এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ঝরা শিউলির গন্ধ -- ২

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ অক্টোবর ২০২৩ | ২৭১ বার পঠিত
  • ঝরা শিউলির গন্ধ – ২  
     
    বাঙলায় শরৎ আসে কাশ আর শিউলি ফুলের হাত ধরে। বাড়ির বাগানে ঝরা শিউলির আলপনা আর প্রকৃতির প্রাঙ্গণে কাশ ফুলের সফেদ ঝালরের ঝলকানিতে শুরু হয় শারদলক্ষ্মীকে আমন্ত্রণের উদ্যোগ। প্রকৃতি দেবী নিজেই নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে উৎসবের তোরজোড় শুরু করেন আপন খেয়ালে মূল উৎসবের মাসখানেক আগে। আর বারোয়ারী পুজোর তোরজোড় শুরু করতে হতো পাঁজিতে নির্দ্ধারিত দিন ক্ষণের কমবেশি মাস পাঁচেক আগে। একদিকে বারোইয়ারের এক ডজন মাথা আর মনকে এক ভাবনার সুরে বাঁধা তো অন্যদিকে আয়োজনের কাজ তো আর কম নয় ! ডেকরেটর, ইলেকট্রিশিয়ান ঠিক করা, পাল পাড়ায় গিয়ে প্রতিমার বায়না দিয়ে আসা,ঢাকি, পুরোহিত মশাই, ফুল, দশকর্মার দোকানি তাদের সঙ্গে আগাম কথা বলে রাখা – সে এক এলাহী রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন ! তার ওপর ছিল পুজো কমিটি গঠনের পর্ব। রিকশায় ব্যাটারি চালিত মাইক লাগিয়ে পাড়ার আনাচকানাচে কমিটি গঠনের জরুরি সভায় সকলকে হাজির থাকার অনুরোধ জানানো হতো — " ঘোষণা শুনছেন আপনাদের বিশ্বস্ত যুব সংঘের পক্ষ থেকে। আগামী রবিবার শ্রী….. বাবুর বাড়িতে আসন্ন শারদোৎসব উদযাপন উপলক্ষে পরিচালক সমিতি গঠনের উদ্দেশ্যে সকাল দশটায় এক সভার আয়োজন করা হয়েছে। এই সভায় বিগত বছরের আয় ব্যয়ের হিসাব পেশ করার পাশাপাশি বর্তমান বছরের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। উক্ত সভায় আপনাদের উপস্থিতি একান্ত কাম্য। সুধী পল্লীবাসীবৃন্দ, ঘোষণা শুনছেন …….. "

    এমন ঘোষণা কানে আসতেই মন উদ্বেল হয়ে উঠতো পুজোর জন্য। এসব গুরুত্বপূর্ণ  সভায় উপস্থিত থাকার ছাড়পত্র তখনও আমরা পাইনি, তাই স্কুপ নিউজ সংগ্রহের আশায় তক্কে তক্কে থাকতে হতো। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত সিদ্ধান্তর বিষয়গুলোই প্রকাশিত গোপন সত্যের আকারে আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতো। স্কুলের বন্ধুদের অবসরকালীন আলাপচারিতায়‌ও উঠে আসতো নানান পাড়ার পুজো প্রস্তুতির কথা। সেই সব বিবরণী থেকে আমাদের আয়োজনের বহর সম্পর্কে আন্দাজ করা যেত।

    সেই সময়তো আর একালের মতো থিমের পুজোর চল হয়নি, তাই ডেকরেটরের পছন্দ অনুযায়ী তৈরি করা হতো পুজোর প্যান্ডেল। পুজো প্যান্ডেলের পরিসর কতটা হবে তা নির্ভর করতো এই খাতে নির্দ্ধারিত বাজেটের ওপর। ব্যাপারটা ঐ যত চিনি তত মিষ্টির মতো আর কি ! এবার কোন ডেকরেটর পাড়ার পুজোর প্যান্ডেল তৈরি করার দায়িত্ব পেল তা জানার জন্য আমাদের বেশ আগ্রহ ছিল। সেই সময়ের নাগের বাজার এলাকায় দুটি ডেকরেটরের বেশ নামডাক ছিল – মুখার্জি ডেকরেটর ও ইউনাইটেড ডেকরেটর ‌। এঁরা নিজেদের চেনা এলাকার বাইরেও পুজো প্যান্ডেল তৈরির বরাদ্দ পেতো। মুখার্জি   ডেকরেটর পাড়ার পুজোর প্যান্ডেল তৈরি করবে এ কথা শুনলে মনে হতো এবার নতুন কিছু চমক থাকবে মন্ডপ জুড়ে। এদের কাজকর্ম হতো পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল।

    ইউনাইটেড ডেকরেটরের মনতোষ দা ও সেন্টু দার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল সেই কিশোর বয়সেই। এঁরাও খুব সুন্দর করে মন্ডপ গড়তেন। এঁদের পাশাপাশি আরও তিনটি ডেকরেটর তাঁদের স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ছিল, সাজসজ্জা, নিউ বেঙ্গল ডেকরেটর  এবং কিছুটা সময় পরে রাধা ডেকরেটর। এইসব মন্ডপ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেকেই নিজের নিজের সংস্থার পরম্পরা ও সুনাম বজায় রাখার বিষয়ে অত্যন্ত সচেষ্ট থাকতো। প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে অভিজ্ঞ কর্মীর ওপর দায়িত্ব থাকতো পরিকল্পনা মোতাবেক মন্ডপটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করার।

    সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেত প্যান্ডেল বানানোর জন্য বাঁশ পড়ার সময় থেকেই। কোনো এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই হয়তো নজরে পড়লো ঠেলা গাড়ি করে বাঁশ এসেছে, ব্যস! সেই খবর নিমেষেই ছড়িয়ে পড়তো আমাদের পরিচিত বন্ধুমহলে। সেকালে বাড়িতে বাড়িতে বাড়িতে ফোন ছিলনা,আর মুঠোফোন তো তখনও স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মতো অবাস্তব স্বপ্নচারী। তাও কীভাবে সবার কাছে খবর পৌঁছে যেত ঘরে ঘরে এখন তা নিয়ে ভাবতে বসলেই রীতিমতো রোমাঞ্চিত হ‌ই । সেকালে প্যান্ডেল তৈরির উপকরণের একালের মতো বিবিধতা ছিলনা। বাঁশ,দড়ি,আর নানান রঙের কাপড় দিয়েই তৈরি হতো মন্ডপ। প্লাইয়ের যথেচ্ছ ব্যবহার একদমই ছিল না।

    নারকেল ছোবড়ার কাতা দড়ি দিয়ে বাঁশ বেঁধে বেঁধে আগে নিচের আয়তাকার কাঠামো তৈরি করা হতো। তারপর তৈরি করা হতো দো চালা ছাউনি, চালের অংশ ঢাকা দেওয়া হতো মোমের প্রলেপ দেওয়া তেরপল দিয়ে। এভাবে কিছুদিন ফেলে রাখার পর বাহারী রঙের কাপড় দিয়ে একটু একটু করে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলা হতো মন্ডপটিকে। দেবী প্রতিমার সামনের অংশে সুন্দর খিলান তৈরি করা হতো লোহার ফ্রেমের ওপর কাপড় সেলাই করে। প্যান্ডেলের বাইরের কানাত বরাবর লাগানো হতো সাদা কাপড়ের ঝালর। তাতে করে মন্ডপটি বেশ দেখনদার হতো।

    আমাদের চোখের সামনেই তিল তিল করে মন্ডপের এই আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে যেত। আর আমরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে তা উপভোগ করতাম আর তেতে উঠতাম আসন্ন শারদোৎসবের আঁচে।
    মাঝে মধ্যে বন্ধুরা দলবেঁধে ঘুরে আসতাম আর এন গুহ রোডের কুমারটুলি থেকে। সেখানেও সুবল পাল, ধীরেন পাল, যতীন পালদের স্টুডিও ঘুরে ঘুরে প্রতিমা তৈরির কৃৎকৌশল সরজমিনে চাক্ষুষ করে আসা ছিল জীবনের দুর্লভ সৌভাগ্য।

    আজ এই ব্যস্ত হয়ে কেবলই ছুটে চলা সময়ের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক আগে আমাদের ফেলে আসা দিনগুলোকে ঠিক যেন রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। সেই স্মৃতিকে সংগোপনে মনের ময়ূরমহলে আগলে রেখেই এ সময়ের পথ বাওয়া।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • তপন কুমার | 2409:4060:84:cecc:5a68:794c:48f6:***:*** | ১৭ অক্টোবর ২০২৩ ২১:৫০524713
  • এটা আগের লেখার সিক্যুয়েল। ডেকরেটরের নামধাম এখনও মনে আছে দেখে বেশ মজা পেলাম। আন্তরিক অনুসন্ধান।চলুক।
  • শৌভিক তালুকদার | 2409:4060:98:5077:ab13:2f5b:d5e0:***:*** | ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:২৮524759
  • এই লেখার বিষয়বস্তু পুজোর অন্য এক প্রস্তুতি নিয়ে।  সময়ের সাথে সাথে মন্ডপ তৈরির কাজ এক অনবদ্য শিল্পের রূপ পেয়েছে। এই পরিবর্তনের একটা ধারণা পাওয়া যাবে এই লেখার মধ্যে। 
  • সপ্তর্ষি মিত্র | 2607:fea8:6c0:1e50:721a:782b:16a6:***:*** | ২০ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:০৮524830
  • মন ভালো করা ছোট্ট একটা গল্প
  • Chiranjoy chakraborty | 2402:3a80:1987:8daa:ffa8:d2a6:8aa0:***:*** | ২১ অক্টোবর ২০২৩ ২১:০৩524945
  • লেখাটি পড়ে আমারও ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।আর এন গুহ রোডের পাল মশাইদের দুরত্ব বেশি নয়।আমরাও দেখতে যেতাম।তবে আমাদের বাড়িতেই আসতেন যোগিন্দ্র পাল কাকা,আমাদের বাড়ির ঠাকুর বানাতেন।আমাদের বাড়িতে বাসন্তী পুজো হত।পালকাকার সঙ্গে আমরাও ঠাকুর তৈরিতে হাত লাগাতাম।
    আপনার লেখাটা খুব সুন্দর লাগল।
    পুজোর শুভেচ্ছা নেবেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন