অনেকদিন থেকেই একটা দ্বন্দ্বে আছি, সময় কি মানুষকে প্রভাবিত করে, নাকি মানুষ সময়কে প্রভাবিত করে? সমঝদাররা বলেন, সময় তার নিজের নিয়মে চলে, নিজের ছন্দে চলে, সে কারোর ওপর নির্ভরশীল নয়, সোজা কথায় সময় কারও ধার ধারে না। কথাটা আপাতবিচারে ঠিকই। সময়কে তো কেউ সৃষ্টি বা নির্মাণ করেনি, আবার কারও ক্ষমতা নেই তার গতি রুদ্ধ করার এবং তাকে ধ্বংস করার। সময় আদি অন্তহীন। তার কোনো সামগ্রিক মাপজোকও করা যায় না। যদিও আমরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সময়কে মাপি, তাকে ভাগ করি অনেক অনেক মাপকাঠিতে। অসীম ব্রক্ষ্মান্ডের একটি ক্ষুদ্র গ্রহের বাসিন্দা আমরা নিজেদের বিচারবুদ্ধিতে সুবিধার জন্য আমাদের সীমার অন্তর্গত বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্রহ উপগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত সময়কে নিজেদের বাগে আনার চেষ্টা করি। সূর্য নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রহ পৃথিবীর ক্লান্তিহীন ঘূর্ণন এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে উপগ্রহ চাঁদের অক্লান্ত ঘূর্ণন, আমাদের সময়ের মাপকাঠি নির্ধারণে সহায়তা করেছে। আমরা নিজেদের প্রয়োজনে সময়কে বাঁধার অভিপ্রায়ে তাই নির্দিষ্ট করেছি কিছু একক, যেমন – দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দ, সহস্রাব্দ... অন্যদিকে ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড, পল, অনুপল... নির্দিষ্ট করেছি চান্দ্রমাস, চান্দ্রবছর, সৌরমাস, সৌরবছর...
তা না হয় করলাম, সময়ের তাতে থোড়াই কিছু এলো গেলো কি? কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে, মানুষ কি আদৌ সময়কে প্রভাবিত করতে পারে, অথবা সময়ই মানুষকে প্রভাবিত করে? উদাহরণ বা নমুনা হিসেবে যেমন কিছু কিছু সময়ের কথা উদ্ধৃত করা যেতে পারে, যা মানুষই নির্ধারিত করেছে, যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে আদিযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিকযুগ, উত্তর আধুনিকযুগ, প্রাক ঔপনিবেশিকযুগ, ঔপনিবেশিকযুগ, নয়া ঔপনিবেশিকযুগ ... যেমন চৈতন্য পূর্ববর্তীযুগ, চৈতন্যযুগ, চৈতন্য পরবর্তীযুগ, ফোর্ট উইলিয়ামযুগ, বঙ্কিমযুগ, রবীন্দ্রযুগ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যদি এইসব যুগের কথা স্বীকার করতে হয়, তাহলে সমকালীন সময়ে এইসব যুগের প্রভাবের কথাও স্বীকার করতে হয়। তা সে সাহিত্যের ক্ষেত্রেই হোক বা সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা সব সব ক্ষেত্রেই। অর্থাৎ অনন্ত সময়ের ক্ষমতার সঙ্গে সীমিত মানুষের ক্ষমতার তুলনার মতো বোকামি না করেও একথা বলা যায় যে, সর্বগ্রাসী সময় যতই শক্তিশালী হোক না কেন মানুষের মস্তিষ্কেও আছে অপরাজেয় দুর্বিনীত সৃষ্টিশীল মনন ও মেধা। আর তাই সে হয়তো সময়কে বাঁধতে পারে, প্রভাবিতও করতে পারে!
লিখতে বসে সময় সম্পর্কিত এই দ্বন্দ্বের কথা স্বাভাবিক কারণেই এসে গেল আমাদের সমকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা সাধারণ মানুষ মনে করি যে, যে সময়ে আমরা এই পৃথিবীতে বসবাস করছি, তা ক্রমশই থাকার অযোগ্য হয়ে উঠছে। তা সে প্রাকৃতিক সমস্যার কারণেই হোক বা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণেই হোক। পৃথিবীর বাতাস ক্রমশ দূষিত হচ্ছে, জল দূষিত হচ্ছে, মাটি দূষিত হচ্ছে, উৎপাদিত ফসল দূষিত হচ্ছে এবং এই সামগ্রিক দূষণের জন্য মূলত দায়ী মানুষই। অন্যদিকে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে মানবিকদূষণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণকে কেন্দ্র করে হানাহানি; তথাকথিত জাতীয়তাবোধকে কেন্দ্র করে লড়াই, বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজার দখলের জন্য সংঘটিত যুদ্ধ সমকালীন সময়কে কলুষিত করে তুলেছে, নষ্ট করে তুলছে। আর এই নষ্ট সময়ে মানুষ এখন অন্য মানুষের প্রতি প্রেমহীন, আস্থাহীন, বিশ্বাসহীন, নির্ভরতাহীন। এ এক অসহনীয় অস্থিরতার সময়। এবং বলা বাহুল্য, এর জন্য একদিকে যেমন দায়ী ঘৃণ্য কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন কিছু মানুষ, গোষ্ঠি, চক্র ও আঁতাত; অন্যদিকে তেমনই দায়ী তাদেরই পদলেহনকারী কিছু জনসাধারণ। যাদের কখনই ক্ষমা করতে পারবে না অনাগত সময়ও। ভাবতে কষ্ট হয়, মূর্খ কালিদাসের যুগের বুদ্ধি ও বিবেচনা থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারলাম না!
কাজল সেন
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।