এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জাপান ৬

    Rumjhum Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ মে ২০২২ | ৬৪৩ বার পঠিত
  •  "পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?" এ উক্তি বাঙলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উক্তি বলা চলে।পথ হারানোর মধ্যে যে চূড়ান্ত রোমান্টিসিজমের ছোঁয়া আছে তা যুগে যুগে বাঙালির মন ছুঁয়ে গেছে। গানে, কবিতায়, উপন্যাসে বাঙালি বার বার পথ হারিয়েছে বা হারানোর কল্পনায় রোমাঞ্চিত হয়েছে। দুই বঙ্গ কন্যা সেদিন নবকুমারের সেই পথ হারানোর আনন্দ পেতে রাতের কিয়োতো দর্শনে বেড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাধ সাধল  গুগুল ম্যাপ। প্রযুক্তির দৌলতে আমাদের জীবনে সেই হারিয়ে যাওয়ার অবসরটুকুও হারিয়ে গেছে। একটুও না হারিয়ে মেট্রো রেল মারফৎ পৌঁছোলাম শিজো স্টেশন। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ( প্রায় কুড়ি মিনিট মতো) চোখে পড়ল গিয়ন শিজো স্টেশন। তখন দিনের আলো সম্পূর্ণ মুছে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। একধারে ছোট একটা নদীর জলে চিকচিক করছে রাতের আলো। কামো নদী। রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে প্রচুর মানুষ। জাপানের মানুষ যেমন আছে তেমনি অন্য দেশের মানুষের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। চার দিকে প্রচুর দোকান। চেরি ফুলের সাজে  আর আলোর রোশনাইয়ে সজ্জিত সেসব দোকানপাট, সুসজ্জিত নরনারী, আমার চেনা পরিবেশের থেকে এতোটাই আলাদা ছিল যে সমস্ত পরিবেশের আবহে আবেগের জোয়ারে  ভেসে গেলাম। জাপান দেশের মানুষজনের সৌজন্যবোধ সর্বজনবিদিত। তার সুবাদে জাপানি ভাষার দুটি শব্দ ইতিমধ্যেই রপ্ত করেছি। এক আরিগতো গোসাইমাস্তা অর্থাৎ কিনা ধন্যবাদ। দ্বিতীয় হল গোমেনোশাই যার মানে দু:খিত। জাপানের মানুষের মুখে হাসি আর আরিগতো গোসাইমাস্তালেগেই থাকে। তাদের জন্য অন্যের সামান্য অসুবিধার সৃষ্টি হলে তারা মরমে মরে যায়। তাই গোমেনোশাইয়েরও ব্যবহার আছে। আর কিছু বোধগম্য না হলেও এই দুই শব্দ টুকটাক ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছি। জাপানের মানুষজন নিজেদের ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। অধিকাংশ মানুষ অন্য বিদেশি ভাষায় কথা বলেন না। কাজেই আমাদের ইংরাজি বলার চেষ্টা ওখানে ভস্মে ঘি ঢালার মতোই ব্যর্থ চেষ্টা। তবে উপায়? গুগুল গুরুর দয়ায় সে সমস্যারও সমাধান আছে। কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করা্র থাকলে মোবাইলের ট্রানস্লেটর  অ্যাপের সাহায্যে জেনে নেওয়া হচ্ছিল। কারণ এদেশের অধিকাংশ মানুষের ব্যবহার সহযোগিতাপূর্ণ ও ধৈর্যশীল। যত তাড়াই থাক  তবু অসহিষ্ণুতার লেশমাত্র প্রকাশ পায় না তাদের ব্যবহারে। হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর এগোবার পর গমগমে রাস্তার ওপারে চোখে পড়ল আলোয় আলোয় সজ্জিত বিরাট এক ভবন।। আমরা ভাবলাম কোন স্রাইন ( মন্দির) হবে বুঝি বা। কিন্তু কাছাকাছি যেতে ভুল ভাঙল। গেটের ওপর ফলকে লেখা দেখে বোঝা গেল এটা কোনো থিয়েটার হল। নাম জানা গেল 'মিনামি যা', কিয়োতোর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক কাবুকি থিয়েটার। 

    সালটা ১৬০৩ সাল। হেইয়ান পরবর্তী যুগে জাপান দীর্ঘ দিনের গৃহযুদ্ধে জেরবার। বিভিন্ন গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত। জাপানের রাজা পক্ষান্তরে এই সব সামন্ত রাজাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন।সমাজে শ্রেণী বৈষম্য প্রকট। সামন্ত রাজারা সমাজের মাথা এবং তারা দাইমো নামে পরিচিত। এডো যুগের গোড়াপত্তন হল। দীর্ঘ দিন কিয়োতোয় রাজধানী থাকার পর তা স্থানাতরিত হল অধুনা টোকিও তে। এডো যুগে স্বৈরতন্ত্র প্রবল হলেও জাপানের ব্যাপক আর্থিক উন্নতি হল।বিদেশিদের সাথে যোগাযোগ নীতিগতভাবে এড়িয়ে চলা হতে লাগল।সামাজিক শ্রেণী বিভাজনের কড়াকড়ি থাকলেও যুদ্ধ বিগ্রহ ছেড়ে শিল্প সংস্কৃতির দিকে মানুষ মন দিল। জাপানের শহুরে মানুষ ভোগ ও আনন্দের জোয়ারে গা ভাসাল। ফ্যাশান, পপ কালচার, জীবনযাপনে ও দৃশ্যমান সব কিছুতেই সৌন্দর্য সন্ধান মানুষকে নতুন নতুন বিনোদেনের প্রতি আকৃষ্ট করল। ঠিক তেমনি এক সময়ে এই কামো নদীর শুকিয়ে যাওয়া বুকে স্টেজ বেঁধে সম্পূর্ণ এক নতুন ধারার গীতিনাট্যের জন্ম দিলেন ইযুমো নো ওকুনি। ওকুনি তার মহিলা নৃত্য শিল্পীদের দল নিয়ে মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য যে নাট্যদল গড়ে তুলেছিলেন তা কাবুকী নামে আজও জাপানের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছে। ওকুনির গীতিনাট্য জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ওকুনির নাচের দলের অনুকরণে গড়ে উঠল আরও নতুন নতুন দল। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে, হাস্য কৌতুকের রসে সিক্ত গীতি নাট্যগুলো অচিরেই জনপ্রিয়তা অর্জন করল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে নাচ গান আনন্দ ফুর্তি তাই আশে পাশে গজিয়ে উঠল অনেক টি হাউস জাপানি ভাষায় যা কিনা ওচায়া। এই টি হাউস গুলো জমায়েত হওয়া মানুষের সারা দিনের খাদ্য পানীয়ের যোগান দিতে থাকল। বলতে গেলে আম জাপানির জীবনে পপ কালচারের ছোঁয়া লাগল এই কাবুকীর দৌলতে। বিচিত্র ভঙ্গিমা, বিশেষ পোশাক, ভিন্ন স্বাদের বাজনা সম্পূর্ণ অন্য একধারার শিল্পের জন্ম দিল। তদানীন্তন শাসক গোষ্ঠী তোকুগাওয়া শোগুনতে কিন্তু মানুষের এই বিনোদন যাপনের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। তাই চটজলদি মুষ্টিমেয়  কয়েকটি কাবুকী থিয়েটার হলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কামো নদীর পূর্বপারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে দেখছি  থিয়েটার হলটিকে। এমনি সাতটি লাইসেন্সেড হলের  একটির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি ভাবতেই মন রোমাঞ্চিত হল। এমনি পথ না হারালেও ইতিহাসের অলিতে গলিতে পথ হারিয়ে আমরা দুই নবকুমারের উত্তরসূরি কামো নদীর পূর্বপারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে থিয়েটার হলটিকে দেখতে লাগলাম। চারশো বছর পেরিয়ে আজ কাবুকী শিল্প ধারা ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ১৬১০ সালে নির্মিত আর ১৯২৯ সালে পুর্ননির্মিত এই অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদোপম থিয়েটার হলে এখন চেরি ফুলের উৎসবের সময়ে গেইশাদের নৃত্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। 
     
    কাবুকী থিয়েটারকে কেন্দ্র করে এই  মিয়াগাওয়া চো-য়ের পুরো চত্বর জুড়ে গজিয়ে উঠল অসংখ্য ওচায়া অর্থাৎ চা ঘর। আজও কিয়োতোর পূর্বদিকে গিওন জুড়ে অবিকল সেই সময়ের এক টুকরো প্রতিচ্ছবি সচল হয়ে আছে। আমরা দুজন  যা দেখতে এখানে এসেছি এবার তার সন্ধানে পা বাড়ালাম। কিয়োতোর বিখ্যাত হানামাচি (ফুলের শহর) ডিস্ট্রিক্ট এই গিওন। ফুলের সঙ্গে ঠিক কি সম্পর্ক আছে বুঝলাম না তবে জানলাম এই ধরণের অঞ্চলে অর্থাৎ হানামাচি জুড়ে থাকে বেশ কিছু ওকিয়া আর ওচায়া। ওচায়া যে চা ঘর সে তো আগেই বলা হয়েছে। নিশ্চয়ই কৌতুহল হচ্ছে ওকিয়া আবার কি বস্তু। আমাদেরও হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা তখন ঢুকে পড়েছি হানামি কোজি ডোরিতে। ডোরি মানে গোদা ইংরাজিতে যাকে বলে অ্যাভিনিউ। এই রাস্তায় ঢুকে মনে হল সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারশো বছর আগের জাপানের রাস্তায় আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটুও অতিশয়োক্তি নয়। রাস্তার আলো থেকে ওচায়া সবই সেই যুগের মতোই। রাস্তার দুধারে পুরোণো মাচিয়া বাড়িগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যার অধিকাংশই এখন রেস্ট্রুরেন্ট বা কাফে হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। এই মাচিয়া বাড়ি জাপানের সনাতন কাঠের বাড়ি। কিয়োতোর মাচিয়ার বিশেষ স্থাপত্যশৈলী হেইয়ান যুগ থেকে শুরু করে (অষ্টম শতক) আর এডো যুগ ( সতেরোশো শতক) পেরিয়ে মেজি যুগেও ( উনিশ শতক) সনাতন ধারাকে বয়ে নিয়ে গেছে। মাটির দেওয়াল, টেরাকোটার   টালি দিয়ে তৈরি  ছাদ আর সামনের স্লাইডিং দরজায় সম্পূর্ণ অন্য ধরণের নির্মাণশৈলীতে তৈরি এই কো মাচিয়া কিয়োতোর মানুষকে ওখানকার চরম আবহাওয়া থেকে অনেকটা রক্ষা করত। পরতে পরতে সাজানো স্লাইডিং দরজাগুলো শীতের দিনে প্রচন্ড ঠান্ডায় ঘরকে রাখত গরম আর প্রচন্ড গরমে দরজাগুলো খুলে দিলে কিছুটা নিস্তার পাওয়া যেত গরমের হাত থেকে। মাচিয়ার সামনের অংশ সচরাচর দোকান হিসাবেই ব্যবহার হত। হাঁ করে রাস্তার দুধারের বাড়িগুলো দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি এমন সময় অনুভব করলাম বোন উত্তেজিত হয়ে আমার জামায় টান মারছে। ছবি নেবে বলে আমার কাছ থেকে ক্যামেরাখানা ছিনিয়ে নিয়ে সাটার ক্লিক করতে না করতে দুই সুন্দরী অত্যন্ত দ্রুত পায়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন একটি পথের ধারের রেস্তোরাঁর মধ্যে। এক ঝলক দর্শন পেলাম মাত্র। ছবি তোলা গেল না। কিন্তু এটা বুঝলাম যা রটে তার অনেকটাই সত্য বটে। এক মুহুর্তের এই উপস্থিতি যেন এক অপরূপ বিহ্বলতা ছড়িয়ে দিল চারপাশে।বুঝলাম এনারাই গেইকো ( তথা গেইশা)। এনাদের দর্শন পেতেই আমাদের এই নবকুমার হওয়ার সাধ আর তাই ভর সন্ধ্যা বেলা গিওনের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো। এই গেইকোদের বাড়িই হল ওকিয়া। 
    কারা এই গেইকো?  কি বা তাদের অবস্থান জাপানের সমাজে? আবার পথ হারাই ইতিহাসের গলিতে। 
     
    এডো যুগে মানে সপ্তদশ শতকে, তোকুগাওয়া শাসনকালে জাপান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক নীতি অবলম্বন করল।বিদেশী শক্তির প্রভাব প্রতিহত করতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক সব ধরণের সম্পর্ক বর্জনের সিদ্ধান্ত নিল। এদিকে গৃহযুদ্ধের আগুন নিভে গেছে। এমন অবস্থায় যোদ্ধা ও ধনী ব্যবসায়ীরা সময় কাটাতে নিষিদ্ধ পল্লীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠতে লাগল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তোকুগাওয়া শাসক মানুষের বিনোদনের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ রাখায় বিশ্বাসী, তাই ১৬১৭ সালে তদানীন্তন শাসক কড়া নির্দেশ জারি করে নিষিদ্ধ পল্লীর গন্ডী শহরের বাইরের দিকে সীমিত করলেন যার জাপানি নাম হল ইউকাকো মানে বিনোদন গৃহ। কিন্তু শুধু যৌন তৃপ্তিতে তো সময় কাটতে চায় না। আরও অন্য ধরণের সাহচর্যের জন্য ব্যাকুল হল তারা। নাচ গান কবিতায় বেশ্যাপল্লীর গ্রাহকদের মাতিয়ে রাখতে বিনোদন জগতে আমদানী হল সম্পূর্ণ নতুন এক দল পেশাদার মানুষের যাঁরাই গেইশা নামে পরিচিত। প্রাথমিকভাবে, পুরুষরাই এলেন এই পেশায়। বিগত শতাব্দীর সামন্ত জমিদারদের মনোরঞ্জন করার জন্য সভায় বিদূষকের কাজ করতেন কিছু পুরুষ। ক্রমে যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাই যেন নতুন রূপে ফিরে এলেন গেইশা তথা তাইকোমোচি নামে। তাঁরা এখন পার্টিতে অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য হাস্যকৌতুক পরিবেশন করেন, আদি রসাত্মক গল্প করেন, বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গিমার মাধ্যমে যৌন ইচ্ছা জাগিয়ে তোলেন বেশ্যাপল্লীতে আনন্দ নিতে আসা উচ্চবিত্ত মানুষদের মধ্যে। এভাবেই চলে প্রায় একশো বছরেরও কিছু বেশি সময়। ১৭৫১ সালে হঠাৎ করে এক পার্টিতে প্রথম মহিলা গেইকো(গেইশার স্ত্রী লিঙ্গ) আবির্ভাব জাপান সমাজে আলোড়ন ফেলে দিল। তারপর ধীরে ধীরে মহিলারাই এই পেশায় একচেটিয়া হয়ে উঠলেন। 

    কিন্তু তাঁরা যখন নিষিদ্ধ পল্লীর গ্রাহকদের মনোরঞ্জন করতে শুরু করলেন তখন একটা বিষয় নিশ্চিত করা হল যে তাঁরা যৌন কর্মী হিসাবে কাজ করবেন না। তাঁদের সমাজে শিল্পীর মর্যাদা দেওয়া হল। আজ একবিংশ শতকেও কিন্তু সেই ধারা বজায় রয়েছে। মেজি শক্তির পুনরোত্থানে ক্রমাগত বহির্বিশ্বের ছোঁয়া লাগল জাপানি সমাজে। সামন্ত্রতন্ত্রের অবসান হয়ে আবার রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেল। রাজনীতি, ব্যবসা ও আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য মানুষ ওচায়া অর্থাৎ চা ঘরগুলিতে যাতায়াত করতে লাগলেন। তখন ওচায়ায় উচ্চবিত্ত মানুষদের সঙ্গ দিতে গেইকো ও মাইকো ( শিক্ষানবীশ গেইকো)দের নিযুক্ত করা হত। কিয়োতোয় 'ওকিয়া' হল এই গেইকোদের বাড়ি। এখানে একজন হাউস মাদারের তত্ত্বাবধানে সচরাচর পনেরো বছর বয়স থেকে শুরু হয় কঠোর শিক্ষানবিশী। জাপানের সঙ্গীত ও নৃত্যকলা আয়ত্তের পাশাপাশি কবিতা, শামিসেন ( জাপানের বাদ্য যন্ত্র) বাদন সবের ওপর দক্ষতা অর্জন করতে হয়। তাছাড়া  তাদের হাঁটা চলা কথা বলা এমনকি দৃষ্টিপাতের মধ্যে দিয়ে মানুষের মন জয় করার কলা কৌশল শিক্ষা করতে হয়। এছাড়া আছে পোশাক আশাকের বৈচিত্র‍্য, মেক আপ, গয়না সব মিলিয়ে এক সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈলী নির্মাণের মাধ্যমে আজও এই শিল্পীরা মানুষের মনে রহস্যময় রোমাঞ্চ তৈরি করতে সক্ষম। এক এক জন গেইকোর শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে প্রচুর পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়। সামান্য চোখের চাওয়ায়, মুখের অভিব্যক্তিতে, আচার ব্যবহারের মাধুর্যে গানে কথায় কবিতায় আতিথেয়তাকে শিল্পের স্তরে উন্নীত করার  ক্ষমতা রাখেন একজন গেইকো। তার সাদা মুখ, টুকটুকে লাল ঠোঁট, কাজল কালো টানা চোখ আর মেঘ বরণ চুলের পরিপাটি সজ্জায়, সিল্কের কিমোনোয় সর্বোপরি কমনীয় আচরণে ও আভিজাত্যের সুষমায় নারীত্বের যে উদযাপন তার সূক্ষতা অনেক সময়েই বিদেশি পর্যটকদের বোধের অগম্য হয়ে পড়ে। তাঁরা ধরেই নেন পয়সার জোরে একজন গেইকোকে সহজেই শয্যা সঙ্গিনী হিসাবে পাওয়া যেতে পারে। সেইখানেই হয় বিপত্তি। 

    ইতিমধ্যে আমাদের মনে জেদ চেপেছে এমন শিল্পীদের সামনা সামনি না দেখে ফেরা চলে না। অতএব দুই বোন দেখে শুনে একটা ওচায়ায় ঢুকে বসলাম। খাবার খাওয়ার থেকেও হোস্ট হিসাবে একজন গেইকোর সান্নিধ্য পেতে পারব ভেবে উত্তেজনায় টগবগ করছি। রিসেপশনের লোকটিকে ডাকা হল। জানা গেল, ফোন করলেই গেইকো যিনি আছেন তিনি আসবেন। তবে টাকার অঙ্ক শুনে আমাদের ভিরমি খেয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার  অবস্থা হল। মাত্র এক লক্ষ ইয়েন( জাপানি মুদ্রা)  ভারতীয় মুদ্রায় তা মোটামুটি ষাট হাজার টাকা। 
    সে যাত্রায় আর গেইকো বা মাইকো কারও সান্নিধ্য পাওয়া হল না। আমরা অনুপম বাবুর সেই বিখ্যাত গানের মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম। সত্যিই তো 'সব পেলে নষ্ট জীবন'। আর জীবন নষ্ট করার চেষ্টা না করে পরের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম। 
     
    কাবুকী থিয়েটর
     

    ছবি সূত্র: ইন্টারনেট
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন