১
আজকে তবে লিখছি সামনে সমুদ্রতট, সন্ধে শেষের অল্প আলোয় খেলতে আসা জলের ধারার হামাগুড়ি। একটু আগেও সবাই ছিল, অশোক-দা আর শম্পাবৌদি, ঝুমাপিসি পিসেমশাই। রঞ্জন তো অনেক আগেই চলে গেছে। কোত্থেকে সে মাছ ভাজাবে, সস্তা দরে। রিম্পিটাও তো "মাছভাজা কই" 'মাছভাজা কই" বলতে বলতে পাগলা করে। আগে থেকে বাচ্চাটাকে বলার কোনও কারণ ছিল? ওকে নিয়েই অশোক-দা রা দোকান-টোকান ঘুরছে হয়ত।
আমার কোথাও যাওয়ারও নেই, আসারও নেই। ওই সমুদ্রের বেশ কিছুটা জল যে রকম পাড়ের থেকে দূরে যায় না। বারংবারই সেই একই জল ফিরে আসে বালির বুকে স্পর্শ দিয়ে — আবার ফেরে। সত্যি বলছি — জলের মধ্যে লক্ষ-কোটি জলজাতি, জলবংশ — কাছে থাকলে টের পাওয়া যায় জলের মধ্যে নানান রকম জল রয়েছে। রোদ্দুর কেউ ভালোবাসে, পাড়া-বেরোনো, বহির্মুখী, হাওয়ায় হাওয়ায় ঢেউ তুলে যায়। সকাল সকাল সূর্য উঠলে স্বর্ণ আভা বদলিয়ে হয় অভ্রকুঁচি — খুব পছন্দ। নিচের তলার ঘুমকাতুরে জলেরা খুব গোমড়ামুখো। তারা আবার নাতি-নাতনি মাছের সঙ্গে খেলা করে আনন্দ পায়। তেমন কিছু জলের ইচ্ছে মানুষ ছোঁবে নানান রকম। যে খুশি হয় তাকে যেমন দেয় জুড়িয়ে, ভীতু কাউকে দেখলে আবার তারই পাশে ঢেউ ভেঙে দেয় এমন ধাক্কা — চোখে মুখে লোনা জলে হাবুডুবু — ওরা আমার প্রিয়বন্ধু, আমার মতো জলেরা তো তটরেখায় সাদা ফেনার ছবি এঁকেই মুছতে থাকে, নতুন রেখা আঁকবে বলে।
এবার ফিরি, বাদ-বাকিরা হয়ত এখন অন্যরকম জলকে ঘিরে বসে গিয়েছে। এরা আবার কেমন ধারা — এইখানে এই বালির ধারে সবাই মিলে বসলে বরং ভালোই হ'ত। কৃষ্ণপক্ষ চতুর্থী চাঁদ ন'টা নাগাদ কড়া নাড়বে। জ্যোৎস্নাপ্রিয় জলের দলটি আজকে নাকি তাই নিয়ে তো অনেকক্ষণই কানাকানি করছিল খুব।
২
তেমন কিছু হয় না মোটে, যা ভাবা হয় — কোত্থেকে এক ঝগরুটে মেঘ গতরাত্রে আটটা নাগাদ আকাশ ঢেকে দখল নিল। "কী ভাগ্যিস তারই আগে বুড়ো-বাচ্ছা সবাই মিলে ফিরে আসলাম — নয়ত যে কী কাণ্ড হ'ত" — শম্পাবৌদি। পারেও বটে। ঝড়ের মতো হাওয়া ছিল, সঙ্গে বৃষ্টি খানিকক্ষণের — কী আর হ'তো? ওদিকে তো জ্যোৎস্নাপ্রিয় জলের দলের কী আক্ষেপ! ওদের ফেলে ঝড়-পাগলা জলেরা সব খুব দাপাল চন্দ্রোদয়ের ওই সময়ে। অতি বিরল লালচে চাঁদের "হরির লুটের জ্যোৎস্না কুড়োই" পালাগানটি স্থগিত থাকল। নীল জ্যোৎস্নার প্রবীন দলটি সে তুলনায় বাকি রাতভর মঞ্চ পেল।
অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে যায় ঢেউয়ের শব্দে। আলো তখন ফুটব ফুটব। জলের দাগ পিছিয়ে গেছে, ভাটার সময়। ঠিক যেখানে সারিবদ্ধ ঢেউরা ভাঙে — প্রথমবার আছড়ে পড়ে বালির ওপর, গতি বাড়িয়ে যায় ছড়িয়ে বেলাভূমির প্রসারতায়। ঠিক তখনই সাদা ফেনায় কী সব যেন চিহ্ন থাকে স্বল্পক্ষণের। ধাঁচ আছে তার, হাতের লেখার।
লেখাও কেমন জলের মতো। অক্ষরেরা মিলে মিশে শব্দ গড়ে। শব্দ জোড়ে, শব্দ জোড়ে, মাঝে-মধ্যে বিশ্রাম নেয়, হাত-পা ছোঁড়ে। একটা-দু'টো অর্থবোধ্য বাক্য হ'লেই তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের আদিখ্যেতা।
আদি ভাষার প্রথম বাক্য হয়ত ছিল — "খিদে পেয়েছে, শিকারে যাই।" কেউ একজন পেটটা চেপে করে উঠল ধ্বনি প্রকাশ, পাশের জনে বুঝতে পেরে বলশালী কাউকে ডেকে তুলে দিয়েছে পাথর-ডাঙশ। সেই গুহাতেই আঁকা একটি হরিণ অবয়বের দিকে তাক করেছে পাথরখন্ড — সেই ধ্বনিটির অর্থ হ'ল - শিকার চল। হয়ত সে-সব উচ্চারণের চোখ ফুটল ক্রমে ক্রমে — হাসতে শিখল, উল্টে যেতেই দেখল কেমন বুকে হেঁটে যায় এগোন। এবার তবে হামাগুড়ি। ঠিক এর পরেই শক্ত দু'পায়ে হাঁটল ভাষা, মানুষ পেল নাগাল তারই। সবাই মিলে পালা-পার্বন পেলেই বোনে নক্সীকাঁথায় শব্দগুলি। কে বা কারা তারই মধ্যে উচ্চারিত শব্দগুলি আঁকতে চাইল — লেখা অক্ষর — কী আশ্চর্য! তখন থেকেই হয়ত কিছু অভিজ্ঞতার পাঠ শিখে নেয় সন্তানেরা। তারা আবার যায় এগিয়ে ওই পথে ফের আর একটু দূর। ঠিক এমনই পাথরখন্ড চৌকো থেকে গোলাকৃতি চাঁদের মতো — গড়গড়িয়ে এগোয় মানুষ নতুন ভাষার কাপড়-জামায়।
৩
ওরা সবাই ঘুরতে গেলে দ্রষ্টব্যস্থান, ঝুটোমুটো এক অছিলায় এড়িয়ে গেছি। জল দেখলে, বিশেষত সমুদ্রতট — আটকিয়ে যাই। ক'দিনই বা, পরশু আবার ফিরতে হবে সোনার খাঁচায়, বসতে দাঁড়ে।
মাঝে মধ্যে যাই বিষিয়ে। এখন যেমন ফিরে যাওয়ার কথা উঠতেই মনে পড়ল কাজের জামা গায়ে চড়ালেই কেমন যেন জিন-লাগামে সেজে ওঠা ঘোড়ার মতো দেখায় আমায়। ঠুলি এঁটে সোজা পথে তীব্রগতির একটু আধটু ভুল ও চুকে চাবুক পিঠে। কেমন যেন বদলিয়ে যাই। অন্য ভাষায় অন্য মানুষ ছাতার মাথা কাজ করে যায়। নিজের থেকে দূরে গিয়ে দেখতে থাকি — কী বিশ্রী যে দেখায় আমায়!
যা বলছিলাম, ওই দেখেছ — আবার কেমন তোমায় লেখার সময় হ'লে সম্বোধনহীন, ভূমিকাহীন কথার চাদর পেতে বসি। কী যে করি, স্বভাব এমন সারাক্ষণই তোমায় কিছু বলার হ'লেই ঠিক মনে হয় সামনে আছ। এই মুহূর্তে ওই তো তুমি, ঠিক যেখানে তটরেখা এঁকে আবার ফিরে যাচ্ছে আমার মতো জলের অংশ। অন্যসময় সাদা পাতায় যে অক্ষর শব্দ বোনে, যে শব্দরা পাশাপাশি বাক্য গড়ে যায় বেড়াতে, কিংবা মেলায় — সেই তো তুমি।
সুযোগ পেলেই যাই পালিয়ে যখন খুশি যেমন খুশি — এখন যেমন একটা দলের সঙ্গে মিশে পুরী এলাম। পাড়ার লোকই। কাল হয়ত কলেজবেলার বন্ধুরা সব সুন্দরবন, সজনেখালি। টানা দু'দিন দুই রাত্তির নৌকা-যাপন। রাতে যখন আলো নিভবে সারা আকাশ তারায় ভরা — তারই মধ্যে রেখা টেনে লিখব তোমায়। মাঝে মধ্যে সময় ভ্রমণ — বাড়ির ছাতে মাধ্যমিকের ওই বছরে। তৎকালীন এক প্রিয় মুখের সঙ্গে কল্প-গল্পগাছা। ভুল বুঝো না, সে সব কথা সাদা-মাটাই। কথার ছুতোয় যতক্ষণ না সময় ফুরোয় — আটকে রাখা।
৪
যখন থেকে চেনা হ'লে, সারাক্ষণই সঙ্গে থাকতে এক শহরে, গা করিনি। শহর ছাড়ার পরেই দেখি কী প্রচণ্ড নেশার মতো গ্রাস করেছ। বইয়ের পাতায় দেখলে তোমায় ছাড়ছি না প্রায়। এমন করেই কোন একদিন লিখতে বসে সে কী কাণ্ড। এক একটা অক্ষর যেই পর্দা জুড়ে উঠছে ফুটে মুগ্ধ হয়ে দেখছি শুধু। শেষ অবধি যা দাঁড়াল — তার মধ্যে সারবত্তা কিচ্ছুটি নেই। পরে আবার পড়ে দেখতেই খুব হেসেছি নিজে নিজেই। তারই মধ্যে বাক্যগঠন, বানানবিধির সাত-সতেরোও শেখাও তুমি। হয়ত তবু ভুল থেকে যায় মাঝেমধ্যে, ছোটবেলায় যত্ন নিলে পাকা হ'ত। সে যাই হোক — লিখতে বসলে ঠিক মনে হয় সঙ্গে আছ, দেখছ আমায়। আমি শুধুই বলতে থাকি, বলতে থাকি বলার ছুতোয়। এ অক্ষর, সে অক্ষর ওই শব্দ সেই শব্দ আঙুল যা ছোঁয় যতক্ষণ না সময় ফুরোয় — লিখতে থাকি।
লিখতে থাকি মন খারাপে, লিখতে থাকি ফুর্তি হ'লে। মনে মনে লিখতে থাকি ইচ্ছেমতো আড্ডা পেলে ওই শহরে। পরে আবার ফিরে এলে সে সব কথার মশলা মেখে জাবর কাটি। সে রূপকথার নক্সা বোনে প্রিয় অক্ষর শিতলপাটি।
যেমন থাকি যেখানে যাই দিনের শেষে তোমার কাছেই ফিরে আসা। কথার ছলে তোমায় ছুঁয়ে যাবজ্জীবন বাংলা ভাষা…..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।