এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাংলায় রামকথা এবং সীতার জন্ম

    TANJAN BOSE লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ জুলাই ২০২৩ | ৪৫৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • #বাংলার_উপকথা ৩

    সীতার জন্মকথা
    --------------

    আগের পর্বে আমড়াগাছি অনেক হল। এইবারে সরাসরি গল্পে চলে আসি। আগেই বলে রেখেছি যে গল্পটা দুটো রামকথার গল্প মিলিয়ে বানানো। তো হয়েছে কী, কৌশিক নামে এক মুনি ছিল যার গানের গলা ছিল অসামান্য। সেই গলার প্রশংসা শুনে স্বয়ং হরি কৌশিককে ডেকেছেন গান শোনানোর জন্য। বৈকুন্ঠেতে চাঁদের হাট বসেছে। সমস্ত দেবতা, নারদ সবাই গান শুনছে। এমন সময় লক্ষ্মী সখীসমেত এসে উপস্থিত। এসেই সব দেবতাদের খেদিয়ে হরির পাশে একা বসে তন্ময় হলে গান শুনতে লেগেছেন। এতে নারদ গেছেন রেগে। এত সুন্দর গান শুনতে দিলনা বিষ্ণুপ্রিয়া? রেগে অভিশাপ দিয়েছেন লক্ষ্মীকে রাক্ষসকুলে জন্ম নেওয়ার।

    "জেমতি রাক্ষসি বুদ্ধি কলি হরিপ্রিয়া।
    তেমতি রাক্ষসি গর্ভে জনমহ গিয়া।।
    তোর দাসী মোরে আসি করিল লাঞ্চন।
    রাক্ষসি চেড়িতে তোমা করিবে তেমন।।
    (বানান অপরিবর্তিত)

    মুনির বাক্য অমোঘ। অতএব লক্ষ্মীকে জন্ম নিতেই হবে। তাই সে নারদের কাছে প্রার্থনা করল তার জন্ম যেন মুনিদের রক্ত নিয়ে হয়।

    এবার চলে আসি লঙ্কায়। দশগ্রিব ব্রহ্মার বর পেয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছে। এমন সময়ে নারদ এসেছে রাবণের কাছে। নারদকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন কারে জয় করলে তার চরাচরে নাম হবে। নারদ শুনে বলেন যে যদি ব্রাহ্মণদের বলে জিততে পারেন তবেই তার যশ সারা পৃথিবীতে হবে। এই শুনে রাবণ বিমান সাজিয়ে বামুনদের মারতে চলল। দণ্ডক অরন্যে কয়েক লক্ষ মুনি তপস্যায় মত্ত ছিলেন। এমন সময় রাবণ তাদের ঘিরে ধরে আক্রমণে উদ্যত হয়। তখন ব্রাহ্মণরা বিনা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করতে গেলে রাবণ বলে যে তার জয় ধন হিসাবে মুনিদের বুকের রক্ত লাগবে। তাতে ব্রাহ্মণেরা নিজেদের বুকের রক্ত দিয়ে একটা কলসী ভরে দিল। কলসিটা ছিল গৃৎসমেধ নামে এক মুনির। তিনি কন্যার প্রার্থনায় এক কলসি দুধ নিয়ে রোজ লক্ষ্মীর আরাধনা করতেন। রাবন সেই কলসীতেই রক্ত ভরে নিয়ে যায়। তখন ব্রাহ্মণেরা অভিশাপ দেয় যে এই কলসীর রক্ত দিয়েই রাবণের মারন কারণ জন্মাবে।

    রাবণ এরপর সেই কলসী নিয়ে লঙ্কা ফিরে আসে। এসে মন্দোদরীর হাতে সেই কলসী ধরিয়ে বলে সে যেন এই কলসী সাবধানে রাখে, এতে বিষ আছে। এইভাবে ব্রাহ্মণকুল জয় করার আনন্দে রাবণ হিমালয়ে গিয়ে সুন্দরীদের সাথে রমণে মত্ত হয়ে যায়। লঙ্কায় আসার কথা মনেই থাকেনা। এতে মন্দোদরী রাগে দুঃখে প্রান বিসর্জন দেওয়ার কথা ভাবে। সেই উদ্দেশ্যেই মন্দোদরী মুনিদের রক্ত যাকে রাবণ বিষ বলেছিল, খেয়ে নেয়। কিন্তু মরা তো দূর, উলটে রানী পোয়াতি হয়ে যায়।

    এইখান থেকে দুই রামকথায় গল্প দুই ভিন্ন মোড় নেয়। জগদ্রামী রামায়ণে মন্দোদরী সদ্যোজাত শিশুকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে কুরুক্ষেত্রে ফেলে আসে। পরের দিন হাল চালাতে গিয়ে তা জনকের নজরে আসে এবং জনক সেই শিশুকে নিজের করে নেয়। চন্দ্রাবতীর রামকথায় মন্দোদরী এক ডিম প্রসব করে। সেই খবর চরের মুখে শুনে রাবণ গণককে ডাকে। সেই গণক বলেন

    "এই ডিম্বে কন্যা এক গো লভিল জনম।
    তা' হইতে রাক্ষস-বংশ গো হইবে নিধন।। "

    এতে রাবণ রেগে গিয়ে রাবণ যখন সেই ডিম ভাঙতে যায় তখন মাতৃস্নেহে মন্দোদরী তাকে বাধা দেয়। শেষে মন্দোদরীর অনুরোধে রাবণ কারিগরদের ডেকে সোনার সিন্দুক বানিয়ে তাতে ডিমটি রেখে জলে ভাসিয়ে দেয়। সেই সিন্দুক এসে মিথিলার ঘাটে বাঁধে।

    মিথিলা নগরে এক জেলে আর তার বউ থাকত। মাধব জেলে আর সতা জেলেনি। প্রচন্ড গরীব। কোন রকমে দিন কাটে, পরণে কাপড় নেই, খাওয়ার চাল নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। তো একদিন মাধব নদীতে গেছে মাছ ধরতে। সারা সন্ধ্যা জাল রাত হয়ে এল, কিন্তু মাছ আর আসেনা। শেষে মনসার নাম নিয়ে শেষবারের মতন জাল ফেললে সোনার সিন্দুকতে এসে ওঠে তার জালে। সেই সিন্দুক এনে ঘরে রাখায় তার কপাল খুলে যায়। ঘরে লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান হয়।

    একদিন রাতে সতা জেলেনি স্বপ্ন দেখে যে সিন্দুক থেকে এক কন্যা বেরিয়ে এসে মা বলে ডেকে সতার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে জনক রাজার ঘরে নিয়ে যেতে বলছে। পরেরদিন সকালে সতা সেই সিন্দুক নিয়ে রানীর হাতে দিয়ে স্বপ্নের কথা খুলে বলেন। রানী এর বদলে গজমোতির হার, ধামায় মেপে সোনা দেয়। সতা তখন রানীকে বলে যে সত্যিই যদি স্বপ্ন অনুযায়ী কন্যা জন্মায়, তবে যেন সতার নাম অনুযায়ী তার নাম রাখা হয়। যথাসময়ে ডিম ফুটে কন্যা জন্মালে কথা অনুযায়ী সতার নাম অনুযায়ী তার নাম রাখা হয় সীতা। এইভাবেই মন্দোদরীর কন্যা রাবণের মারন কারণ রূপে বেড়ে উঠতে থাকে জনকের ঘরে।

    তথ্যসূত্র -
    রামকথা, উৎপত্তি ও বিকাশ - কামিল বুল্কে
    চন্দ্রাবতীর রামায়ণ
    জগদ্রামী রামপ্রসাদী রামায়ণ
    বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত - অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
    বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- দেবেশ কুমার আচার্য
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb91:87b:8018:4d57:2457:ff9a:***:*** | ১৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৭521426
  • এই লেখাগুলো সব একটা থ্রেডে থাকলে বেশ ভালো হতো। নাহলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা। মাধব জেলে, সতা জেলেনীর গল্পটা জানতামনা। জেনে ভালো লাগলো।
  • Sara Man | ১৯ জুলাই ২০২৩ ০৮:১৬521427
  • আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। 
  • aranya | 2601:84:4600:5410:7942:87c4:45c1:***:*** | ১৯ জুলাই ২০২৩ ০৯:০০521428
  • সুন্দর 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন