হিসেব রাখা—বড় দায়।
নিজের হিসেব? ধারণা, বক্তব্য, আর যাপনের গরমিলের হিসেব? আরও কঠিন। যদিও আমাদের, বাঙালিদের সুবিধে একটু বেশি। Hypocrisy-র বাংলা নেই যে! ওসব 'কপটতা'-ফপটতা বাদ দিন, কন্সেপ্টটাই ভিনদিশি। যা ভাবি, তা গুরুজনের বা সমাজের কথা ভেবে গিলে/বদলে ফেলবো না? সে আবার কেমন কথা! অতএব, 'যখন যেমন, তখন তেমন'!
এর ওপর যদি আবার নিয়ে আসি সামঞ্জস্য বা ধারাবাহিকতার ব্যাপার, সে তো আরও কঠিন! পরশু মোহনবাগানকে নিয়ে যে জ্ঞানবাক্যি ঝেড়েছিলাম, আজ সেই একই কথা বেপাড়ার ছোকরা পাকিস্তানের ক্রিকেট টিম নিয়ে বললে, মেনে নিতে হবে? সমাজে সম্মান বলে একটা ব্যাপার নেই?
তা, এমতাবস্থায়, সোশ্যাল নেটওয়র্কে জ্ঞান বিতরণের ঝক্কি অনেক। সাত বছর আগের নিজের পোস্ট/স্ক্রিনশট তুলে এনে যদি কেউ চেপে ধরে? না, কেভিন হার্ট ও অস্কার অনুষ্ঠানের পেঁয়াজির কথা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে কারুর মতামত, ধারণা—বদলে যেতেই পারে। মুশকিল হল, যদি না বদলে থাকে? যদি চিন্তায় কন্টিন্যুইটির সমস্যা আসে? তবে?
একটাই উদাহরণ নিয়ে কথা বলি। শিল্পী, শিল্প আর ব্যক্তি নিয়ে। ওরফে, "আমার হিরো হাগেন না" সিনড্রোম। পরে ব্যাপারটা আরেকটু টেনেটুনে দেখা যাবে না হয়। এ লেখা লেখার সময় অবধি আমার যা জানাশোনার দৌড়, তাতে এ তর্কের কোনো সাধারণ সমাধান পাওয়া গেছে বলে, অন্তত আমার, জানা নেই (জানলে প্লিজ বলবেন)।
মাইকেল জ্যাকসন পিডোফাইল ছিলেন বলে তেনার নাচা-গানা শোনা বন্ধ করে দেবো কি? উত্তর 'হ্যাঁ' হলে, একই দাবিতে শ্রোয়েডিঙ্গারের ইক্যুয়েশন থেকে তেনার নাম সরিয়ে ফেলা দরকার, তাই না? দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সমীকরণটি 'ব্যবহার' না করার সৌভাগ্য আমাদের হবে না—ফান্ডামেন্টাল সমীকরণ হাজার হোক। মরে যাওয়া লোকের অসুবিধে নিয়ে ভেবে লাভ নেই না হয়, কিন্তু বেঁচে থাকা লোকজন তো হামেহাল 'ক্যান্সেল' হয়ে যাচ্ছে জনতার দরবারে, থুড়ি, খাপে। অভিযোগ সত্য-মিথ্যা—যা-ই হোক। কেভিন স্পেসি, সি এস ল্যুইস—নানা জন। ওদিকে, রোমান পোলান্সকি ফ্রান্সে গিয়ে খুব ফুর্তিতে কাটাচ্ছেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও—ক্ষণজন্মা পরিচালক হওয়ার সুবাদে।
একটু কেস ধরে ধরে ভাবলেই দেখা যাবে, 'ক্যান্সেল' হওয়ার সম্ভাবনা হল—প্রতিভার বিচ্ছুরণ, অপরাধের সাম্প্রতিকতা, আর খ্যাতি – এ সবের এক জটিল অপেক্ষক। কারুর রিসার্চের কাজে লাগতেই পারে, আমার-আপনার মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। যা হচ্ছে—মানব সমাজের দশচক্রে—হোক।
সে নয় হল। আমরা নিজেরা কী করি? মানে, নিজের জীবনে কোন নিয়মটা মানবো? এইসব উদাহরণ তো খুব সাঙ্ঘাতিক সব অপরাধের কথা। আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতা (এবং এইরকম আরো ভারি ভারি কিছু কথা)– এইসবের সঙ্গে খাপ খায় না—এমন কিছু শিল্পীর মধ্যে দেখলেই কি তাকে নিয়ে চর্চা করা, তার সৃষ্টি থেকে আনন্দ নেওয়া বাদ দিয়ে দেবো? তাহলে কি আর কোনো প্রথাভাঙা শিল্পীই পড়ে থাকবে?
তবে কি সবসময়েই শিল্পীর থেকে শিল্পকে আলাদা করে দেখবো? যদি সে সৃষ্টি তাঁর নিজের জীবন থেকে সরাসরি প্রভাবিত হয়, তা-ও?
যদুবাবু-কে কোট করি,
"একটা দারুণ কবিতা/লেখা পড়লেই প্রশ্ন আসে কে লিখেছে? তারপর তাকে খুঁজে বের করি, তার অন্য লেখা পড়ি, তার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনি, সে প্রথমে লেখা নিয়ে বলে, তারপর সে বলে সমাজ নিয়ে, তারপর বোঝার আগেই সে আমার কথা আমার মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বলে... এই ইনহেরেন্ট ব্যক্তিপূজা ঝেড়ে ফেলা খুব শক্ত। আসলে শিল্পের মধ্যে একটু হলেও শিল্পীসত্তার ছাপ থেকে যায়, যাকে বলে 'individual trace', সেটা শিল্পকে transcend করতে সাহায্য করে কখনো কখনো ... ওই যে লেখার ইতিহাস সেটা ডিনাই করবো কী করে?"★
এই অবধি এসে, তবে সহজতম উত্তর—এই দুই চূড়ের কোনোটাই পালনীয় নয়, সমাধান আসলে এর মাঝে কোথাও আছে।
কোথায়? কতটা পথ পেরোলে তবে (অনিন্দনীয়) 'শিল্পী' হওয়া যায়?
যাহ্, সুমনের প্রসঙ্গ এসেই পড়লো। বেশ, একেই প্রথম উদাহরণ করা যাক। কখনো মমতাকে নিয়ে লাফালাফি করছেন, কখনো চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর হচ্ছেন, কখনো রিপাবলিককে গালি দিচ্ছেন, তো কখনো সত্তরোর্ধ্বে বিছানা, মুক্ত কাম—এসব প্রসঙ্গ নিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে অস্বস্তিতে ফেলছেন। একই সময়ে তাঁর গান, কবিতার ধরন, বাংলা গানে তাঁর অবদান– নিয়ে আলাদা করে যা লেখা হচ্ছে, আবেগের ঘনঘটা বাদ দিলেও—প্রায় পুরোটাই সত্যি! সুমনের (কারুরই) বক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে আমার কোনোকালেই কোনো অসুবিধে ছিল না (শুদ্ধাচারী হাবড়াদের—নেহাত হাতে কোনো কাজ বা সময়ের কোনো দাম নেই বলে—এত ঘৃণা বিতরণ করতে দেখেছি, যে, তার বদলে যৌন আনন্দ নিয়ে একটা লোক যদি নিজের মনে নিজের কাজ করে যায়—আমার মোটেই খারাপ লাগে না। আপনার লাগতেই পারে, সেইসব জাজমেন্ট নিয়েই তো কথা বলতে বসা...), কিন্তু সমস্যা তো ছিল—অন্য অনেক কিছু নিয়ে! সমন্বয়ের, প্রান্তিকের ভাষার গুরুত্ব যার গানে প্রথম শুনে অবাক হয়েছি, মুক্তমনের মনে হয়েছে— অযথা তেনাকে ধর্ম পরিবর্তন করে এক প্রাচীন ধর্মগুরুর প্রশস্তি করতে দেখে অবাক হয়েছি বইকি! (খেয়াল করুন—ধর্ম পরিবর্তনে অসুবিধে হয়নি, প্রশস্তিতে অসুবিধে। প্রথমটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত যাপন, পরেরটি পাবলিকে আচরণ) একজন রিপোর্টারকে নোংরা গালি দিতে দেখে সমর্থন করতে পারিনি, কিন্তু একই সঙ্গে রিপাবলিক নামের ওঁচা সার্কাসকে গালি দেওয়ায় হাল্কা পুলক বোধ করেছি। ভেতরের ঘটনা যা-ই হোক, অপেক্ষাকৃত কমবয়সী কবির সঙ্গে খোলাখুলি নিম্নরুচির তর্জায় নেমে পড়তে দেখে বেজায় বিরক্ত হয়েছি। কিছুদিন পরে আবার গান শুনেছি, আর ভুলে গেছি—বুড়োটা কী বলেছিল।
এবারে, পুরোনো ক্যাসেটের গান তো যেমন আছে, থাকলো—যে লোকটার লাইভ শো একটা অভিজ্ঞতা, লাইভে তাঁর কথা শোনার সময়, গলায় গম্ভীর ইনফ্লেকশন এনে শ্রোতার মনে এক-একটি বিশেষ আবেগ আন্ডারলাইন করে দেওয়া দেখতে দেখতে মনে হবে না তো, যে লোকটা হিপোক্রিট? এই উচ্চরুচির সচেষ্ট প্রদর্শনের আড়ালে আসলে নেহাত ছেঁদো এক মানসিকতা লুকিয়ে আছে? মনে হলে, তা শ্রোতারই দায়, মানছি, কিন্তু শিল্প-শিল্পী সেপারেশনের সমস্যাটা তো থেকেই গেলো, তাই না?
যদি ধরেও নিই, যে, এই সেপারেশন সম্পূর্ণত সম্ভব, তাহলেও সমস্যা কমে না। আচ্ছা, শুভাপ্রসন্ন যদি খুব এক্কেরে দুনিয়া-কাঁপানো, সমাজ-বদলানো শিল্পী হতেন, যদি তাঁর লক্ষ লক্ষ ডাই-হার্ড ফ্যান থাকতো, আর তাঁর কথাকে তারা বেদবাক্য মনে করতো (যেমন কিছু লোকে মোদি, মমতা বা ট্রাম্পের কথাকে মনে করে), তাহলে বাংলা ভাষা নিয়ে তেনার অগা মন্তব্যগুলো আরো জোর পেতো না? শুধু মমতার সরকারের থেকে সুবিধে পেয়েছেন বলেই, জয় গোস্বামীর লেখা 'দগ্ধ' বা 'নিজের বিরুদ্ধে' বেরোনোর পরে, তথাকথিত 'আলোকপ্রাপ্ত' এই সমাজের বামপন্থী চিন্তাশীলেরা সেই লেখাগুলিকে (যতই সেই আবেগ ও তজ্জনিত কবিতা সত্য হোক না কেন) শিল্পীর থেকে আলাদা করে দেখেছিল? আদৌ দেখা যায় কি?
নাকি জয় গোস্বামীর মত বিদগ্ধ, প্রতিভাবান, খ্যাতনামা হলে দেখা যায়, নচেৎ নয়? চাড্ডি (সে প্রকাশ্য বা ছুপা—যাই হোক না কেন) কোনো লেখকের ভালো লেখা আলাদা করে সময় নিয়ে পড়ার, ভালো লাগলে তা স্পষ্ট বলার কষ্ট কি করবো আমরা, বিশেষ করে এ জীবনের অবশিষ্ট সীমিত সময়ে (চল্লিশের দোরগোড়ায়—খুব খানিক চিন্তা হয়েছে, বুঝলেন কিনা)? নাকি যার মতামত আমাদের নিজেদের মতো মনে করি, তেমন কেউ সেই চাড্ডির লেখার প্রশংসা করলে অস্বস্তি হবে খুব?
গুরুচণ্ডা৯ বইপত্র নিয়ে ভালো কাজ করছে — এমন কেউ বললে, বঙ্গ-বামের কি প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে বছর ষোলো আগের নন্দীগ্রামের সময়ে বেরনো একটি বহুচর্চিত লেখার লিঙ্ক তুলে এনে নিজের গুরু-বিরোধের কারণ দর্শানো, নাকি বলা—"সে নদীতে আজ এতদিনে অনেক জল বয়ে গেছে, যাক সে কথা"?
গুরু-র বইপত্র, সম্পাদিত বিভাগ—এসবেও, কেবল খুব চাড্ডি বলেই, কোনো শিল্পীকে কি আমাদের আঁকতে, লিখতে বলতে বাধবে? কারণ হিসেবে, "প্রকাশনা আর এই উদার আঙিনা এক নয়"–এইমতো কোনো যুক্তি দিয়ে নিজেদের মনের কাছে ওকালতি করবো না তো? গুরুর পাতায় কোনো চাড্ডি ট্রোল (ট্রোলিং-এর সাধারণ্যে মান্য সংজ্ঞা ধরেই বলা) ঠিক কতগুলো পোস্টে স্প্যামিং করলে আমাদের উদার প্ল্যাটফর্মের ঔদার্যে টান পড়বে? ক্ষুধার্ত, বয়স্ক লেখক ঠিক কতগুলো "আমায় দেখো" পোস্ট করলে তা স্প্যাম বলে গ্রাহ্য হবে? যে গালাগাল একজন লগিন করা, পরিচয়ধারী ব্যক্তির থেকে এলে তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, বেনামে ঠিক তার কতগুণ গালাগাল কোনো এক ব্যক্তিকে করলে তা অ্যাবিউজ বলে ধরা হবে?
প্রশ্নগুলো সহজ, তবে উত্তর (আমার) অজানা।
শিল্পের ধান ভানতে কেন রীতিনীতির গীত নিয়ে এলাম? কারণ এ সবই, অন্তত আমার মাথায়, সামাজিক আচরণবিধির মধ্যে পড়ে। আর কোনোকালেই সে বিষয়ে আমার কনসেপ্ট ক্লিয়ার ছিলো না। এই লেখাকে আবার কোনো ইঙ্গিত/আওয়াজ/খোঁচা ভেবে বসবেন না। ওসব আমার সত্যিই আসে না। এগুলো আমারই মনের কথা—বহুদিন ধরেই খোঁচাচ্ছে আর আগেও যেমন বললাম—এসবের উত্তর আমার জানা নেই। প্রশ্নগুলো পরিষ্কার করে একবার উচ্চারণ করা, নিজের তরফে, দরকার মনে হল—তাই করলাম।
এখন, যদি জিজ্ঞেস করেন— এত অজ্ঞানতা আর অম্বল নিয়ে, দ্বিধায় দোদুল্যমান হয়ে, রাতে ঘুমোই কী করে? ইডিথ স্যামসন রাস্তা দেখান। ওঁর Choose one of five বক্তৃতাটার লিঙ্ক দেওয়া থাকলো (যাদের ইঞ্জিরি পড়ার থেকে শুনতে বেশি ভালো লাগে, তাদের জন্যে অ্যান্ড্রু স্কটের গলায় বক্তৃতাটার একটা ভিডিওর লিঙ্কও আছে লেখাটার তলায়)।
★ এ লেখা লেখার পরে, বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে, যদুবাবুকে পাঠিয়েছিলাম। সে পাঠালো বছর দুয়েক আগেকার ফেবু-পোস্ট আর তার তলার কমেন্ট-সম্ভারের লিঙ্ক। সুবিধে হল। এ ধরনের চিন্তা নানা সময়ে, নানা আলাপে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে করেই থাকি, কিন্তু সে কথার সাজানো টই পেলে, ভাবনা গোছাতে সুবিধে হয়। গুছিয়ে কোট করলাম, অতএব। সেই পোস্টের লিঙ্কও থাকলো, ঘেঁটে দেখুন গিয়ে...