গত ২৬শে জুন বাংলা গদ্যসাহিত্যের অসামান্য প্রতিভা বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। তাই বাংলা সাহিত্যের পাঠক রূপে বঙ্কিমকে নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
বঙ্কিম নিয়ে বাঙালী সমাজে দুটি চূড়ান্ত পরস্পরবিরোধী মতামত বিদ্যমান। একদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি বঙ্কিমকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক, অন্যদিকে তথাকথিত বামপন্থীরা বঙ্কিমকে রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী লেখক হিসাবে দেখাতে বদ্ধপরিকর। সমস্যা হল এঁদের মধ্যে অধিকাংশই বঙ্কিম ঠিকমতো পড়েননি, আর যাঁরা পড়েছেন তাঁরা নিজেদের মতপ্রচারের স্বার্থে মূল উপন্যাসের দু-তিনটি পংক্তি উদ্ধৃত করে নিজেদের মতপ্রচারে ব্যস্ত। কিছু ব্যতিক্রম বাদে বঙ্কিমকে নিয়ে সামগ্রিক মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি।
যেকোনো ব্যক্তিকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, তাঁকে বিচার করতে হবে তৎকালীন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। নাহলে সেই মূল্যায়ন হবে চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ বা যেই হোন না কেন- তাঁকে বিশ্লেষণের জন্য এই নীতি মেনে চলতে হবে। দুশো বছর আগে যে মানুষ জন্মেছেন, তাঁকে যদি আজকের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে যাই- তার চেয়ে চূড়ান্ত মূর্খামি আর হয়না।
প্রথমেই একটি কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, ইসলাম ও ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদ এক নয়। যাঁরা এই দুই ভিন্ন চিন্তাধারাকে এক করে দেখাতে চান তাঁদের ইতিহাস বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।
বঙ্কিমের ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করেছেন, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। পাঠান-মোগল আমলে বলপূর্বক ধর্মান্তর, দেবমন্দির লুণ্ঠন, সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় তিনি ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে এর অজস্র প্রমাণ আছে। কিন্তু বঙ্কিম কখনোই ইসলামবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ নন! তাই দেখতে পাই "বঙ্গদেশের কৃষক" প্রবন্ধে তিনি হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত উভয়ের কথাই সমান দরদের সাথে ঊল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে যোগ্যব্যক্তিকে সম্মানপ্রদর্শনে বঙ্কিম কখনোই কুণ্ঠিত নন। তাই দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ওসমান "পাঠান কুলতিলক, আয়েষা "রমণীরত্নস্বরূপা"। সুতরাং যাঁরা বঙ্কিমকে নিছক সাম্প্রদায়িক রূপে প্রতিপন্ন করতে চাইছেন, তাঁদের মূল্যায়ন যথাযথ নয়।
(২)
বর্তমান পরিচ্ছেদে আমরা আনন্দমঠ উপন্যাস নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই। এই আনন্দমঠ উপন্যাস নিয়েই বঙ্কিম সর্বাধিক সমালোচিত, তাই এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করেই আলোচনা শুরু করছি। আনন্দমঠ উপন্যাস প্রথমে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। এটি কোনো ঐতিহাসিক গবেষণাগ্রন্থ নয়, এমনকি ঐতিহাসিক উপন্যাসও নয়। বঙ্কিমের কথানুযায়ী ইতিহাস এখানে প্রেক্ষাপট মাত্র। ইতিহাসের কাঠামোটুকু গ্রহণ করে বঙ্কিম নিজস্ব সৃষ্টি করেছেন। সত্যানন্দ, মহেন্দ্র, কল্যাণী, ভবানন্দ, জীবানন্দ, শান্তি প্রভৃতি চরিত্রগুলি কাল্পনিক, এদের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। খুব স্পষ্টভাবেই আমরা বলতে পারি ইতিহাসকে পটভূমি রেখে বঙ্কিম নিজস্ব কল্পনার সাহায্যে এই উপন্যাসের নির্মাণ করেছেন। ইতিহাসের মূল কাঠামো অক্ষুণ্ণ আছে, বাকিটা ঔপন্যাসিকের কল্পনা। যদি এটি গবেষণাগ্রন্থ হতো, তাহলে এই গ্রন্থে তথ্যপ্রমাণ সব সঠিক কিনা তানিয়ে বিচার করা হতো। কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই বিশ্লেষণের কোনো অর্থ নেই। সেখানে সাহিত্যিক ঊৎকর্ষই মূল বিবেচ্য।
আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ১১৭৫-৭৬ বঙ্গাব্দের অবিভক্ত বাংলাদেশ। পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে পরিবর্তন হয়েছে। বাংলার নবাব হয়ে মীরজাফর মসনদে বসে আছে বটে, কিন্তু তার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। বাস্তবে সে কোম্পানির হাতের ক্রীড়নক ব্যতীত আর কিছুই নয়। সমস্ত ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কিন্তু রাজ্যরক্ষায় ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কোম্পানি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়, একমাত্র খাজনা আদায় ছাড়া তাদের আর কোনো চিন্তা নেই। কোম্পানির দেওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁ ভয়ানক অত্যাচারের মাধ্যমে খাজনা আদায় করে চলেছে, গ্রামে গ্রামে তার কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করে খাজনা আদায়ে বদ্ধপরিকর। আর ক্ষমতাহীন নবাবের হাতে রয়েছে রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব, যে নিজেই মসনদে বসে আছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুগ্রহে। বাংলার ইতিহাসের এই মৌষলকাল "দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা" নামে কুখ্যাত। এই চূড়ান্ত মাৎসন্যায়ের ফলশ্রুতি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ। বঙ্কিম এই পটভূমি গ্রহণ করে আনন্দমঠ উপন্যাসের সৃষ্টি করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার উপর বঙ্কিমের তীব্র ক্রোধ প্রকাশিত হয়েছে। এবিষয়ে আরেকটি তথ্য স্পষ্টভাবে বলতে হবে। বাংলার তদানীন্তন নবাব বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি- উভয় শাসকই বিজাতীয়। এদের কারো সাথেই বাঙালী সমাজের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে শোষণ করে চলেছে, নির্বোধ মীরজাফর ও তার সহচরেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রীড়নক। উভয় শক্তির হাতেই বাংলা পরাধীন। এই দুই শক্তির প্রতি বঙ্কিমের তীব্র ঘৃণা আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে। দুই অশুভ শক্তির হাত থেকে বঙ্কিম বাংলাদেশের মুক্তি চেয়েছেন।
(৩)
আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবার পর থেকেই ব্রিটিশ রাজশক্তি বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কর্মক্ষেত্রে তাঁকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এমনকি তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়। এইভাবে একের পর এক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে বঙ্কিম তাঁর হিতৈষী ও শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়ে বলেন যে আনন্দমঠ নবাবী আমলের অরাজক অবস্থা তুলে ধরেছে। এই উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করা হয়নি, বরং ব্রিটিশ শাসনের প্রশংসা করা হয়েছে। এই কথার সত্যতা প্রতিপন্ন করতে বঙ্কিম তাঁর গ্রন্থে নানাবিধ পরিবর্তন করেন। উপন্যাসের নামভূমিকায় তিনি লেখেন - রাজবিদ্রোহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মপীড়ন মাত্র, আর সন্তানদল (সত্যানন্দের অনুগামী বিদ্রোহীদল) সেই আত্মপীড়নে অংশ নিয়েছে। আর ইংরেজ রাজত্বে বাংলাদেশে সুখশান্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভূমিকার পথ অনুসরণ করে বঙ্কিম মূল উপন্যাসেও বেশ কিছু পরিবর্তন করেন। 'ইংরাজ' শব্দের পরিবর্তে 'যবন' বা 'নেড়ে' শব্দ প্রয়োগ করেন। ইংরাজকে আক্রমণের জায়গায় যবন বা নেড়েকে আক্রমণের কথা বলা হয়। উপন্যাসের মধ্যে বলা হয়, তখন (ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়) অনিয়মের দিন, আর বর্তমানে অর্থাৎ ইংরেজ আমলে নিয়মের দিন। উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় ওয়ারেন্ হেস্টিংসকে প্রশংসা করা হয়। এই পরিবর্তনগুলির মাধ্যমে বোঝানো হয় উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনকে প্রশংসা করা হয়েছে।
উপসংহারে বঙ্কিম ঘটনাপ্রবাহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করেন। প্রথম সংস্করণে বঙ্কিম এমনভাবে উপন্যাস শেষ করেন তাতে বোঝা যায় বঙ্কিম এই উপন্যাসের পরবর্তী sequel রচনা করতে চেয়েছিলেন। শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিচারণা থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্কিম তাঁকে বলেছিলেন তাঁর ইচ্ছা ছিল ১৮৫৭-৫৮ সালের মহাবিদ্রোহ নিয়ে উপন্যাস রচনা করবেন যাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্র হবেন রানী লক্ষ্মীবাঈ। কিন্তু আনন্দমঠ প্রকাশিত হবার পর ব্রিটিশ সরকার তাঁর উপর চূড়ান্ত ক্ষিপ্ত, রানী লক্ষ্মীবাঈকে নিয়ে লিখলে আর রক্ষা থাকবে না। স্বাভাবিক ভাবেই বঙ্কিম এইসব অংশ উপসংহার থেকে বাদ দেন। এই পরিবর্তিত সংস্করণ ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়। স্পষ্টই বোঝা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রাজকোষ থেকে বাঁচতে বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে এই পরিবর্তন করেছিলেন।
(৪)
পূর্ব পরিচ্ছেদে আমরা আনন্দমঠ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি। উপযুক্ত প্রমাণ সহযোগে দেখিয়েছি কোন পরিস্থিতিতে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠের দ্বিতীয় সংস্করণে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এককভাবে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলনা, আর বাঙালী সমাজে সেদিন কোনো রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন ছিলনা যারা তাঁকে সাহায্য করবে। ব্রিটিশ রাজশক্তি ক্রমশঃ তার ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করছে, মহাবিদ্রোহের পর অস্ত্র আইনে (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ) কোনো ভারতীয় নিজস্ব অস্ত্র রাখতে পারেনা; নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন (১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ) ও সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ) পাশ হয়ে গেছে। এই আইনগুলির সাহায্যে ব্রিটিশ সরকার যেকোনো সরকারবিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করতে বদ্ধপরিকর। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বঙ্কিমের পক্ষে সরাসরি রাজশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব ছিলনা। যাঁরা এর জন্য বঙ্কিমকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্তাবকরূপে প্রতিপন্ন করতে চাইছেন, তাঁরা তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অসচেতন। বঙ্কিমকে সমালোচনা করার উৎসাহে তাঁরা ভুলে গেছেন, তৎকালীন সময়ে অনেক লেখককেই এই কাজ করতে হয়েছে। দীনবন্ধু মিত্রর নীলদর্পণ প্রকাশিত হবার পর মহাকবি মধুসূদন এই নাটকের ইংরেজী অনুবাদ করেন। অনুবাদগ্রন্থে কিন্তু তাঁর নাম দেওয়া ছিলনা। তাহলে কি বলতে হবে মধুসূদন ব্রিটিশ রাজশক্তির স্তাবক ছিলেন? এইসব অত্যুৎসাহীদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন পাশ হবার পর নাটকে সরাসরি রাজশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলা সম্ভব ছিলনা। তাই আইনকে ফাঁকি দেবার জন্য তৎকালীন নাট্যকাররা ঐতিহাসিক ঘটনাকে তাঁদের নাটকের উপজীব্যরূপে প্রয়োগ করতে থাকেন। পাঠান-রাজপুত দ্বন্দ্ব, মোগল-রাজপুত যুদ্ধ, মোগল-মারাঠা সংগ্রাম প্রভৃতি ঘটনা তাঁদের নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চন্দ্রগুপ্ত, রাণাপ্রতাপ, মেবারপতন প্রভৃতি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে তোলা। অরবিন্দ তাঁর প্রবন্ধে এটি খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। শিবাজী উৎসব নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে এর উত্তরে অরবিন্দ লেখেন শিবাজীর যুদ্ধ ছিল মোগল রাজশক্তির বিরুদ্ধে, কখনোই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নয়।শিবাজীর সময়ে মারাঠাদের শত্রু ছিল মোগল রাজশক্তি, বর্তমান সময়ে ভারতবাসীর মূল শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এরপরও যাঁরা এঁদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আনেন; হয় তাঁরা আদৌ তৎকালীন ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়েননি, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্যবিকৃতি করে নিজস্ব propaganda প্রচার করতে বদ্ধপরিকর!
আরো একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা একান্ত প্রয়োজন। আনন্দমঠ উপন্যাসে পলাশী যুদ্ধোত্তর নবাবী আমলের যে অরাজক অবস্থা দেখানো হয়েছে, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। আগেই দেখানো হয়েছে, পলাশী যুদ্ধের পর নবাব মসনদে আসীন মাত্র, কিন্তু তার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। সমস্ত ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে। এই অরাজক অবস্থার সুযোগ নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় চূড়ান্ত মাৎসন্যায় চলছে। তাই শেষপর্যন্ত নিজেদের স্বার্থেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এই বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছে, নাহলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই অবিভক্ত বাংলায় নবাবী আমলের অরাজকতার পর শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব অবশ্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রাপ্য। সুতরাং বঙ্কিম এক্ষেত্রে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃত করেননি। যাঁরা বঙ্কিমের বিরুদ্ধে তথ্যবিকৃতির অভিযোগ এনেছেন, তাঁরা নিজেরাই তৎকালীন বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
বঙ্কিমের অবদান ব্যর্থ হয়নি। উনিশ শতকের শেষ থেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রসার ঘটতে থাকে। এই কাজে অন্যতম সহায়ক হয়ে ওঠে আনন্দমঠ। পরবর্তী শতকে এই জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণ রূপ আমরা দেখি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলনের সময়।এই আন্দোলন থেকেই সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের সূচনা। এঁদের আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ছিল আনন্দমঠ। ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিসের রিপোর্টেই এইকথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রিপোর্টই বঙ্কিমের অবদানের সবচেয়ে বড় প্রমাণ! আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ও সমাজে যে জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রসার, তার প্রধান উদ্গাতা বঙ্কিমচন্দ্র! এখানেই ভারতীয় ইতিহাসে বঙ্কিম ও আনন্দমঠের সার্থকতা।
(৫)
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছি। কিন্তু শুধুমাত্র উপন্যাস দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মতন অসামান্য প্রতিভার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই বঙ্কিমমনীষা বুঝতে হলে আমাদের তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্কিম-মানস আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।
উনিশ শতকের বাঙালী মানসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ বঙ্কিম। প্রবন্ধের মাধ্যমে এই অসামান্য সাহিত্যপ্রতিভা পাঠকের সামনে প্রকাশিত হন, পাঠক তাঁর মননশীলতার পরিচয় উপলব্ধি করেন। কখনো শান্ত কিন্তু দৃঢ়ভাবে তীক্ষ্ণ যুক্তির আঘাতে বিপক্ষকে খন্ডন করেন; কখনো ব্যঙ্গাত্মক লেখায় বিপক্ষকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে স্বমত প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবন্ধের সরসতা, গদ্যের সাবলীলতা ও মাধুর্য, সংহত যুক্তির মাধ্যমে বিরুদ্ধমতের খন্ডন; এই বৈশিষ্ট্যের জন্য বঙ্কিমের প্রবন্ধ পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করে, বঙ্কিমের অসামান্য প্রতিভা পাঠকের কাছে প্রকাশিত হয়। তাই প্রবন্ধ বাদ দিয়ে বঙ্কিম নিয়ে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।
বঙ্কিমের প্রবন্ধ পড়তে পড়তে আমরা বঙ্কিমকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারি। বাইরের আপাত-দাম্ভিক, রাশভারী খোলস থেকে তখন যে বঙ্কিমকে আমরা খুঁজে পাই, তিনি সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মী; সামাজিক বৈষম্য তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা তাঁকে আকৃষ্ট করে, তবে একথাও তিনি জানেন জোর করে সমস্ত বৈষম্য দূর করা যায়না। বঙ্কিমের এই চিন্তা পাঠককে তাঁর প্রতি আগ্রহী করে তোলে। কখনো তিনি যুক্তিতে স্থিরপ্রত্যয়ী, কখনো বা ব্যঙ্গে সমুজ্জ্বল। পাঠক যত তাঁর লেখা পড়ে, তত তাঁর মনস্বিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে।
উদাহরণ স্বরূপ বঙ্কিমের "লোকরহস্য" নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই বইতে বঙ্কিম ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে সমাজের নানা অসংগতিকে আক্রমণ করেছেন। সামাজিক অসাম্য ও মাৎসন্যায়কে আক্রমণ করে তিনি অবলীলায় বলতে পারেন, "যে দস্যুর দণ্ডপ্রণেতা আছে তাহার কার্যের নাম দস্যুতা, যে দস্যুর দণ্ডপ্রণেতা নাই, তাহার দস্যুতার নাম বীরত্ব।" "বাবু" প্রবন্ধে মহাভারতীয় রচনারীতিতে সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ করেন। নিজেকেও ছাড় দেননা, বিচারব্যবস্থা ও হাকিমদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। এই ব্যঙ্গ আরো তীব্রভাবে ফুটে ওঠে "গর্দভ" প্রবন্ধে, যেখানে তিনি দেখান আমাদের সমাজে গর্দভেরাই বিভিন্নরূপে সর্বত্র উচ্চপদে সমাসীন। এই গর্দভ কখনো বিচারক, কখনো পাঠশালার টুলোপণ্ডিত, কখনো নবমীতে লাউ না খাবার বিধান দেওয়া পুরোহিত। অথচ এই তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের পরও একশ্রেণীর যুক্তিবাদী বঙ্কিমকে ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক হিসাবে দেখাতে চাইবেন। এই তথাকথিত যুক্তিবাদীদের একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ জন্মগত ব্রাহ্মণত্বে বিশ্বাসী নন, তাঁরা গুণগত ব্রাহ্মণত্বে বিশ্বাসী। ব্রাহ্মণ বলতে তাঁরা কখনোই টিকি-নামাবলী শোভিত, ভুলভাল অং-বং আওড়ানো একশ্রেণীর চালকলাভোজী পরশ্রমভোগী শ্রেণীকে বোঝাননি। সত্য, অহিংসা, অপরিগ্রহ, ইন্দ্রিয়সংযম, তপস্যা প্রভৃতি গুণে যিনি বিভূষিত তিনিই যথার্থ ব্রাহ্মণ। তিনি নির্লোভ; অধ্যয়ন, গবেষণা ও তপস্যায় তিনি রত। এই আদর্শ চরিত্রই ব্রাহ্মণত্বের নিদর্শন। এই গুণগত ব্রাহ্মণত্বকেই বঙ্কিম নমস্কার জানিয়েছেন, চালকলাভোজী প্রতারকদের নয়!
(৬)
বঙ্কিম-সমালোচকদের প্রধান বক্তব্য বঙ্কিম সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি, রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন। সমালোচনার উৎসাহে তাঁরা ভুলে গেছেন সরাসরি সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন, বিদ্যাসাগরের মানসিক দৃঢ়তা সবার থাকেনা। আর আড়াই হাজার বছর আগের গৌতম বুদ্ধ হোন কিংবা উনিশ শতকের বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ; সবাইকে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়েই কাজ করতে হয়েছে। সামাজিক ব্যবস্থাকে কেউই পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেন নি। বিংশ শতকে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ে আমরা দেখি ব্রাহ্মণ ছাত্র ও অব্রাহ্মণ ছাত্র ভিন্ন পংক্তিতে বসছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মতো অসামান্য প্রতিভাকেও তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা স্বীকার করে নিতে হয়েছে। এই ঘটনা বলার উদ্দেশ্য কারো সমালোচনা করা নয়; শুধু এটুকু মনে করিয়ে দেওয়া যে কোনো ব্যক্তির মূল্যায়ন করার সময় তৎকালীন সমাজের কথা মনে রাখা প্রয়োজন। সামাজিক প্রেক্ষাপট অস্বীকার করে ইতিহাসচর্চা সম্ভব নয়। সেই ইতিহাসচর্চা মূলতঃ অন্ধের হস্তীদর্শন। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে। কর্মজীবনে বঙ্কিম ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী। সরকারী চাকরিজীবির অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে, সরাসরি সরকারের সমালোচনা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও আমরা দেখি বঙ্কিম অনেক জায়গায় ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশ সভ্যতার অনুকরণকারী শিক্ষিত সমাজকে তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। এর অসামান্য নিদর্শন তাঁর "ইংরাজস্তোত্র", যেখানে তিনি যুগপৎ ব্রিটিশ সরকার ও তার অনুগ্রহপুষ্ট শিক্ষিত সমাজকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে জর্জরিত করলেন।
বঙ্কিমের মূল অস্ত্র মননশীলতা, সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যমে তারই প্রকাশ। তাই তাঁর লেখার মাধ্যমে বঙ্কিম সমাজব্যবস্থাকে আক্রমণ করলেন। সরাসরি বঙ্কিম সমাজের বিরুদ্ধে যে কথা বলতে পারেননি, সেই কথা বলার জন্য সৃষ্টি করলেন পাগলাটে, চালচুলোহীন অথচ মানবদরদী কমলাকান্তকে। এই কমলাকান্ত মননশীল বঙ্কিমের মানসমূর্তি, তার জবানবন্দীর মাধ্যমে বঙ্কিম আক্রমণ করলেন সামাজিক অসঙ্গতিকে, প্রকাশিত হল "কমলাকান্তের দপ্তর"। মননশীলতা, অসামান্য রসবোধ, মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের উজ্জ্বল উপস্থিতি; সব মিলিয়ে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমের প্রতিভার অসামান্য উন্মোচন প্রকাশিত হল এই গ্রন্থে।
(৭)
বঙ্কিমপ্রতিভার অসামান্য প্রকাশ "কমলাকান্তের দপ্তর"। এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি মননশীলতা ও তীক্ষ্ণ রসবোধে উজ্জ্বল, আজো এই সংকলন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত হয়। এই সংকলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ "বিড়াল", যেখানে আমরা মানবদরদী, সমাজতান্ত্রিক বঙ্কিমকে দেখতে পাই যিনি পাঠকের সামনে শোষিত, নিপীড়িত, দরিদ্র শ্রেণীর জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরেন। দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি রূপে বিড়াল আমাদের সামনে বলে ওঠে -"তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ, দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না।" তীব্রক্রোধে পাঠককে সে প্রশ্ন করে "চোরের চুরির দণ্ড আছে, ধনীর কার্পণ্যের দণ্ড নাই কেন?" বিড়াল পাঠককে মনে করিয়ে দেয়, দরিদ্র শ্রেণীকে শোষণ করে ধনিক সম্প্রদায় স্ফীতোদর হয়ে ওঠে। তথাকথিত উন্নয়নের অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করে সে বলে,"সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কি ক্ষতি?" সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের প্রতি অসামান্য মমত্ববোধ না থাকলে বঙ্কিম কখনো এই লেখা লিখতে পারতেন না।
অনুরূপ চিন্তাধারা প্রকাশ পায় "আমার মন" প্রবন্ধে যেখানে বঙ্কিম ধনতান্ত্রিক সভ্যতার ভয়াবহ রূপ তুলে ধরেন। বাহ্য সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে, কিন্তু অর্থই যদি সমাজব্যবস্থার একমাত্র চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে, সমাজের ভালোমন্দ সব কিছুই যদি অর্থশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে; তবে সে সমাজের পরিণতি ভয়াবহ। বর্তমান সমাজব্যবস্থার অসামান্য মূল্যায়ন বঙ্কিমের এই প্রবন্ধ! আমাদের দেশে জাতিভেদপ্রথা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার জায়গায় জাঁকিয়ে বসছে এই ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যা জাতিভেদপ্রথার চেয়ে কোনো অংশে কম বিপজ্জনক নয়। বঙ্কিম উনিশ শতকেই এই ধনতান্ত্রিক সভ্যতা ও মুদ্রারাক্ষসের ভয়াবহ রূপ সম্বন্ধে পাঠককে সচেতন করে তোলেন।
অন্যান্য প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য "পলিটিকস" যেখানে বঙ্কিম কংগ্রেসের আদি পর্যায়ের নরমপন্থী মনোভাবকে তীব্র ব্যঙ্গ করেন। এই আবেদন-নিবেদনের রাজনীতিকে তিনি "কুক্কুরজাতীয় পলিটিকস" বলে অভিহিত করেন। "কমলাকান্তের জোবানবন্দী" তে তিনি কমলাকান্তকে আদালতে নিয়ে আসেন, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা ফুটিয়ে তোলেন। মনে রাখতে হবে, বঙ্কিম নিজেও হাকিম রূপে বিচারব্যবস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ বঙ্কিম নিজেকেও ছেড়ে দেননি, নিজের পেশাকেও বিদ্রুপে জর্জরিত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অন্য একটি প্রবন্ধে বঙ্কিম বিচারব্যবস্থাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, "আইন, সে তো তামাশা মাত্র। বড়োলোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে।" মাত্র দুটি বাক্য দিয়ে বঙ্কিম বিচারব্যবস্থার নগ্নরূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত করেন।
সর্বশেষে "আমার দুর্গোৎসব"। বঙ্কিমের ধ্যাননেত্রে উদ্ভাসিত হয় সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা। বাস্তববাদী বঙ্কিম জানেন আজ তিনি এই মূর্তি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু কালস্রোতের পথ বেয়ে একদিন এই রত্নপ্রসূ সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা প্রকাশিত হবে। বামে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও ঐশ্বর্যময়ী লক্ষ্মী, দক্ষিণে বীর্যরূপী কার্তিকেয় ও বিদ্যাদায়িনী বাণীমূর্তি নিয়ে পশুরাজপৃষ্ঠে বঙ্গজননী আবির্ভূত হবেন, পরাধীন দেশে বঙ্কিমের মানসপটে সেই অনাগত ভবিষ্যতমূর্তি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বঙ্কিমের এই জাতীয়তাবাদী চিন্তার পরিণত রূপ প্রকাশিত হয় "আনন্দমঠ" উপন্যাসে। উনিশ শতকের শেষ থেকে এই লেখাগুলি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বিস্তারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তী শতকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এই চিন্তারই পরিপূর্ণ রূপ। বঙ্কিমের দেশমাতৃকার অনুধ্যান এই সময়ে আরো উজ্জ্বলতর, ব্যাপকতর রূপ পরিগ্রহ করে। আধুনিক ভারতের মহাকবির মানসপটে তাই উন্মোচিত হয় অসামান্য মাতৃকল্পনা-
"আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে,
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।"
(পুনশ্চ - কোনো কোনো যুক্তিবাদী "আমার দুর্গোৎসব" প্রভৃতি লেখাকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার প্রকাশ হিসাবে দেখাতে চাইবেন। তাঁরা ভুলে যান সাহিত্য কখনো সামাজিক চিন্তাকে অস্বীকার করে সৃষ্টি হয়না। দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম এই চিন্তাকে উজ্জ্বলরূপে প্রকাশ করেছেন।আর ভারত ছাড়াও বহু দেশে দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা করা হয়। সেইসব দেশে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা আছে কিনা তা অবশ্য আমার জানা নেই। অবশ্য তাঁরা ভুলেও "বিড়াল" বা "আমার মন" প্রবন্ধগুলির উল্লেখ করবেন না। তাহলে তো বঙ্কিমকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখানো যাবেনা!
দেশকে মাতৃরূপে উপাসনা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনেক স্রষ্টাকেই প্রভাবিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, নজরুল, অতুলপ্রসাদ- এঁদের কবিতায়, গানে এই প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যের পাঠক এই সত্য অবগত আছেন। এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে মাত্র। অতএব যুক্তিবাদীর যুক্তি অনুযায়ী এঁরা সবাই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক লেখক!)
(৮)
এর আগের পরিচ্ছেদে "কমলাকান্তের দপ্তর" নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বঙ্কিমের অসামান্য মননশীলতা কিভাবে সামাজিক অসঙ্গতিকে লেখার মাধ্যমে আক্রমণ করেছে, তা পাঠকের সামনে প্রকাশ করা হয়েছে। বঙ্কিম সরাসরি সমাজের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হননি অবশ্যই, কিন্তু তাঁর মননশীলতার মাধ্যমে বারবার সামাজিক বৈষম্যকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধের মধ্যেও এই মননশীল, সংবেদনশীল মানসিকতার পরিচয় বাংলা সাহিত্যের পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ বঙ্কিমের "বঙ্গদেশের কৃষক" নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই প্রবন্ধে বঙ্কিম জমিদার শ্রেণীর অত্যাচার ও কৃষক সম্প্রদায়ের দুর্দশা পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। জমিদার শ্রেণীকে আক্রমণ করে বঙ্কিম বলে ওঠেন, জমিদার প্রকৃতপক্ষে প্রজার শোণিতপান করেন না বটে, কিন্তু যা করেন তার চেয়ে শোণিতপান অধিকতর দয়ার কাজ। বাঙালী ভূস্বামী সম্প্রদায় যে দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়ের দুর্দশার মূল কারণ, এই একটি বাক্যের মাধ্যমে পাঠককে বুঝিয়ে দেন। অনুরূপভাবে গভীর সহানুভূতির সঙ্গে হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্তর দৈনন্দিন জীবনের লড়াইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেন। মনে করিয়ে দেন, এই রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখই দেশের যথার্থ প্রতিনিধি; এদের জীবনযাত্রার উন্নতি না হলে দেশের যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব নয়। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন তাঁর পক্ষে এই তথাকথিত উন্নতির হুলুধ্বনিতে কণ্ঠস্বর মেলানো সম্ভব নয়। আজকের দিনেও বঙ্কিমের এই চিন্তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক!
সমাজবাদী বঙ্কিমের অন্যতম পরিচয় তাঁর "বৈষ্ণব ধর্ম" প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে বঙ্কিম বলেন, সমস্ত ধর্মের মূল কথা চিত্তশুদ্ধি ও আত্মসংযম। বৈষ্ণব ধর্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সর্বভূতে সমদর্শন বৈষ্ণব ধর্মের মূল আদর্শ। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান- যিনি এই আদর্শকে নিজ জীবনে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন, তিনিই যথার্থ বৈষ্ণব। এই প্রবন্ধে আমরা অসামান্য উদারহৃদয় বঙ্কিমকে উপলব্ধি করি, যিনি সমস্ত ধর্মের মূল আদর্শকে শ্রদ্ধা করেন। সমাজবিজ্ঞানী ও প্রাবন্ধিক রেজাউল করিমের মতে বাঙালী যেদিন বঙ্কিমের এই উদার আদর্শকে গ্রহণ করবে, সেদিন আর হিন্দু-মুসলমান বিরোধ থাকবে না।
(৯)
মননশীল বঙ্কিমের অনুরূপ উদার মূর্তি আমরা দেখতে পাই তাঁর "সাম্য" প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধ সংকলনে সাম্যবাদী বঙ্কিম আমাদের সামাজিক বৈষম্য সম্বন্ধে সচেতন করে তোলেন। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি তথাগত বুদ্ধ ও যীশুখ্রিস্টের নামোল্লেখ করে পাঠককে মনে করিয়ে দেন, কিভাবে তাঁরা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। একইসঙ্গে ফরাসী বিপ্লবের চিন্তানায়কদের সামাজিক অবদান বিশ্লেষণ করে তাঁদের প্রণতি নিবেদন করেন। মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকবেই, এ পার্থক্য সহজাত। কিন্তু এই বৈষম্য যদি গুরুতর হয়ে ওঠে, এক শ্রেণীর মানুষ যদি অর্থ ও সামাজিক পদমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে অন্যান্য শ্রেণীকে নিষ্পেষিত করতে থাকে, তবে তা সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে। এর ফলে উভয়শ্রেণীই চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাস বারংবার এই সত্য প্রমাণিত করেছে। ভারতের ইতিহাসেও আমরা একই সত্যের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। সেখানে উচ্চবর্ণের মানুষ নিম্নবর্ণের মানুষকে পশুবৎ নির্যাতন করেছে, পরিণামে সারা দেশ বৈদেশিক আক্রমণকারীদের হাতে পরাজিত হয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিতে বঙ্কিম ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ক্রমিক অধঃপতন তুলে ধরেন। যে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় একসময় বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন; পরবর্তীকালে তাঁরাই কিছু নিষেধাত্মক স্মৃতিশাস্ত্র ছাড়া আর কিছু রচনা করতে পারেননি। কিন্তু তাঁরাও এর ফলে চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, অপরকে নিষেধের বেড়াজালে আটকাতে গিয়ে তাঁরাও সেখানে আটকে পড়লেন। শেষপর্যন্ত তাঁরা পরিণত হলেন চূড়ান্ত পরশ্রমজীবী, পরনির্ভরশীল এক প্রজাতিতে। বর্তমানে এই প্রজাতি চালকলাভোজী প্রবঞ্চক ব্যতীত আর কিছু নয়। তথ্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক বঙ্কিম নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এই ক্রমিক অধঃপতন তুলে ধরেন।
"বিজ্ঞানরহস্য" বঙ্কিমের আরেক অসামান্য সৃষ্টি। বাস্তববাদী বঙ্কিম জানেন বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ, বিজ্ঞানসাধনা ব্যতীত কোনো জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। কিন্তু এও জানেন, সকলের পক্ষে সেই সাধনায় ব্রতী হওয়া সম্ভব নয়। তাই সর্বসাধারণের জন্য বৈজ্ঞানিক সত্যের মূলকথাগুলি তাদের উপযোগী করে প্রকাশ করতে ব্রতী হন বঙ্কিম। মনে রাখতে হবে, বঙ্কিম যখন এই কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তখন ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা শুরুই হয়নি। তখনই বঙ্কিম আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, প্রথাগত ভাবে বিজ্ঞানী না হয়েও বঙ্কিম বুঝতে পেরেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবসভ্যতার খোলনলচে পালটে দেবে। যে সমস্ত ঘটনার কথা মানুষ রূপকথার বইতে পড়েছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলি বাস্তবরূপ নেবে। দৃঢ়নিশ্চিত বঙ্কিম তাই তাঁর প্রবন্ধে লেখেন আর কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ একস্থান থেকে আরেকস্থানে শব্দপ্রেরণ করতে সমর্থ হবে কিংবা কৃত্রিম যন্ত্রের মাধ্যমে আকাশমার্গে গমন করতে পারবে! মনস্বী বঙ্কিমের অসামান্য দূরদর্শিতা আমাদের বিস্মিত করে। আরো বিস্মিত হই এই ভেবে যে প্রথাগত বিজ্ঞানচর্চায় শিক্ষিত না হয়েও বঙ্কিম কিভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন! শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে যাতে বিজ্ঞানচেতনা ছড়িয়ে পড়ে, বঙ্কিম তার জন্য অন্যান্যভাবেও সচেষ্ট হয়েছেন। সাইন্স কাল্টিভেশন প্রতিষ্ঠিত হবার পর বঙ্কিম বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এই সংস্থাকে সাহায্যের জন্য দেশের ধনী সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। দেশে বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে বঙ্কিম এভাবেই তাঁর অবদান রেখে গেছেন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম আরেক অসামান্য অবদান "কৃষ্ণচরিত্র"! কৃষ্ণকে নিয়ে মহাকাব্যে, পৌরাণিক গ্রন্থে যে অসংখ্য অতিরঞ্জিত, অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক কাহিনী বিদ্যমান; সেখান থেকে ঐতিহাসিক কৃষ্ণকে খুঁজে বের করতে তিনি সচেষ্ট হন। মহাকাব্য ও পুরাণগ্রন্থকে বিশ্লেষণ করে অতিপ্রাকৃত বর্ণনার মধ্যে থেকে তিনি ঐতিহাসিক তথ্যকে উন্মোচিত করতে প্রয়াসী হন। একথা কখনোই আমি বলছি না যে বঙ্কিম যা লিখেছেন তাই বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে। কিন্তু এই গ্রন্থের মাধ্যমে বঙ্কিম ভারতইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন চিন্তাধারার সৃষ্টি করেন যা পরবর্তী গবেষকদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। বঙ্কিম এই চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান ভগীরথ!
(১০)
আগের অধ্যায়গুলিতে আমরা বঙ্কিমচন্দ্র নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করেছি। একথা কখনোই বলা হয়নি যে বঙ্কিম ত্রুটিবিচ্যুতির ঊর্ধ্বে বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কোনো মানুষ, তিনি যতবড়ো ব্যক্তিত্বই হোন না কেন, কখনোই ত্রুটিবিচ্যুতির ঊর্ধ্বে নন। বঙ্কিমও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু উনিশ শতকের ব্যক্তিত্বকে একবিংশ শতকের দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন চূড়ান্ত মূঢ়তা ব্যতীত আর কিছু নয়। যেকোনো ব্যক্তির মূল্যায়ন করতে হয় তৎকালীন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। এটিই ইতিহাস বিশ্লেষণের যথার্থ ধারা। তা না করে যাঁরা বঙ্কিমকে রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধিরূপে প্রতিপন্ন করতে চান, তাঁদের মূল্যায়ন ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!
উনিশ শতক বাংলার ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণ! দেশ তখন ব্রিটিশ রাজশক্তির পদানত। একদিকে পুরানো চিন্তাধারা নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে পাশ্চাত্য প্রভাব তীব্রবেগে শিক্ষিত সমাজকে প্রভাবিত করছে। রক্ষণশীল সমাজের হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও সমাজে এই চিন্তাধারা ধীরে ধীরে ক্রিয়া করতে শুরু করছে। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী পাশ্চাত্য সমাজকে প্রশ্নহীনভাবে অনুকরণ করছে, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ একে প্রাণপণে আটকাতে চাইছে, ব্রাহ্মসমাজ এই দুই চিন্তাধারার মধ্যবর্তী পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। বঙ্কিম (১৮৩৮-৯৪) এই সময়ের প্রতিনিধি, এই সময়ের পরস্পরবিরোধী চিন্তার ঘূর্ণিঝড় তাঁর চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর লেখাতে এই সংঘাতের ছাপ স্পষ্ট। কখনো তিনি রক্ষণশীল সমাজের দ্বারা প্রভাবিত, কখনো আধুনিক চিন্তারীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন, কখনো বা মধ্যপন্থা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তৎকালীন সমাজের প্রতিনিধি রূপে বঙ্কিমমানসে এই পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা প্রকটিত হয়েছে। কিন্তু এই চিন্তারাশির ঘূর্ণিঝড়ে মধ্যেই তাঁর প্রতিভা হারিয়ে যায়নি, এই পরস্পরবিরোধিতার মধ্য দিয়েই তিনি সঠিক পথ খুঁজতে চেয়েছেন। তাই তাঁর লেখা তৎকালীন সমাজের চিন্তাধারার যথার্থ প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে।
বঙ্কিম সরাসরি রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। যে প্রচণ্ড তেজ ও পৌরুষ নিয়ে বিদ্যাসাগর রক্ষণশীল সমাজের জড়ত্বকে আক্রমণ করেছিলেন, সে ক্ষমতা বঙ্কিমের ছিলনা। বিদ্যাসাগর তাঁর অসামান্য তেজ ও চরিত্রমাহাত্ম্য নিয়ে বঙ্গদেশে অভ্রভেদী হিমাদ্রির ন্যায় বিরাজমান, সেই অসামান্য পৌরুষমূর্তির সামনে বঙ্কিম অবশ্যই নিষ্প্রভ। কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র সম্পূর্ণ পৃথক; সেখানে তিনি অনবদ্য, অসামান্য! মননশীল চিন্তাধারার মাধ্যমে তিনি বাঙালী সমাজকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। একথা খুব স্পষ্টভাবে বলা চলে, উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ বিদ্যাসাগরের মধ্যে দেখেছে "অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব" আর বঙ্কিমে দেখেছে মননশীলতার অসামান্য উৎকর্ষ!
বঙ্কিম যখন বাংলা গদ্য নিয়ে চর্চা শুরু করেছেন, বাংলা গদ্যের তখন নিতান্ত শৈশবাবস্থা। সেই সময় বঙ্কিম তাঁর অসামান্য প্রতিভার সাহায্যে বাংলা গদ্যকে বিশ্বসাহিত্যের সমকক্ষ করে তুলেছেন। উপন্যাস ও প্রবন্ধ উভয়ক্ষেত্রেই বঙ্কিম অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসে তাঁর মৌলিক প্রতিভা পাঠককে মুগ্ধ করেছে, আর তাঁর প্রবন্ধ পাঠকের মননশীল চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যের এই উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্কিম অসামান্য! তবে তুল্যমূল্য বিচারে মনে হয় ঔপন্যাসিক বঙ্কিমের চেয়ে প্রাবন্ধিক বঙ্কিম আরো বেশী প্রতিভাশালী! কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর লেখার মাধ্যমে বাংলা গদ্যসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। পরবর্তী লেখকেরা একে সমৃদ্ধতর করে তুলেছেন। কিন্তু আজো বঙ্কিমকে বাদ দিয়ে বাংলা গদ্যের আলোচনা সম্ভব নয়। বাংলা গদ্যসাহিত্যে বঙ্কিমের এই অবদান অসামান্য!
প্রাবন্ধিক বঙ্কিম তাঁর মনীষার প্রকাশে বাঙালী সমাজকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। সরাসরি সমাজের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি, তাঁর লেখনীই তাঁর অস্ত্র। কখনো তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, কখনো বিজ্ঞানচর্চার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কখনো তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, দর্শন- সমস্ত বিষয়েই বঙ্কিম স্বীয় মননশীলতার পরিচয় রেখেছেন। সর্বোপরি বঙ্কিমের রচনা বাঙালী শিক্ষিত সমাজে জাতীয়তাবাদী চিন্তার সূত্রপাত করেছে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের অসামান্য মনীষা এই জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে পরিপূর্ণরূপ প্রদান করেছে।
বিংশ শতকের শুরুতে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়, তার পিছনে বঙ্কিমের রচনার প্রভাব অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ পুলিশের রিপোর্টেই একথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বঙ্কিম আনন্দমঠে সরাসরি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে লেখেননি বটে, কিন্তু তাঁর বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে বাঙালীসমাজ কোনো ভুল করেনি! বঙ্কিম লিখেছিলেন, "সকল ধর্মের উপরে স্বদেশপ্রীতি, ইহা বিস্মৃত হইও না।" একথাই বিংশ শতকের জাতীয়তাবাদী চিন্তার মূল সুর, যার উদ্গাতা বঙ্কিমচন্দ্র! আবার ধর্মবেত্তা বঙ্কিম উপলব্ধি করেছেন, সমস্ত ধর্মের মূলকথা মানবপ্রীতি। এই উভয়চিন্তার মেলবন্ধন বঙ্কিমপ্রতিভার অসামান্য প্রকাশ, এর মধ্য দিয়েই তাঁর সৃজনীশক্তি সার্থক রূপপরিগ্রহ করেছে!