সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং য়থা পূর্বে সংজানানা উপাসতে।।
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভি মন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি।
সমানী ব আকুতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমস্তু বো মনো য়থা বঃ সুসহাসতি।।
(ঋগবেদ ১০/১৯১/২-৪)
অনুবাদ- হে মনুষ্য! তোমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলে আলোচনা কর, তোমাদের মন উত্তম সংস্কার যুক্ত হোক। পূর্বকালীন জ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করেছে তোমরাও সেরূপ কর। তোমাদের সকলের মন্ত্র এক হোক, মিলনভূমি এক হোক, মন এক হোক, সকলের চিত্ত এক হোক। তোমাদের সকলকে একই মন্ত্রে সংযুক্ত করেছি, তোমাদের সকলের জন্য অন্ন ও উপভোগ একই প্রকারে দিয়েছি। তোমাদের সকলের লক্ষ্য সমান হোক, তোমাদের হৃদয় সমান হোক। তোমাদের মন সমান হোক, এই ভাবে তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হোক।
ঋগবেদের দশম মণ্ডলের সর্বশেষ অর্থাৎ ১৯১ তম সুক্ত, সংজ্ঞান সুক্ত থেকে নেওয়া ওপরের শ্লোকটি। সুক্তটিকে ধর্মনিরপেক্ষ সুক্ত বলা হয় কারণ সুক্তটিতে প্রকাশিত হয়েছে একতার বাণী, সংহতির চিন্তা, সুস্থ সামাজিক জীবন পরিচালিত করার নির্দেশ। ঋগবেদের মন্ত্রকেই ব্যবহারিক অর্থাৎ সহজ, সরল ভাষায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের কবিতায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে লিখেছিলেন –
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,
পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট,
বাংলার বন, বাংলার মাঠ—
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক,
পূর্ণ হউক হে ভগবান॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা—
সত্য হউক, সত্য হউক,
সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,
বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন—
এক হউক, এক হউক,
এক হউক হে ভগবান॥
তারও অনেক আগে ১৮৬৭ সনে (এই সালের উল্লেখ বেশীরভাগ জায়গায় পাওয়া গেলেও তথ্যের সাথে মেলে না। প্রশান্ত কুমার পাল তাঁর "রবিজীবনী"র প্রথম খন্ডে উল্লেখ করেছেন পৌষ ১২৮৩ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৭৬ সনের শেষ বা ১৮৭৭ সনের শুরু। আবার ১৮৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ৭ বছর, সুতরাং ১৮৭৬ বা ১৮৭৭ সন হওয়া অধিক যুক্তিগ্রাহ্য) জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী একতার বাণীকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, গণচেতনার উন্মেষের জন্য, গণজাগরণের উদ্দ্যেশ্য নিয়ে তৈরী করে ফেলেছে "সঞ্জীবনী সভা"। ঋগবেদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের জনগণকে স্বদেশিকতার মন্ত্রে জাগ্রত করার লক্ষে তৈরী হয়েছিল এই গুপ্ত সমিতি। এই সভা সম্পর্কে- রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে লিখেছেন-
জ্যোতিদাদার উদ্যোগে আমাদের একটি সভা হইয়াছিল, বৃদ্ধ রাজনারায়ণবাবু [রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৯০০)] ছিলেন তাহার সভাপতি। ইহা স্বাদেশিকের সভা। কলিকাতায় এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসিত ("ঠন্ঠনের একটা পোড়োবাড়িতে এই সভা বসিত" -জ্যোতিস্মৃতি)। সেই সভার সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল। বস্তুত, তাহার মধ্যে ঐ গোপনীয়তাটাই একমাত্র ভয়ংকর ছিল। আমাদের ব্যবহারে রাজার বা প্রজার ভয়ের বিষয় কিছুই ছিল না। আমরা মধ্যাহ্নে কোথায় কি করিতে যাইতেছি, তাহা আমাদের আত্মীয়রাও জানিতেন না। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋক্মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপিচুপি— ইহাতেই সকলের রোমহর্ষণ হইত, আর বেশি-কিছুই প্রয়োজন ছিল না। আমার মতো অর্বাচীনও এই সভার সভ্য ছিল। সেই সভায় আমরা এমন একটি খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে, অহরহ উৎসাহে যেন আমরা উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ আমাদের কিছুই ছিল না। এই সভায় আমাদের প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো। বীরত্ব জিনিসটা কোথাও বা সুবিধাকর কোথাও বা অসুবিধাকর হইতেও পারে, কিন্তু ওটার প্রতি মানুষের একটা গভীর শ্রদ্ধা আছে। সেই শ্রদ্ধাকে জাগাইয়া রাখিবার জন্য সকল দেশের সাহিত্যেই প্রচুর আয়োজন দেখিতে পাই। কাজেই যে-অবস্থাতেই মানুষ থাক্-না, মনের মধ্যে ইহার ধাক্কা না লাগিয়া তো নিষ্কৃতি নাই। আমরা সভা করিয়া, কল্পনা করিয়া, বাক্যালাপ করিয়া, গান করিয়া, সেই ধাক্কাটা সামলাইবার চেষ্টা করিয়াছি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনস্মৃতিতে এ বিষয়ে লিখেছেন -
'সভার অধ্যক্ষ ছিলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু। কিশোর রবীন্দ্রনাথও এই সভার সভ্য ছিলেন। পরে নবগোপালবাবুকেও সভ্যশ্রেণীভুক্ত করা হইয়াছিল। সভার আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল ভাঙা ছোটো টেবিল একখানি, কয়েকখানি ভাঙা চেয়ার ও আধখানা ছোটো টানাপাখা― তারও আবার এক দিক ঝুলিয়া পড়িয়াছিল।
'জাতীয় হিতকর ও উন্নতিকর সমস্ত কার্যই এই সভায় অনুষ্ঠিত হইবে, ইহাই সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। যেদিন নূতন কোনো সভ্য এই সভায় দীক্ষিত হইতেন সেদিন অধ্যক্ষমহাশয় লাল পট্টবস্ত্র পরিয়া সভায় আসিতেন। সভার নিয়মাবলী অনেকই ছিল, তাহার মধ্যে প্রধান ছিল মন্ত্রগুপ্তি; অর্থাৎ এ সভায় যাহা কথিত হইবে, যাহা কৃত হইবে এবং যাহা শ্রুত হইবে, তাহা অ-সভ্যদের নিকট কখনও প্রকাশ করিবার কাহারও অধিকার ছিল না।
'আদি-ব্রাহ্মসমাজ পুস্তকাগার হইতে লাল-রেশমে-জড়ানো বেদমন্ত্রের একখানা পুঁথি এই সভায় আনিয়া রাখা হইয়াছিল। টেবিলের দুই পাশে দুইটি মড়ার মাথা থাকিত তাহার দুইটি চক্ষুকোটরে দুইটি মোমবাতি বসানো ছিল। মড়ার মাথাটি মৃত-ভারতের সাংকেতিক চিহ্ন। বাতি দুইটি জ্বালাইবার অর্থ এই যে, মৃত-ভারতে প্রাণসঞ্চার করিতে হইবে ও তাহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া তুলিতে হইবে। এ ব্যাপারের ইহাই মূল কল্পনা। সভার প্রারম্ভে বেদমন্ত্র গীত হইত-সংগচ্চধ্বম্ সংবদধ্বম্। সকলে সমস্বরে এই বেদমন্ত্র গান করার পর তবে সভার কার্য (অর্থাৎ কিনা গল্পগুজব) আরম্ভ হইত। কার্যবিবরণী জ্যোতিবাবুর উদ্ভাবিত এক গুপ্তভাষায় লিখিত হইত। এই গুপ্তভাষায় 'সঞ্জীবনী সভা'কে 'হামচুপামূ হাফ্' বলা হইত।
―জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ১৬৬-৬৭
এই সভার প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায় না। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর “রবিজীবনী”র প্রথম খণ্ডে (ভূর্জপত্র, ১৩৮৯, ১ বৈশাখ। পৃষ্ঠা ৩০৫) 'সঞ্জীবনী সভা' আয়ুষ্কাল সম্পর্কে লিখেছেন '...অনুমান করা যায় সঞ্জীবনী সভার আয়ুষ্কাল মোটামুটি ছ'মাস -পৌষ ১২৮৩ থেকে জ্যৈষ্ঠ ১২৮৪ পর্যন্ত বিস্তৃত।' ধারণা করা হয়- এই সভার অনুপ্রেরণায় তিনি একটি গান রচনা করেছিলেন। গানটি হলো―
তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ [জাতীয় সংগীত-৮]
