এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ ডিসেম্বর ২০২২ | ৩৩২ বার পঠিত
  • মানুষ যত বড় হয়, যত বয়স বাড়তে থাকে, ধীরে ধীরে নিজের অগোচরে জীবনটাও ছোট হয়ে আসে। ফেলে আসা শৈশবকালটা মনের আকাশে তখন যেন বাড়তেই থাকে। টুক করে শৈশবকালটা পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কত পুরোনো স্মৃতি মনে ভেসে আসে তখন। কত পুরোনো ছবি এসে ভিড় করে মনের আকাশে। তখন ইচ্ছে করে শৈশবকালের জগৎ থেকে ঘুরে আসতে, ডুব দিতে।

    সমরেশ মজুমদারের অনিমেষ সিরিজের প্রথম উপন্যাস 'উত্তরাধিকার'। পটভূমি স্বর্গছেঁড়ার চা-বাগান, জলপাইগুড়ি। প্রথম এই উপন্যাসটি পড়ি যখন আমি পড়তাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সম্প্রতি আবার পড়লাম। যতবারই পড়ি মনে আসে আমার দাদুভাইকে, গাছগাছালি ঘেরা বসতবাড়িটিকে, শুয়ে থাকা চৈত্রের দুপুরে দাদুভাইয়ের সাথে আমগাছের কিংবা নিমগাছের তলায় মাদুর বিছিয়ে, ফেলে আসা দুপুরের সায়াহ্নে মাছ ধরা পুকুর থেকে ছিপ দিয়ে, আরও কত কত স্মৃতি এসে ভিড় করে মনের দুয়ারে। 'উত্তরাধিকার' উপন্যাসে যখন পড়ি "এই বাড়িটার চারপাশে শুধু গাছপালা। সবকটা গাছের আলাদা আলাদা গল্প আছে, মন  ভালো থাকলে দাদু সেগুলো বলেন। এই যে ঝাপড়া কাঁঠাল গাছ সারাদিন উঠোনের উপর ছায়া ফেলে রাখে, সেটা বড় ঠাকুমা লাগিয়েছিলেন। চল্লিশ বছর হয়ে গেছে গাছটার।"

    ঠিক সেরকমই শুনেছিলাম দাদুভাইয়ের কাছে, আমাদের বসতবাড়ির পুকুর পাড়ে যে কাঁঠাল গাছটা আছে - সেটা লাগিয়েছিলেন আমার ঠাম্মা। উনি বাড়ির পিছনের উঠোনে  হাতটেপা কলের পাশে লাগিয়েছিলেন একটি লেবু গাছ। যার ঝাড় এসে উপছে পড়ত সিমেন্ট বাঁধানো কলতলায়। বাস করতো একটা বাস্তুসাপ ঐ লেবুগাছটায়। ঠাম্মা রোজ দুপুরে আহারাদি সেরে ভাত ছড়িয়ে দিতেন কলতলায়, আর সাপটি এসে ঠাম্মার পা জড়িয়ে ভাত খেয়ে চলে যেত। আমার নিজের চোখে দেখা এ দৃশ্য। বাড়ির  সামনের ডান পাশের  বড় উঠোনের প্রায় মধ্যিখানে ছিল লিচুগাছ, তার পিছনে বাড়ির সীমানার বেড়া ঘেসে জামরুল গাছ - টগর ফুলের গাছ। লিচুগাছটি লাগিয়েছিলেন আমার বড়কাকা, কাকুমণি বলে ডাকতাম ওনাকে। উনি লাগিয়েছিলেন একটি চাঁপা ফুলের গাছও বামদিকের উঠোনে, ঠাকুরমন্দিরের পাশে। ফুলের তীব্র মধুর সুগন্ধে বাতাস থাকত ভারাক্রান্ত।

    'উত্তরাধিকার' উপন্যাসের "উঠোনের শেষে গোয়ালঘর", "সারাদিন রঙিন পাখির কিচিরমিচির" কিংবা "গোয়ালঘরের পিছন দিকে কোনো বাড়িঘর নেই। বড় বড় জঙ্গলে গাছের সঙ্গে আম, কুল ছড়িয়ে আছে" পড়তে পড়তে মনের পর্দায় ভেসে আসে আজও - আমাদের বসত বাড়ির পিছনদিকে কলতলার পিছনের আমের বাগান, সেটা ছাড়িয়ে বামদিকে গেলে পুকুরের ডানদিকের বিশাল জমিতে আম, জাম, তেঁতুল গাছের সমারোহ। আমবাগানের শেষপ্রান্তে গোয়ালঘর। গ্রীষ্মকালে কী ঠান্ডা থাকত এই আমবাগানের তলা। গাছের নীচে মাদুরের উপর শুয়ে শুনতাম পাখপাখালির কিচির-মিচির, গরুর হাম্বা ডাক। দাদুভাই বলতেন, এই অসংখ্য আমগাছের বেশিরভাগ লাগিয়েছিলেন আমার বাবা।

    ****

    শৈশব আমার কেটেছে দাদু, ঠাকুমা, দুই কাকা এবং দুই পিসির সাথে আমাদের বসতবাড়ি বারাসাতে। দেশভাগের কিছু আগে কুমিল্লা থেকে চলে আসেন দাদু সব পরিজনদের নিয়ে। আমার বাবা ছিলেন সবার বড়। বারাসাতে বানান দাদু আমাদের বসতবাড়ি, নারকেল-সুপারি-নিম-কুল গাছে ঘেরা পুকুর এবং পুজোমণ্ডপসহ। ছিল আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-জামরুল-পেয়ারা গাছগাছালি ঘিরে বাড়িটিকে। ছিল শিউলি, টগর, জবা, চাপা, জুঁই ফুলের সমারোহ।

    বাবার ছিল বদলির চাকরি। আমার বয়স যখন দুই মতন, দাদুভাই চেয়ে নেন আমাকে আমার মায়ের থেকে ওনার সাথে থাকার জন্য বারাসাতে। আমার ভাই'এর বয়স তখন তিন-চার মাস।
    দিদি ছিল সাড়ে তিন বছরের বড় আমার থেকে। আমার মামার বাড়িও ছিল বারাসাতে। দিদি প্রথমদিকে আমাদের বসতবাড়িতে থাকত। তারপর যখন স্কুলে ভর্তি হয়, চলে যায় মামার বাড়ি সুন্দরদাদুর সাথে থাকতে।

    আমাদের বসতবাড়ির সামনের বিশাল উঠোনের বামদিকে ছিল পুজোমণ্ডপ। পুজোমণ্ডপের গাঁ ঘেসে ছিল একটি বাতাবি লেবুর গাছ। আর মণ্ডপের পিছনে বিশাল মাঠ, যেখানে বড় হয়ে আমরা খেলেছি ফুটবল অথবা ক্রিকেট। প্রথমে এই মাঠে ধানচাষ করা হত, কিন্তু আমাদের বসতবাড়ির পিছনে এত বিশাল ধানক্ষেত ছিল যে - দাদুভাই এই মাঠে আর চাষ করাতেন না। আগেই জানিয়েছি মণ্ডপের বামদিকে ছিল চাঁপা ফুলের গাছ। তার থেকে একটু এগিয়ে প্রবেশদ্বার। একপাশে বেলগাছ যার তলায় এখনও হয় আমাদের মণ্ডপে অনুষ্ঠিত দুর্গাপুজোর বোধন। আর একপাশে আগাগোড়া সাদা ফুলে ছেয়ে থাকা জুঁই ফুলের গাছ।

    মনে পড়ে গরমকালে শুয়ে আছি বাইরের বারান্দায় দাদুভাইয়ের সাথে মশারির ভিতরে - পাশে হ্যারিকেনের স্বল্প আলো। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া - গেটের পাশে সাদা জুঁইফুল ভরা গাছের পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে সাদা ঘোমটা মাথায়। ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলা - আবার চোখ পিটপিট করে দেখার ইচ্ছা - ভয়মিশ্রিত চোখে শেষে গভীর ঘুমে ঢলে পড়া। সকালে উঠে দাদুভাইকে রাতের কথা জানাতে বলতেন, ওটা ঘুম চোখের ভ্রম - সাদা জুঁই ফুলে ঢেকে থাকা গাছটাকেই মনে হত এক সাদা কাপড়ের ঘোমটা পরা বউ। 

    মনে এসে যায় লিচু গাছের সামনের জমিটুকু উর্বর করতে আলু চাষের জন্য আমাকে কাঠের পিঁড়ির উপর বসিয়ে গণেশ কাকু কিংবা ছোট কাকুর দড়ি ধরে টানা। দেখতে পাই  নিজেকে সেই ধুলো-মাটি মেখে লুটোপুটি খেতে, গড়াগড়ি খেতে। নেই মা-বাবার শাসন, নেই মা-বাবার বকুনি, শুধু আনন্দ আর আনন্দ। এরকম শৈশবকাল কজন পেয়েছে তার জীবনে ! পুকুরটির চারপাশ ঘিরে ছিল নারকেল, সুপারি গাছের মেলা। ছিল সিমেন্ট বাঁধানো একটি বড় ঘাটলা, দুইপাশে উঁচু করে বানানো বসার জায়গা। দাদুভাই সন্ধ্যের পর আহ্নিক করে এখানে বসে পাড়ার বিভিন্ন লোকের সাথে করতেন গল্পগুজব। দাদুভাই এই পুকুরটি কাটিয়েছিলেন দুটো কারণে। পুকুরের মাটি দিয়ে উঁচু করা হয় আশপাশের জমি, যার উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই বসতবাড়ি আর গাছ-গাছালির সমারোহ। আর পাড়ার দুই কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ছিল এই একটিমাত্র পুকুর, যাতে দুইবেলা প্রায় শতাধিক লোক করত স্নান। ঘাটলার এক কোনায় ছিল একটি তুলসিমন্ডপ, যেখানে ঠাম্মা দিতেন সন্ধ্যাপ্রদীপ রোজ। ঘাটলার ঠিক বাইরে দুই কোনায় ছিল দুটো শিউলি গাছ। দুর্গাপুজোর ঠিক প্রাক্কালে উঠোন ভরে থাকত শিউলি ফুলের ম-ম  করা মাদকতার সুগন্ধে। 

    ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন