আজ সকাল থেকেই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়িটা দিয়ে দিলাম। বড়ো যত্নের, বড়ো কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে কেনা ঐ বাড়ি। আমার বাগান, গন্ধরাজ গাছ, জারুল গাছ, সারি সারি হাসনুহানা, সব ফেলে দিয়ে এলাম। এখন থেকে ফ্রেশ আনকোরা নতুন জীবন শুরু হবে। এমন সুযোগ কজন পায় গোটা জীবনে? আমি পজিটিব থিংকিং করছি।ফ্লাইট লেট হলো, ট্যাক্সি স্ট্রাইক, তবু আমার মন বলছে আজকের দিনটা হেলায় ফেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
কিন্তু ডবল ঝামেলা অটো নিয়ে। প্রথমত নাইন ইলেভেন হবার পর থেকে অ্যামেরিকান এমব্যাসীর ঐ গোটা এলাকায় সর্বক্ষণের জন্য ব্যারিকেড, গাড়ি ঢুকতে দেয় না। সুইস এমব্যাসী ঐখানেই আগেই বলেছি। দ্বিতীয়ত তবু যদিবা ট্যাক্সি থাকলে ঐ ব্লকের ভেতরে কিছুদূর অবধি যাওয়া যেত, অটোরিক্সাকে একেবারেই ঢুকতে দেবে না। প্রায় দুশো আড়াইশো মিটার দূরে মেইন রোডের ওপর অটো আমাদের ঐ কথাই জানালো।
জিনিসপত্র টেনে টেনে অতটা পথ হাঁটা যায় না। বাবু দাঁড়িয়ে রইল চওড়া ফুটপাথের ওপর দুটো সুটকেস, হ্যান্ড ব্যাগেজ ট্যাগেজ নিয়ে। আমরা মা মেয়ে কাগজপতর্ নিয়ে জোর পায়ে হাঁটছি সুইস এমব্যাসীর দিকে।
এমব্যাসীর সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে কাগজ বের করব, একটা নোটিস টাঙানো, মেয়েই সেটা প্রথম দেখে পড়ে নিল।
— মা! এমব্যাসী বন্ধ হয়ে গেছে। জানুয়ারীর ছ তারিখে খুলবে!
মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা। ঘড়িতে বারোটা দশ। বারোটায় দরজা বন্ধ। দারোয়ান ঐ ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।
— ভাইসাব!
— ম্যাডাম, অফিস বন্ধ হো গিয়া।
আমার মাথায় হিন্দি আসছে না।
— প্লিজ প্লিজ প্লিজ ভাই একটু যেতে দিন। নইলে কী অবস্থা হবে আমাদের বলুন দিকি! এ দেখুন টিকিট কাটা রয়েছে,.... আমার চোখে জল আসছে না, কিন্তু ভয়ে গলা শুকেচ্ছে।
দারোয়ান দরজা খুলে দিলেন।
ভ্তরের ঘরে অনেক লোক। প্রায় ছ সাতজন ভিসাপ্রার্থী। চেয়ার বিশেষ খালি নেই। কিন্তু প্রত্যেকের হাতে সিরিয়াল নম্বরের টিকিট। আমরা দেরি করে ঢুকেছি টিকিট পাই নি।
এদিকে পারিজাত ঝুঁকে পড়ে মেঝেয় কীসব করছে।
— উঠে বোসো। চেয়ারে বোসো।
আমি রেগে গেলে ওকে তুমি তুমি করে বলি।
পারিজাত মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে কার যেন ফেলে দেওয়া একটা টিকিট, তাতে কিছু একটা সিরিয়াল নম্বর দেওয়া। ক্রমশঃ ঘর খালি হতে থাকে। আমরা কাউন্টারে যাই। কাগজপত্র, পারিজাতের পাসপোর্ট জমা দিই। খুব সম্ভবত ভিসা ফি লাগে না। কাল ছুটি। তবুও পাসপোর্ট মালীর কাছ থ্কে নেওয়া যাবে।
আমরা নাচতে নাচতে ফের মেন রাস্তায়। বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছে সুটকেস আগলে।
একজন অটোচালক জানতে চাচ্ছে আমরা কোথায় যাব।
আমি তাকে বলে দিই কনট প্লেস, অপোজিট টু সুপার বাজার।
আমার মেয়েটা এত বোকা, ও বলে, ও ফ্লাইট থেকে নেমে ভেবেছিল এটাই সুইটজারল্যান্ড কিনা।
দিল্লি ওর খুব ভালো লেগেছে। কী সুন্দর শহর, কী পরিষ্কার।
কনট প্লেস আমার যেন নিজের জায়গা। ওখানে দুটো হোটেল আমি বেশ চিনি। বহু বছর আসি নি, তবে এটুকু জানি যে বুকিং ছাড়াই আমাদের থাকার ব্যবস্থা তারা করে দেবে।
হয়েও গেল। ঐ বিশাল যে গোল সাদা বাড়িটা, ওরই মধযে আমার চেনা হোটেল, সস্তার হোটেল। এমনকি ম্যানেজার এখনও সেই শর্মাজী।
একটা ডবল রুম পেয়ে গেলাম। তারপর খেতে যাব গোল মার্কেটের বসু বোর্ডিং হাউসে। হেঁটেও যাওয়া যায়, কিন্তু এখন ওসব না। প্লাজা সিনেমার মোড়টায় গিজগিজ করছে অটো।