এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চিলেকোঠার সেপাই নাটক : কিছু কথা

    Eman Bhasha লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | ৩৬৬ বার পঠিত
  • বয়স বাড়লে পরিণত হয় মানুষ। মানুষের চিন্তাও। উচ্চারণে আসে নতুন চিন্তন। একই লেখা আরেকবার পড়ায় অন্য অর্থ আনে। একই চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। ২৬ বছর আগে দেখা 'চিলেকোঠার সেপাই' আর এখনকার 'চিলেকোঠার সেপাই'য়ে অর্থগত তাৎপর্য একটু হলেও অন্যরকম। 'চিলেকোঠার সেপাই' নাটক মানে আগে হাড্ডি খিজির আমাদের মাতিয়ে রাখতেন। এই নাটকটি আমি আগে দুবার এবার দুবার মোট চারবার দেখলাম।
    এখন অধ্যাপক চরিত্রটি নাটকের মূল কথাটা ধরিয়ে দেয়।
    ওসমান একই কথা বারবার বলে, বারবার বলে খেই হারিয়ে যাওয়ার মতো করে বলে, ধরিয়ে দেয় আসলে মিলিটারি মানসিকতা সত্য,  ক্ষমতার নিজস্ব নিয়মে পাওয়ার এবং power কঠিন বাস্তব হয়ে ওঠে।
    ক্ষমতার জন্যই বহু দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা, অসূয়া, ক্রোধ, উষ্মা
    অধ্যাপক আনোয়ার বলেন,

    ১.
    তোমরা বাঙালীর হাতে পাওয়ার চাও তো? মানে বাঙালীকে এক্সপ্লয়েট করবার লাইসেন্স চাও।

    ২.
    তোমরা আলাদা আর্মির কথা বলছো তো? বাঙালি আর্মি? বাঙালি আর্মি হলেই হলেই কি বাঙালি রক্ষা পাবে? সেই বাঙালি আর্মি তখন চেপে বসবে সেই বাঙালির উপরেই। বাঙালি ছাড়া কার উপরে দাপট দেখানোর ক্ষমতা আছে তার?

    বাঙালি আদমজি ইস্পাহানী হবে, তাতে বাঙালি চাষার লাভ কি হবে।


    ভোটে তো মিডিল ক্লাসের লোক আসবে, তারা সাধারণ মানুষের সমস্যা বুঝবে কেমন করে?
    আনোয়ার চরিত্রে অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় মার্জিত সুন্দর অভিনয় করেছেন।
    হাড্ডি খিজির পুরাতন খিজিরের ছায়া হননি। অনুপম, সৌমী, মধুমিতা, অনিরুদ্ধ, অজয়বাবু সবাই ভালো অভিনয় করেছেন। আলো সুন্দর। সঙ্গীতের ব্যবহার যথাযথ। এবং মনকাড়া। গৌতম হালদারের কন্ঠ দ্যুতিময়।
    সুপর্ণা দাস যথারীতি অনবদ্য।
    বাংলার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের তিনি একজন।
    ওসমান চরিত্রে ২৬ বছর আগে কিশোর সেনগুপ্তকে দেখেছি। আমার প্রিয় নাটক 'গাব্বু খেলা'র দীপ্তেন্দ্র সেনগুপ্তর মতো শরীরটাকে মুচড়ে নীচে ঝাঁপ দিতেন কিশোর।
    এখন শারীরিক অভিনয়ের চেয়েও জোর এসেছে সংলাপ উচ্চারণে।
    ফলে, গভীরতা এসেছে।
    বাংলা বাংলার রাজনীতি জাতিসত্তা ক্ষমতা ধর্মের রাজনীতিটা বড় বেশি প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে ।

    সংলাপটি বড় প্রতীকী
    দুইজন কর্নেল একখান খাট
    বন্ধ কপাট হ্যাঁ বন্ধ কপাট
    ম্যান অফ দি কপাট ম্যান ইন দি কপাট
    কপাট বন্ধ হলে কপাটই জমাট
    স্টেমাটিল সিডেটিভ ঝপাট ঝপাট
    ম্যান অফ দি কপাট ম্যান ইন দি কপাট

    কিশোর প্রাজ্ঞ দার্শনিক হয়ে ওঠেন।
    ওসমান হয়ে ওঠে জীবন্ত রক্তমাংসের।

    এর সঙ্গে পড়ুন এই লেখাটাও, ২৬ বছর পর প্রথম প্রদর্শনীর পর লেখা।

    মধ্যবিত্ত পাতি বুর্জোয়া পরিচালিত আন্দোলন অনিবার্যভাবেই ক্ষমতা দখলের আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের জায়গায় বাঙালি ক্যাপ্টেন। অবাঙালি শোষকের জায়গায় বাঙালি শোষক। শোষকের জাতি বদলায়। শ্রেণিচরিত্র নয়। 
    বিপ্লবী বামপন্থী আনোয়ার এটা ধরতে পারে। কিন্তু তাঁর গলাতেও মহাজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নাই। বাংলার মুক্তি সংগ্রামে হাড্ডি খিজির যোগ দেয়, শ্রেণিচেতনা থেকে। সে মহাজনের বিরুদ্ধে। যে মহাজন রহমতুল্লাহ তাঁর স্বামী ত্যাজী মা ও তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। যে মহাজনের সঙ্গে তাঁর বউ লটরপটর করে। তাঁর বউকে মহাজন অন্তর্বাস উপহার দেয়।
    আর মহাজনের বিরুদ্ধে লোককে ক্ষেপানোর চেষ্টায় তাঁকে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব পায় আরেক প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন প্রলেতারিয়েত বজলু।
    খিজির যত চায়, আন্দোলন মহাজনদের বিরুদ্ধে হোক, মহাজন রহমতুল্লাহর আত্মীয় নেতা চায় সেটা পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে হোক।
    খিজির গুলি খেয়ে মরে।
    আর খিজির প্রেরণা হয়ে থাকে ওসমানের।
    যে ওসমান আসলে উদ্বাস্তু।
    তাঁর বাবা থাকেন ইন্ডিয়ায়। ওসমান ঢাকা  কলেজে পড়ে চাকরি করেন। মিছিলে যেতে চান। যান। কিন্তু পুরোপুরি যোগ দেওয়ার সাহস নাই।
    মহাজন রহমতুল্লাহর ছাদে থাকেন ওসমান।
    নীচে থাকে রাণুর পরিবার। রাণুর বড়ভাই তালেব পুলিশের গুলিতে মারা যান। রাণুর ছোটভাই রঞ্জু। ওসমানের ডাক নামও রঞ্জু। রঞ্জুর প্রতি এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করেন ওসমান। রাণুর প্রতি টান।
    কিন্তু সে-সব বলা হয় না।
    তাঁর একমাত্র আনন্দ তিনি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ছবিতে প্রথমে আগুন দিয়েছেন।
    উদ্বাস্তু মধ্যবিত্তের আবেগ, দোদুল্যমানতা, দ্বিধা, অসহায়তা চমৎকার ধরা পড়ে ওসমানের চরিত্রে।
    ২৬ বছর আগে রবীন্দ্রসদনে 'চিলেকোঠার সেপাই' নাটকটি দেখি।
    কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাটক দেখে ভক্ত হয়ে যাই।
    সে-বারও ওসমান করেছিলেন কিশোর সেনগুপ্ত। এবারও। তখন ছিপছিপে তরুণ। এখন বয়স বেড়েছে।
    অভিনয়ের ধারও।
    জানি না, কিশোর কোন ওসমানকে বেশি নম্বর দেবেন।
    আমার তো দুটোই দারুণ লেগেছে।
    খিজির চরিত্রাভিনেতা শেখর গুপ্ত নেই। রোগা টিঙটিঙে চেহারা।‌ সত্যিকারের হাড্ডি খিজির।
    এবার কে?
    দলের সভাপতি শান্তনু ঝা ভাঙলেন না।
    বললেন, দেখুন। একটা নতুন ছেলে।
    অনিরুদ্ধ চমকে দিয়েছেন। চেহারায় মিল নেই কিন্তু অভিব্যক্তি অভিনয় জীবনবোধে একেবারেই খিজির।
    ২৬ বছর পর একটা নাটকের পুনরাভিনয় একটা বড় ঘটনা।
    সত্যিই বড় ঘটনা।
    অসাধারণ টিম ওয়ার্ক।
    এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে।
    বিশেষ করে সুপর্ণা দাসের কথা বলতেই হবে।
    বাংলা নাটকে তূর্ণা, বিন্দিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন: সুপর্ণা।
    'অথৈ জল' দেখে চমকেছিলাম।
    লাস্যে হাস্যে রহস্যে শরীরি বিভঙ্গে নৃত্যে কুশলিনী।
    বেলা তিনটার সময় বন্ধু কিশোর সেনগুপ্তের সঙ্গে দ্বৈত অভিনয় 'ভোরের বারান্দা' সেখানে এক ধরনের চরিত্র। 'চিলেকোঠার সেপাই'য়ে আরেক ধরনের।
    দুটো দু রকম। দুটোতেই মাত।
    আরেক নারী চরিত্র বজলুর বউ সৌমী। তিনিও অনবদ্য।
    আনোয়ার চরিত্রাভিনেতা অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ে মুগ্ধ। বজলুও দারুন।
    রহমতুল্লাহ একই মানুষ। 
    ২৬ বছর বয়স বেড়েছে অভিনেতার।
    পরিণতিও।
    আরও পরিণত। বিশেষ করে পঙ্গু রহমতুল্লাহ অনবদ্য।
    আলাউদ্দিন আছেন দাপটের সঙ্গে।
    স্বল্প সুযোগ।
    পুরোটা নিংড়ে দিয়েছেন।
    জয় হোক কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের।
    জয় হোক চিলেকোঠার সেপাইদের।
    কোনও তথাকথিত স্টার ছাড়াই এ নাটক মঞ্চ দাপাবে।
    হাউসফুল বোর্ড ঝুলবে।

    আর এবার একটা সুপর্ণা দাস দিন হয়ে যাক।
    সকাল ১০ টায় 'অথৈ জল'।
    বিকাল তিনটায় 'মহালয়া'।
    সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় 'মণিকর্ণিকা মণিকা'।
    আমরা আছি।
    অপেক্ষায়।
    জয় হোক বাংলা নাটকের।
    পুনশ্চ: ২৬ বছর আগে দেখা নাটকে শারীরিক অভিব্যক্তি ছিল অনেক বেশি, এবার সংলাপ উচ্চারণে জোর।
    ওজনও বেড়েছে।
    আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক নাটক হয়ে উঠেছে।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন