এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ফটোদার চায়ের দোকান

    Himadrisekhar Datta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ আগস্ট ২০২৩ | ৪৯৭ বার পঠিত
  • নামটা খুবই আনকমন। যদি মধ্যিখান থেকে লাইটেড ব্যানার বক্সে লাগানো, পুরো নামটা থেকে "দা" অক্ষরটা ঝরে যায়, তাহলে আরোও আজগুবি হয়ে পড়বে নামটা। অটোতে করে সন্ধ্যাবেলায়, সিঁথি, মণ্ডলপাড়ায় ভাইয়ের বাড়ি যেতে যেতে এই দোকানের নামটি চোখে পড়ার পর থেকে, এর বুতপত্তি নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে থাকি। আসলে আমি যে কত উঁচু দরের অকেজো মানুষ, এটি তার একটি উৎকৃষ্ট  উদাহরণ হিসেবে, অবশ্যই গণ্য করতে পারেন।

    আসলে বরাহনগর বাজার যাবার পথে, কমলা মেডিকেল স্টোর্সের আগে, এই সদা ব্যাস্ত চায়ের দোকানটির বয়স, প্রায় আমার সমান। দু-পা পিছিয়ে আসলেই, রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়, যেখানে আমি পড়ার, স্কুল করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেটা ষাট দশকের কথা, ১৯৬২। তখন এই দোকানে যাতায়াত যারা করতেন, তারা অধিকাংশই হতেন মিশনের শিক্ষকরা। স্কুল শেষ করে, বাড়ি যাবার পথে। সন্তোষদা আর কেমিস্ট্রির মোটা নন্দদাকে আমি প্রায়ই দেখতাম এই দোকানে, দেওয়ালের সাথে লাগানো ছোট ছোট টেবিলে, ছোট ছোট কাপে চা খেতে। বেঞ্চিও ছিল দোকানে, সেখানে লম্বা সময়ের চা-খোর'রা বসে, নানা কথা নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকতেন। সেখানে সোনার দামের ওঠাপড়া থেকে নেহরু টিটো পর্যন্ত থাকত। বরানগর সে সময়ে পশ্চিমবাংলার একটি উচ্চ শিক্ষিত শহরতলীর মধ্যে গণ্য হত। এই চায়ের দোকানের আরোও একটা ইতিহাস আছে, সেটা আমার ব্যক্তিগত জীবনের সাথে জড়িত। তাই সেটা এখানে উল্লেখ করব না। যদিও স্কুল জীবনে আমি কখনও চা খাই নি, তবে চা খাবার চান্স হত প্রথম, প্রথম- খুব বৃষ্টি ঝরা দিনে, মায়ের কাছে আবদার করে করে - হাফ হাফ কাপ। অবশ্য সাথে ছোটরা চা খায় না, এই আপ্তবাক্য ভুলে না যাবার কথা বার বার মনের ভিতরে গেঁথে নিয়ে। এরপর কলেজ ক্যান্টিনে, পাল্লায় পড়ে যখন একটুখানি গোল্লায় যাব বলে ঠিক করি, তখন সাদা সাদা লম্বাটে কাপে এই গরম তরলটি খেতে শুরু করি। কিন্তু সেখানেও দুটো চা নিয়ে চারটে বা পাঁচটা বানিয়ে। আমাদের প্রাক যৌবনের ক্যান্টিন যাত্রা আসলে কখনই চা কেন্দ্রিক এমন কি খাওয়া কেন্দ্রিকও হত না। আমাদের অফ পিরিয়ডের সাথে হিস্ট্রি আর ইংলিশের ক্লাসগুলোরও অফ পিরিয়ড হত। আর এ'দুটো ক্লাস ছিল,কলেজের খাজানা, কলেজ গার্লদের খাজানা। আমাদের জিওলজি বিভাগের বিল্ডিং ছিল প্রেসিডেন্সী কলেজের শেষ মাথায়, নারী বর্জিত। মানে ডিপার্টমেন্টের পেছনের কোলাপসেবল গেট, সোজা হিন্দু হোস্টেলের গলিতেই খুলত। হিস্ট্রি আর ইংলিশ ক্লাস হত মেইন বিল্ডিং-এ যেখানে গম্বুজের মাথায় ঘড়ি লাগানো। আর ক্যান্টিন ছিল এই মেইন বিল্ডিং এর পিছনের দিকে। বাংলা বিভাগের করিডর দিয়ে শেষ মাথায়। কলেজের এই পিছন দিকে অনেক গাছপালা, একটা ছোট বাগান মত ছিল।

    ফটোদার দোকানের টিউব লাইটের বক্সড প্যানেলড নাম দেখে, এত সব কথা, মনের মধ্যে দিয়ে নির্বাক চলচ্চিত্রের মত পার হয়ে গেল। এরই মধ্যে সিঁথির মোড় চলে এসেছে - এই অটোর  টার্মিনাল স্টপেজ। ভাড়া দিয়ে, রাস্তা (বি.টি.রোড) পার করে, আর.বি.টি স্কুলের পাশের গলিতে অন্য আর একটি অটো স্ট্যান্ডে চলে আসি। এই অটো আমাকে নিয়ে মন্ডলপাড়ায়, ক্যালকাটা পাবলিক স্কুলের সামনে। সেখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট ভাইয়ের বাড়ি।
    সেই অটোতে বসে, আমার মনের ভেতর ফটোদার নামটা নিয়ে গল্প তৈরী হতে থাকলো।
    ফটোদার আসল নাম নিশ্চয়ই ফটিক চরণ হবে। বলা বাহুল্য এই ফটিক নামটি বাংলায়, স্ফটিক শব্দেরই অপভ্রংশ। কে এই স্ফটিক? তার আবার চরণ? স্ফটিক কি তাহলে শিবের আর এক নাম? শিবুচরণ বা শিবচরণ রাখার বদলে ফটিক চরণ। স্কুলে পড়ার সময় নিশ্চয় করে, এই নাম "ফটকে" হয়েছিল। মিশনেই পড়তেন কি আমাদের স্ফটিক ওরফে ফটিক চরণ? পড়লে আমার সমসাময়িকই হবে সেই ছেলে। কিন্তু কি কারণে, যে সে স্কুল শেষ করতে পারে নি, জানি না। হয়ত, কম বয়সে বাবা চলে গেছিলেন, পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যায়। ফটিকের মা? কোন বড় ভাই? কোন মামা, মাসী কেউ কেন তাকে আর পড়ালো না?
    কিংবা পড়িয়েছে - পাশ কোর্সে, ইতিহাস বা বাংলা নিয়ে পাশও করেছিল হয়ত, কিন্তু নম্বর আর নিজের নামের কারণে হয়ত কেউ চাকরি দেয় নি। শেষে এই চায়ের দোকান? কিন্তু চায়ের দোকান তো আমি স্কুল লাইফের শুরু থেকেই দেখছি।
    তবে এই ফটিক আদৌ স্কুলে পড়া নয়? বারাসতের সীমা পেরিয়ে আসা কোন বাচ্ছা ছেলে? যে তার ভাই বোন মা বাবা আর বিয়ে না হওয়া পিসির সাথে, এই বরানগরের জন জঙ্গলে এসে মিশে গেছিল। সব খুইয়ে আসা মানুষগুলির যতগুলি পেট, প্রায় ততগুলি আয় না হলে, দিন গুজরান মুস্কিলের পাহাড়। বাজারের কাছে চায়ের দোকানে কাপ ডিশ ধোয়ার কাজে জুটে যায় সে। সেটা ১৯৭১-৭২ সালের কথা।
    মণ্ডলপাড়া নেমে - আপাতত: আমার গল্পকে বিরতি দিলাম। ভাইয়ের বাড়ি অসুস্থ ভাই বৌ-কে দেখতে এসেছি। মনের পট একেবারেই বদলে নিতে হল। এখন যা কিছু কথা, যা কিছু ভাবনা সবই, বাস্তব সময়ের এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে আলোচিত হবে। কথা কম বলি, তবে কখনও কখনও বাচালও হয়ে পড়ি, আলোচনার গতি প্রকৃতি বুঝে। হয়ত,যে কথা যেখানে বলার নয়, তাও বলে ফেলি। তাকেই তো লোকে বাচাল বলে। সেই যে আমাদের গোল্ডেন ভয়েস হেমন্ত মুখার্জির একটি গানের লাইন আছে না,'বহুদিন এমন কথা বলার সুযোগ,পাইনি যেন'। সেই এমন কথাটা কি? বেশি করে কথা বলাই না!  তাই তো গেয়েছেন, 'একটু বোসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোন'।
    ঘন্টা দেড়েক পরে, ফিরতি পথে আবার দোকানটা পথে পড়লো।
    ফটকে থেকে ফটো'দা-র মেটামরফোজড হওয়াটা কিছুতেই মাথায় খেললো না তখন চলার পথে। চায়ের দোকানের পুরোন আসল মালিক হয়ত, অপুত্রক বা অবিবাহিত ছিলেন। অথবা তার ছেলেরা চায়ের দোকান চালাতে চায় নি। তখন ফটিককেই তিনি দোকানটা লিখে দিয়ে গেলেন, চোখ বোঁজার আগে। ছেলেরা এসে লাভের ভাগ চাইতো প্রথম প্রথম। ততদিনে,সারা বাংলা সিদ্ধার্থ শংকরের কালো কোট ঝেড়ে ফেলে, রাশিয়ার ক্রিমসন লালে, লাল হয়ে উঠেছে। খুবই সংঘটিত পার্টি আর তার নেতারা। আমার হঠাৎ মনে হল, লিখতে লিখতে, যদি সিপিএম-র পতাকার মত, কমরেডদের প্রতি তাদের স্যালুট পদ্ধতি এই সবই যেমন নিয়ম মেনে হত, যদি তাদের ড্রেস কোডও নিয়ম মেনে লাল হত! তবে জ্যোতি বাবুকে লাল ধুতি পাঞ্জাবিতে কেমন দেখাত? সাদা অ্যাম্বাসেডার থেকে লাল জ্যোতি বাবু বেরোলেন।
    চীনে এক সময় ছিল রেড ফৌজ।
    যাই হোক, সেই মালিকের ছেলেদের,ফটিক, পার্টির ব-দৌলতে ফুটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কে জানে, হয়ত সেই থেকে তার নাম পড়ে যায় ফোটো মাস্তান। মাস্তানি করা, বাঙালির ছেলেপুলেরা সেই সময় থেকেই শেখে। এই শব্দবন্ধটি বাংলা ভাষা এবং রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে শুরু করে, সেই থেকেই। পরে সময়ের সাথে, তার সাথে আরোও অনেক অপগুণাবলী জুড়ে যায়।

    ফটোদা নাম নিয়ে, আমার নিজের এই গল্পটা যে খুব পছন্দসই হয়েছে, তা মোটেই নয়। তবে একবার ভাবছি,এই ব্যাপারে, সরেজমিন একটা তদন্ত সারতে, ফটোদার দোকানে চা খেতেই যাব। আসুন না আমার সাথে। সামনের রবিবার, সকালের দিকে, বাজারটা সেরেই।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb91:142e:498e:23fe:d54:2f3a:***:*** | ১০ আগস্ট ২০২৩ ১৯:০৯522337
  • চমৎকার লাগলো। এই ব্যাকগ্রাউন্ড গল্প খোঁজার বাতিকটা আমারও কতকটা আছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন