এই জায়গাটার নাম ওয়ার্জ়াওয়াৎ। যেখানে আমরা রাত্রিবাস করব। গাড়ির সারথি ইউসুফ একটানা গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে এতটুকুও ক্লান্ত হয় বলে মনে হয় না। দুপুরে যে রেস্টুরেন্টে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা আকারে আয়তনে বিশাল, ধাপ কাটা অট্টালিকার মতো, নানান হলঘরে নানান অতিথি খাচ্ছে দাচ্ছে। আমাদের আটজনের জন্য টেবিল নির্দিষ্ট, খরচ এখানে যার যার তার তার। যার যেমন খুশি মেন্যুকার্ড দেখে পছন্দ করো।মরোক্কান ছেলেটি ও প্যাট্রিশিয়া ছাড়া আমরা এখানে তিন কাপল। যে যার মত খাবার বেছে বেছে অর্ডার দিচ্ছি, হঠাৎ প্যাট্রিশিয়া ঘোষণা করল যে সে কিচ্ছুটি খাবে না।
ভোরে সেই মেঘলা পাহাড়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে যখন আমরা কফি খাচ্ছিলাম, তখনও তাকে কিছু খেতে দেখিনি, সারাটা দিন না খেয়ে আছে, এখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলল, এই মেয়ে এরকম উপোস করে থাকলে শরীর টরির খারাপ করবে না তো?
আমরা সকলেই বলি, অল্প কিছু খাও, ছোট্ট কোনও একটা ডিশ নাও...
প্যাট্রিশিয়া বলে যে সে খাবার দাবার্র ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে, চুজ়ি।
অবশ্য আমরা যখন খেলাম, তখন সে আমাদের সকলের প্লেট থেকেই টুকটাক তুলে তুলে খেলো।
গোটা তুনিসিয়া সফরেও সে নাকি খুঁটে খুঁটে খেয়েছে জানালো।
খাওয়া দাওয়া ধোঁয়া গেলা শেষ করে আমরা ফের চললাম আরও পূবের দিকে, আরও বেশ কয়েকঘন্টা চলবে গাড়ি, জল টল কিনে এবার এখানেই শেষ সুযোগ। পথে একটা জনপদ পড়ল, সেখানে কার্ফুর (Carrefour) এর সুপার মার্কেট থেকে নেওয়া হলো পানীয় জল, ওয়াইন, অল্পস্বল্প বাদাম, বিস্কুট।
জলের দাম বাড়ছে। এরপরে প্রায় দুর্মূল্য হয়ে যাবে।
পাহাড় এবার কেবল চড়াই উৎরাই এবড়ো খেবড়ো হতে লেগেছে। রোদ পড়ে গিয়ে বিকেলও শেষ হতে চলল।
বলা হয় নি, পথে যে কটি গ্রাম চোখে পড়েছে সবকটাতেই মাটির বাড়ি।
দেশের রাজা এরকমই নিয়ম করে দিয়েছেন। গ্রামে বাড়ি তৈরি হবে লালমাটি দিয়ে, আমাদের সারথি এবং সেই গাইড কাম অভিনেতাও একথা জানিয়েছিল। শুকনো খড় ও মাটি মিশিয়ে তৈরি করা হয় এসব বাড়ি। শীতে বা গ্রীষ্মে তাপমাত্রার প্রখরতার প্রকোপ তেমন নাকি পড়ে না এসব বাড়ির ভেতরে। তার ওপর সিমেন্ট কংক্রিট এসবের ব্যবহার নেই বলে দূষণও নেই। পাহাড় মরুভূমির মানুষ এমনি করেই রয়েছে যুগ যুগ ধরে।
অবশ্য আমরা যেসব হোটেলে থাকব আশাকরি সেগুলো মাটির বাড়ি হবে না।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পরেই গাড়ি কিছুটা হুড়মুড়িয়ে রাস্তার একদিকে খাদের মধ্যে নেমে গেল। গাড়ি থেমে গেল। আমরা একটু চমকেছি। কী কেস?
দরজা খুলে বাইরে নামতেই এবড়ো খেবড়ো নুড়ি পাথরের ওপর পা হড়কে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম।
খাদের পাশে একটা সরু পথ দেখা যাচ্ছে, কিছু গাছ, আলোর শেষ রশ্মিটুকু মিলিয়ে যেতে যেতে ইউসুফ ঐ পোলিশ চারজনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তল্পি তল্পা সহকারে পা চালিয়ে সেই সরু পথে নীচের দিকে নামিয়ে নিয়ে গেল। ওখানেই ঐ চারজনের হোটেল।