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থের 'স্বাদেশিকতা' অংশে আরও একটি গানের উল্লেখ করেছেন। এই গানটি হলো―
এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন [জাতীয় সংগীত-৭]
এই গানটির রচয়িতা নিয়ে সংশয় ছিল, পরে এটি রবীন্দ্রনাথের গান হিসাবেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
ঠাকুরবাড়িতে একসময় সবরকম ক্রিয়াকাণ্ডের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর অনুগত কিশোরবাহিনীর একজন। হামচূপামূহাফ একটি গুপ্তসভার সাংকেতিক নাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গুপ্তসভার গুরুত্ব ছিল অনেকটাই। ঠাকুরবাড়িতে এই গুপ্তসভার উদ্যোগের মূল কারণ ছিল স্বাদেশিকতা। তবে ধীরে ধীরে এই সভায় বিচিত্র কর্মকাণ্ডের ভিড়ে প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। তবে, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে অমলিন হয়েছিল হামচূপামূহাফ। এই গোপন গুপ্তসভা, পোড়োবাড়িতে তার অধিবেশন, ঋগ্বেদের পুথি, মড়ার মাথার খুলি, খোলা তলোয়ার নিয়ে অনুষ্ঠান— এইসব রোমাঞ্চকর স্মৃতির কোলাজ সভাটিকে ঘিরে সদস্যদের আবেগের নস্টালজিয়াকে আরও প্রতিষ্ঠা দিত। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব। তিনি সভার সকলকে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথকেও। সভাটির আসল নাম ছিল ‘সঞ্জীবনী সভা’। পরাধীন ভারতবর্ষকে নতুন করে জাগিয়ে তোলাই ছিল এই সভার উদ্দেশ্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই সভার ধারণা পেয়েছিলেন ইতালির ‘কার্বোনারি সভা’র থেকে। মাৎসিনি ছিলেন এই সভার প্রতিষ্ঠাতা। ‘কার্বোনারি’ কথার অর্থ হল the charcoal burners— সভার সবরকম কাজকর্ম হত সাংকেতিক ভাষায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হামচূপামূহাফেও এই সংকেত ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। প্রথমদিকে, মানে ১৮৭৭ সালে সভার সদস্যদের উৎসাহ ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু অতি আবেগ অনেক অসাধ্য পরিকল্পনার জন্ম দিয়েছিল। স্বদেশ উদ্ধার ও বিলিতি বস্তু বয়কটের তাগিদে অনেক জল্পনা কল্পনা হত। দেশলাইয়ের কারখানা, কাপড়ের কল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই দেশলাই কারখানা থেকে কয়েকটি দেশলাই বাক্স বেরোলেও এক বাক্স দেশলাইয়ের জন্য যা খরচ হয়েছিল তাতে একটা পল্লীর সম্বৎসরের চুলা ধরানো চলত। রবীন্দ্রনাথ পরে লিখেছিলেন, দেশের প্রতি ওই জ্বলন্ত অনুরাগ যদি ওই দেশলাই কাঠির জ্বলনশীলতা বাড়াতে পারত তবে তারা বাজারে চালু থাকত। কাপড়কলের ইতিহাসও দুঃখজনক। এক অল্পবয়স্ক ছাত্রের কাপড়কলের জন্য যথেষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই কাপড়কল একটি মাত্র সবেধন নীলমণি গামছা প্রসব করে দেহ রেখেছিল। কিন্তু সেই একটুকরো গামছা মাথায় বেঁধে দুহাত তুলে আশ্চর্য ভঙ্গিতে নেচেছিলেন ব্রজনাথ দে। তিনি আবার রবীন্দ্রনাথের শিক্ষকও ছিলেন। সভার অন্য সভ্যরাও সেই উদ্বাহু নৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন। এই আবেগভরা উন্মাদনাই ছিল হামচূপামূহাফের প্রাণ।
এই সভাকে ঘিরে একটা রোমাঞ্চকর গোপনীয়তা ছিল। যদিও তাদের আচরণে রাজা বা প্রজার ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু ভরদুপুরে তাদের গতিবিধি বিষয়ে আত্মীয়পরিজন কেউ কিছু জানতেন না। রুদ্ধ ঘরে, ঋকমন্ত্রে দীক্ষা, চুপিচুপি কথায়, অব্যক্ত ভাবাবেগে, ভীষণ গাম্ভীর্যে সঞ্জীবনী সভা ওরফে হামচূপামূহাফ বেশ জমজমাট ছিল।উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে একর পরিত্যক্ত স্কুলবাড়িতে সভা বসত। একটা ভাঙা টেবিল, কয়েকটি ভাঙা চেয়ার, একদিকে ঝুলে পড়া ভাঙা টানা পাখা আর লাল রেশমে জড়ানো একটি বেদমন্ত্রের পুথি— বেশ একটা আবহ তৈরি করত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য টেবিলের দু-পাশে রাখা ছিল দুটি মড়ার মাথা, তাদের চোখের কোটরে মোমবাতি জ্বলত। মড়ার মাথা ছিল দুর্বল ভারতের প্রতীক, বাতি জ্বালানো ছিল মৃত ভারতে প্রাণ সঞ্চারের প্রতীক। ‘সং গচ্ছ্বধ্বম্ সং বদধ্বম্’ গেয়ে সভার কাজ শুরু হত। নতুন কোনো সভ্য দীক্ষা নিলে রাজনারায়ণ বসু লাল পাটের বস্ত্র পরে আসতেন। মন্ত্রগুপ্তির গুরুত্ব সভার সব সভ্যরা জানতেন। প্রাণ থাকতে সভার কথা বাইরে যাবে না— এই ছিল তাঁদের পণ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জনের সাহায্যে সাংকেতিক বর্ণমালা তৈরি করেছিলেন । ‘হামচূপামূহাফ’ নামকরণটি আর সভার কাজ ওই ছদ্ম বর্ণমালা অনুসারেই হত। এই সভার কাজে আরেকটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। একটি সর্বজনীন ভারতীয় পোশাকের কথা ভাবা হয়েছিল সেই প্রস্তাবে। ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবী ঐক্যের কথা ভেবে পোশাক পরিকল্পনার ভার নিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। অনেক ভেবে ঠিক হল, মালকোঁচা মেরে পরা কাপড় ও মাথায় যাতে রোদবৃষ্টি না লাগে তার জন্য মাথায় শোলার টুপির উপর পাগড়ি বসানো শিরস্ত্রাণ হবে সর্বজনীন ভারতীয় পোশাক। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাজামার উপর একখণ্ড কাপড় পাট করে কৃত্রিম মালকোঁচার মতো করে পরে, মাথায় শোলার টুপির উপর শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে শহর পরিক্রমায় বেরোলেন। সকলের বিস্মিত চোখ তাঁকে থামাতে পারে নি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এমন বীরপুরুষ অনেক থাকিতে পারে কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য সর্বজনীন পোশাক পরিয়া গাড়ি করিয়া কলকাতার রাস্তা দিয়া যাইতে পারে এমন লোক নিশ্চয়ই বিরল।’ এই সভার উদ্যোগে বন্দুক চালনা এবং শিকার করার ব্যবস্থা হয়েছিল। উদ্দেশ্য —দেশবাসীকে সাহসী করা। শিকারের আয়োজন থাকত, খাবাররের ব্যবস্থা থাকত। কিন্তু শিকার ছিল গৌন। এই সভার জন্যই একটি ইটিং ক্লাব তৈরি হয়েছিল। পালা করে সভ্যদের খাবারেরও আয়োজন করতে হত। সে এক কাণ্ড বটে। হয়তো অতিরিক্ত আবেগ সব উদ্যোগকে সফল হতে দেয়নি। হামচূপামূহাফ এমনি এক কর্মকাণ্ড। তবু পরাধীন ভারতবর্ষে কয়েকটি তরুণ ও কিশোরের এই গোপন সভাটি স্নিগ্ধ মাটির পিদিমের মতোই বাঙালির স্মৃতির ঘরে জ্বলছে, জ্বলবে। অতীতের স্মৃতির প্রকোষ্ঠ থেকে ঠিকরে আসা এ এক অন্য জ্যোতি।
আবার অন্য সূত্রে পাওয়া যায় যে, ১৮৭৫ সালের জুলাই মাসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিলেত থেকে ফিরেছেন ব্যারিষ্টার হয়ে। সেই সময়ে ব্যারিস্টারী ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় আর অর্থকরী পেশা। কিন্তু সেই মোহ ত্যাগ করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরুণসমাজকে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবার কাজে। সঙ্গে পেলেন আনন্দমোহন বসু, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ও আরও কয়েকজনকে। তাঁদের বক্তৃতায়, ইতালিকে অস্ট্রিয়ার-শাসন থেকে মুক্ত করবার জন্য কার্বোনারি-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত গুপ্তসমিতির কার্যকলাপ তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এক দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। শোষক ইংরাজকে দেশ থেকে বহিষ্কার, স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার আর দেশমাতৃকাকে ভালোবাসবার প্রতিজ্ঞায় এখানেও গড়ে উঠেছিল ছোটো ছোটো অনেক গুপ্তসমিতি। উত্তেজনার আঁচ এসে পড়ল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেও। বৈপ্লবিক কাজ করবার অদম্য বাসনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রাজনারায়ন বসুর উদ্দ্যোগে তৈরি হল সঞ্জীবনী সভা নামে এক গুপ্ত সমিতি। সভার সাঙ্কেতিক নাম হামচুপামূহাফ। সভাপতি মনোনীত হলেন রাজনারায়ণ বসু। ভয়ংকর রহস্যাবৃত এই গোপন সভার উদ্দেশ্য স্বাদেশিকতা। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সবেমাত্র ১৫ বছর। তিনিও যোগ দিলেন এই যজ্ঞে। সমিতির অফিস ছিল ঠনঠনিয়ার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পোড়ো বাড়িতে। আসবাব বলতে ভাঙা টেবিলচেয়ার, হেলে পড়া টানাপাখা আর টিমটিমে তেলের প্রদীপ। সেখানে ‘দ্বার রুদ্ধ, ঘর অন্ধকার, কথা চুপিচুপি, উত্তেজনা চরম’। সঞ্জীবনী সভার নূতন সদস্যদের দীক্ষাদান হত ঋকমন্ত্রে। গভীর রাত্রে অগ্নিকুণ্ডের সামনে, বুকচিরে রক্ত দিয়ে বটপাতায় লিখে দিতে হত মন্ত্রগুপ্তির প্রতিজ্ঞা। তারপরে সেই রক্তলেখা বটপাতা পোড়ানো হত পবিত্র হোমাগ্নিতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই দীক্ষানুষ্ঠানের এক অসাধারণ বর্ণনা লিখেছেন তাঁর স্মৃতিচারণায় , ‘যেদিন নূতন কোনও সভ্য এই সভায় দীক্ষিত হইতেন সেদিন অধ্যক্ষমহাশয় লাল পট্টবস্ত্র পরিয়া সভায় আসিতেন।.. আদি-ব্রাহ্ম সমাজ পুস্তকাগার হইতে লাল-রেশম জড়ানো বেদ-মন্ত্রের একখানা পুঁথি এই সভায় আনিয়া রাখা হইয়াছিল। টেবিলের দুইপাশে দুইটি মড়ার মাথা থাকিত, তাহার দুইটি চক্ষুকোটরে দুইটি মোমবাতি বসানো ছিল। মড়ার মাথাটি মৃত ভারতের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। বাতি দুইটি জ্বালাইবার অর্থ এই যে, মৃত-ভারতে প্রাণসঞ্চার করিতে হইবে ও তাহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া তুলিতে হইবে’। এইভাবে গগনচন্দ্র হোম, ব্রজনাথ দে, নবগোপাল মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিগণ সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। সভা শুরু হত বেদমন্ত্র গানে, কার্যবিবরণী লেখা হত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্ভাবিত গুপ্তভাষায়। সভার কাজটি কেমন ছিল? রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘আমরা সভা করিয়া, কল্পনা করিয়া, বাক্যালাপ করিয়া, গান গাহিয়া সেই ধাক্কাটা (উত্তেজনার আগুন) সামলাইবার চেষ্টা করিয়াছি।…তাহাতে ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ইস্টকও খসে নাই’। কিন্তু কিছু কাজের চেষ্টাও হয়েছিল। সদস্যরা নিজেদের আয়ের দশ শতাংশ দান করতেন। সেই টাকায় একটা স্বদেশী দেশলাই কারখানা স্থাপন করা হল। অনেক গবেষণা ও অর্থব্যায়ের পরে যে দেশলাই তৈরি হল তার একটি বাক্সের যা খরচ পড়ল, তাতে সারা পাড়ার সম্বৎসরের উনুন ধরানো যেত। এর পরের প্রচেষ্টা হল স্বদেশী কাপড়। অনভিজ্ঞ সদস্যরা প্রচুর ঋণ নিয়ে কিনে ফেললেন কাপড় তৈরির সরঞ্জাম। বহু প্রতীক্ষার পর, ‘অবশেষে ব্রজবাবু একদিন মাথায় একটা গামছে বেঁধে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উপস্থিত এবং তঁদের কলে এই গামছার টুকরো তৈরি হয়েছে বলে তাণ্ডব নৃত্য জুড়ে দিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অনেক গবেষণা করে ভারতবাসীর জন্য এক অভিন্ন সার্বজনীন পোষাক উদ্ভাবন করলেন। কেমন সেটি? বলা যায় পাজামা, ধুতি, শোলার টুপি আর পাগড়ির মিশ্রণে তৈরি এক অপরূপ পোষাক। বলাবাহুল্য স্বয়ং আবিষ্কারক ছাড়া আর কেউ এই পোষাক পরিধান করতে সাহস পাননি। সঞ্জীবনী গুপ্ত সভার সদস্যদের উদ্দীপ্ত করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছেন। তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ এবং একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন। শেষোক্ত গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা পুরুবিক্রম নাটকে ব্যবহৃত হয়েছিল। রাজনারায়ণবাবু গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে, হাতপা নাড়িয়ে চিৎকার করে এই গানগুলি গেয়ে সংস্থার সদস্যদের উজ্জীবিত করতেন।
এতসব ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ কাজের টেনশন থেকে মাঝে মাঝে মুক্তি পাবার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সঞ্জীবনী সভার সদস্যরা সদলবলে শিকারে বেরোতেন। সঙ্গে থাকত কাদম্বরীদেবীর হাতের তৈরি ‘রাশিকৃত লুচি তরকারি’। শিকারের ক্ষেত্রটি ছিল মানিকতলার কোনও পোড়ো বাগান বাড়ি। দলে জুটে যেত চেনাঅচেনা ছোটোবড়ো নানা শ্রেনীর লোক। সেই রোমাঞ্চকর শিকারের বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, ‘এই শিকারে রক্তপাতটাই সবচেয়ে নগণ্য ছিল। শিকারের অন্য সমস্ত অনুষ্ঠানই বেশ ভরপুরমাত্রায় ছিল। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসিয়া উচ্চনীচ নির্বিচারে সকলে এক্ত্র মিলিয়া লুচির উপরে পড়িয়া মুহূর্তের মধ্যে কেবল পাত্রটাকে মাত্র বাকি রাখিতাম’।
এইভাবে সঞ্জীবনী সভা দেশসেবার মহতী উদ্দেশ্যে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন। ধীরে ধীরে সদস্যসংখ্যাও বেড়েছিল একটু একটু করে। কিন্তু সব ভালো কাজের মধ্যেও কিছু সন্দেহপ্রবণ মানুষ থাকে। এখানেও কিছু ‘সুবুদ্ধি লোক’ এসে জুটল। তাদের জ্ঞানগর্ভ পরামর্শে সঞ্জীবনী সভার সদস্যরা রাষ্ট্রীয়-বিদ্বেষের আশঙ্কায় নিজেদের গুটিয়ে নিলেন। মাত্র ছয়মাসেই (১৮৭৬-১৮৭৭) শেষ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনাময় বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানের।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গুপ্তভাষার কৌশল
আকার = অকার | অকার = আকার | ই = উ | ঈ = উ |
উ = ই | উ = ঈ | এ = ঐ | ঐ=এ | ও = ঔ | ঔ = ও
ক খ গ ঘ = গ ঘ ক খ | চ ছ জ ঝ = জ ঝ চ ছ | ট ঠ ড ঢ = ড ঢ ট ঠ
ত থ দ ধ = দ ধ ত থ | প ফ ব ভ = ব ভ প ফ | শ ষ স = হ
হ = স | র = ল | ল =র | ম = ন | ন = ম
স ন্ জী ব নী স ভা = হা ম্ চু পা মূ হা ফ্
এই সভা কি কেবলই ঠনঠনিয়ার পোড়ো বাড়িতে গভীর রাতে হত? অন্য স্থান ও সময়ের উল্লেখও পাই। “কোন এক ব্রাহ্মণ জমিদার সভ্যের গঙ্গার ধারের বাগানবাড়িতে” আর সময় বোধহয় সন্ধ্যা। কেন না উল্লেখ আছে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আর একটা গানের উল্লেখ পাই। ” আজি উন্মদ পবনে “। স্মৃতি হয়তো প্রতারিত হয়েছে, কোন গানের প্রথম পঙ্ক্তি এই রকম নেই। এই সময় ভারতী পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি গান একসঙ্গে প্রকাশিত হয়। শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটা নিশীথ যামিনীরে। এই রকম পঙ্ক্তি আছে। যদিও সঞ্জীবনী সভার কেন্দ্রীয় ভাবনার সঙ্গে এই গানের কোন মিল নেই। হয়তো সেদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রাজনারায়ণকে এই গান গাইতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
গ্রন্থঋণ-
জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ - পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।