বারান্দায় দাঁড়িয়েই মুডটা খিচড়ে গেল অনুরাধার। আজ খানিকটা আগেই খাওয়াদাওয়া সেরে রেখেছেন। টব পরিচর্যার সব জিনিসপত্র সাজানো আছে হাতের সামনে। কাজের মেয়েটাকে বলে ঝাঁজরিতে জল ভরে রাখিয়েছেন সেই কোন সকালে। এত সব আয়োজন যার জন্য, সেই ফ্লেম লিলি গাছে ফুল আর আসছেই না।
রোদটাও বড় বেগড়বাই করছে দিক কয়েক। গত হপ্তায় মাসকাবারি চেক্-আপের সময় ডাক্তারবাবু তো বলেই খালাস, মাসিমা, রোদ-টোদ একটু লাগান শরীরে। ডজন খানেক ক্যালসিয়ামের কৌটো তো মনে হয় সাবাড় করেছেন। আর হাঁটু মুড়ে পুজো বন্ধ করেন নি এতবার বলা সত্ত্বেও, এটা না বললেও বুঝতে পারছি। আর এর আগে পায়ে পরার যে বেল্টটা কিনেছিলেন, সেটাও বোধ হয় প্যাকেট থেকে বের হয় নি, তাই না? যাই হোক, রোদটা লাগান, শরীরে। এই শীতকালের মাসকয়েকই তো রোদে শরীর সেঁকে মজা, তাই না। তারপর তো আধঘণ্টা রোদে বসেছেন, হয় কাবাব নয় তন্দুর।
আপাত গম্ভীর অনুরাধা হেসে ফেলেছিলেন ডাক্তারের কথা শুনে। ওনাকে আর বলতে ইচ্ছে হয় নি, হাঁটুর ব্যাথাটা না থাকলেই এখন যেন মনে হয়, কী একটা নেই যেন। আর রোদের কথা শুনেই তার ওপর বড্ড অভিমান হল অনুরাধার। নিজে তো দিব্বি চলে গেলেন ড্যাং ড্যাং করে। বাড়ির সামনে ছ’তলার দৈত্যাকার ফ্ল্যাটটার ভিত খোড়া দেখলেও, নির্লজ্জের মত সাধের বাড়িটাকে আড়াল হতে দেখতে হল না, এটা, অনুরাধার মতে, একদিকে ভালোই হয়েছে। চাকরি জীবনের প্রথমেই শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে খোলামেলা এই জমিটা পছন্দ করে কেনা। অনুরাধাই বরং গাঁইগুঁই করছিল, বাজার, বাস স্ট্যান্ড, মেয়ের স্কুল - সব এত দূরে হবে। আত্মীয়স্বজনদের কাছেও শুনতে হবে, দু’জনে চাকরি করে এই খোলা মাঠে কেউ বাড়ি করে? তার চেয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনে নিলেই ভালো হত। তখন এই জেলা শহরে সবে দু চারটা ফ্ল্যাট ওঠা শুরু হয়েছে। কারো কোনো কথায় কান না দিয়ে চার কাঠা জমির ওপর অনুরাধাদেরে বাড়িটা যখন শেষ হল, তখন সবাই তাকিয়ে দেখত সেই বাড়ি। দোতলার বড়সড় ঝুলবারান্দায় সারা দিন ধরে রোদ খেলত। ছাদে ভেজা জামাকাপড় না মেললেও চলত এই বারান্দার জন্য।
পূর্নিমার রাতগুলোতে অনুরাধা খুব চাইত, একটু লোডশেডিং হোক। কোনো কোনো সময় হতও। তখনও ঘরে ঘরে ইনভার্টার আসে নি। সবাই মিলে বেতের চেয়ারে বসা হত গোল হয়ে। নিশুত রাতে চাঁদের আলোয় ধুয়ে যেত চরাচর। চোখ বন্ধ করে এখনো এসব দেখতে পান অনুরাধা।
