দেশ স্বাধীনতার আগে এই বাঙালিরা নাকি মহা তেজস্বী ছিল! বিশ্বাস করতে মনের মধ্যে ভীষণ কষ্ট হয়। কিছুতেই বুঝে উঠতেই পারিনা বা বলা ভাল মেলাতে পারি না। রাস্তার কেলো কুকুরটাকে দেখিয়ে যদি কেউ বলেন, ওটা আগে জার্মান শেফার্ড ছিল। এটা শুনে যেরকম মনে হবে, ঠিক তেমনটাই আমার মনে হয়। মাঝে মাঝে নিজেকেও আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দেখি, যা ভাবছি তা কতটা সত্যি? আয়না প্রমাণ করে দেয়, আমার ভাবনা নির্ভেজাল সত্যি। নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় পিঠে। টের পাই ঈশ্বরদত্ত শিরদাঁড়াটা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্তির পথে। এমন দিন বেশিদূর নেই যেদিন এই জাতির সাথে কেঁচো বা কেন্নোর তুলনা করা হবে। আর তাও নাহলে যাদুঘরে একটি আলাদা ঘর বরাদ্দ হবে। যার দরজার ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে 'বাঙালি প্রজাতি, অধুনা বিলুপ্ত'। আমি ভেবে কুল পাই না, একটা গাট্টাগোট্টা (না, গাট্টাগোট্টা বলা বোধহয় সমীচীন হবে না। সমাজের কিছু সৌখিন আঁতেল হয়ত ভেবে নিতে পারেন তাঁদেরকে পশ্চিমী রাজ্যের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলিয়ে গালি দিয়েছি। কারণ বাঙালি সারাজীবন নিজেকে রসগোল্লা সুলভ পেলব ভাবতেই ভালবাসে। তাই ওই বিশেষণটি বাদ) সোমত্ত পুরুষ্টু ডাকাবুকো মেধাবী জাতি কয়েক দশকের মধ্যে এমন ম্যাদামারা কি করে হয়ে যায়? ভাবতে আশ্চর্য্য লাগে এই জাতির মধ্যেই এককালে নাকি রঘু ডাকাতের মত বীর পরাক্রমশালী ডাকাতও জন্মেছিলেন। রঘু ডাকাত আজ জন্মালে বোধহয় মরমে মরেই যেতেন। লজ্জায় ডাকাতির পেশা ছেড়ে দিয়ে বিষ বেচতেন। কিংবা হয়ত জুতসই তেমন কোনো কাজ না পেয়ে শেষে টোটো চালাতে বাধ্য হতেন। আর সব দেশপ্রেমিক বীর সন্তানদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। নিদেনপক্ষে "হা রে রে' শব্দ করে ওঠা একটা জাতির আজকে ভাজা মাছটি উল্টে খাওয়ার শক্তিটুকুও বিলুপ্তির দিকেই চলেছে, এটা ভাবতে ভীষণ কষ্ট হয়।
বেশিদিন নয়, এই কিছুকাল আগেও বাসে ট্রামে ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে কিছু টান টান ঝকঝকে প্রতিবাদী মুখ খুঁজে পাওয়া যেত। এখন সন্ধ্যে পেরোলেই, তার বদলে মুখে মোদো গন্ধওলা মাতালের দেখা মেলে। আগে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলোতে ব্যায়ামাগার থাকতো। প্রতিটি ক্লাবই স্বাস্থ্যসচেতন ছিল। এখন সব ক্লাবই মদ সচেতন হয়ে গেছে। আগে নিজেরা চাঁদা তুলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, থিয়েটার, খেলাধুলার আসর বসাতে দেখেছি। বরং এখন ক্লাবগুলো সরকারি অনুদানে পুষ্ট হয়ে ওসব কীর্তিকলাপ ভুলে গিয়ে মাতাল লম্পট তৈরিতে মন দিয়েছে। খেলাধুলার জন্য সেই দিগন্ত জোড়া মাঠ প্রান্তর কবেই গায়েব হয়ে গেছে। যাবতীয় খেলা এখন মোবাইল ফোনের ছোট্ট পর্দায় খেলা হয়। আর টেলিভিশনে বসে খেলা দেখতে দেখতে মাঠের খেলোয়াড়দের পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত সমালোচনা করে ভূত ভাগিয়ে দেওয়া হয়। ভাবটা এরকম, আমি ইচ্ছে করে মাঠে নামিনি তাই... নাহলে তোর থেকে দশগুণ ভাল খেলে দেখিয়ে দিতাম! কি অদ্ভুত পরিবর্তন, তাই না? কিছুকাল আগেও ঘরে ঘরে অন্তত একজন ফুটবলার মিলত। বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয় খেলা বলে ধরা হত ফুটবল। তার প্রভাবে তৈরি হয়েছিল 'ধন্যি মেয়ে' ছবির সেই কালজয়ী গান "সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল"। এখন বাংলার ফুটবল ক্লাবগুলোতে এগারো জন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচজনই বিদেশী।
যুগের পরিবর্তনে একটি প্রজাতির যে এরকম আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে, তার বিন্দুমাত্র আঁচ যদি আগে থেকে থাকত...! কারণ একটি জাতি তার সমস্ত বীরত্ব, কৌলিন্য ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র আর পাঁচটা ভারতবাসীর মত বেঁচে বর্তে থাকবে, এ যেন মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। যে বাঙালি বরাবর বৌকে ভয় করে অফিস থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে ফিরে বাড়িতে সেঁধিয়ে যেত। সন্ধ্যেটা উপভোগ করত বৌয়ের হাতের চা আর মুড়ি তেলেভাজা সহযোগে। সেই বাঙালি এখন রাত এগারোটার আগে বাড়ি ফিরে এলে নিজেকে জাত কুল হারানো মনে করে। এর জন্যে কর্ম জগতের পরিবর্তিত পরিস্থিতি অবশ্যই দায়ী। এখন পয়সাওলা বাঙালি রাতভর জেগে পাঁচতারা হোটেলে "উলালা উলালা" গেয়ে পার্টি করে। বাঙালি ও বাঙালিনীরা এখন কদাচিৎ অনুষ্ঠান বিশেষে ধুতি ও শাড়ি পরে বাঙালি সাজার চেষ্টা করে। শাড়ি কিংবা ধুতি পরে সেল্ফি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে স্ট্যাটাস দেয়, 'বং ঢং এ Me'। বৃত্তের বাইরে দুজন উচ্চবিত্ত বাঙালির হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে ইংরেজিতে কথা না বললে এখনকার দিনে মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।
বাংলা সিনেমায় এখন হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষা মিশ্রিত সংলাপ ও সঙ্গীত না থাকলে বাংলা ছবি হিসেবেই নাকি বিবেচিত হয় না। এখনকার বাংলা সিনেমা শুরুই হয় ইংরেজিতে টাইটেল অর্থাৎ নাম দেখিয়ে। বাংলার নায়ক নায়িকা গায়ক গায়িকারা দর্শকের সামনে বা টেলিভিশনের পর্দায় এসে একুশটি শব্দ বললে, মেপে জুপে ঠিক তিনটি বাংলা শব্দ আর আঠেরোটি ইংরেজি বলেন। নাহলে তাঁদের যে মান থাকে না! বাংলা মেগা সিরিয়ালে তো প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হিন্দি ফিল্মি গানেরই এখন রমরমা। হিরো হিরোইন একটু রোম্যান্টিক হয়ে পড়েছে... ব্যস! অমনি বেজে উঠলো "তেরি মুহব্বত নে দিল মে মোকাম কর লিয়া.." লাও ঠ্যালা! সেই মুহূর্তে এক লহমা দেখলে বোঝা মুশকিল ধারাবাহিকটি কোন ভাষায় চলছে? চারপাশে এ এক বিচিত্র খিচুড়ি সংস্কৃতির আমদানি ঘটেছে।
বাঙালিদের বাচ্চারা বাংলা ভুলতে সাহেবমার্কা স্কুলে যায়। তারপর সেই সাহেবি শিক্ষায় অর্ধ্বশিক্ষিত হয়ে বাংলা না জানার ভান করে প্রভূত আনন্দ পায়। সেই বকচ্ছপদের মা বাবারা গর্বিত চিত্তে বলেন, "ছেলের আমার বাংলাটা ঠিক আসে না !" বাংলা ও বাঙালীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরিই হচ্ছে বাংলা না শিখে নচেৎ স্বল্প শিখে। যারফলে এক অদ্ভুত শঙ্কর প্রজাতির বাঙালি প্রজন্মতে সারা পৃথিবী ক্রমশ ভরে যেতে বসেছে। যারা রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছে কিন্তু পড়েনি। শরৎচন্দ্রের হয়ত ছবি দেখেছে, তিনি কি জন্য বিখ্যাত জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাত মাথা চুলকে মরবে। উত্তমকুমার মহানায়ক নামে খ্যাত, বাপ মায়ের মুখে এ কথা শুনেছে। কিন্তু তাঁর অভিনীত সিনেমার একটিও দেখেনি। এরকম সর্বক্ষেত্রে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যাবে।
এইভাবেই বড় আশ্চর্যের বিষয়, একটি জাতি এই কয়েক দশকে এত ভীতু, স্বার্থপর কি করে হয়ে গেল? একদা নেতাজীর আহ্বানে ঘর ঘর থেকে জোয়ান ছেলেপুলেরা দেশের জন্য প্রাণ দেবে বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল। পাড়ার যেকোনো সমস্যা, সে শবদাহ হোক বা অনুষ্ঠানে হাঁকডাক করে লোক খাওয়ানো.. সবেতেই শুধু ডাকবার অপেক্ষা থাকতো। এখন কেউ টেঁসে গেলে, সেই পরিবারের লোকজন যদি তেমন সংখ্যায় না থাকে। তাহলে কাঁধ দেওয়ার চারটে লোক খুঁজে পাওয়া ভীষণ দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। শববাহী যানই এখন বহু পরিবারের শেষ ভরসা। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। একলা ড্রাইভারই শবদেহ বয়ে নিয়ে চলে যায়।
বাঙালি মহিলারা আগে শাড়ি পরতেন। সে বাড়িতেই হোক কিংবা বাইরে। এখন সে চল উঠে গেছে কবেই। বাড়িতে শাড়ির বদলে এসেছে নাইটি। ওই রাত পোশাকটি একটু সম্ভ্রান্ত ঘরে মহিলারা ঘুমাতে গেলে পরতেন। সেই পোশাকটি যে সারাদিনব্যাপী ব্যবহৃত হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন তো সম্ভ্রান্ত দেশি সাহেবদের বাড়ির মহিলারা বাড়িতে নাইটি পরাও ত্যাগ করেছেন। এখন ক্যাপ্রি, থ্রী কোয়াটার, মড হট প্যান্টের ওপরে গোলগলা টি-শার্ট জাঁকিয়ে বসেছে ফ্ল্যাট নামক সফিষ্টিকেটেড বস্তির অন্দরমহলে।
যুগ বদলেছে এটা আপনাকে মানতেই হবে। সে যুগে পরিবারের সকলে মিলে সিনেমা থিয়েটার কিংবা চিড়িয়াখানা যেতে পারলেই মানুষ বর্তে যেত। এখন ওসব অতীত। পুরোটাই আজ মল কালচার। সিনেমা হ'লের কথা বলতে গেলে তো চোখে জল চলে আসে। এই বঙ্গে ছয়শ হ'লের মধ্যে বড় জোর দেড়শো কি দুশো ধুঁকতে ধুঁকতে কোনোরকমে টিকে রয়েছে। সিনেমা হ'লগুলোর সিংহভাগ ভরিয়ে রাখতেন বঙ্গললনারা। এখন তাঁরা টেলিভিশনের মেগা সিরিয়াল ছেড়ে যদিও বা বের হন.. তাহলে সোজা গিয়ে ম'লে ঢুকে পড়েন। হ'লমুখো আর হন না। সাহিত্যেও তার ছাপ পড়েছে। গল্প উপন্যাসের মূল পাঠক ছিলেন বঙ্গের নারীকুল। টেলিভিশন তো ছিলই, গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েছে স্মার্ট ফোন। ডাল রান্নায় কতটা পাঁচফোড়ন দিতে হবে সেটা যেমন ইউটিউবে মিলছে তেমনিই "তুনুক তুনুক তাঁ না না না"ও সেখানেই দেখা যাচ্ছে।
বাঙালি এখন গ্লোবাল। সেই গ্লোবালত্ব'র ঠ্যালায় বাঙালীর চিরাচরিত বাঙালিয়ানা শিকেয় ওঠবার দাখিল। এই জাতি অবশ্য চিরটাকালই অন্যের কাছা ধরে টেনে খুলে, নিজের পিছনে গুঁজে নিতে ওস্তাদ ছিল। একমাত্র "করবা চৌথ" ব্রতটি এখনও বাঙালীর খাটের তলায় ঢুকতে পারেনি। বাদ বাকি ধনতেরাস থেকে সন্তোষীমাতা সবই আজ গ্লোবাল বাঙালীর ভায়রাভাই। বাঙালি নিজের কৃষ্টি সংস্কৃতি আর ভাষা অবলীলায় ভুলে যেতে পারে। ঠিক আবার তেমনিই অন্যের সংস্কৃতিকে নিজের মাসির ছেলের মত জাপটে ধরতে একটুও কুণ্ঠিত হয় না। পোশাকে আশাকে চলনে বলনে সর্বত্র বাঙালীর একদা নিজস্বতা ছিল। গ্লোবালবাবার কৃপায় সেসব ধুয়ে মুছে সাফ। নাহলে কি আর ব্যবসা শুকিয়ে যাচ্ছে বলে শাঁখারীরা পা ছড়িয়ে বসে কাঁদত? আলতা সিঁদুর কোম্পানিগুলোকে সারাবছর ব্যবসায় টিকে থাকতে কি চানাচুর ভাজতে হত! যে শাঁখা সিঁদুর বঙ্গললনাদের অঙ্গে মানসম্মান বাড়িয়ে শোভিত হত, সেই সকল আজকের যুগে একেবারে ব্রাত্য। তাই বলা যেতেই পারে... সেই বাঙালিও নেই, সেই শাড়িও নেই। তাই হাতের শাঁখাযুগল আর সিঁথির একচিলতে সিঁদুরও এখন মিলিয়ে যেতে যেতে ঈদের চাঁদ। কোথাও সেটুকুও নৈব নৈব চ।
______________
©রজত দাস
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।