এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গান্ধীগীত : বিহার ও গুজরাটের লোকগানের এক অনন্য ধারা 

    Suchetana Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ অক্টোবর ২০২২ | ৩৬৫ বার পঠিত
  • স্বরাজনু মঙ্গলসূত্র : আজ দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব : গুজরাটের গান্ধীগীত

    গুজরাটের 'গান্ধীগীত': 
    বিহার থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য গুজরাটের খেদা। ১৯১৫ থেকেই তাঁর আপন রাজ্যে গান্ধী গ্রামীণ জনতার বড় আপনার জন হয়ে ওঠেন। চম্পারণের মতো এখানেও খেদা সত্যাগ্রহের সময় গ্রাম-গ্রামান্তরের গুজরাটি চারণকবিরা তাঁদের গানে-কবিতায়-লোকনাট্যে দেশনেতা গান্ধী ও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডকেই শুধু নয়, বরং লিখতে শুরু করেন এক পরম কাছের মানুষকে।

    গুজরাটের 'ভাওয়াই' নামক লোকনাটিকাগুলোতে প্রথম উঠে আসে 'সবরমতীর সন্তের' কথা। তারগালা ভাওয়াই দ্বারা প্রকাশিত 'তারগালা ভোজক হিতেচু' পত্রিকার 'ক্ষমতার নেশা' প্রবন্ধে ভাওয়াই কবি কুসুমকান্ত লেখেন, 
    "তাঁর হাতে না আছে অস্ত্র/ না তাঁর মনে ধরে হানাহানি/ যিনি লড়ছেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে/ যাঁর অস্ত্র কেবল ইচ্ছাশক্তি/ তিনি আমাদের সেই সবরমতীর সন্ত…"। 

    জাতি ধর্ম লিঙ্গ নির্বিশেষে গুজরাটের সমস্ত
    ভাওয়াই শিল্পী ঐক্যবদ্ধ ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের সন্তের অহিংস সত্যাগ্রহের পথকে সর্বতোভাবে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা শপথ করেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সাদা খাদির কাপড়ই পরিধান করবেন। একদিকে জাতীয়তাবাদী নাচ গান নাটকের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ দমননীতি আর অন্যদিকে গান্ধীবাদী আন্দোলন ও আদর্শের সমর্থনে তামাম গুজরাটের গ্রামে পথে প্রান্তরে জুড়ে অনুষ্ঠিত অজস্র ভাওয়াই লোকনাটিকায়, শিল্পীরা সদাসর্বদা মঞ্চে আসতেন ওই সাদা খাদিতেই।

    সমভাবে গুজরাটের ভ্রাম্যমাণ চারণকবিরাও মহাত্মার ব্যক্তিত্ব ও আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে আঞ্চলিক সূরাটি,কাথিয়াওয়াড়ি, সিন্ধি, কাচ্ছি লবজে লিখতে শুরু করেন অজস্র কবিতা। বিখ্যাত চারণ কবি দুলা ভায়া কাগ ছিলেন যাঁদের অন্যতম। যেহেতু ভক্তিমূলক গান চিরকালই গুজরাটের সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ লোককলা ছিল, তাই দুলা ভায়া জনমনে গান্ধীবাদ প্রচারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ভজনের জনপ্রিয় মাধ্যমকেই।

    'গান্ধীজি নে কন্যা', 'গান্ধী দো মাহরো' গানে তিনি গাঁ-দেহাতের জনতাকে নির্ভীক ও স্বার্থশূন্য মনে "আমাদের গান্ধীর" নেতৃত্বে দেশের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেওয়ার ডাক দিয়েছেন। 'বানিও খেড়ে বীর' কবিতায় তেমনি অহিংস সত্যাগ্রহের আদর্শকে তিনি রাঙিয়েছেন চিরন্তন বীররসের আবেগে। 
    দুলা ভায়ার ভাওয়াই কবিতার ছত্রে ছত্রে গান্ধী কখনো হয়ে উঠেছেন 'ধর্মের' কখনো বা 'মুক্তির' মুর্ত প্রতীক। জাভেরচাঁদ মেঘানি, মগনলাল বাপুজি গোধরাওয়ালা সহ বহু নামহীন লোককবির কলমে সমৃদ্ধতর হতে থাকে গুজরাটি গান্ধীগীতের নানা রূপ।

    বিহারের মতো এখানেও গান্ধীগীতও সমাজের সকল প্রান্তিক অংশের ভিতর ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। বিশেষ করে এই গানের প্রতিরোধের ভাষা বুকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন খেটে খাওয়া গরিব মানুষ আর মহিলারা। পারম্পরিক কীর্তন-ভজনের পাশাপাশি গরবা-রাস, নবরাত্রির ডান্ডিয়া, আখিয়া, পাউড়া ইত্যাদি লোকগানে সোজাসুজি উঠে আসছিল অহিংস সত্যাগ্রহ, দেশগঠন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, বিদেশি পণ্য বয়কট, চরকা ও স্বদেশী খাদিবস্ত্রের গুরুত্ব, নিবিড় সমাজসংস্কার সহ দেশের নানা কাজে অংশ নেওয়ার আহ্বান।  

    মগনলালের 'বালক নি মাঙ্গানি' কবিতায় একটি ছোট্ট ছেলে তাঁর মা'কে বলছে, 
    "মা এনে দাও খাদির টুপি/ এনে দাও খাদি পেহরান(উর্ধাঙ্গ আবরণী)/ ধুতি, ঝোলা, জুতো সবই খাদির/ অঙ্গে খাদিই লাগে ভালো আমার.."।

    সারদাবেন, মিঠুবেন, পুষ্পাবেন, ভক্তিবা অথবা গ্রামের অনাম্নী মহিলা কবিরাও চারণ, গরবা, কীর্তন, নবরাত্র ডান্ডিয়ার আঙ্গিকে গ্রামের শ্রমজীবী মহিলাদের মনে বিলিতি শাসককে উৎখাত করে নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার স্পৃহা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অতি জরুরি ভূমিকা নিয়েছিলেন। লোককবি জ্যোৎস্নাবেন বিশেষ করে কম বয়সী মেয়েদের জন্যই ১৯২০র দশকে লিখলেন, জনপ্রিয় 'সত্তা বালে ছে', 'বারদোলিনো রঙ', 'বীর পূজন', 'স্বরাজনু মঙ্গলসূত্র' শীর্ষক গান্ধীগীত। বারদৌলি সত্যাগ্রহের সময় অনাম্নী এক নারী লিখলেন, 'ধন্য বারদোলি নো বীর'...। 

    একদিকে যেমন চঞ্চল তিওয়ারি বা কুঞ্জলতা শাহরা ভুলে যাওয়া গান্ধীগীতকে বিহার ও গুজরাটের লোকায়ত সংস্কৃতির প্রান্তিক উঠোন থেকে একনিষ্ঠ উদ্যোগে একুশ শতকের গবেষক ও পাঠকদের কাছে ফিরিয়ে আনছেন, তেমনি কয়েক দশক আগে প্রকাশিত 'গান্ধী শতদল' নামের একটি বিস্মৃতির ধুলোমাখা বই খুঁজে বার করে মহাত্মা সমসাময়িক সময়ে তাঁরই সম্পর্কে দেশের ১৪টি রচিত ১০৮টি গীতিকবিতাকে বর্তমানের আলো দেখিয়েছেন ঐতিহাসিক কল্পনা পালকিওয়ালা। 

    মূলত কল্পনার গবেষণা থেকেই আম পাঠকের সামনে এসেছে হিন্দি বা গুজরাটি ভাষার আঞ্চলিক নানা উপভাষায় তো বটেই, এমনকি কাশ্মীরি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, তেলুগু, তামিল, কানাড়া, মালায়লম, ওড়িয়া, অসমীয়া, আর বাঙলাতেও কিংবদন্তি কবিদের পাশাপাশি নামজাদা লোকশিল্পী, এমনকি অজানা অনামা লোককবিরাও নিজেদের অননুকরণীয় লবজে লিখে গেছিলেন মহাত্মার মহাজীবনের গীত। সেসব গান্ধীগীতের বিষয়-ভাষা ও শিল্পসুষমার ব্যাপ্তিই যে কেবল বিপুল ছিল তা নয়, মরমী আবেদনেও এই গীত গ্রামের দরিদ্র শ্রমজীবী প্রান্তিক নারী পুরুষের কাছে ছিল তাঁদের গান্ধীবাবার মতোই যেমন একান্ত আপন, যেমন চিরন্তন, তেমনই সার্বজনীন।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন