মা দীক্ষা নিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানে আমাদের যাতায়াত শুরু হয়, মায়ের মাধ্যমেই। সেখানে বিরাট এবং অতি সুন্দর একটি সরস্বতী দেবী প্রতিমা ছিল। মনে হত জ্যান্ত। এখুনিই নাম ধরে যেন ডাকবে। আমি সেই সরস্বতীকে দেখে সত্যি বলছি ভালোবেসে ফেলে ছিলাম। আমার নিজের,একান্তই নিজের বলে তাকে ভাবতাম। আপনারা কেউ আমার বাড়ি এলে, আমি সেই সরস্বতীকে দেখাতে পারি। তখন বুঝে যাবেন, এক সদ্য কিশোরের মনে ওই মূর্তির ভাব কতটা বিস্তার করতে পারে।  এই ভাবেই বড় হচ্ছিলাম৷ তারপরের কাহিনী অনেক বড়, এখানে বলার নয়।
    আজকের সরস্বতী পূজার দিন, এই ৬৭-বছর বয়সে, এসে একেবারেই মন খারাপ করিয়ে দিল। পড়াশুনোর পাট এখন অনেকটাই সেকেন্ডারি, কিন্তু প্রতিমা পূজা আর তার প্যান্ডেল- আলোকসজ্জা ঝমঝম করে বেড়ে গেছে৷ আয়োজকের ৯৯ ভাগের সাথে বই খাতা স্কুল কলেজের কোন সম্পর্ক নেই। হলুদ পাঞ্জাবি, হলুদ শাড়ি বা ফ্রক (আজকাল গরীব আর খুব বড়লোকেরাই পরে), শ্যাম্পু করা বা রং-করা লাল চুল আর ডিও-র বগল সজ্জা করে সকলে রাস্তায়। অঞ্জলি দিশ নি, জিজ্ঞাসা করলে বলবে, সে তো সকাল সকালেই শেরে দিয়েছি। পড়াশুনো না করা ছেলে মেয়ের দল আমাদের সময়ও ছিল - কিন্তু তারা ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই অবস্থার শিকার ছিল। আর ছিল, শ্রীকান্তের মেজদার মত কিছু ছেলে। যারা শুধু বার বার ফেলই করত। কিন্তু একটা শ্রদ্ধা আর ভক্তির ভাব তাদের আচরণে ফুটে উঠত। হয়ত, এখনও তাই হয়, আমার চোখ দিয়ে দেখার দোষ হয়ত। কিন্তু অনুভুতিও কি ধোকা দিচ্ছে আমাকে?  প্রশ্নটা থেকেই যায়।
    এ বছরে সরস্বতী পূজার ডেট আর বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডেট একসাথে সমপাতিত। পতিতই বোধহয় ঠিক হবে বললে। রোজ (rose) থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে পর্যন্ত পৌঁছাতে, কতগুলি স্টেপ অতিক্রম করতে হয় আমার কারেক্টলি জানা নেই। খুঁজলেই পাব, কিন্তু আমি জানতে চাই না। কিন্তু যারা এই নিয়ে মত্ত, প্রায় উন্মাদ অবস্থা, তাদের সবিনয়ে ভ্যালেনটাইন দিন সম্বন্ধে জানাতে চাই।
    যদি বর্তমান প্রজন্ম পড়ে, তাহলে তাদের আনন্দ উৎসবের হয়ত কিছুটা রাশ টানা সম্ভব হবে। তবে, সারা পৃথিবী জুড়ে এই দিবস উপলক্ষ্যে যে বাজার, যে ব্যবসা তা প্রতিহত করার সাহস বা ক্ষমতা আমার নেই। সরস্বতী পূজা তো আর সারা পৃথিবী জুড়ে হয় না।
    ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পটি শুরু হয় অত্যাচারী রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এবং খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দিয়ে। তৃতীয় শতকে সম্রাট ক্লাডিয়াস সমগ্র রোমানবাসীকে মাত্র ১২জন দেব-দেবীর আরাধনা করার নির্দেশ দেন।
    সেসময় রোমে এবং রোমান সাম্রাজ্যের আওতায় থাকা অঞ্চলে বা দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা ছিলো কাঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি খ্রিস্টানদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্যও, শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।
    এদিকে, সাধু ভ্যালেন্টাইন ছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। মৃত্যুর ভয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম পালনে পিছপা হননি। তার ফলে যা হবার তাই হলো, সম্রাট ক্লাডিয়াস তাকে কারাগারে বন্দি করে রাখলেন। বাকি সারা জীবন তিনি বন্দী অবস্থাতেই ছিলেন। প্রভু যীশুর সাধনা এবং প্রার্থনায় তার দিন-রাত অতিবাহিত হত। ক্লডিয়াস তাকে কেন সঙ্গে সঙ্গেই মেরে ফেলেন নি, এও এক আশ্চর্য্য ব্যাপার।
    ভ্যালেন্টাইনের জীবনের শেষ সপ্তাহগুলোতে ঘটলো এক জাদুকরী ঘটনা। তিনি যে কারাগারে বন্দি ছিলেন সেখানকার কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনের প্রজ্ঞা দেখে মুগ্ধ হন। কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনকে জানান, তার মেয়ে জুলিয়া জন্মগতভাবেই অন্ধ, ভ্যালেন্টাইন তাকে একটু লেখাপড়া শেখাতে পারবেন কিনা।

    জুলিয়া চোখে দেখতে পেত না, কিন্তু সে ছিল খুব বুদ্ধিমতী। ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে রোমের ইতিহাস পড়ে শোনাতেন,পাটিগণিত শেখাতেন। মুখে মুখে প্রকৃতির বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতেন ও ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত বলতেন। জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনের চোখে দেখতেন অদেখা অজানা পৃথিবীকে। তিনি ভ্যালেন্টাইনের জ্ঞানকে গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন, ভ্যালেন্টাইনের শান্ত প্রতিমূর্তি ছিলো জুলিয়ার শক্তি।
    একদিন জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করেন-
    -    ভ্যালেন্টাইন, সতিই কি ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন?
    -    হ্যাঁ, তিনি সবই শোনেন।
    -    জানো, রোজ সকাল আর রাতে আমি কি প্রার্থনা করি? প্রার্থনা করি, যদি আমি দেখতে পেতাম। তোমার মুখ থেকে আমি যা যা দেখেছি তার সবই আামি দেখতে চাই ভ্যালেন্টাইন।
    -     আমরা যদি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি তাহলে তিনি আমাদের জন্য যা ভালো তার সবই করেন। ভ্যালেন্টাইন উত্তর দিলেন।
    এভাবে প্রার্থনা করতে করতে একদিন জুলিয়া ঠিকই তার দৃষ্টি ফিরে পেলেন। কিন্তু সময় ঘনিয়ে এসেছে ভ্যালেন্টাইনের। জুলিয়ার এই দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ায়, খৃষ্টের জয়গান, সাধু ভ্যালেন্টাইনের জয়গান করতে থাকে খৃষ্টানরা, সামান্য রোমবাসীরাও। এতে ক্রুদ্ধ ক্লাডিয়াস, তখনই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দিন ধার্য করলেন। দিনটি ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ অব্দ। মানে যিশু জন্মাবার ২৭০ বছর পরে।
    মৃত্যুর আগের দিন ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির শেষে লেখা ছিলো, ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু কার্যকর হয় ও তাকে বর্তমান রোমের প্রক্সিদেস গির্জার স্থলে সমাহিত করা হয়।
    কথিত রয়েছে, ভ্যালেন্টাইনের কবরের কাছে জুলিয়া একটি গোলাপি ফুলে ভরা আলমন্ড গাছ লাগান। সেখান থেকে আলমন্ড গাছ স্থায়ী প্রেম ও বন্ধুত্বের প্রতীক।
    এখন একজন বৃদ্ধ সাধু, যিনি সংসার ছেড়ে চলে গেছেন, যিশুর প্রতি নিবেদিত প্রাণ, একজন যাজক, ধর্মপ্রচারক, যে জুলিয়াকে শিক্ষিত করে তুলেছিল, যার ঈশ্বর বিশ্বাসের গভীরতা আর আস্থা, জুলিয়াকে অভিভূত করতে পেরেছিল, সেটা কি আমাদের জাগতিক,সামাজিক অর্থে প্রেম বলা যায়? বলাটা উচিত হবে? আজকের পৃথিবীতে, ভ্যালেন্টাইনের ঈশ্বর বিশ্বাস এবং আস্থার কোন প্রতিফলন নেই। শুধু মোটাদাগের শারিরীক এবং আকর্ষনের প্রেমের দিন হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ ভ্যালেন্টাইন ছিলেন সাধু আর জুলিয়া অন্ধ। তাই শরীর বা রূপ জাতীয় কোন বস্তুর আকর্ষণ সেই তথাকথিত প্রেমের মধ্যে ছিল না। সেখানে ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস, শিক্ষা, জ্ঞান আর ঈশ্বরের প্রতি দুজনেরই গভীর আস্থা এবং অনুরাগ। সেই ঈশ্বরীয় অনুরাগের উভয়ত: মিল ছাড়া, তাদের ভেতরে ব্যাক্তিগত স্তরে ভালোবাসা-র কোন গল্প ছিল না। কিন্তু আজকের মানুষ, আজকের সমাজ আর বাজারু অর্থব্যাবস্থা, সেই স্বর্গীয় প্রেমের এক বাণিজ্যিক সংস্করণই কি উত্তর পুরুষের কাছে বিক্রি করে নি? করছে না? অথচ আশ্চর্য্য ভাবে সুধী সমাজ থেকে চার্চ সকলেই নিশ্চুপ এ ব্যাপারে। কেন? আমার মতে তো এই বিশেষ দিনটি একটি আহুতি দিবস হিসাবেই দেখা উচিত। যে ঈশ্বরকে দেখেন নি, কিন্তু প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর আছেন এবং তিনিই একমাত্র সত্যি। ঈশ্বরের কারণে কারাগারে বন্দী থাকার পরে, হত হবেন জেনেও, নিজেকে স্থির রাখার মনের জোর যিনি দেখিয়েছেন, সেই সাধুর নাম আর তার বলিদান যেন এই চাপিয়ে দেওয়া এবং বিকৃত সত্য হিসাবে যুগের পথে এগিয়ে দেওয়াটা কি দোষের হল না? সনাতনীরা কি বলবেন? 
    পরবর্তীতে,সাধু ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর ২২৬ বছর পরে ৪৯৬ অব্দে প্রথম পোপ জেলাসিউস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
    ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উদ্ভব হলেও এটি বিশ্বব্যাপী প্রথম দিকে তেমনিভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্ম দিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। খ্রিস্টীয় চেতনা ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিক ভাবে এ দিবস উৎযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া,হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

    যদিও ভ্যালেন্টাইনের এই কাহিনীর কিছু ইতর বিশেষ এবং অন্য মত প্রচলিত আছে। কারও কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেঁতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো। একদিন রোমের এক কারা প্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন বুঝতেপেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর কারা প্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন মেয়েটিকে। তাতে লেখা ছিল, ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল কারণ, ইতোমধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দু’চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল।
    ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎপত্তির বিষয়ে আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নমত রয়েছে। এই মতের লোকেরা বলেন, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষদিকে মানুষ বিশ্বাস করত এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজেবেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এই দিনে।
    অন্য আরেকটি মতে, প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেব-দেবীর রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারো করো মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। আবার কেউ বলেন, রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস ২০০ খ্রিস্টাব্দে দেশে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনও যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ। তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে তবে যুদ্ধ করবে কারা? সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এক যুবক। যার নাম ভ্যালেন্টাইন। অসীম সাহসী এযুবকের প্রতিবাদে ক্ষেপে উঠেছিলেন সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলা হয় তার। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এ দিনটিকে পালন করা হয় ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে।
    ক্লডিয়াস বা পাখী বা সাধু ভ্যালেন্টাইন বা ডাক্তার ভ্যালেন্টাইন, বা প্রথম পোপ, যেই বা যিনিই থাকুন না কেন এই ১৪-ই ফেব্রুয়ারির পেছনে - এর পেছনে আজকের সামাজিক মাপদন্ডের বিচারে যে প্রেম ভালোবাসা আমরা বুঝি, তার সাথে ভ্যালেন্টাইন দিবসের, আমি কোনও যোগাযোগ খুঁজে পাই না। এই বিয়োগান্ত এবং অত্যাচারের ঘটনাটি ভুলে গিয়ে, আমরা অসম্ভব এবং অসম এক প্রেমের বিবরণ এর থেকে খুঁচিয়ে বের করে নিয়ে এসেছি আর তার বাণিজ্যকরণ করেছি। সেই বাণিজ্যের সারা পৃথিবীর যুবা কিশোর থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এক নেশাময় অনুষ্ঠানে মেতে রয়েছেন।
    বর্তমানে পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এই দিবস উপলক্ষে এই দিনে প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করে। ভালোবাসা দিবসের জন্য মানুষেরা কার্ড, ফুল, চকোলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয় করে। যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনে প্রায় আনুমানিক ৩ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
    ভাবা যায়?  একটি কার্ডের জন্য অ্যাভারেজ এক ডলার মূল্য ধরা হলে, শুধু শুভেচ্ছা কার্ডই তিন কোটি ডলারের ব্যাবসা৷ ফুল, কেক, ডিনার, উপহার এইসব ধরিই নি। বুঝুন অবস্থাটা।
    সিনেমার পর্দায়, আমাদের পরিচালক এবং অভিনেতারা যখন বলিয়ে নেন বা বলেন, "উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন"? তখন যে ভাব পর্দায় দেখানো হয় - ভেবে দেখুন তো, অন্ধ বাচ্চা একটি মেয়ে জুলিয়ার ভ্যালেন্টাইন কি তেমন ভ্যালেন্টাইন ছিলেন আদতে? 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সৃষ্টিছাড়া | 2401:4900:7359:ea5d:532b:d8dc:8476:***:*** | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৫২528524
  • বেকার বকবক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন