||শতদ্রু||
ওই যে জারুল গাছটা, স্কুল ক্যাম্পাসের ডানদিকেই। ওটা পেরিয়ে গেলেই, জানি কী দেখব, আজ ৮ বছর ধরে তাই দেখে আসছি....মেন রোডের ধারে, কম্পাউন্ড ওয়াল লাগোয়া ফুটপাথটায় মুখ গুঁজে উল্টে পড়ে আছে একটা ছেলের রক্তাক্ত দেহ, চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে হতভম্ব হয়ে থেমে যাওয়া গাড়িটার চাকায়, টায়ারে মাখামাখি হয়ে, ঘিলুটা বেরিয়ে গেছে মাথা ফেটে, থকথকে রক্ত আর মজ্জায় মাখামাখি শীতবাতাসে ঝরে পড়া তেঁতুলের পাতা আর শুকনো অশ্বত্থের পাতাগুলো, এমন সময়- একটা দমকা হাওয়া উঠল। উঠবেই, এমনটা ওঠেই, জানা কথাই....আর হাওয়াটায় ঘূর্ণি পাকাতে পাকাতে এলোমেলো কটা নীল কাগজের টুকরো ভেসে এল, কিছুক্ষণ আগেই যেগুলো আমিই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম ছেলেটার সামনেই, সেগুলো এখন উষ্ণ, তাজা শোণিতে ভেজা, চোখের জলে কাগজের লেখাগুলো ধেবড়ে ঝাপসা হয়ে খালি সেখানে দলা দলা অন্ধকার, সেই মুঠো মুঠো কালো আমার দিকে ছুটে এলো....এ-লো-ও-ও-ও...ওই এলো-ও, আর এই অন্ধকার আমায় ছাড়বে না, আমি অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছি, কেউ বাঁচাও, বাঁচা-ও-ও, বাঁ-চা-ও-ও, কি অন্ধকার...মণিমা..বাবা...সুনীত....আঃ, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, সুনীত, আমায় বাঁচা.....।।
||সুমেধ||
আবার স্বপ্নটা দেখছে, রোজ রোজ এই রাতদুপুরে ঝুটঝামেলা ভালো লাগে....আমার হয়েছে জ্বালা!
ওরে এই শতদ্রু, ওঠ না রে, চোখ খোল...দেখ না রে আমি পাশে....আঃ, ভালো যন্ত্রণা তো!
"শতদ্রু ওঠো দেখো, কোত্থাও কিচ্ছু নেই, আমি আছি এখানে, তুমি তোমার বিছানায় শুয়ে আছো, ওঠো।"
"সাজ,সাজ,অ্যাইই সাজ,ওঠো।"
আস্তে আস্তে ঠেলা মারি...আহা,পুরো ঘামে ভিজে গেছে গলা,ঘাড়,পিঠ...এসিটা তো চলছেই, আর এখন তো অতো গরম নেই কলকাতায়, সদ্য দুর্গাপুজো গেছে, ঘড়িতে বাজছে ৩:৩০টে, কাল আবার অফিস...উঠতে হবে জলদি, তার মধ্যেই এইসব...এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আরেকবার ঠেলা মারি, ডাক দিই আস্তে আস্তে, কাজ হয়। এতক্ষণে উঠে বসেছেন রাজপুত্তুর, আবার ভ্যাবলার মতো তাকাচ্ছে দ্যাখো এদিক-সেদিক।
মায়া লাগে বড্ডো, জলের বোতলটা বেডসাইড টেবিলটা থেকে নিয়ে এগিয়ে দিই, একটু ধাতস্থ হয়েছে বোধহয়।এসিটা বন্ধ করে দিই, হাল্কা গা শিরশিরে ঠান্ডা লাগছে,হেমন্ত তো চলেই এল,যদিও ক্যালেন্ডারে এখনো সেপ্টেম্বর ও আশ্বিন মাসের শুরুর দিকটা, তাও পুজো শেষ হয়ে গেলেই কেমন যেন একটা ছমছমে হিমছোঁয়া লাগে বাতাসে।
"তুই শো, এসি অফ করে দিয়েছি, সবে সাড়ে তিনটে বাজে, ঘুমোলে ঘুমো বা বাথরুমে গেলে যা।"
জবাবে খালি "উঁঃ" বলে পাশ ফিরে শোয়, গায়ে চাপাটা ঠিক করে দিয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তারপর দরজাটা খুলে বারান্দায় আসি।
রাত পৌনে তিনটের রাস্তা শুনশান, নিঃঝুম ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পাড়ার প্যান্ডেলের তোরণের জন্য বাঁধা বাঁশগুলো চকচক করছে, দুটো কুকুর ঘুমোচ্ছে নিঃসাড়ে পাশের বাড়ির রোয়াকে, হিম মেশানো উত্তুরে হাওয়ার পরশ ভাসছে।
একটা আইস বার্স্ট ধরালাম।
নাঃ,দিন দিন শতদ্রুর হাবভাবে এই ব্যাপারগুলো খুব অদ্ভুত ঠেকছে, কিছু একটা করতেই হয়, দেখা যাক, পরের মাসেই কোন ভালো সাইকোলজিস্টের কাছে ওকে নিয়ে গিয়ে কথা বলতে হবে, এরকম ভাবে চলতে পারে না।
সিগারেটটা ফেলে দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকি, ২০° টেম্পারেচারের এসির ঠান্ডায়, নীল লাইটল্যাম্পের চিলতে আলোয় ঘরের ভেতরে অপার স্তব্ধতা।চাদরমুড়ি দিয়ে ওপাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে ও,আমিও শুয়ে পড়ি,এখনো একটু রাত বাকি, আবার সকালে উঠে বেরোনো আছে।
কাঁথাটা টেনে শুয়ে পড়ি।
||শতদ্রু||
সু শুয়ে পড়েছে আবার, বড্ড ধকল যায় বেচারির! নিশ্চয়ই ব্যালকনিতে গিয়ে একটা স্মোক করে এলো।
না করলেই পারে, নেশাটা বড্ড বাজে, আমিও ছেড়ে দিয়েছি পুরোপুরি, ও এখনো ছাড়তে পারেনি, প্রচন্ড চাপের মুখে এক-আধটা খায়।
একবার উঠলে হয়তো আমারো ভালো হতো, একটু ব্যালকনিতে পায়চারি করলে বা একবার বাথরুমে গেলে হতো, জল খেয়ে ঘুমের ঘোরটা চলে গেছে, মাথাটা ভার লাগছে যদিও।শুয়ে শুয়ে কতো পুরোনো কথা মনে আসছে-
........
ফ্ল্যাশব্যাক
আমি আর সুনীত ছিলাম খুব ভালো বন্ধু, খুব মানে খুবই ভালো, চন্দননগরে আদি মায়ের পুজোর কাছেই চৌমাথার মোড়, ওখানেই বাড়ি ছিল আমাদের, একই পাড়ায় বাড়ি, একই স্কুলে দুজনে পড়েছিলাম, শ্যামলাল বিদ্যামন্দির, সেসব বড়ো ধূসর অতীত মনে হয় এখন-দু'জনে সাইকেলে করে বাড়ি থেকে যেতাম বাজারের রাস্তা বা দরগার পাশের গলি দিয়ে, চন্দননগর পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে,একসাথে স্কুল যাওয়া-আসা,বাড়ি যাওয়া-যাওয়ি লেগেই থাকতো; অনেকসময় স্কুল থেকে বেরিয়ে পেছনেই কলেজ আর স্ট্র্যান্ডের ঘাট, সেখানে গিয়ে গল্প, একসাথে ফুচকা,চুরমুর, আইসক্রিম বা জীবনের প্রথম জয়েন্ট শেয়ার করা- সব মিলিয়ে সুনীতের সাথে আমার বন্ধুত্বটা বা সম্পর্কটা এতোই গভীর ছিল, এখন সেসব দিনের কথা ভাবলে দুঃখগুলো নতুন করে চাগাড় দেয়।
আমাদের দুজনের মধ্যে প্রকৃতিগত মিল যেমন ছিল, অমিল ও ছিল অনেক।স্কুলের বন্ধু বা শিক্ষকরা যেমন ভালোবাসত, বলতো মানিক-জোড় বা হরিহর আত্মা, তেমন আমার মা না থাকায় অপর্যাপ্ত স্নেহ পেতাম কাকিমা, অর্থাৎ সুনীতের মায়ের কাছে....আহা, বলতেই যেন কাকিমার স্নেহময়ী জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মতোই মুখখানি ভেসে উঠলো, খুবই ভেঙে পড়েছিলেন সুনীতের চলে যাবার পর, আমি আর কোনদিন সামনে যাবার মতো সাহস পাইনি মানুষটার, যদিও দেখতে চাইতেন বারবার, আমাকে কখনো নিজের ছেলের চাইতে আলাদা করে দেখেননি, সুনীতের যাবার পর আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার অপরাধী মন এই গ্লানি নিয়ে আর দাঁড়াতে চায়নি ওনার সামনে, পরে বাবার কাছে শুনেছিলাম কাকিমারও চলে যাবার কথা, নতুন করে একটু অবসন্ন বোধ করা ছাড়া কিছুই হয়নি আর, এখন যেমন লাগছে আবার।
সুনীত পেয়েছিল ওর মায়ের মতোই মুখখানা, লোকে বলে নাকি মাতৃমুখী পুত্র সুখী হয়-ফর্সা রং,রোগা হিলহিলে শরীরখানা যা নিয়ে কাকু-কাকিমার বেশ দুঃখ ছিল আর চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা, আমি রাগাতাম হরলিক্সের বোতলের কাঁচ বলে, কিন্ত তাও সেই মান্ধাতার আমলের মোটা কাঁচের কালো চৌকো ফ্রেমের চশমা ছাড়েনি ও। এই চশমা নিয়েই একবার এক কান্ড হয়েছিল।
তখন আমাদের ক্লাস থ্রি, সুনীত চিরকালই খুব শান্ত, ধীরস্থির ধরনের ছেলে ছিল, বিমান বাবু আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন, একটু রাগী মানুষ তবে পড়াতেন ভালোই, মানুষ হিসেবেও ভালো, ছাত্রবৎসল ছিলেন-সেবার ক্লাসে বসেই আমরা দুজন পাশাপাশি, কথা বলছি আর স্টিকার এক্সচেঞ্জ করছি, তাই স্যার রেগে গিয়ে সন্তুকে ডাস্টার ছুঁড়ে মারেন;হ্যাঁ ওর ডাকনাম সন্তুই ছিল, পাড়ায়, বাড়িতে সব জায়গায়, আমিও ওই নামে ডাকতাম কখনো সখনো। স্যার ডাস্টার ছুঁড়ে মারায় ওর চোখের চশমাটা ছিটকে গিয়ে একদিকের কাঁচটা চিড় খেয়ে খুলে যায় আর কপালের রগ চিরে রক্ত পড়তে থাকে, আর তাই দেখে আমি এতো কাঁদতে থাকি যে অন্য স্যার ম্যামেরাও চলে আসেন আমাদের রুমে।ততদিনে বন্ধুত্বটা বেশ পাকাপোক্ত হয়ে গেছে।
আমাদের দুজনের মধ্যে প্রকৃতিগত মিল ছিল বই পড়া, গান শোনার নেশা মূলত, দুজনেই মোটামুটি পড়াশুনোয় খারাপ ছিলাম না, এক থেকে দশের মধ্যেই থাকতাম দুজনে কিন্তু কোন রেষারেষির জায়গা ছিল না,আর পড়ার বইয়ের বাইরে বই পড়া আর তা নিয়ে আলোচনা করে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিতাম আমরা দুজনে, সুনীতদের বনেদি জীর্ণ বাড়ির তেতলার ঠাকুরঘরের পাশে আমাদের নিভৃত আস্তানায়। হাঁদা-ভোঁদা, বুদ্ধু-ভুতুম বা রাদুগা প্রকাশনীর রাশিয়ান উপকথা থেকে পরে রাহুল সাংকৃত্যায়ন, মুজতবা আলী বা গ্যেটে, হাইনের পুরনো সোনার জলে বাঁধানো বাদামী চামড়ার মলাটের হলদে পাতা বইয়ের গন্ধে আমাদের গরমের ছুটি, শীতের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষের পরের অবকাশ ভরে থাকত।সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম কাছের প্রবর্তক সঙ্ঘ বা দূরের চুঁচুড়ার সদর লাইব্রেরিতে বই আনতে, তারপর মাদুরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়া একসাথে ভাগাভাগি করে আনা আলাদা আলাদা লাইব্রেরির বই....এসব এখন শুধু আমার স্মৃতিভান্ডারেই চোরা রক্তক্ষরণ ঘটায় ।
খেলাধুলোর নেশা না থাকলেও দুজনেই সাইকেল চালিয়ে প্রায়শই ঘুরতে যেতাম এদিক-সেদিক,দুজনেরই খুব একটা বন্ধু ছিল না, দরকার আছে বলেও মনে হতো না তখন।স্কুলের শিক্ষকরা বা লাইব্রেরিয়ান হারাধনবাবু, দারোয়ান ভগবান সকলেই চিনে গেছিল দুই কিশোরকে, যারা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তো টিফিন বা অফ পিরিয়ডে শেষের কবিতা বা অনুবাদে আনাতোল ফ্রাঁসোর জীবনী আর মাঝের সারির কোন বেঞ্চে বসে নিজেদের মধ্যেই কথা বলতো নতুন পড়া বই, নতুন পত্রবন্ধু-তার কাছে পাওয়া পোস্টকার্ড ও নতুন পোস্টস্ট্যাম্প বা সদ্য কেনা ওয়াকম্যানে শোনা গান নিয়ে।তাদের মধ্যে খালি একজনের আর বয়স বাড়েনি ১৮র পর, সে তার আসন্ন যৌবন, গতাসু কৈশোরের সমস্ত লাবণ্য, মাধুর্যটুকু নিয়ে আজো সৌরভে অমলিন হয়ে রয়ে গেল কোন নিশ্চিন্দিপুরে, আর আরেকটা ছেলের বয়স বেড়েই চলেছে, কেবল বেড়েই চলেছে, আর আরো দূরে সরে যাচ্ছে ওদের সাইকেলগুলো ক্রমশ....
প্রায় ৪:৩০টে বাজে, আরেকটু ঘুমোনোর জন্য পাশ ফিরতে গিয়ে মনে পড়লো-আর চারদিন পর সুনীতের মৃত্যুর ১৯ বছর পেরিয়ে যাবে। সময় বড়ো নিঠুর নিগড় বৈকি!
চোখের কোণে কেমন চিলতে ভেজা স্পর্শ, থাক বরং-
||সুমেধ||
আজ উঠতে একটু দেরি হলো, কাল রাতে সাজ এমন করছিল-বেচারি! খারাপ লাগে খুবই, কিন্ত ও নিজের সমস্যাগুলো একদমই খুলে বলে না, খুবই অন্তর্মুখী আর খুব সংবেদনশীল হওয়ায় ওকে যে খুঁচিয়ে কিছু জানব তার উপায়ও নেই।আজ সকাল থেকেই ওর মুখটা ভারি লাগছে, কালকে রাতে ঘুম তো তেমন হয়ইনি উল্টে ভোররাতে কেঁদেছে হয়তো আবার তাই চোখমুখ বসে গেছে, কিন্তু কিছু প্রশ্ন করে সদুত্তর পাওয়া সম্ভব নয় ।আবার এই শরীর-মন খারাপ নিয়ে আজকেও আমাকে অফিসে পৌঁছোতে এসেছে, নিজেও অফিস গেছে, ওর বিল্ডিংটা একটু দূরের ক্যাম্পাসে, ১০ মিনিট যেতে হয় গাড়িতে।
মাসে প্রায়শই এরকম হয়, দু-তিন দিন তো বটেই, যবে থেকে আমি এনগেজড সাজ এর সাথে, তবে থেকেই এগুলো লক্ষ্য করছি- মাঝে মাঝেই ওকে কেমন অচেনা দূরের মানুষ বলে মনে হয়, বড্ডো বেশি শামুকের মতো নিজের খোলের মধ্যে ঢুকে যায়, দুঃস্বপ্ন দেখে রাতে শরীর খারাপ করে, সবসময় আমি বাইরে বেরোলেই সাথে সাথে খায় বা গাড়িতে করে যাতায়াত করে, কেমন ত্রস্ত, শঙ্কিত, চিন্তিত লাগে ওর সুদর্শন মুখখানা তখন, দেখে আমার বড়ো ভয় করে, দুশ্চিন্তা হয়....হে ঈশ্বর, রক্ষা করো। দেড় বছর হয়ে গেল মানুষটার সাথে সম্পর্কে আছি, বাকি জীবনটাও দুজনেরই একই সাথে কাটানোর ইচ্ছা, কিন্ত মাঝখানে এ এক এমন অচেনা দেয়াল:ধূসর আড়ালের এপারে দাঁড়িয়ে বড়ো দুর্ভাবনা জাগে আমার মনে। নাঃ, এবার সত্যিই কোন মনোবিদের কাছে যাওয়া দরকার, এর আগেও ওকে একই কথা বলায় তেমন আমল দেয়নি, এবার রাজি করাতেই হবে, দেখা যাক।
শতদ্রু আর আমার পরিচয় এই কলকাতা অফিসে এসেই, আমি ওর নাম দিয়েছি সাজ আর ও ডাকে আমায় সু বলে,সুমেধ থেকে সু আর শতদ্রু বা সাটলেজ এর থেকে সাজ- সু আর সাজের সাজানো সংসার...আমার পোস্টিং ছিলো গুরগাঁও তে আমার কোম্পানীর আর শতদ্রু তখন এই কোম্পানিরই ডিজাইনিং টিমের চিফ, আমার সিনিয়র আর আমি ডিজাইন ডিপার্টমেন্টের পাশেই প্ল্যানিং সেকশনে জয়েন করলাম কলকাতা অফিসে তিন-সাড়ে তিন বছর আগে, দু'জনে যেতে আসতে দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কথাবার্তা হতো আর আমি চিরকালই পছন্দসই মানুষদের সাথে মন খুলে কথা বলতে ভালোবাসি, তো দুজনের প্রায়ই কথাবার্তা চলছিল। আর, সত্যি বলতে কি, আমার প্রথম বারেই শতদ্রুকে দেখে বেশ ভালোরকম হৃদয়বেদনার সঞ্চার হয়েছিল বলা যায়, কারণ অমন সুদর্শন, সুপুরুষ মানে বেশ সুপুরুষ, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতোন...আর মুখে একটু বিষাদগম্ভীর মেলানকোলিয়াক ভাব, চুপচাপ কর্মদক্ষ মানুষটা আমার মনে বেশ নাড়া দিয়েছিল শুরুতেই অস্বীকার করবো না, তবে যখন থেকে একটু-আধটু কথাবার্তা শুরু হল এবং মূলত ওর উদ্যোগেই, একটু অবাক হইনি নয় তবে খুব পাত্তাও দিইনি, নিখাদ কেজো বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেই সম্বন্ধটা ধরে রাখতে চেয়েছিলাম, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা মিলে ক্যান্টিনে আড্ডা বা উইকেন্ডে রেস্টুরেন্ট বা পাবে যাওয়া, সেখানে আমাদের সবার, মানে আমি বা এইচ আর এর সুরূপাদি, শতদ্রু, প্রচেত, প্রিয়দর্শিনী মিলে পাঁচ-ছ'জনের যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সার্কেলটা তৈরি হয়েছিল আর এখনও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে- এসবের মধ্যেই শতদ্রু ছিল বাকিদের মতোই।
এরপর জয়েনিং এর প্রায় ১ বছর পর যখন বাম্বল এ শতদ্রুর প্রোফাইলটা এলো আমার ফিডে আর ওর প্রেফারেন্স গুলো দেখে আমি নিশ্চিত হলাম, তখন ওর তরফ থেকেই প্রথম প্রস্তাবটা এলো ক্যাজুয়াল ডেটিং এর জন্য, দু'জনেই নতুন অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্ত্তত ছিলাম খুব বেশি কোনো আশা না করেই।
এরপর আর আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, ক্রমে ক্রমে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, পরিচয় আরো গভীর হয়েছে, শতদ্রু যেমন জেনেছে আমার নবি মুম্বাই,দিল্লি,লখনৌতে কাটানো প্রবাসী বাঙালি ছাত্রজীবনের কথা, আমার অফিসার বাবা আর আইআইটি কানপুরের অধ্যাপিকা মা বা বোনের কথা, কামিং আউট করার পর কিভাবে আমি বাড়ির সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছি, আমার প্রিয় বই, রং, গান বা আমার একসময়ের সেতারচর্চার কথা; একইভাবে আমিও জেনেছি ওর ফরাসি ঔপনিবেশিক গন্ধ মাখা মফস্বলে বেড়ে ওঠা বা কলকাতায় কাটানো ছাত্রজীবন আর বইপড়ার নেশা, মোচা বা বোবা কফিপ্রীতির কথা।আবার ওর জীবনে যে ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটেছিল-ওর চোখের সামনেই ওর বন্ধুর মৃত্যু, সেটা যে ওর প্রভূত মানসিক চাপের কারণ এখনো পর্যন্ত তাও ওর মুখেই শোনা-ঘটনাটা সত্যিই বড়ো ট্রমাটাইজিং, হাইস্কুলে পড়ার সময়ে অর্থাৎ ১৭-১৮ বছর বয়সে ওরকম নিজের চোখের সামনে থেকে কাছের বন্ধুর মৃত্যু দেখা যেকোনো মানুষের পক্ষেই বিভীষিকাময়। এর মধ্যেই আমি একবার কোম্পানি সুইচ করে নতুন কোম্পানি জয়েন করেছি, এখনো আমাদের উভয়ের কর্মক্ষেত্রের বন্ধুরা কেউ জানেনা আমাদের সম্পর্কের কথা, আমিও এই সদ্য এবছরই মুভ ইন করেছি শতদ্রুর অ্যাপার্টমেন্টে, তবে এখনো পর্যন্ত লিভ-ইনে আমাদের মধ্যে কোন জটিলতা তৈরি হয়নি, বরং বোঝাপড়া আরো দৃঢ় হয়েছে সম্পর্কের সুতোয়।
তা সত্ত্বেও কেন আমার মনে হয়, সাজ মাঝে মাঝে বড়ো উদাস বড়ো বিষণ্ণ বড়ো একলা, যেন আমি ওর মনের নাগাল পাই না, বড়ো অদ্ভুত সব কাজ করে শতদ্রু মাঝেমাঝে, কোনো সময়ই আমায় রাস্তায় একা ছাড়ে না বা হেঁটে রাস্তা পার হয়ে যেতে দেয় না একসাথে থাকলে যেন আমিও মরে যাব ওকে একা ছেড়ে ওর বন্ধুর মতোন, কখনো কখনো জোন আউট করে যায় কথাবার্তা বা কাজের মধ্যেই বা রাত্তিরে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে মন ভার করে থাকে বা কখনো সখনো হঠাৎই উধাও হয়ে যায় এক-দু বেলার জন্য, ফোন করেও কেউ যোগাযোগ করতে পারি না - আর এসব কিছুই আমার কাছে গোপন করে রাখে, আর আমি অসহায় বোধ করি ওর এইসব একাকিত্বের সময় আমি ওকে সঙ্গ দিতে পারি না,সব মিলিয়ে এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তবে আমাদের দুজনের মধ্যে যথেষ্টই প্রেম, আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জায়গাটা আছে, তাই এই সম্পর্কটা নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী ও আমরা দুজনেই এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, শুধু সাজ যদি আমাকে আরো একটু ভরসা করতে পারত আর নিজের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণাগুলো নিজের মধ্যে চেপে না রেখে বলতে পারতো আমায়.....
দেখা যাক,পরের সপ্তাহে যদি কোনো ভালো সাইকোলজিস্টের সন্ধান পাই কাছাকাছির মধ্যে, অফিসের থেরাপিস্টদের সাথে কথা বলে, ওকে নিয়ে যাব একবার, যাওয়াটা দরকার।
||শতদ্রু||
আজ সুনীতের মৃত্যুবার্ষিকী, আকাশে বাতাসে কিন্ত পরিপূর্ণ শরতের মহিমা লেগে রয়েছে উৎসব শেষের আলোয়, এখনো অনেক মন্ডপের বাঁশ খোলা চলছে, আবার কোথাও বাঁশ বাঁধা হচ্ছে কালীপুজোর, চন্দননগরে জোরকদমে চলছে আসন্ন জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রস্তুতি, চারদিকে হাসি, আগমনী, এক উৎসব শেষের অবসন্নতার মাঝেই আগামী উৎসবের প্রস্ততি, শেষা আশ্বিনের নরম শিউলিবোঁটা রোদ্দুরটি কেমন বাউলরঙে ছুপিয়েছে রেললাইনের ধারে ঝাড় হয়ে ফোটা কাশের বনে ঝরা আঁশ আর পালককে...খালি সুনীতই নেই হয়ে গেছে গঙ্গার তীরে রাখা বিসর্জিত প্রতিমার অবশেষগুলোর মতোনই...ভাবতেই গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করে, দলা পাকিয়ে আসে একটা যেন।
কুড়ি বছর হয়ে গেল আজ, জীবনটা চলে গেল কুড়িটা বছরের পার, কুড়িটা বসন্ত আজ সেই বন্ধু, সেই মানুষটার সাথে কথা বলিনি, একসময় একটা দিনও যার সাথে কথা না বলে যেত না, কুড়িটা শরৎ আর বৃষ্টিভেজা নিভৃত বর্ষা গান শোনা আর বইপড়ার বা গল্প করার, আড্ডা দেবার-আহহ!এই সব পুরোনো কথা কেন যে ফিরে ফিরে আসে এসব সময়ে, কে জানে। আর তো সেই মানুষটাও কোনোদিন ফিরে আসবে না, শুধু এই স্মৃতিগুলোই আমার কাছে শেষ পারানির কড়ি হিসেবে রয়ে গেছে, এটুকুই সম্বল, আর কাকু-কাকিমাও চলে গেছেন শোকাতাপা দুটো মানুষ, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে।
এখন এসেছি চন্দননগর, দু-তিন মাস অন্তর অন্তর আসি বাবার সাথে দেখা করতে আর বিজয়ার প্রণাম করতে বাড়িতে যদিও ফোনে মৌখিক ভাবে বিজয়ার প্রণাম-আশীর্বাদ বিনিময় হয়েছে; মণিমা, জেঠুর সাথেও দেখা হয়ে যায় এই ফাঁকে- আমার মা আমার দু'বছর বয়সেই চলে যাওয়ায় নিঃসন্তান মণিমা বা জেঠিমাই আমার দেখাশোনা করেছে বাড়িতে, মাকে আমার চেনা বলতে পুরোনো অ্যালবামের সাদা-কালো আর সিপিয়া টোন ছবিতে কনেচন্দন পরা বধূবেশিনী কিশোরী বা আটপৌরে সলজ্জ গৃহবধূটি হিসেবেই, মণিমাকেই মা বলে জেনেছি আজন্ম; আমাদের একান্নবর্তী বংশভিটেতে বর্তমান প্রজন্মের একমাত্র সন্তান হিসেবে আমারই দায়িত্ব তিনজনের যত্নআত্তি করা, খেয়াল রাখা; কিন্ত কোলকাতায় কর্মসূত্রে থাকায় সবসময় সবদিকে নজর রাখা সম্ভব হয় না, যদিও তিন বুড়োবুড়িই এখনো বেশ শক্তসমর্থ আছেন ঈশ্বরের কৃপায়, খালি আমার বিয়ে নিয়ে তিনজনেই সবিশেষ চিন্তিত....