নারী ও শিশু পাচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সারা ভারতের চেয়ে এগিয়ে। এই হিসেব জাতীয় অপরাধ তথ্য-পরিসংখ্যান দপ্তরের, যা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকার ভুল বলে দাবি করেছিল।
কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী সংসদে একদা বেশ জোরের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, বাল্য বিবাহ এবং নারী ও শিশু পাচারে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। এবং প্রতি বছরই নারী পাচারের সংখ্যাটা বাড়ছে৷ ২০১৫-১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ নারী ও শিশু পাচারে পয়লা নম্বরে ছিল৷ ২০১৫ সালে নারী পাচারের সংখ্যাটি ২১০০ এর ধারেকাছে ছিল। পরের বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬০০ জনের কমবেশিতে৷ শিশু পাচার ২০১৫ সালে ছিল ১৮০০ জনের ধারেকাছে। ২০১৮ সালে সেটা প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেড়ে গেছে । এই হিসেব ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো'র অর্থাৎ NRCB এর তথ্য ৷ যদিও NCRB এর রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যে ৫৪ হাজারের মত নারী ও ১৭ হাজারের মত শিশু নিখোঁজ ছিল সমসাময়িক সময়কালে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাভাবিক কারণেই এই হিসেবে ক্ষুব্ধ ৷ এবং রাজ্যে চিট ফান্ডের বাড়বাড়ন্ত থেকে শুরু করে আর্থিক দুরবস্থা, সবকিছুর দায়ই যেমন পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাজ্য সচিবালয়ের দাবি, আগের সরকারের আমলে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটলেও তা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হতো না। কিন্তু তৃণমূল সরকারের আমলে সেটা নিয়মমাফিক হচ্ছে৷ তাই সংখ্যাটা বেশি মনে হচ্ছে৷ সেসময়ে যদিও রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা নিজে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে দলীয় সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদার দাবি করেছিলেন, কেন্দ্র সরকারের দেওয়া এই রিপোর্ট ভুল৷ রাজ্যে শিশু পাচারের দায়ে অভিযুক্ত খোদ বিজেপি নেতা-নেত্রীরা। তাই এখন ভুল পরিসংখ্যান দিয়ে অন্য দিকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে। এরকম রাজনৈতিক চাপানউতোর চলবেই। তবে আসল যে সমস্যা তার নিষ্পত্তির দিকে সরকারের কতটা নজর সেটাই দেখার।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই তথ্য-পরিসংখ্যানকে ভুল না বললেও অন্য একটি অসঙ্গতির দিকে নির্দেশ করেছিলেন 'দূর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি'র দায়িত্বে থাকা ডাঃ স্মরজিৎ জানা৷ সোনাগাছির যৌনপল্লীতে বহু বছর ধরেই যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে লড়ছে দূর্বার। যার মধ্যে এক বড় কাজ অনিচ্ছুক যৌনকর্মীদের উদ্ধার করা৷ অর্থাৎ জোর করে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিংবা ভুলিয়ে ভালিয়ে যৌনপেশায় আনা হয়েছে এমন মেয়েদের, যারা পাচার হয়ে এসেছে, দূর্বার তাদের চিহ্নিত করে এবং হয় বাড়িতে ফেরত পাঠায় অথবা বিকল্প কর্মসংস্থান করে৷ ডঃ জানার বক্তব্য, যারা যৌন পেশায় আসছে.. প্রতি বছর তাদের সবাইকেই পাচার হওয়া মেয়ে হিসেবে দেখানো হয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যে৷ কিন্তু অনেক মেয়েই হয়ত স্বেচ্ছায়, বা জীবিকার তাগিদেও যৌন পেশায় অবতীর্ণ হয়৷
দূর্বারের নিজের কাছে এ সংক্রান্ত যা তথ্য আছে, তাতে দেখা যায় মেয়েরা তিন ধরনের কাজে মূলত শহরে আসে৷ গৃহ পরিচারিকার কাজ, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ এবং যৌন পেশা৷ প্রথম দুটি কাজ যেহেতু পরিশ্রমসাপেক্ষ এবং সেই তুলনায় মজুরি যথেষ্ট নয়, অনেকে নিজেরাই অপেক্ষাকৃত কম শারীরিক পরিশ্রমের, কিন্তু বেশি উপার্জনের যৌন পেশা বেছে নেন৷ ডাঃ স্মরজিৎ জানার বক্তব্য, এটা একটা বাস্তব প্রবণতা, যাকে উপেক্ষা করা যায় না৷ বরং অগ্রাহ্য করা যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের তদ্কালীন সংসদে দেওয়া ওই তথ্যকে, যা সমস্যার পুরোটা দেখছে না৷
শিশু পাচারের ব্যাপারটি বিশদে বললে বোঝা যাবে। কয়েক বছর আগে দত্তক দেওয়ার নাম করে অবৈধ উপায়ে শিশু পাচারের অভিযোগে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বিমলা ‘শিশু গৃহ’ নামের একটি হোমের কর্ত্রী চন্দনা চক্রবর্তী, তাঁর ভাই মানস ভৌমিক ও হোমের অ্যাডপশন অফিসার সোনালি মন্ডলকে গ্রেপ্তারও করেছিল পুলিশ। সে সময়ে শিশু পাচারের কাজে সহযোগিতা করার অভিযোগে দার্জিলিং জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক মৃণাল ঘোষ, জলপাইগুড়ি জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক সুস্মিতা ঘোষ ও শিশু কল্যাণ কমিটির সদস্য চিকিৎসক দেবাশিস চন্দকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
উত্তরবঙ্গের ঘটনার তদন্তের মাঝেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতা থেকে একটি শিশু পাচার চক্রের হদিস পাওয়া গিয়েছিল। তিনটি সদ্যোজাত শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি এক নার্সিং হোমের মালিকসহ চারজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল
উত্তর ২৪ পরগণার বাদুড়িয়ার এক ডেরা থেকে ৩২টি সদ্যোজাত ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ। এই চক্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন জায়গা থেকে চিকিৎসক, নার্সিং হোমের মালিক ও এনজিও’র আধিকারিকসহ ১৮জনকে আটক করা হয়েছিল। দত্তকের নামে নিলাম করে শিশু বিক্রির খবরও রটেছিল। তদন্তকারীদের মতে, রীতিমতো নিলাম করে শিশু বিক্রি করা হতো। যে সব শিশুকে বিদেশি দম্পতিদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে তাদের বয়স ৬ মাস থেকে শুরু করে ১৪ বছর। আর এদের জন্য মূল্য হাঁকা হয়েছিল ১২ হাজার থেকে ২৩ হাজার মার্কিন ডলার।
এই তথ্যটিও জানিয়ে রাখা অতি প্রয়োজন যে, ভারতে প্রায় ২ কোটি অনাথ শিশু রয়েছে । তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা ও জনগণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উল্লেখ করে এসওএস চিলড্রেন্স ভিলেজেস ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এদের অধিকাংশই অভিভাবকদের দ্বারা পরিত্যক্ত। অনাথ শিশুদের দত্তক দেওয়ার জন্য সারা দেশে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃত বহু এডপশান এজেন্সি। এদের তদারকির জন্য প্রত্যেক রাজ্যে রয়েছে চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার কমিটি। জেলায় জেলায় রয়েছে শিশু সুরক্ষা অফিসারও। এতকিছু সরকারি ব্যবস্থা থাকা সত্বেও ফাঁক ফোকর গলে এই গর্হিত কাজ সন্তর্পণে ঠিকই চলছে। তবে এটাও গুরুতর অভিযোগ যে, ভারতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দত্তক দেওয়ার আইনটি প্রয়োজনের তুলনায় কঠোর, জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। তারজন্যই বিদেশি দম্পতিরা দালালের সাহায্য নেয় বলে অভিযোগ। নারী শিশু পাচার রোধ নিয়ে কাজ করা কিছু এনজিও এরকমও অভিযোগ করেন, “গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করে দরিদ্র গর্ভবতী মহিলাদের চিহ্নিত করা হয়। দত্তক দেওয়া হবে প্রতিশ্রুতিতে টাকার টোপ দিয়ে শিশু জন্মের পর শিশু তুলে দিতে বলা হয়। অবিবাহিত গর্ভবতী মহিলাদেরও টার্গেট করে টোপ দেওয়া হয়। বহু নার্সিং হোম এই কাজে যুক্ত। এ জন্য একটি দালাল চক্রও ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাজ্যে।
নারী ও শিশু পাচার রোধে তথাকথিত উন্নত মানবসমাজের ভূমিকা:-
নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে এক ধরনের সহিংসতা যা মানব সভ্যতার প্রতি উপহাস, বর্বর যুগের প্রতিচ্ছবি, মানবিক মূল্যবোধ ও অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করার নিদর্শনের এক করুণ প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজুড়ে মানব পাচার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সব নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ও শিশু পাচারের কারণ দেশ-কাল, পাত্র ও সমাজভেদে বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। এর প্রতিরোধের উপায় যেমন খুঁজতে হবে। তেমনি এর প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে এ জাতীয় মানসিকতার অবস্থানকে লক্ষ্য রেখে। নারী ও শিশু পাচারের প্রধান কারণগুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আইনগত দুর্বলতার সুযোগ, নীতি ও অনুশাসনের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, দুর্বলতা ও শিক্ষার অভাব এবং তা প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের কমতি এবং সর্বোপরি প্রতিকারের জন্য আইনি সহায়তার সীমিত সুযোগ নারী ও শিশু পাচারের কারণগুলোর অন্যতম। আমাদের দেশের দরিদ্র নারী ও শিশুরা পাচারকারী চক্রের হাতে পড়ে যায় সামান্য প্রলোভনে। অথবা তাদের অপহরণ করে পাচার করা হয়। এভাবে তারা স্থানান্তরিত হয়ে একপর্যায়ে দেশ ছাড়া হয়। গ্রামের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের নারী, যারা চাকরির উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে শহরে আসেন, তারাই মূলত পাচারের শিকার হয়। এছাড়াও অবিবাহিত, বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকপ্রাপ্তা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারী, স্বল্প শিক্ষিত নারী ও শিশু, বাড়ি থেকে পালানো কিশোরীরা পাচারের শিকার হয়। আবার সুখী ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে পড়ে আশ্রয়হীন; অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত শহরমুখী নারী ও শিশুরাও পাচারের কবলে পড়েন। একশ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্র নারী ও শিশুদের চাকরি, বিবাহ, ভালোবাসা বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বিদেশে পাচার করে চলেছে। বছরের পর বছর এসব পাচারকৃত নারী ও শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সহ্য করছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্ট সূত্র ধরে জানা যায়, নারী ও শিশু পাচারকারী অবৈধ ও অনৈতিক ব্যবসার সঙ্গে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক দল নিয়োজিত রয়েছে। এই জাতীয় পাচার বর্তমানে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী রাজ্য বলে প্রতিবেশী দেশ থেকেও ব্যাপক হারে নারী শিশু পাচার ঘটে থাকে। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত যশোর, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দর্শনা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট সীমান্ত ও স্থলবন্দর এলাকা দিয়ে নারী ও শিশু পাচার হয়ে আসছে। তবে এর মধ্যে যশোর ও সাতক্ষীরা শিশু পাচারের প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই সাতক্ষীরা, যশোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হলে পাচার কমে আসবে।
সন্দেহজনক লোকদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টিসহ কেউ চাকরি ও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে তার সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষক, অভিভাবকরা তাদের ছাত্রছাত্রী ও সন্তানদের সচেতন করতে পারেন। মসজিদের ইমামদের এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। তাঁরা সবচেয়ে বেশি মুসলিম সম্প্রদায়ের গ্রামবাসীকে সচেতন করতে পারেন।
নারী ও শিশু পাচার রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমই নিতে পারে বড় ধরনের ভূমিকা। গণমাধ্যমগুলো জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও ফিচার নিয়মিতভাবে প্রচার করতে পারে। যদিও গণমাধ্যমে গত কয়েক বছরে এ বিষয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার কিংবা সংবাদ পত্রগুলোর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে নিয়মিতভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, ফিচার, অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন প্রকাশে আশ্চর্য্যজনকভাবে ভাঁটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বেশকিছুদিন যাবৎ এই জাতীয় সংবাদ বিভিন্ন কারণে প্রচারের সামনে আসছে না। এতে রাজ্য সরকারের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে অভিযোগ উঠেছে।
___________________________________
(১৩.০৯.১৯ তারিখে "একদিন" সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশিত প্রতিবেদন )
___________________________________
তথ্য ও গবেষণা সূত্র :- বিভিন্ন গণমাধ্যম ও অন্তর্জাল
--------------------------------------------------------
All copyrights reserved©Rajat Das | 13.06.20
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।