এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গণমাধ্যম ও মেরুকরণের ইতিহাস 

    Antareep Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ জুন ২০২৩ | ৪৬৪ বার পঠিত
  • যে কোনো মূলধারার রাজনৈতিক দল, যাদের লক্ষ লক্ষ, অথবা ভারতবর্ষের মত এত বিশাল একটি দেশে, কোটি কোটি সমর্থক আছে, তাদের কিছু বক্তব্যের সারবত্তা অবশ্যই আছে। তা নাহলে এত মানুষ সকলেই নিজেদের বোধবুদ্ধি হারিয়ে যুক্তিহীন নির্বোধের মত তাদের সমর্থন করে চলেছে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তাদের পরিপ্রেক্ষিত থেকে তাদের যুক্তিটাও খানিকটা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত, নাহলে রাজনৈতিক বোধ অনেকটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

    আবার উল্টোপিঠে কোন রাজনৈতিক দলের সমস্ত রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে পূর্ণ সহমত্য পোষণ করাটাও একইরকম গোলমেলে... দলদাস্যের লক্ষণ। দুটো মানুষ, এমনকি নিকটতম দুটো মানুষের মধ্যেও সব বিষয়ে ১০০% মিল হওয়া প্রায় অসম্ভব। সেখানে একটা গোটা দলের সাথে সব বিষয়ে মতের মিল খুঁজে পাওয়াটা কেমন একটা অস্বাভাবিক না?

    এই কারণে বার্ট্রাণ্ড রাসেল সবাইকে পরামর্শ দিয়েছিলেন নিজের বিপক্ষ রাজনৈতিক মতের একটি অন্তত মুখপত্র নিয়মিত পড়তে। যদি তার প্রতিটি বক্তব্যই এত অসহ্য মনে হয় যে তার একলাইনও পড়া অসম্ভব লাগে, তাহলে ধরে নিতে হবে যে দেশে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি তো নেইই, বরং তার সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতাও প্রশ্নের মুখে। কারণ একপক্ষের যদি অন্যপক্ষের রাজনৈতিক অবস্থান এতই অসহ্য মনে হয়, তাহলে অন্যপক্ষেরও নিশ্চয় প্রথমপক্ষের অবস্থান ততটাই অসহ্য লাগে। মৌলিক স্তরে বিভাজন যদি এত গভীরে পৌঁছে যায়, তাকে রাজনৈতিকভাবে জোড়া দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

    রাজনীতি, গণতন্ত্র এসব কোন সমাজের জন্য? যেখানে অন্তত বুনিয়াদী স্তরে আদর্শ সমাজব্যবস্থা নিয়ে একটা প্রাথমিক ঐকমত্য রয়েছে। রাজনীতির কাজ হল কীভাবে সেই আদর্শের দিকে সমাজকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে তার ডিটেলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ, আলোচনা, বিতর্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করা। কিন্তু সমাজদর্শনের প্রাথমিক স্তরেই যদি এতবড় মতানৈক্য থাকে যে একপক্ষ আরেকপক্ষকে জাস্ট সহ্যই করতে পারছে না, সেখানে বিতর্কেরই বা জায়গা কোথায়!

    এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় সমস্ত দেশে রাজনীতি এরকমই একটা বিভাজনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই তার জন্য সামাজিক মাধ্যমকে দায়ী করেন। কথাটা মিথ্যে একেবারেই নয়। কিন্তু এ বিষয়ে সেদিন এক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের একটি মন্তব্য শুনলাম যেটা বেশ চমকপ্রদ। তিনি বললেন যে ইতিহাস সঠিকভাবে পড়লে এর পূর্বাভাস আমাদের আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। ইতিহাসে যখন যখন গণমাধ্যমে এই ধরণের প্রযুক্তিগত বিপ্লব এসেছে, তখন তখনই গণমানসে এরকম তীব্র মেরুকরণ দেখা গেছে।

    উদাহরণস্বরূপ তিনি বললেন প্রিন্টিং প্রেসের কথা। বই জিনিসটাকে আমরা আজ যতই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি না কেন, ছাপাখানা প্রবর্তনের তাৎক্ষণিক ফলশ্রুতি আমাদের আজকের সোশাল মিডিয়ার চেয়ে ঢের বেশী ধ্বংসাত্মক। প্রাচীন সে ছাপাখানায় সবচেয়ে বেশী ছাপা বইয়ের নাম আন্দাজ করা হয়তো কঠিন নয়: অবশ্যই বাইবেল... কিন্তু বাইবেলের পর সবচেয়ে বেশী মুদ্রিত বইটির নাম বেশ চমকপ্রদ: Malleus Maleficarum। এটি একটি ম্যানুয়াল... কোন মেয়েটি আসলে ডাইনি তা যথাযথভাবে চিনতে পারার বিস্তারিত বিবরণ সমৃদ্ধ ম্যানুয়াল। এবং এটি সেই মধ্যযুগের ইউরোপে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে ও ডাইনি সন্দেহে স্বাধীনচেতা নিরীহ বহু নারীর বিভৎস যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর কারণ ঘটে। আজ আমরা যে 'Social media witch-hunt'-এর কথা বলি, সেটা গোটাটাই রূপক না, তার একটা বাস্তব ইতিহাস আছে।

    কিন্তু এটা সবে শুরু। ছাপাখানার এই বৈপ্লবিক প্রযুক্তি ইউরোপে প্রোটেস্টান্ট রিফর্মেশনে বিরাট সহায়তা করে ও এক ধাক্কায় প্রটেস্টান্ট দেশগুলিতে শিক্ষার হার প্রায় ১০০%-এর কাছাকাছি নিয়ে চলে যায় একথা সত্য। কিন্তু সেই শিক্ষার ফলে সমাজে শান্তি-সম্প্রীতি-সমন্বয়ের মধুর ঐকতান বাজতে আরম্ভ করল এমন ভেবে নেওয়া মারাত্মক ভুল হবে। বরং ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট যুযুধান দুই পক্ষই নিজেদের মতামত ছাপার অক্ষরে আগের চেয়ে অনেক দ্রুততার সঙ্গে নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে বিলি করতে পারায় সমাজে মেরুকরণ তীব্র মাত্রা নেয়। ফলস্বরূপ পরবর্তী দুই শতাব্দী ইউরোপে প্রোটেস্টান্ট-ক্যাথলিক ধর্মযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস। এই যুদ্ধের ইতিহাস কতটা রক্তাক্ত তা সম্বন্ধে ভারতীয়দের কোন ধারণা নেই। এটুকু বলে রাখা ভালো যে সংখ্যার বিচারে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গাহাঙ্গামা বা যুদ্ধবিগ্রহ এর কাছে নস্যি। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাবসোলিউট সংখ্যায় হয়ত ইউরোপে অনেক বেশী লোক মারা গেছল, কিন্তু জনসংখ্যার শতাংশ হিসেবে ইউরোপের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কিন্তু প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, বরং ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্টের 'ত্রিশ বছরের যুদ্ধ'। যুদ্ধটি মূলত আজ যে দেশটাকে জার্মানি বলে আমরা চিনি সেখানেই হয়েছিল, কিন্তু লড়তে সেখানে প্রায় সারা ইউরোপই হাজির হয়েছিল। এই একটি যুদ্ধে জার্মানির বিভিন্ন অংশে ৪০ থেকে ৫০%, অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ মারা যায়!

    তবে এর পরে যুদ্ধক্লান্ত ইউরোপে ধর্মীয় উন্মাদনা ধীরে ধীরে কমে আসে। আবার প্রায় একইরকম উন্মাদনা শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে...এবারে রাজনৈতিক মতাদর্শকে ঘিরে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস 'টোটাল ওয়ার'-এর ইতিহাস। সে রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা আর এখানে আলাদা করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এই রাজনৈতিক উন্মাদনা ও টোটাল ওয়ারের পিছনে সেযুগের নবতম প্রযুক্তি রেডিও ও সিনেমার অপরিসীম অবদানের কথা আমাদের তেমন খেয়ালে থাকে না। এছাড়াও রেডিও সিনেমার পাশাপাশি মুদ্রণপ্রযুক্তির আধুনিকীকরণেরও একটা বিরাট ভূমিকা এর পিছনে আছে। সংবাদপত্র জিনিসটা এসময়ে নতুন না হলেও, আজকের মত হাতে হাতে ছড়িয়ে যাওয়া প্রাত্যহিক সংবাদপত্রের উৎপত্তিও এই সময়েই।

    ইতিহাসবিদ ভদ্রলোক আক্ষেপ করছিলেন যে সিলিকন ভ্যালির টেক-ব্রোরা ইতিহাস পড়েন না... তাঁদের ইতিহাস শুরুই হয় ২০০৪ সালে Google IPO-র সময় থেকে। তার আগের সবই তাদের কাছে ancient history। নাহলে তাঁরা এই সোশাল মিডিয়া জিনিসটি বানিয়ে মোটেই শান্তি-সম্প্রীতি-সমন্বয়ের মধুর ঐকতান আশা করতেন না ও সোশাল মিডিয়ার ফলে সমাজে এই তীব্র মেরুকরণের রূপ দেখে চমকে উঠতেন না। অবশ্য এর ফলাফল তাঁরা আন্দাজ করতে পারলেও একে রোধ করতে তারা পারতেন কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিবর্তনের ইতিহাসে মানুষ-ই হিংস্রতম জীব। মারামারি কাটাকাটি-ই তার স্বাভাবিক ধর্ম। ইতিহাস সাক্ষী, একমাত্র বহু রক্তক্ষয়ের রণক্লান্তিতেই তার কানে শান্তির বাণী ধ্বনিত হয়, নচেৎ নয়। সেই হিসেবে আমাদের বর্তমান এই মেরুকরণের সবে মুখেভাত...ঝিমিয়ে আসার আগে তার এখনো অনেক পথ চলা বাকি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 203.22.***.*** | ২০ জুন ২০২৩ ১৪:৩৭520556
  • ভালো লাগলো। দরকারি কথাগুলোসহজভাবে বলাহয়েছে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন