বাংলার সাহিত্যাকাশে রায়চৌধুরী অর্থাৎ রায় পরিবারের অবদান অপরিসীম। সেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী থেকে শুরু। বলা যায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল, "সন্দেশ" পত্রিকার সৃষ্টি। ১৯১৩ সালে সন্দেশ জন্মের পর উপেন্দ্রকিশোর মাত্র দুই বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর পর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায় প্রায় ৮ বছর সন্দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁর অকাল প্রয়ানে হাল ধরেন ভাই সুবিনয়। তাঁর পরে সত্যজিৎ হয়ে সন্দীপ রায় বর্তমান। এবছর ১৪২৭ শারদীয়া সংখ্যার সন্দেশে পালিত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ। সন্দীপ পুত্র সৌরদীপ এই প্রথম সন্দেশের কাজে হাত রেখেছেন। পিতা ও পুত্রের পরিকল্পনায় সেজে উঠেছে এবারের শারদীয়া সন্দেশের প্রচ্ছদ। অর্থাৎ সন্দেশ এমন একটি পত্রিকা যাতে রায় পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মও সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে চলেছেন। সেই সন্দেশের অনেক জানা অজানা তথ্য সন্দেশ প্রিয় পাঠকের দৃষ্টিগোচরে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম...
সন্দেশ হল শিশু কিশোরদের পাঠ্য কলকাতা থেকে বাংলায় প্রকাশিত একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা(বর্তমানে)। ১৯১৩ সালে এই পত্রিকাটির জন্ম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, তাঁর মেসার্স ইউ. রায় অ্যান্ড সন্স (M/s U. Roy & Sons) কোম্পানী প্রকাশনের মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে উপেন্দ্রকিশোর মারা যাবার পর এর সম্পাদনার ভার নেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়। সুকুমার রায়ের সম্পাদনার সময়েই সন্দেশ একটি অনন্য সুন্দর পত্রিকা হয়ে ওঠে। যাতে সাহিত্য রসের সঙ্গে হাস্য ও কৌতুক রস, বিজ্ঞান ও জগৎ সম্বন্ধে তথ্যাদির সমাবেশ ঘটে। তবে সুকুমার রায় নিজে পত্রিকাটিতে শিশুদের উদ্যেশ্যেই বেশি লিখতেন।
১৯২৩ সালে সুকুমারের অকালমৃত্যুর পর তাঁর ভাই সুবিনয় সন্দেশের সম্পাদনা দেখাশোনা শুরু করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯২৬ সালে পত্রিকাটি সময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে নতুন মালিকানার অধীনে পত্রিকা পুনরায় প্রকাশিত হয় এবং এবারে সুবিনয়ও একজন সম্পাদক হিসাবে থেকে যান। কিন্তু ১৯৩৩-৩৪ সালে ইউ. রায় অ্যান্ড সন্স কোম্পানী উঠে গেলে পত্রিকাটি আবার বহুদিনের(প্রায় তিন দশকের) জন্য বন্ধ হয়ে য়ায়। জলের দরে বিক্রি হয়ে যায় সন্দেশ পত্রিকার কার্যালয় ও বাড়ি শুদ্ধ সমস্ত সম্পত্তি।
১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় সন্দেশ পত্রিকা আবার নতুন করে প্রকাশিত হয়। সত্যজিৎ রায়ের অনেক রচনাই এখানে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বদলে সত্যজিতের পিসি স্বনামধন্যা লেখিকা লীলা মজুমদার সত্যজিতের সঙ্গে সন্দেশের সাম্মানিক সহসম্পাদকত্ব অধিগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালেই সত্যজিৎ রায় "সুকুমার সাহিত্য সমবায় সমিতি" নামে একটি অলাভজনক সাহিত্য সমবায়-সমিতি (কো-অপারেটিভ) গঠন করেন যা এখনো অবধি সন্দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৪ সাল থেকে সত্যজিতের মাসতুতো বোন নলিনী দাশ সন্দেশের আরো একজন সহ-সম্পাদক হন। এবং বস্তুতপক্ষে হন এর কার্যনির্বাহী (এক্সিকিউটিভ) সম্পাদক। তাঁর স্বামী অশোকানন্দ দাশ হন এর সাম্মানিক প্রকাশক। সত্যজিৎও এঁদের সঙ্গেই কাজ করতে থাকেন। তিনি তাঁর অনেক মূল রচনা ছাড়াও সন্দেশে অনেক জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা লিখতেন। যেমন কিছুদিন তিনি প্রতিটি সংখ্যায় একটি করে স্বল্প পরিচিত প্রাণীর ছবি ও তার সম্বন্ধে নানা মজার তথ্য লিখতেন। চিত্রবিচিত্র ধাঁধা, কমিক স্ট্রিপ, লিমেরিক, ছোট গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদির সুসমন্বয়ে পত্রিকাটি সেই সময়ে ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর একটি অংশে ১৬ বছরের থেকে ছোটদের নিজেদের লেখা ও আঁকা ছাপা হত, যার নাম ছিল "হাত পাকাবার আসর"। তার মানও ছিল যথেষ্ট উন্নত। সুকুমার রায়ের সন্দেশ ছিল শিশু ও কিশোরদের মনোরঞ্জনের এক অনন্য উপাদান সমৃদ্ধ ঝুলি। ছোটদের কাছে তো বটেই, সম্পাদকমণ্ডলী এটিকে তরুণদের কাছেও আকর্ষণীয় করে তোলেন।
১৯৯২-৯৩ সালে পত্রিকাটি আবার দুর্গতির সম্মুখীন হয় কারণ মাত্র ১৪ মাসের মধ্যে সত্যজিৎ রায়, নলিনী দাশ ও অশোকানন্দ দাশ পরলোক গমন করেন। ১৯৯৪ সালে লীলা মজুমদারও এত অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাঁর পক্ষেও এর কার্য নির্বাহী সম্পাদক রূপে কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এই ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকেই সত্যজিতের পুত্র সন্দীপ রায় সন্দেশের সহ-সম্পাদক হন । এবং নলিনী দাশের পুত্র অমিতানন্দ দাশ এর প্রকাশনা গ্রহণ করেন। কিন্তু এই অনভিজ্ঞ জুটির পক্ষে দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছিল - কারণ কমিক্স, দূরদর্শন, কেবল টিভি, এবং রংবেরঙের ছবিওয়ালা পত্রিকাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগীতায় এই শিশু ও কিশোর পত্রিকাটি পিছিয়ে পড়তে থাকে। সন্দেশ ছিল একটি সাদা কালো পত্রিকা। যা তখন ধুঁকতে ধুঁকতে লড়ে চলেছে, ক্রমাগত লোকসান হচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটা সংখ্যা বাদ পড়ছে।
২০০৩ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন সন্দেশকে পুনর্জীবিত করার উদ্দশ্যে কিছু অর্থসাহায্য দেয়। কিন্তু তখন অনেক রঙীন পাতা ও দৃষ্টিনন্দন চেহারা সত্ত্বেও সমবায় সমিতির মতানৈক্যের কারণে সন্দেশ আর্থিক ভাবে অচল হয়ে পড়ে। ২০০৫-এর জুলাই থেকে ২০০৬-এর এপ্রিলের মধ্যে এর বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ হতে পারেনি।
২০০৬ সালের আগষ্ট মাস থেকে আবার নতুন উদ্যমে সাহিত্যের উন্নতমান ও সুসংহত পরিচালনার মাধ্যমে পত্রিকাটিকে পুনরায় জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে। চারটি অপ্রকাশিত সংখ্যার পর শারদীয়া সন্দেশ আবার বের হয়েছে। পত্রিকাটি যাতে আবার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এবং এর মান যাতে বজায় থাকে ও পাঠকমণ্ডলী বৃদ্ধি পায় তার জন্য নানারকম পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর শারদীয়া বা ত্রৈমাসিক সন্দেশ গুণমানে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখছে না। একমাত্র সন্দেশের পৃষ্ঠাতেই মেলে সত্যজিৎ রায়ের অপ্রকাশিত চিত্রনাট্য বা অন্যান্য লেখাগুলি। পড়ার সৌভাগ্য ঘটে মাকে লেখা সত্যজিতের অমূল্য চিঠিগুলো। তাই আমার মত সকল সাহিত্যানুরাগী পাঠকগণ সন্দেশ ভালবাসুন। যুগ যুগ ধরে এগিয়ে চলুক ঐতিহাসিক পত্রিকা একামেবাদ্বিতীয়ম "সন্দেশ"।
(ঋণ স্বীকার:- বাংলা উইকিপিডিয়া)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।