|| ৩. হিন্দুরা কি উদার এবং পরধর্ম সহিষ্ণু? ||
এই বর্তমান পর্যায়ে, অর্থাৎ, বিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ শাসকের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে জোয়ার আসে, যার পরিণতিতে অবশেষে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়, তার মধ্যেই বহু খেপে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটা নৈমিত্তিক অ্যাজেন্ডায় পর্যবসিত হয়। আর তাতে ধুনো দেবার প্রয়োজনে ক্রমাগত বেশ কয়েকটি হিন্দু মিথের নির্মাণ হতে থাকে। এই মিথ সকল এখনও স্বমহিমায় আমাদের চারপাশে বিদ্যমান এবং ঘুর্ণমান। তাই তাদের একটা তালিকা প্রথমেই দেখে নেওয়া আমাদের এই আলোচনার পরবর্তী অগ্রগতির স্বার্থে খুবই জরুরি:
- ধর্মীয় মতভেদের ব্যাপারে হিন্দুরা বরাবরই খুব উদার ও সহিষ্ণু;
- হিন্দু সমাজের জাতপাতের বর্তমান কঠোরতা আসলে একটা বিকৃতি; আদি বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা এতটা কঠোর এবং দলিত বিরোধী ছিল না;
- মুসলিম শাসনে ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়;
- মুসলমান শাসকরা অসংখ্য হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছে;
- মুসলমান শাসনে হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিপন্ন ছিল;
- মুসলমান শাসনামলে লাগাতার এক হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ চলেছিল; ইত্যাদি।
আসুন, আমরা একটু খুঁটিয়ে বিচার করে দেখি। নানা রকম তথ্যসম্ভার ঘাঁটাঘাঁটি করে যুক্তিতর্কের সাহায্য নিয়ে এই সমস্ত মিথের সম্ভাব্য সত্যতা যাচাই করি।
প্রথমেই বলে রাখি, এই মিথসমূহ শুধু যে আরএসএস বা তাদের অনুগামীরাই প্রচার করে চলেছে এমন নয়। এই সব কথা আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা কর্মী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক লেখকদের কণ্ঠে ও লেখনীতে অনেক কাল ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো বিদ্বান, স্বামী বিবেকানন্দের মতো ধর্মনেতা, কিংবা যদুনাথ সরকারের মতো বিশিষ্ট ঐতিহাসিকও এই মিথ রচনায় পিছিয়ে ছিলেন না। সঙ্ঘ পরিবার তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে সেই দিক থেকে প্রায় একটা তৈরি চষা জমি হাতে পেয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই এই সমীক্ষা শুরু করি। কথা ও কাহিনীর এক কবিতায় তিনি লিখেছেন:
অজাতশত্রু রাজা হল যবে
পিতার আসনে আসি,
পিতার ধর্ম শোনিতের স্রোতে
মুছিয়া ফেলিল রাজপুরী হতে,
সঁপিল যজ্ঞ-অনল-আলোতে
বৌদ্ধ-শাস্ত্র-রাশি।
ভারতে উদ্ভূত হয়ে যে বৌদ্ধধর্ম একদিন সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তার মৌল শাস্ত্রগ্রন্থগুলির পুঁথি আর এই দেশে পাওয়া যায়নি। অনেক পরে চিন জাপান নেপাল প্রভৃতি দেশ থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে এবং অনুবাদে লিখিত হয়েছে। কে বা কারা করল? সেই কালে তো আর মুসলমানরা এদেশে রাজত্ব করছিল না। অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার ছিল বলে যে অঞ্চলটার নাম হল বিহার, সেখানে আজ বৌদ্ধ বিহার কটা টিকে আছে? পুরীর জগন্নাথ মন্দিরও এক কালে বৌদ্ধমঠ ছিল, তাকে দখল করে হিন্দু মন্দির বানিয়ে ফেলা হয়েছে। “ভারতবর্ষের এই যে সব সন্ন্যাসীর মঠফট দেখতে পাচ্ছিস—এসব বৌদ্ধদের অধিকারে ছিল, হিন্দুরা সেই সকলকে এখন তাদের রঙে রাঙিয়ে নিজস্ব করে বসেছে।” [বিবেকানন্দ ১৯৮৯, ৯, ২৭, ৭২] বৌদ্ধরা আজকাল যেগুলিকে “স্তূপ” নাম দিয়ে পবিত্র স্থল হিসাবে গণ্য করে, নামেই মালুম, এগুলোও আসলে বৌদ্ধ বিহার মঠ মন্দির প্যাগোডার ধ্বংসস্তূপেরই চলে আসা অপভ্রংশ। সেই ধ্বংসই বা কারা করেছিল সহজেই অনুমেয়। সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা বৌদ্ধদের এবং তাঁদের ধর্মস্থানের উপর শৈব বা বৈষ্ণবদের আক্রমণের পূর্ণাঙ্গ সূত্রোল্লেখ সহ এক বিশাল তালিকা এবং বিবরণ পেশ করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে। [Jha 2018, 95-111]
চার্বাক মতের আদি পুঁথি একটাও আজ অবধি পাওয়া যায়নি। আমরা আজকে যেটুকু চার্বাক স্কুলের মতবাদ সম্পর্কে জানতে পারছি, তা বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে গ্রন্থে চার্বাকদের গালি প্রদান উপলক্ষে তাদের বক্তব্য হিসাবে যে সমস্ত টুকরো টাকরা উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে।
এই প্রসঙ্গে সবচাইতে চমকপ্রদ ঘটনাটির উল্লেখ করে গেছেন রাজতরঙ্গিনী-তে কলহন। কাশ্মীরের এক হিন্দু রাজা হর্ষদেব একজন মন্ত্রীকে নিযুক্ত করেছিলেন হিন্দুদের দেবমন্দির থেকে দেবমূর্তি লুট করে এনে মূল্যবান ধাতু গলিয়ে রাজকোষের ধনস্ফীতি ঘটাতে। সেই মন্ত্রীর পদের নাম ছিল “দেবোৎপাটক নায়ক”। আহা, মন্দির এবং দেবতাদের প্রতি হিন্দু রাজাদের কী গভীর ভক্তি! বিস্তারিত পাঠে এও জানা যায়, দুই হিন্দু রাজার মধ্যে যখন যুদ্ধ হত, বিজয়ী রাজা বিজিত রাজ্যের ইষ্টদেবতাকে মন্দির থেকে উচ্ছেদ করে আনত, কেন না এতে সেই রাজ্যের অমঙ্গল হবে। [Eaton 2004, 35] এই জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়, যদিও আমাদের দেশের প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকে এই সব তথ্য ছাত্রছাত্রীদের জানানোই হয় না।
বাংলার বুকে ১৭৪০-এর দশকে শিবাজীর অনুচরেরা ভাস্কর পণ্ডিতের সৈন্যাধ্যক্ষে একাধিকবার যে ভয়ঙ্কর হামলা এবং লুটপাট চালিয়েছিল—ইতিহাসে যা মারাঠা বর্গী আক্রমণ নামে কুখ্যাত, হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান মেরেছিল, কয়েক হাজার নারীকে ধর্ষণ করেছিল, তার মধ্যে হিন্দুদের তথাকথিত উদারতা সহিষ্ণুতা ইত্যাদি কোথায়? বরং বাংলার সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁ-ই তখন বাংলার শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুদেরও বাঁচিয়েছিল--নারী এবং মন্দির সহ।
হিন্দু ধর্মের প্রামাণ্য পবিত্র শাস্ত্র হিসাবে গীতা পাঠ করলে দেখা যাবে, সেখানে বলা হয়েছে, “শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাত স্বনুষ্ঠিতাত্। স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয় পরোধর্ম্মো ভয়াবহঃ।” [শ্রীমদ্ভগবত গীতা ৩/৩৫] যস্যার্থ—নিজ ধর্ম নির্গুণ হলেও তাকেই শ্রেয়তর ভেবে সন্তুষ্ট থাক, পরের ধর্মের যত ভালো গুণই থাকুক, তাকে গ্রহণ করতে যেও না। আপন ধর্ম (আসলে জাত ধর্ম) পালন করতে গিয়ে মৃত্যু হলেও সই, কিন্তু অপরের (জাত) ধর্ম কখনও ভুলেও যেন গ্রহণ কোরো না। আচার্য মনুও প্রায় একই ভাষায় সাবধান করে বলে দিয়ে গেছেন: “বরং স্বধর্ম্মো বিগুণো ন পারক্যঃ স্বনুষ্ঠিতঃ। পরধর্ম্মেন জীবন্ হি সদ্যঃ পততি জাতিতঃ।।” [মনু ১০/৯৭] অনুবাদে: “স্বকীয় কর্ম নিকৃষ্ট হইলেও তাহাই করা উচিত, পরকীয় কর্মকরণ অনুচিত। স্বকীয় কর্ম করিতে সমর্থ হইয়া যদি পরকীয় কর্ম করে তবে তৎক্ষণাৎ পতিত হয়।” সুতরাং যাঁরা হিন্দু ধর্মে উদারতা সহিষ্ণুতা ইত্যাদি হাতড়ে বেড়ান, তাঁরা আসলে কোন জিনিসটা কোথায় খুঁজতে হয়, সেই ব্যাপারে যথোচিত অবহিত নন। কবিরের দোহার ভালো ভালো বক্তব্য কিংবা তুকারামের উদার ভাবের উপদেশগুচ্ছ দেখিয়ে এই উদারতার দাবি পেশ করা চলে না, কেন না হিন্দুরা তাদের নিত্যকর্মে কখনই কবির বা তুকারামের উপদেশ মেনে চলে না।
|| ৪. হিন্দু জাতবর্ণ ব্যবস্থার বর্বরতা ||
বেশি দিনের কথা নয়। কংগ্রেস শাসিত রাজ্য রাজস্থানের একটি প্রাইমারি স্কুলের এক দলিত ছাত্র ইন্দ্রকুমার “উচ্চ” জাতের জন্য রক্ষিত কলসী থেকে জল পান করায় জনৈক উচ্চবর্ণের শিক্ষক শৈল সিং তাকে এমন মারধোর করে যে ছেলেটির হাসপাতালে মৃত্যু হয়। ২০২২ সালেই যদি এমনটা ঘটতে পারে, ২২ বা ২২২ অথবা ১০২২ সালে কী হত, “উচ্চ” বর্ণের লোকেরা দলিত বর্গের মানুষদের কী চোখে দেখত এবং কীরকম আচরণ করত, বুঝতে খুব কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
অনেকেই শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন, এই ব্যাপারেও মনু আচার্যের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে: “চণ্ডালশ্বপচানান্তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ। অপপাত্রাশ্চ কর্ত্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দ্দভম্।।” [মনু ১০/৫১] বাংলা অনুবাদে এর অর্থ দেওয়া আছে:- “চণ্ডাল ও শ্বপচদের আশ্রয় গ্রামের বাইরে। তাদের অপপাত্র করবে (অর্থাৎ জলপাত্রাদি দিবে না), এদের ধন কুকুর ও গাধা।” যদি আমরা মনুর বচনকে নিন্দা না করি, তাহলে সেই কু-শিক্ষকের আচরণে দোষ ধরতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
রাধাকৃষ্ণান গান্ধী প্রমুখর মতো অনেকের ধারণা, আদি বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অতীব সুন্দর সামাজিক বিন্যাস ছিল। পরবর্তী কালের মানুষরা তাকে বিকৃত করে এই ঘৃণার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিবেকানন্দ দাবি করেছেন, দেশের কল্যাণের জন্য আমাদের সমাজকে সেই “গৌরবময়” অতীতেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এই সব কথা কি সত্য?
মনুর নামে প্রচলিত যে বিধানগুলো আদতে গৌতম ধর্মসূত্রে আছে, তাতেও নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের লোকেদের এই ঘৃণা ও নিপীড়ণের মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্ট: বেদ পাঠ করলে শূদ্রের জিহ্বা কেটে দিতে হবে; বেদ শুনলে দুই কানে গরম গলিত সিসা বা টিন ঢেলে শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দিতে হবে; ইত্যাদি। [গৌতম ধর্মসূত্র ১২/৪-৬] কালচক্রে সভ্যতার বিকাশ ক্রমে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাবে যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, পাঁচশ বছর পরে রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ উত্তরকাণ্ডে বেদ পাঠ ও তপস্যার মতো সাংঘাতিক অপরাধের কারণে রামের হাতে শম্বুক বধের যে কাহিনি পল্লবিত হয়েছিল, তাতেই এর সাক্ষ্য সেই উদার সনাতন হিন্দুরা নিজেরাই দিয়ে গেছে।
অর্থাৎ যেমন অতীতের উজ্জ্বল স্বর্ণালী কালে, তেমনই এই মসীকৃষ্ণ কলিযুগে—ব্রাহ্মণ্যবাদ, হিন্দুত্বের সর-অংশ—চূড়ান্ত দলিত বিরোধী অবস্থানেই থেকে গেছে। শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশের কোনো ছাপ সেই মানসিকতায় পড়েনি। দলিতদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণার যে শারীরিক প্রকাশ ঘটে তার সংখ্যা যদি আজকাল কমে গিয়ে থাকে তা সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রভাবে নয়, আইন আদালতের তরফে চক্ষুলজ্জার খাতিরে যেটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হয় তার ভয়ে।
পৃথিবীতে এই একমাত্র ধর্ম, যে তার নিজের বিশ্বাসীদের গরিষ্ঠ অংশকে নিজের মন্দিরে প্রবেশাধিকার দেয়নি। এ এক তাজ্জব কি বাত! শিবাজি কিংবা রাণা প্রতাপ মুসলমানকে সেনাপতি করেছেন, কিন্তু কোনো দলিত সেনাকে? নৈব নৈব চ। এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, ব্যতিক্রমও নয়। সেই জন্য ইতিহাসের রাজপুত বীর রাণা প্রতাপ থেকে বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য রাজপুত অজিত সিং—এরকম একজনও হিন্দু রাজা পাবেন না যিনি হিন্দু শাস্ত্রের ক্ষত্রিয় অনুশাসনের ঊর্ধ্বে উঠে দলিত বা নিম্ন বর্গের জন্য একটা সংস্কারমূলক কিছু করেছেন। প্রসঙ্গত, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে যে আচার্য বলা হয়নি বা হয় না, তার কারণও সেই একই—আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ নেহরুর বিজ্ঞানমনস্কিত স্বাধীন ভারতের নিপাট জাতপাতগত নিষ্ঠাচার। নমঃশূদ্র কী করে আচার্য হয়! সাহা যে!!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।