ঝুল বারান্দার কার্নিসে রাখা প্লাস্টিকের টবগুলোর দিকে চোখ গেল অনুরাধার। থোকা থোকা চন্দ্রমল্লিকার বান ডেকেছে। বিভিন্ন রঙের ডালিয়া, ইঁয়া বড় সাইজের গাঁদার দল মালির উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে টবে পোঁতা লাঠিতে ঠেকনা দিয়ে কেত মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এসব ফুল আর অনুরাধাকে তেমন টানে না আজকাল। এ তো সবার বাগানেই ফোটে। খুব যে যত্নআত্তি লাগে, তাও নয়। ঠিকঠাক চারাগাছ পেলে ভালো ফুল ফোটানো অনুরাধার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।
এত সব ফুলের নধর গড়ন দেখেও রোদ নিয়ে অনুরাধার খুঁতখুঁতানিটা আর যায় না কিছুতেই। শীত বিকেলের মরা রোদে হাঁটু সেঁকতে হাউজকোটের ঝুলটা তুলে ধরে অনুরাধা। মেয়ে ফোনে যতই বলুক, ‘আমার কাছে এসো মা, তোমার হাটুজোড়া পাল্টানোর সব ব্যবস্থা করে দেব। আর ভুগতে হবে না’, এই বয়সে আর কাটাছেড়া করতে সায় দেয় না অন্তরাত্মা। রোগভোগের কথা না ভেবে চেয়ারে বসে ফ্লেম লিলিটার দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন অনুরাধা। তারে ঝোলানো সায়াটার ছায়া পড়েছে টবক’টার ওপর। একটু সরিয়ে দিলেই দিব্বি হাল্কা রোদটা এসে লাগতো গাছগুলোতেও। কিন্তু ইজি চেয়ারখানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। অনুরাধাদের বাড়ি আর ঢাউস ফ্ল্যাটখানার মাঝের এক চিলতে ফাঁকটা দিয়ে রোদ আসে এই সময়। তাও মেরেকেটে ঘণ্টা দেড়েকের জন্য। এই সময়টুকুকে তাই হাতছাড়া করতে চান না অনুরাধা। বাড়ির কাজকম্ম মিটিয়ে, বিছানায় গড়ানোর অমোঘ আকর্ষনকে উপেক্ষা করে এই ঘণ্টা দেড়েক সময় অনুরাধার বরাদ্দ থাকে মরা রোদটুকুর জন্য।
এটুকু সময় বাদ দিলে সারাটা দিনই কেমন সন্ধ্যা হয়ে থাকে এখানটায়। ঘরগুলো তো আরো ঘুরঘুট্টি। বড় আলো না জ্বাললে কিচ্ছু দেখার উপায় নেই। বারান্দায় বসলে তবু ক’ত বেলা হল একটা আন্দাজ করা যায়। তবে একমনে থাকার উপায় নেই মটেই। উল্টো দিকের ফ্ল্যাট গুলো থেকে আসা ঝগড়াঝাঁটি, রান্নার ছ্যাঁকছ্যাঁক, ওয়াশিং মেশিনের ঘোঁ ঘোঁ, হোম থিয়েটারের গাঁক গাঁক – এসবের অত্যাচারে একটু খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোর উপায় নেই মোটেও।
বারান্দায় থামে সাঁটা ঢাউস ঘড়িটার দিকে তাকালো অনুরাধা। আগে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সময় জানান দিত সে। সময় বাৎলাতে ভুল না হলেও, সময় জানান দিতে ভুলে যায় আজকাল। সেটা সাড়ানোর কথা বেমালুম ভুলে যায় অনুরাধা। ঘড়ির ছোট কাঁটা চারটের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। পাড়ার বৌদের আসার সময় আছে এখনো। মাঝে মাঝে আসে তারা। একটু গল্প গাছা করে। ফুল দেখে। রোদ পড়ে এলে ফুলের বাহার খোলে না, এটাই ভাবনা। এখন ফুলগুলো ছাড়া আর দেখানোরই বা কি আছে তার? আগে পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো বাড়ি, সেসময়কার ফ্যাশন অনুযায়ী মানানসই আসবাব, মেয়ের ঝাঁ চকচকে রেজাল্ট, ব্যাঙ্কের চাকরি সামলেও তার নিখুঁত শরীরি গড়ন – সেসব দিনের কথা ভেবে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয় অনুরাধার পাঁজর থেকে।
ইজি চেয়ার থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হল অনুরাধার। হাঁটু জোড়া মড়মড় করে আওয়াজ করল। একটু কুঁজো অনুরাধা এগিয়ে গেল ফ্লেম লিলির টবের দিকে। অনলাইনে সপ্তাহ কয়েক আগে ফ্লেম লিলির বাল্ব এসেছে। প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশ মেনেই টবে মাটি, সার মিলিয়ে তবেই সেটা বুনেছে অনুরাধা। পাতাগুলো সরাতেই চোখে পড়ল গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ক'খানা ছোট্ট কুড়ি। সেখানে হলদে পাঁপড়ির আভাস দেখে অনুরাধার মুখে খেলে গেল হাসির ঝিলিক।
পাড়ার বউগুলো আর ক'টা দিন পরে এলে বেশ হবে। অনুরাধার বারান্দার বাগানের তুরুপের তাস আজ আর দেখানো হবে না, এটাই আপসোস। কুঁড়ি দেখে ফ্লেম লিলিকে চেনা যাবে না মোটেই। ঝাঁঝড়ি দিয়ে কিছুটা জল টবে ঢেলে ঘাড় উঁচু করে ফ্ল্যাটের ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে চাইল অনুরাধা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনুরাধা ভাবল, আজ ওদের আসার সময় পেরিয়ে গেছে। টিভি সিরিয়ালগুলো শুরু হব হব করছে। এ সময় আর কেউ বাড়ি থেকে নড়বে না। এক দিকে ভালোই হয়েছে, ভাবল অনুরাধা। দিন কয়েক পরে এলে যদি লিলি ফুলের দেখা মেলে।
আলো মিইয়ে আসছে দ্রুত। একটু বাদেই ঝপ করে অন্ধকার করে আসবে। গা ঘেঁসা ফ্ল্যাটবাড়ি ঘরগুলোতে একে একে জ্বলে উঠছে আলো। সেই ক্ষয়াটে আলোয় কেমন ভুতুড়ে দেখাচ্ছে অনুরাধার বারান্দা।
"দিম্মা, দিম্মা", অনুরাধার মুখোমুখি দোতলার ফ্ল্যাটের স্লাইডিং জানালা ফাঁক করে আধো আধো স্বরে বলল বাচ্চাটা, "তোমান একটা একটা ফুন দাও না। বলো ফুনটা "
বারান্দা আর বাইরের আলোটা জ্বেলে দিল অনুরাধা। আবছা সাদাটে আলোয় মাংকি টুপি পরা বাচ্চাটার হাসি হাসি মুখ মন ভালো করে দিল অনুরাধার।
"মা এখনো আসে নি, তাই না?", অনুরাধা বলল।
"ধুল, আজ দেনি করছে। বলো না, দেবে না বলো ফুনটা", চিৎকার করে বলল বাচ্চাটা।
"তোমায় কতগুলো ছোট ফুন দেব, দাদাভাই। সবে কুঁড়ি এসেছে। মা কে বোলো, হলুদ রঙের ফ্লেম লিলিগুলোকের ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখবে। তোমার দারুন লাগবে, দেখো।"
খিলখিল করে হেসে উঠল বাচ্চাটা। এক চিলতে ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে হাওয়া আসছে। খুব শীত করছে। অনুরাধা দেখল, হাওয়ায় দুলছে ফ্লেম লিলির কুঁড়ি।
--------------
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।