এখনো আমার যৌন পরিচয় বা প্রবণতা বিষয়ে কেউই জানেননা বা আমিও এখনো পর্যন্ত কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি সরাসরি, কিন্ত এবার বোধহয় সু কে নিয়ে এসে একবার জানানো দরকার ওঁদেরকে, সু কে এখনো এ বাড়ির সম্বন্ধে প্রচুর গল্প করলেও নিয়ে আসা হয়নি, একেবারে বাড়ির অন্যদের সব জানিয়েই তারপরে যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, তবে আমার প্রেমিক পরিচয়েই আমি সু কে এখানে সমাদরে আনতে চাই।
সু-কে বলে আসা হয়নি এখানে আসার কথা, এরকম আমি প্রায়ই হুটহাট চলে আসায় বেচারি দুশ্চিন্তায় থাকে আমি বুঝি, তাও সু আসার আগে কাউকে বলে ঘর থেকে বেরোনোর অভ্যেসটা বহুদিন না থাকায় এখনো ভুল হয়ে যায় মাঝেমাঝে,পরে একটা টেক্সট করে দিলেই হবে'খন।
যদিও আজকের ভুলটা ইচ্ছাকৃতই, আজ তো আমি শুধু বাড়িতে সময় কাটাতে আসিনি,আজকের দিনে প্রতিবছরই আমি চন্দননগর আসার চেষ্টা করি যেখানেই থাকি না কেন-সন্তদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সন্ত মারা যাওয়ার পর আর ওর বাবা-মা চলে যাবার পর ওদের আত্মীয়রা এই বাড়ি বিক্রি করে দেন, এখন বাড়ির মালিকানা নতুন লোকের হাতে তাও এখানে এসে দাঁড়ালেই সেইসব পুরনো হাসিকান্নার দিন জ্যান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, বরং স্কুলের দিকে যাই।
শরতের দিন এলেই আমার কেন জানিনা মনে হয়, শরত বড়ো অতীতকে টেনে আনে মনের মধ্যে-সুখস্মৃতি,দুখস্মৃতি সবই আর সবকিছুর ওপরেই সোনালি-রূপোলি জরির আভরণ পরিয়ে দেয়...যেসব শোক বর্ষার ঝোড়ো ঘন মেঘ বা বিষাদগম্ভীর ধূসর মেঘের মতো জমে থাকে স্তরে স্তরে, তা-ই যেন অশ্বিনের রোদে শান্ত সোনার প্রতিমা হয়ে ফিরে আসে...তাই বোধহয় দেশে দেশে, কালে কালে লোকাচারে বা ধর্মে এইসময়টায় অতীতের যেসব মানুষগুলো চলে গেছেন, সেইসব অমৃতধামযাত্রীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বা স্মৃতিচারণের সময় এই শরতের পূর্ণিমা, অমাবস্যা বা বিষুবতিথিতে, তারি স্বাক্ষর ছড়িয়ে আমাদের মহালয়া, ভূত চতুর্দশী, ইসলামী শবেবরাত, পশ্চিমের অল সোল'স ডে, হ্যালোউইন বা চিনে মুনকেক বা চিংমিং ফেস্টিভ্যালে মৃত আত্মাদের, বিগত দিনের ঝরা জীর্ণ পাতা মানুষগুলোকে স্মরণ করার মধ্যে....এই শান্ত শারদ দুপুরে, কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে বা ফল এর মেপল, ওকউডের লাল-কমলা-বাদামি-হলদে পাতাছাওয়া ঝরাপাতার বনে সেসব অশ্রু, উচ্ছ্বাসের দিনগুলো রেণু রেণু হয়ে লেগে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের কাছে তো পৌঁছে গেলাম, কিন্তু স্কুল খোলা নেই, হয়তো ভাইফোঁটার পর খুলবে, আমাদের সময়ে তাই হতো। গেটের কাছেও কেউ নেই, প্রাক-হৈমন্তী দুপুরে চারদিক থমথমে স্তব্ধ, আস্তে আস্তে স্কুল কম্পাউন্ডের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, দূরে কোথাও ঘুঘু ডাকছে সাদা রোদ্দুরে ঘোলা নীল আকাশের গায়ে যদ্দূর চোখ যায় কোথাও মেঘের লেশমাত্র নেই- দেখতে পাচ্ছি ওই দূরে কোণের দিকে ক্যান্টিন আর দোতলার ডানদিকের ঘরটাতে ছিল আমাদের সেভেন বি র ক্লাসরুম, ওঘরের ডানদিকের সারিতে থার্ড বেঞ্চে, যদি না বেঞ্চটা পাল্টানো হয়ে থাকে, হয়তো এখনো কম্পাস দিয়ে খোদাই করা দুটো নাম লেখা আছে- শতদ্রু+সুনীত, হার্ট সাইনের মধ্যে, যা দেখে বাকিরা হাসাহাসি করেছিল, কিন্ত সত্যি বলতে কি, সেই বয়সেও আমাদের এতে অন্য কিছু মনেই হয়নি, নিখাদ বন্ধুত্বের দলিল হিসেবেই শুধু লিখেছিলাম সেই অকলুষ কৈশোরে, জানিনা আজো সেই নির্মল কিশলয়বেলার নির্যাসটুকু লেগে আছে কিনা ওই ঘরে।
ওই যে মাঠের ওদিকে বাদামগাছটা, এখানেই এর তলাতে ছায়ায় বসে আমি, সুনীত, শুভময়, দেবাদিত্যরা আড্ডা দিতাম, বই, চন্দ্রবিন্দু বা ফসিলসের গান, যুবরাজ-দ্রাবিড়ের খেলা-সব নিয়েই কথা হতো, গল্প-কখনো কখনো অন্ত্যাক্ষরী বা ক্যান্টিন থেকে কেনা ডিমের ডেভিল, সিঙ্গাড়া খাওয়া...গাছটা এখনো আছে।
আর আছে জারুলগাছটা, ঐ যে পাঁচিলের পাশ দিয়ে ওদিকে মাথাটা দেখতে পাচ্ছি, যেন এক্ষুনি মোড় ঘুরলেই দেখবো, রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন একটা দেহ, একটু আগেই যে ছিল আমার ১২ বছরের প্রিয় বন্ধু আর আমার হাতে এখনো লেগে আছে তার দেওয়া নীলখামের প্রেমপত্রের উষ্ণতার আভাসখানি, যা আমি নিজে হাতে ছিঁড়ে দিয়েছি.....
.........
ফ্ল্যাশব্যাক
একঝাঁক ছেলেপুলে সব ১৬-১৭-র মধ্যে বয়েস, হইহই করে বেরোচ্ছে,আজই উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে, সামনে এখনো পরীক্ষা আছে, প্র্যাকটিকাল রয়েছে একগাদা...তার মধ্যেও একটা পরীক্ষা শেষ হওয়ার আনন্দ, আরেকটা পরীক্ষা হলেই স্কুলজীবনের ইতি, এরপরে কার কী পরিকল্পনা জীবনে-তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা...এসবের মধ্যে দিয়েই ধীরলয়ে হেমন্তের বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে, স্কুল চত্বরও ফাঁকা হতে চললো মোটামুটি, সাইকেল নিয়ে দূরে মাঠের ধারে ল্যাম্পপোস্টের তলায় কয়েকজন গজল্লা করছে...সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের হলদে আলোয় শ্যমাপোকার দল এসে ভিড় করছে, একটু একটু হিম লাগছে ধোঁয়া ধোঁয়া বাতাসে....ঐ যে সুনীত আসছে, ওর সিট অন্য ঘরে পড়েছিলো, এবার আমরা দুজন সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিতে যাব, বাড়ি ফিরতে হবে সন্ধ্যে হবার আগেই।
"চল চল, দাঁড়িয়ে আছিস কেন, সাইকেলগুলো নিই, আরে, লাস্ট অঙ্কটা করতে গিয়ে দেরি হলো, সবাই বেরিয়ে গেছে, পা চালা।"
সুনীত কথা বলছে আর ওর ফর্সা মুখের ডানদিকে অস্তগামী সূর্যের লালচে কমলা আলো ছায়া ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টাচ্ছে যেন শিল্যুয়েট ছবি...চশমার কাচে জ্বলজ্বল করছে ল্যাম্পপোষ্টের লাইটের আভা, মুখের একপাশটা অন্ধকার.....
দূরে কোথাও প্রথম সন্ধ্যার শাঁখটি বাজল, গাছে গাছে পাখিরা দল বেঁধে কুলায় ফিরছে।
"পরীক্ষা কেমন হলো রে?"-নিস্তব্ধতা ভেঙে আমিই বলে উঠলাম, আজ যেন সন্তু একটু বেশিই চুপচাপ, ও এমনিতেই ধীরস্থির শান্ত, আজ যেন নৈঃশব্দ্যখানা একটু বেশিই, দুজনে চুপ করে হাঁটছি সাইকেল নিয়ে, এই মাঠখানা পেরিয়ে গেলেই স্কুল কম্পাউন্ডের মেন গেট।
" ওই ঠিকঠাক, সব অঙ্কগুলোই হয়েছে।"-বলে সুনীত থামলো, তারপর একটু চুপ করে রইলো।পায়ের তলায় শুকনো পাতা খসখস করে উঠছে।
"আচ্ছা শন, তোকে একটা কথা বলব?"-শুনে আমি থেমে গেলাম, সাইকেল দুটো পাশে নিয়ে দুজনে হাঁটছিলাম, দাঁড়িয়ে পড়লাম।
" হ্যাঁ, বল না।"
"তুই কখনো প্রেমে পড়েছিস?"
"না তো, কেন রে, তুই আবার কারোর প্রেমে পড়লি নাকি, কাউকে ভালোবাসলি-টাসলি নাকি?"
একটু চুপ, মাথার ওপর ঝটপট করতে করতে দুটো চামচিকে উড়ে গেল, দূরে স্কুলের পাশে কলেজের লাইব্রেরির মাথার শেডে কমলা রোদের ঠো়ঁটের ছোঁয়া, সন্তুর মুখটা অন্ধকারে অচেনা লাগছে।
"যদি বলি হ্যাঁ?"
"আরেব্বাস, কে রে মেয়েটা, কোথায় থাকে, কোন স্কুলে পড়ে?"
কুকুর ডেকে উঠলো দূরে দুটো, ধোঁয়া উঠছে আকাশে, আমি জানি ওটা পাশের ইস্ত্রির দোকানে উনোনে আগুন দিয়েছে, স্কাইডাইভারের মতো প্যারাশুট পিঠে ঝুপঝুপ করে সন্ধ্যে নামছে।
"তোকে শন তোকে......"- কেমন হাহাকারের মতো শোনালো অস্পষ্ট কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে, গলাটা কেমন গাঢ় আর গভীর, যেন পাতালের অতল থেকে উঠে এল ওই ক'টা কথা।
" ভ্যাট্, কি যে সব বলিস না, মাথা-ফাথা খারাপ হলো নাকি পরীক্ষা দিয়ে পড়াশোনার চাপে....", গলাটা বোধহয় একটু বেশি চড়া শোনাল আমার ফাঁকা প্রায়ান্ধকার মাঠে, চেষ্টাকৃত লঘু হাসির আওয়াজটা নিজের কানেই কির'ম বেখাপ্পা ঠেকল।
"শন, সত্যি রে সত্যি, বিশ্বাস কর আমায়, আমি জানতাম না তোকে কিভাবে বলব, আমিও নিজেকে বারবার এই প্রশ্নগুলোই করেছি, উত্তর পাইনি, নইলে দুটো ছেলের মধ্যে আবার প্রেম হয় নাকি, বই পড়েছি সব, ভাসা-ভাসা সব উত্তর, ভেবেছিলাম কখনো তোকে বলব না, কিন্তু আমি আর পারছিলাম না, বিশ্বাস কর..."
আমি চুপ, আমার মাথার ভেতর লক্ষ ভোমরার গুনগুনানি, এখন বেশ স্ট্র্যান্ডে গিয়ে দুজনে মিলে হরিদার দোকানে চুরমুর খেলে হতো, কতদিন পরীক্ষার চাপে যাওয়াই হয়নি ওদিকে।
"শন, এই চিঠিটা রাখ, বাড়ি গিয়ে খুলে পড়িস, এতে সব লেখা আছে, আমাকে পরে যদি পারিস, উত্তর দিস।"- সুনীত আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে, নীল রঙের খাম, হালকা কস্তরীগন্ধ লাগছে নাকে, সেন্ট?!
" সুনীত, কিসব পাগলামি করছিস, ধুৎ তোর মাথা খারাপ হয়েছে, কিসব চিঠি-ফিঠি দিচ্ছিস, আমি পড়বো না কক্ষনো পড়বো না, আমি তোকে কোনদিন এরকম ভাবিইনি, তুই তো আমার বন্ধু বল, আমি এসব বিষয়ে ভাবিই না...."- আমি কিরকম প্রলাপের সুরে কথা বলছি, নিজের কানেই নিজের আওয়াজ অচেনা লাগছে।
চিঠিটা আমার হাতে, আমি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলাম, ঘাসের ধুলোর ওপর নীল আকাশের মতো কস্তরীগন্ধ দুঃখ ঝরে পড়ল একরাশ, সুনীত কুড়িয়ে নিচ্ছে।
"চলে যা আমার সামনে থেকে, আর কোনোদিন আমার সামনে আসিস না, তুই পাগল, মানসিক রুগী, যা গিয়ে ডাক্তার দেখা, সাইকো, হোমো, নোংরা অসভ্য কোথাকার একটা..."-কর্কশ শব্দ করে কয়েকটা কাক ডেকে উঠলো, আমার মাথার ভেতর বেয়ে আগুনের একটা গোলা নামছে, দাঁতে দাঁত চিপে আছি আমি আর তার ভেতর থেকে ছিটকে ছিটকে বেরোচ্ছে গলানো সীসের মতো সব কথা।
সুনীত কি একটা বলার চেষ্টা করছে কান্নাভেজা গলায়, আমি শুনছি না, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মাথাটা নীচু করে স্কুলগেট দিয়ে, কেউ নেই স্কুল চত্বরে ....আমার ওর পিছন পিছন যাওয়া দরকার, এক ঝলক উত্তরে বাতাসে গা শিরশির করে উঠলো, হিম পড়ছে, কিন্ত আমার পা দুটো যেন কেউ গেঁথে দিয়েছে মাঠের মধ্যে, কেমন বরফ নামছে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে, পায়ের কাছে ধুলোর ওপর দুটো ভেজা জলের ছাপ, ওখানে ওর চোখের জল পড়েছিল চিঠির টুকরোগুলো কুড়োনোর সময়...দারোয়ান আসছে এবার আমার দিকে, স্কুলের গেট বন্ধের সময় হয়ে এলো, এবার সত্যি সত্যিই বেরোতে হবে স্কুল থেকে।
বাইরে হঠাৎ প্রবল শব্দ, কোলাহল, আর্তনাদ-ভিড় জমতে শুরু করেছে, " এই গেল গেল...আহারে বাচ্চা ছেলেটা..."....ভিড় কাটিয়ে দেখি, আমার প্রিয় বন্ধু যাকে সদ্য আমি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছি আমার চোখের সামনে থেকে, সে এখন রক্তে মাখামাখি হয়ে নিথর শান্ত শুয়ে রাস্তার ওপর, সাইকেলটা দুমড়ে-মুচড়ে ছিটকে গেছে মোড়ের পাশের চায়ের দোকানটার বন্ধ ঝাঁপের ওপর, ভিড় আসছে একটা, জনতা ধেয়ে আসছে, একটা কালো গাড়ি, বনেটে রক্ত, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে, "মার শালাকে, ধর ধর, ভরসন্ধেয় লোককে চাপা দিয়ে পালাচ্ছে, খুব তেল হয়েছে...."আমার পা-টা কেমন থরথর করে কাঁপতে লাগলো, মনে হলো পায়ে একবিন্দুও শক্তি অবশিষ্ট নেই, এরপর কিছু মনে ছিল না।
পরের দিন বাড়ির বিছানায় শুয়ে চোখ খুলি।প্রবল তাড়সে জ্বর, ওখানেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম, ওখানকার লোকেরাই ধরাধরি করে বাড়িতে দিয়ে যায়, সুনীত ওখানেই স্পট ডেড, রক্তে পুরো ভেসে গেছলো শরীর, গাড়িটা ভাঙচুর করে উন্মত্ত জনতা, পুলিশ এসে গ্রেফতার করে গাড়ির মালিককে, কিন্তু পরে তাঁকে উপযুক্ত প্রমাণাভাবে ছেড়ে দেওয়া হয় কারণ ঘটনাটা অ্যাক্সিডেন্ট না আত্মহত্যা তা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ধোঁয়াশা ছিল, কেউ কেউ দেখেছিল যেন ছেলেটা সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল গাড়িটার সামনে একটু ধারে আর গাড়িটা তখনই ধাক্কা মারে- এসব কথা আমি শুনেছি অনেক পরে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে, ডাক্তারকাকু বলেছিলেন দু'সপ্তাহ টানা বেডরেস্ট নিতে, সবাই ভেবেছিল ওই দৃশ্য, নিজের প্রিয়তম বন্ধুর মৃত্যুদৃশ্য চোখের সামনে দেখার অভিঘাতটা আমি নিতে পারিনি, স্নায়ুর ওপর চাপ পড়েছিল অসম্ভব, কিন্তু ওরা যদি জানতো.....।
আচ্ছন্ন ঘুমঘোরে বারংবার ঐসব দৃশ্য ফিরে এসেছে আমার চেতনায়- লাল-কমলা-বেগুনিতে মেশা হৈমন্তী সন্ধের আলো-আঁধারি ছবি আর প্রায়ান্ধকার আকাশের তলায় মৃতদেহ।
আর হ্যাঁ, কোন চিঠি বা খাম পাওয়া যায়নি লাশের কাছে, খালি বন্ধ হাতে মুঠো করে ধরা ছিল একটুকরো রক্তে ভেজা নীল কাগজ, তাতে কস্তরীগন্ধ আর চোখের জলে কোন কিছু লেখা ছিল কিনা কেউ জানতে পারেনি । "অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা" বলে ফাইল ক্লোজ করে দেওয়া হয়।
কাকু-কাকিমা ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারই মধ্যে একবার আমার সাথে দেখা করতেও এসেছিলেন, কিন্ত তখন আমি সংজ্ঞাহীন, বাবা, মণিমা, জেঠু সবাই মিলে গেছেন ওনাদের বাড়ি, ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়েছিলেন কাকু-কাকিমা দুজনেই, যদিও কাকিমা এই শোক না নিতে পেরে পরের বছরেই চলে যান ছেলের কাছে, কাকুও চলে যান বাড়ি বিক্রি করে পরে লখনৌতে তাঁর আত্মীয়দের কাছে, সুনীতের আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই আমার কাছে, কাকু-কাকিমার সামনে আর যাইনি কোনোদিনই, পরের বছরেই উচ্চমাধ্যমিকের পর কলকাতায় পড়তে চলে এসেছিলাম কলেজে, পরে বাবার মুখেই কাকিমার মৃত্যুসংবাদ শুনেছিলাম।
এর পরেও একটা অংশ আছে।
একইসাথে এই ঘটনার প্রবল অভিঘাত আমাকে যেমন প্রবল মানসিক চাপের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, আমি যৌন প্রবণতার বিভিন্ন যে রূপ, স্বরগুলি সম্বন্ধে সচেতন ও হয়ে উঠেছিলাম ধীরে ধীরে, কলেজে উঠে মনের পরিণতি ঘটেছিল, কলকাতার নাগরিক সুসংস্কৃত পরিবেশে ধীরে ধীরে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই মেলামেশা, বন্ধুত্ব, বই পড়া কিছুটা আগ্রহ, ঔৎসুক্য আর অনেকটাই অনুশোচনার বশে-এগুলোর মাধ্যমে জেনেছিলাম অনেক কিছু, অনুভব করেছিলাম অনেক এমন অনুভূতি ও উপলব্ধি যেগুলো ক্ষুদ্র পরিসরে আমার পক্ষে, মফস্বলী সমাজের সংকীর্ণ বিচারবুদ্ধির গন্ডিতে, বোঝা সম্ভব হয়নি। আমার ভেতরের বাই-কিউরিয়াস সত্তার অস্ত্বিত্বকেও অনুভব করি কলকাতায় চলে আসার পরেই, তখন অনেকদিন হয়ে গেছে।
তখন নতুন করে লজ্জা হয়েছিল, ভয় লেগেছিল, ধিক্কার দিয়েছি নিজেকে বারংবার, ক্ষমা চেয়েছিলাম- কার কাছে জানি না, কিন্তু নিজের মিথ্যা জানার, সীমিত খর্ব জ্ঞানের গর্বটা ধূলিসাৎ হয়ে গেছিল.....কিন্তু আফশোস হয় এই ভেবে যে, আমার চোখ খোলার জন্য বড়ো বেশি মূল্য দিতে হয়েছিলো তোকে আর আমারও।
...........
বসে বসে ঘোর এসে গেছিল, স্কুলের সামনের আমরুল গাছের বাঁধানো বেদিটাতে, কতো পুরনো ভাবনা আর অপরাধবোধ....এইসব গ্লানি কি কোনদিনও পিছু ছাড়বে না, এভাবেই ভার বয়ে নিয়ে যাব, এখনো যেন মনে হচ্ছে মোড় ঘুরলেই দেখব.....কোনো ভালো থেরাপিস্টের কাছে সত্যিই যাওয়া দরকার, সু ও বলেছে কতোবার, আর ওকেও এবার আনতে হবে এই বাড়িতে। বাড়ি ফিরি এখন, কাল চলে যেতে হবে, সু একা আছে, চিন্তা করবে খুব। অফিসেও ছুটি নেই।
সুনীত, আমায় ক্ষমা করিস, আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দিস, সরি, আমি ভুল করেছিলাম, এতো তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলি তুই, এতো অভিমান ছিল তোর, এত্তো অভিমান, এতো কেন কষ্ট দিস আমায়?
গলার কাছে কতো কথা জট পাকাচ্ছে, ঠোঁটে নোনতা চটচটে স্বাদ, গালের উপর গরম জলের আভাস যেন নামছে ধীরে।
সুনীত, সুনীত, তুই শুনতে পাচ্ছিস? যদি শুনিস, তবে জেনে রাখিস সন্তু, আমি তোর বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি রে, আমি ভুল করেছিলাম, আমায় ক্ষমা করিস রে।
ফাঁকা রাস্তায় শুকনো উত্তুরে হাওয়া এল একঝলক, কটা পাতা খসে পড়লো শুকনো, শীত আসছে।
||সুমেধ||
আজ আমরা চন্দননগর এসেছি দুজনে, সাজ এর বাড়িতে যাব, ওর মণিমা ডেকেছেন আমাদের দুজনকে একসাথে, ফোনে কথা হবার পর। মাথার ওপর ডিসেম্বরের শান্ত উজ্জ্বল নীল আকাশ কার প্রসন্ন আঁখিপাতের মতোই সুন্দর, একঝাঁক ব্রাহ্মণী হাঁস উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। আজ আমরা অনেক জায়গায় ঘুরব, মণিমার সাথে দেখা করব, স্ট্র্যান্ডে যাব, শতদ্রুর স্কুল দেখব- হাজার হোক, আমার শ্বশুরবাড়ির শহর!!
সাজ নিজেই এসে বলার পর আমি আর ও, দু'জনে মিলে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে গেছিলাম, সেখানেই সাজের মুখে শুনলাম সুনীতদার ট্র্যাজেডিটার কথা, বুঝতেও পারিনি যে ও এতো কষ্ট এতো বছর ধরে বুকের মধ্যে চেপে রেখে দিয়েছে, আহা!
ডক কিছু মিল্ড সিডেটিভ ও স্ট্রেস রিলিভারের কথা বলেছেন প্রয়োজন পড়লে খেতে, আর এই যে অপরাধবোধ, অনুশোচনা তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান ওষুধ- কমিউনিকেশন, শেয়ারিং এন্ড কেয়ারিং, সে কথাই বলেছেন। এখনো পর্যন্ত চারটে সেশন হয়েছে কাউন্সেলিং এর এবং বলতে নেই, ফল যথেষ্ট সদর্থক, আগের তুলনায় এখন শতদ্রু অনেক হাসিখুশি থাকে, অনেক সজীব দেখায় ওর চোখমুখ, সেই গ্লানির ভারটা যেন কিছুটা হলেও কেটেছে, আর দুঃস্বপ্ন ও আসে না রাতের বেলা, গাঢ় ঘুম হয় দুজনেরই। আমরাও দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাকি জীবনটা একসাথেই কাটিয়ে দেবার, তাই জানাতেই আজ এখানে আসা, হয়তো একদিন আমার মামণি, বাবাকেও আমি জানাতে পারব সাজের কথা, ওঁদের মুখোমুখি দুজনে দাঁড়িয়ে।আপাতত আমি শতদ্রুর হাতটা শক্ত করে ধরলাম, চেপে ধরে রেখেছি হাতের মুঠো, ডালিয়া ফুটেছে রাস্তার ধারে কারোর বাগানে, দোকানপাট খুলে গেছে অনেকই, বর্ধিষ্ণু মফস্বলের জমজমাট জীবনযাত্রা,লেবুরঙা রোদে সুবাস ছড়াচ্ছে আতপ্ত জীবন।
ভালো থেকো সুনীতদা, যেখানেই আছো ভালো থেকো।
[ভেবেছিলাম ছোটগল্প লিখব, এই পুজোর মধ্যেই প্লটটা মাথায় এলো, খুব নতুনত্ব হয়তো নেই, জানিনা, এই প্লটের উপর বেস করে একটা বড়ো ইংলিশে বিএল নভেল লেখার ইচ্ছে আছে ওয়াটপ্যাডে, কিন্তু তার আগে একবার বাংলায় গল্প আকারে লিখে দেখলাম, বড়োগল্পের মতোই হয়ে গেল, কেমন হয়েছে সবাই পড়ে, যদি অভিমত জানানোর থাকে, অবশ্যই জানাবেন, ভালো-খারাপ সবরকম যুক্তিগ্রাহ্য সমালোচনাই স্বাগত, আর গালাগাল দিতে হলে বা আলোচনা করতে হলে বা এমনিই যোগাযোগ করতে হলে ইমেল তো আছেই :- peepsbiatch@gmail.com : )))।
ভালো থেকো/থাকবেন/থাকিস সকলে।
বাসুদেবম সর্বম।।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।