বিজেপির বাংলা ব্লগ থেকে দেখলাম, এই দল খোলাখুলি নিজেকে ‘একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল’ বলে ঘোষণা করেছে, যে দল ‘সামাজিক রক্ষণশীলতার প্রবক্তা’। ‘সামাজিক রক্ষণশীলতা’ বলতে এই দল ঠিক কী বোঝে তা পরিষ্কার হল আরএসএস-এর ওয়েবসাইটে ‘ভিসন এণ্ড মিশন’ থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বর্ণ, শ্রেণী ও বহু ভাষাভাষী মানুষে বিভক্ত এই সমাজে সমাজ-কর্মীদের মহত্তম কর্তব্য হল এই সামাজিক বুননকে অটুট রাখা’। সংঘ পরিবারের পন্ডিত দীন দয়াল উপাধ্যায়ের ‘একাত্ম মানবতাবাদ’ বইতে লেখা আছে, ‘আমরা এক জাতি এক সমাজ। এইজন্য আমরা ভাষা, প্রদেশ, বর্ণ, মতবাদ বা তথাকথিত রিলিজিয়নের ভিত্তিতে কাহারও বিশেষ অধিকার স্বীকার করি না’। অর্থাৎ বিজেপির স্বর্গ-রাজ্যে দলিতদের জন্য সংরক্ষণ বিলুপ্ত হবে নিশ্চিত। সমাজকে অটুট রাখতে হবে তো!
‘ভিসন এবং মিশন’-এ আরও বলা হয়েছে, বর্ণ-ভেদ, অস্পৃশ্যতা বা আঞ্চলিকতা এসব নিয়ে সংঘাত দেখা দিলে সংঘ তার ‘শক্তিশালী প্রতিষেধক’ হিসেবে কাজ করবে। সে কারণেই সম্ভবত দলিত বা আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন বা মুসলিম-পেষণের বিরোধিতা করেন, এমন অনেক সমাজ-কর্মী ও লেখকের স্থান হয়েছে জেলখানায়। সন্দেহ নেই, গাঁধীজি এই জমানায় থাকলে তাঁরও স্থান হত কারান্তরালে।
হিন্দুত্ববাদীদের এই ‘এক জাতি এক সমাজ’ গড়ে তোলার লক্ষ্য যে আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণ, সেই ভিসন নিয়েও কোনো অস্পষ্টতা নেই। তাদের এই সামাজিক পুনর্গঠন প্রকল্পে দলিত, আদিবাসী বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বা ভারতের অসংখ্য জনজাতির ভাষা ও সংস্কৃতি-ভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য এসব নিয়ে কোনো কথা চলবে না, এটা স্পষ্ট। এটাই হচ্ছে রক্ষণশীলতা, যাকিছু চলে আসছে, তার বিরুদ্ধে ট্যাঁ-ফো করা চলবে না। চলে আসছে মানে গোবলয়ে চলে আসছে। এখন গোবলয়ের রক্ষণশীলতা বাঙালির সইবে কিনা, সেটা বোঝার জন্য নারী সম্পর্কে গেরুয়া শিবিরের অবস্থান বিচার করে দেখা দরকার।
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে সংঘ পরিবারের নারী সংগঠন রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির তিন-দিন ব্যাপী শিবিরে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ‘মাতৃ-শক্তি’ জাগ্রত করার কথা বলেন, যার কাজ হবে আমাদের কুটুম্ব বা পরিবার-ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যা তাঁর মতে ‘সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে’। শিবির শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেবিকা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সীতা আনন্দনম খুব জোরের সাথে সংঘ পরিবারের মুখ্য সংগঠন আরএসএস-কে নারী-বর্জিত রাখার পক্ষে ওকালতি করে বলেন, পুরুষ এবং নারীর সম্মিলিত শাখা গঠন আমাদের সংস্কৃতি বিরোধী। এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমানাধিকারের বিষয়টি আইন-স্বীকৃত হলেও সংঘ পরিবার যে তার বিরোধী সেটা স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘মেয়েদের অধিকার আর আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে একটা সাযুজ্য থাকা দরকার, অন্যথায় পরিবার ভেঙে পড়বে, ভাইরা বোনেদের বিরুদ্ধে চলে যাবে’।
এখন হিন্দুত্ববাদী জমানা এলে বাঙালির কী হবে? বাঙালি মধ্যবিত্ত বহুদিন হল ‘রক্ষণশীল’ কথাটাকে অপছন্দ করেন, এবং তার বিপরীতে প্রগতিশীল বলে নিজেদের ভাবতে ভালবাসেন। যদিও বহু বিষয়ে তলিয়ে দেখতে গেলে শিক্ষাভিমানি বাঙালির মননে রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্ষণশীলতা ধরা পড়বে। যেমন, সরকারী চাকরিতে নিম্নবর্ণ বা আদিবাসী সমাজের কেউ উচ্চপদ লাভ করলে বর্ণ-হিন্দু বাঙালি মনে মনে ভাবে, এ নিশ্চয় সংরক্ষণের সুবাদে। মুসলিম নাম শুনলে ভেতরে ভেতরে ‘প্রগতিশীল’ বাঙালিরও কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হয়। কান পাতলে শোনা যায় তাদের অভিমত, সব মুসলমান সন্ত্রাসবাদী না হলেও সব সন্ত্রাসবাদীই নাকি মুসলিম। এমন মনোভাবের ফলেই বোধহয় বাম অনুগামীদের ভোট অনায়াসে বিজেপিতে চলে যায়, বহু-সংখ্যক বাম এমএলএ যোগ দেন গেরুয়া শিবিরে।
কিন্তু তারপরেও ভাবার বিষয়, বিজেপির রক্ষণশীলতা কি বাঙালির সইবে? বাঙালির রক্তে একটা রক্ষণশীলতা-বিরোধী ধারা আছে, প্রজন্মান্তরে যা প্রবাহিত। এখন যোগী আদিত্যনাথ যেমন বলছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে এরাজ্যেও ‘আন্টি-রোমিও স্কোয়াড’ তৈরি করা হবে। নবীন প্রজন্ম কি তা মেনে নেবে? হিন্দুত্ববাদী শাসকেরা স্বভাবতই প্রেম-বিদ্বেষী। কারণ প্রেম সমাজের বেধে দেওয়া জাতপাত-ধর্ম, বংশ-কৌলিন্য বা আর্থিক নিরাপত্তা—এসবের ধার ধারে না। ফলে প্রেম পারিবারিক বা সামাজিক স্থিতিকে প্রায়শই বিপন্ন করে তোলে। আর সংঘ পরিবারের মহত্তম কর্তব্য, এই সামাজিক কাঠামোকে রক্ষা করা।
সমস্যা হল, প্রেম করাটা বাঙালি সমাজে একপ্রকার রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, পরিবার মেনে নিক না নিক, ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দমত বিয়ে করতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। পরিবারের লোকজন এখন না চাইলেও তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ সমাজ খুব বদলেছে তা নয়, এখনও সম্ভবত বেশিরভাগ বাবা-মা’ই চাইবেন ছেলে-মেয়ে তাদের পছন্দমত বিয়ে করুক, প্রেম করলেও অন্তত তাদের জাত-ধর্মের মধ্যে করুক, আর সামাজিক রীতিনীতিগুলো মাথায় রাখুক।
যেমন, ভিন্ন জাতে বিয়ে হলেও, ভিন্ন ধর্মে যেন না হয়, আর সমকামিতা নৈব নৈব চ। বিয়ে হতে হবে সামাজিক রীতিনীতি অর্থাৎ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনে। ভিন্ন ধর্মে বা সম-লিঙ্গে সম্পর্ক হলে বিবাহ এবং পরিবার নামক পবিত্র প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে পড়ে যাবে যে। ভারতের গোবলয়ে, যোগীজি মোদীজির রাজ্যে শুধু ভিন্ন জাত বা ধর্মে প্রেম বা বিয়ে করার জন্যই যে কত ছেলে-মেয়ের জীবন অকালে ঝরে যায়!
কিন্তু মানব-সম্পর্ক তো কোনো বিধি-নিষেধ মেনে হয়না, বিশেষ করে আজকের দিনে ছেলেমেয়েরা যখন ক্যারিয়ারের তাগিদেই বেরিয়ে পড়ছে দেশ-দেশান্তরে, পরিচিত হচ্ছে নানা জাত-ধর্ম-ভাষাভাষী মানুষজনের সাথে, তখন সম্পর্ক কীভাবে একটা নির্দিষ্ট সামাজিক সীমায় আটকে থাকবে! ফলে, প্রেম নামক এক অদৃশ্য শত্রু শুধু সমাজ নয়, রাষ্ট্র-শক্তিরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। প্রেম আর প্রেম থাকছে না, হয়ে উঠছে ধর্ম-বর্ণভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একেকটা স্ফুলিঙ্গ। দিন কে দিন প্রেমের অনিবার্য বিস্তৃতি ঘনিয়ে তুলছে এক সামাজিক সংঘাত, যা শুধু পারিবারিক বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করেই থেমে থাকছে না, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতিকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে, মৌলবাদকে করে তুলছে বিপন্ন।
সন্দেহ নেই, হিন্দুত্ববাদী শক্তি এই বঙ্গের ক্ষমতায় আসীন হলে এরাজ্যেও ব্যক্তিগত পছন্দ, মেলামেশা এবং সম্পর্কের পরিসরে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে। পরিবার ও সমাজের কর্তাব্যক্তিরা এতে কতটা স্বস্তি পাবেন জানিনা, কিন্তু ছেলে-মেয়ে একসাথে রাস্তায় ঘুরলে গেরুয়া বাহিনী তাদের অপমান করবে, থানায় নিয়ে কান ধরে ওঠবোস করাবে, এটা তরুণ প্রজন্ম মেনে নেবে না নিশ্চিত। রামমোহনের সতীদাহ-রোধ, বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ বা নারীশিক্ষা প্রচলন থেকে শুরু করে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নারী স্বাধীনতার সপক্ষে এযাবৎ বাঙালির যে ঐতিহ্য গড়ে হয়েছে, তা নস্যাৎ করে দেওয়া সহজ হবে না।
এই বাংলার নতুন প্রজন্ম যারা গোবলয়ের তুলনায় অনেকটা উদার ও মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা বুঝে নিতে শিখেছে, হিন্দুত্ববাদী শাসকদের সাথে তাদের বিরোধ এবং সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। প্রেম সেই সংঘাতকে তীব্র করে তুলবে, কারণ প্রেমের জন্য যৌবন অনেক কিছু বাজি রাখতে পারে। সত্তর দশকে বিপ্লবের জন্য বাংলার যৌবন একবার জেগে উঠেছিল, কিন্তু রাষ্ট্র-বিরোধী সে লড়াই ছিল মূলত পৌরুষ-নির্ভর, সেথায় নারীর ভূমিকা ছিল নগণ্য। আজকের বাংলায় যৌবন যখন জাগবে সেখানে তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতী, এককথায় নর-নারী, একসাথে জাগবে (নব-প্রজন্মের প্রতিটি লড়াইয়ে আমরা সেই ছবি দেখতে পাই)। তাই সে হবে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা। ওপার বাংলার নব-প্রজন্ম মুসলিম মৌলবাদের দাপট ভেঙে দিয়ে জেগে উঠেছিল শাহবাগ আন্দোলনে, এপার বাংলার নতুন প্রজন্ম হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকবে না, এই প্রত্যাশা করা কি খুব ভুল হবে!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।