ইলেকশান
১৯৮৫র সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি তাশখন্দে পৌঁছনোর পরে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় নি। অক্টোবরের শুরুতেই পড়েছিল ইলেকশানের তারিখ— ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রত্যেক ইন্ডিয়ানের জন্য একটা করে ভোট। প্রার্থী প্রথম দিকে ছিল দুজন, কদিন পরে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াল তিনজনে। প্রত্যেকের ভোট জরুরি, একটা ভোটের এদিক ওদিক হলেও ইলেকশানের ফলাফল পাল্টে যেতে পারে। ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তিন পক্ষ থেকে তুমুল ক্যাম্পেনিং চলছে। শহরের মধ্যিখানে আমাদের হস্টেলে মাত্র তিনজন ইন্ডিয়ান থাকলেও প্রার্থীরা এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা দলে দলে ক্রমাগত হানা দিতে লাগল আমার ঘরে। অনুরোধ করা, বিপক্ষের প্রার্থীদের নামে কুৎসা রটানো, সমস্তই চলতে লাগল পুরোদমে। সকলের বক্তব্যই শুনছি, সবাইকেই আশ্বাস দিচ্ছি ভোট দেবার। জীবনে এই প্রথম ভোট দেব। ইন্ডিয়ায় থাকতে ভোট দেবার বয়স ছিল না, ভোটার লিস্টে নাম ওঠেনি তখনও। তখনও ইণ্ডিয়ায় একুশ বছর বয়স না হলে ভোটার লিস্টে নাম উঠত না। ভোটাধিকারপ্রাপ্তদের তর্জনীতে কালো দাগ দেখে ভাবতাম কবে আমিও ওরকম দাগ নিয়ে গর্বের সঙ্গে ঘুরতে পারব, ও দাগের স্টেটাসই আলাদা।
এখানে ভারতীয় পাসপোর্টের জোরেই আমার ভোটাধিকার তৈরী হয়ে গেছে। আমাদের হস্টেলের বাকি দুজন ইন্ডিয়ান ভোট দেবে বিহারের ক্যান্ডিডেট রঞ্জন কুমারকে। রঞ্জন কুমার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র, সে থাকে শহরের এক প্রান্তে ভুজগারাদোক নামক একটা জায়গায় একুশ নম্বর হস্টেলে। ঐ অঞ্চলে একজন খুব সিনিয়র বাঙালি আছেন, তিনি দীপুদা নামেই পরিচিত। রঞ্জন কুমার দীপুদাকেও বিশেষভাবে চেনে। দীপুদার হস্টেলে সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার পার্টি আছে, সে আমায় নেমন্তন্ন করে গেল। বলল, চিন্তা নেই কেউ একজন এসে আমায় নিয়ে যাবে দীপুদার হস্টেলে। যে সে রবিবার নয়, সেদিন পঁচিশ ঘন্টায় এক দিন*। বাকি দুজন ক্যান্ডিডেটের একজন তামিলনাডুর ছেলে রবিশংকর, সে ও মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সে ও একুশ নম্বর হস্টেল, এবং তিন নম্বর ক্যান্ডিডেট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বলবন্ত সিং, দিল্লির ছেলে, হস্টেল নং চোদ্দ।
বলবন্তের ক্যারাকটার সার্টিফিকেট ভাল নয় সে খবর রঞ্জন কুমার আগেই জানিয়ে দিয়েছে। সে মদখোর এবং মাতলামির রেকর্ড খুবই বাজে, নিয়মিত ভাংচুর করে, পড়াশোনায়ও সুবিধের নয়, ইত্যাদি। বলবন্তের দল রঞ্জনের বিরুদ্ধে বলে গেছে যে রঞ্জন এক বছর ফেল করে রিপিট করেছে, সে কমিউনিস্ট পার্টির কোটায় পড়তে এসেছে, ইত্যাদি প্রভৃতি। রবিশংকরের চেলাচামুণ্ডা সংখ্যায় কম, ছেলেটাকে দেখে বাকি দুজনের তুলনায় ভদ্র বলে মনে হল, মনে মনে ঠিক করলাম রবিশংকরকেই ভোটটা দেব। তবে রঞ্জন যেরকম উৎসাহ নিয়ে আমাকে দীপুদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চাইছে, পরে হয়ত রঞ্জনকেই ভোটটা দিয়ে দিতে পারি।
সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার ছিল ডে-লাইট সেভিং এর দিন। ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পিছিয়ে দেবার ব্যাপার সেই প্রথম জানলাম। সকাল দশটা থেকেই সেজেগুজে রেডি হয়ে আছি কখন আমায় নিতে আসবে। রঞ্জন নিজেই এল। ট্যাক্সি করে নিয়ে চলল ষোলো নম্বর হস্টেলের দিকে। যাবার পথে সে অনেক কিছু জানাচ্ছে আমাকে, কার সঙ্গে মিশব, কার সঙ্গে মিশব না, ভারতীয় মেয়েদের ভদ্রতা নম্রতা আব্রু সম্মান এসব কতটা জরুরী এ দেশে, দেশের মেয়েদের চালচলনই বলে দেয় দেশের ঐতিহ্য, আরও অনেক কিছু, যেমন, কী করে রেসপেক্ট পেতে হয়, ইত্যাদি। সব কথা আমার কানে পুরোপুরি ঢুকছেও না। আমি আনন্দে ডগোমগো যে আজ বাংলায় কথা বলতে পারব। দীপুদার বাড়ি যাচ্ছি, মানে ঠিক বাড়ি নয় যদিও, হস্টেল। তা হলেও একটা সিনিয়র দাদা বলে কথা। রঞ্জন কানের কাছে ভ্যাড় ভ্যাড় করছে করুক, উঃ বাবা আর কতক্ষণ বাকি ষোলোনম্বরে পৌঁছতে!
দীপুদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হস্টেলের গেটের মুখটায়— এক হাতে দইয়ের বোতল (হুবহু হরিণঘাটার দুধের বোতলের মত দেখতে), অন্য হাতের আঙুল আঁকড়ে ধরে রেখেছে তার বছর দুয়েকের মেয়ে ইন্দিরা। শুনলাম বৌদি ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে অ্যাডমিটেড, সদ্যোজাত ছেলের জন্ডিস হয়েছে। উনি হাসপাতালে গিয়ে বৌদিকে দইটুকু দিয়েই ফিরে আসবেন জলদি, সংক্রামক রোগের হাসপাতালে এমনিতেও রোগীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করবার ব্যবস্থা নেই। তবে চিন্তা নেই, অতিথিরা অনেকেই এসে গেছে, সোজা চারতলায় গিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে গল্প গুজবে যোগ দিতে পারি।
এদেশে যত ইন্ডিয়ানের ঘরে মেয়ে জন্মায় সবার নাম এক ধারসে ইন্দিরা রাখে। মেডিক্যালে পড়ে বর বৌ শিবকুমার ও উর্মিলা, তাদের মেয়ের নামও ইন্দিরা। নামের কি এতটাই আকাল পড়েছে?
চারতলায় লিফট থেকে বেরোতে না বেরোতেই গমগম আওয়াজে মালুম হয় পার্টি শুরু হয়ে গেছে। এই টাইপের হস্টেলগুলো নতলা হলেও প্রত্যেক তলায় চারটে করে বড়ো ঘর এবং আটটা ছোটছোট ঘর। এছাড়া চারটে টয়লেট একটা স্টোররুম এবং তার বিপরীতে বড়োসড়ো একটা রান্নাঘর। প্রত্যেক তলায় দুটো কমন ব্যালকনির একটা রয়েছে সিঁড়ি তথা লিফটের দিকে, অন্যটা রান্নাঘর সংলগ্ন। রান্নাঘরের দিক থেকেই আড্ডার আওয়াজ আসছে, গোটা দশবারো ছাত্র সেখানে বিয়ারের বোতল হাতে ঘোরাঘুরি করছে, একজন মধ্যবয়সী ভারতীয় ভদ্রমহিলা কোমরে আঁচল বেঁধে দুধ জ্বাল দিতে ব্যস্ত। আমি সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। সম্ভবত ভ্যানিলা কাস্টার্ড তৈরী হবে, তাই দুধ অল্প আঁচে ঘন করা হচ্ছে। ভদ্রমহিলা কলকাতার বাঙালি, নাম শিপ্রা, তিনি ভারত সরকারের কোন একটা বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার। গভর্নমেন্ট থেকেই ওঁকে মাস দুয়েকের জন্য কীসব কাজে এখানে পাঠিয়েছে, থাকছেন তাশখন্দের নামকরা হোটেল গাসতিনিৎসা তাশখন্দ -এ, নিজের কাজের ব্যাপারে উনি খুব একটা খুলে কিছু বলতে চান না। ওঁর থাকার মেয়াদ প্রায় শেষ, আগামিকালই বেড়াতে যাচ্ছেন রাশিয়ায় কৃষ্ণসাগরের তীরে সোচি-তে। সেখানে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে তাশখন্দে ফিরবার পরেই বিদায়ের বাঁশি বেজে উঠবে। একেবারে কাকতালীয়ভাবে রাস্তায় দীপুদার সঙ্গে ভাগ্যিস ওঁর দেখা হয়ে গেছল, তাই ওঁকে নেমন্তন্ন করে আনা সম্ভব হয়েছে। সবাই বিয়ার খাচ্ছে দেখে আমিও একটা বোতল তুলে নিতে গিয়ে তুষারের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। তুষার আমারই সঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছে, যদিও এ শহরে ওর এবং আমার হস্টেল আলাদা। ও বলল— নিবি নাকি একটা? খাবি? খেতেই পারিস, তবে এতসব লোকজন রয়েছে তো, কে কী মনে করবে, বুঝতেই পারছিস, অন্য কোন সময়ে আলাদা করে খাস, আসলে এখানকার পাবলিক তো, হঠাৎ করে কে কী কমেন্ট করে দেবে…।
রান্নাঘরের মুখোমুখি স্টোররুমটায় ঢুকলাম। ওটাই দীপুদার বৈঠকখানা। নড়বড়ে শেলফে পুরোনো বাসন, টেবিলের নীচে বেশ কিছু ছোটছোট আরশোলা, টেবিলের ওপর রাখা আছে দুটো গোটা শুকনো মাছ। নোনা মাছ, চ্যাপ্টা মত, আঁশ টাস শুদ্ধই শুকোনো হয়েছে। এগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিয়ারের সঙ্গে খেতে হয় টাকনা হিসেবে। আপাতত দুটো মাছই অক্ষত, কেউ হাত লাগায় নি। সবাই খোলা ভেঙে ভেঙে চিনেবাদাম খাচ্ছে। রান্নাঘর এবং বৈঠকখানার মধ্যবর্তী করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে একটা প্লাস্টিকের কমোড, শিশুদের ব্যবহারের জন্য। সম্ভবত ইন্দিরা ওটা ব্যবহার করে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দীপুদা ফিরে এলেন। ইন্দিরা বাংলা বলে না, রাশিয়ান বলে, তাও উত্তমপুরুষে কিছু বলতে শেখেনি, সমস্তই প্রথম পুরুষে। সে কাঁদোকাঁদো স্বরে ঘোষণা করল, “ইন্দিরা পায়খানা করতে চায়”। বেগতিক দেখে আমি তাকে কমোডে বসিয়ে দিলাম। দীপুদার ঘরটার দিকে কেউ যাচ্ছে না, অন্য একটা ফাঁকা ঘরে গোটা দুয়েক টেবিল পাশাপাশি জুড়ে বড়ো ডাইনিং টেবিলের আকার দেওয়া হয়েছে, টেবিলক্লথের অভাবে সেটা ফুল ফুল ডিজাইনের বেডকভার দিয়ে ঢাকা। কাস্টার্ড কতটা কী হয়েছে জানা গেল না, কিন্তু প্রচণ্ড ঝাল দেওয়া ভেড়ার মাংসের ঝোল রান্না করেছিল কামরুজ্জমান। কামরু কে এই প্রথম দেখলাম, সে ডাক্তারির ছাত্র। কে একজন মাংসের ঝোল গড়ানো গরম ডেচকিটা তাড়াতাড়ি বেডকভারের ওপর এনে রাখল। চিনেমাটির প্লেটে প্লেটে ভাত পরিবেশন হয়ে যেতেই সবাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ডেচকির ওপর। শিপ্রাদি নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে নীচু স্বরে দীপুদাকে বললেন, আহা সত্যিইতো অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, দুটো বেজে গেছে, তার মানে অন্য দিন হলে তো তিনটেই হতো, তাইনা?
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর শিপ্রাদিকে আর আটকে রাখা গেল না, উনি চলে যাবেনই, অনেক বাঁধা ছাদার কাজ বাকি পড়ে আছে হোটেলে। ইন্ডিয়ান ছাত্ররা বিয়ার এবং ভরপেট মাংসভাত খেয়ে ইতিউতি বসে বসে ঝিমোচ্ছে, কয়েকজন কেটেও পড়েছে। অগত্যা দীপুদা শিপ্রাদিকে হোটেলে পৌঁছে দিতে ছুটলেন। ইন্দিরার দেখভাল করতে রইলাম আমি, সেও খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়।
লোকসংখ্যা খানিকটা কমে গেলেও সন্ধেবেলা পার্টি আবার টগবগিয়ে উঠল। এখন আর শিপ্রাদি নেই, তাই ছেলেরা স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলতে পারছে, এখন আর খিস্তি টিস্তি দেবার আগে আগুপিছু দেখে ব্রেক কষবার প্রয়োজন হবে না। অস্থায়ী ডাইনিং রুম ছেড়ে সেই ঘুপচি স্টোররুমে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে শুরু হয়ে গেল গোপন আলোচনা। আসন্ন নির্বাচনে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রার্থী বলবন্ত সিং কে হারানোর জন্য পরামর্শ করা দরকার। ঘরের কোণে রাখা একটা নোংরা মত বালতির ভেতর থেকে বেরোলো দু বোতল সস্তার ভোদকা, এ সমস্ত ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনাসভায় অল্প একটু মদ টদ না থাকলে পরিস্থিতির গুরুত্ব হালকা হয়ে যায়। ছোট ছোট গ্লাসে নীট মদ। সেই মাছ দুটোকে আগেই খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে বাক্স প্যাটরার পেছনে চালান করে দেওয়া হয়েছে, মদের বোতল ও গ্লাস রাখবার জন্য টেবিলের ওপর যথেষ্ট জায়গা চাই।
যাদের ভোট রঞ্জন কুমারের দিকে টেনে আনা যেতে পারে তাদের একটা লিস্ট তৈরী হয়ে গেল মুখে মুখে। ওরা ধরেই রেখেছে যে আমার ভোটটা পাবে। তিনজন আউটকাস্ট টাইপের ভোটারের নাম সসঙ্কোচে উচ্চারিত হল, দরকার হলে তাদের কাছে গিয়েও দরবার করতে হবে, তিনজনই মহিলা। কী কী অপরাধে তাদের ধোপা নাপিত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তা সরাসরি জিগ্যেস করাটা শোভন হয় না, চুপ করে থাকলে ধীরে ধীরে ওদের কথাবার্তা আলোচনা থেকে আপনি জানা যাবে। তিনজনের একজন হচ্ছে মীনাক্ষি, ওর একঘরে হবার কারণ আমার জানা, — ‘রান্ডি’ টাইপ। বাকি দুজনও কি একই গোত্রের? উঁহু, সম্ভবত না। তাদের কাছে গিয়ে অ্যাপ্রোচ করতেই সবচেয়ে বেশি ঘাবড়াচ্ছে রঞ্জন, একজনের নাম মিসেস খান, ডক্টরেট করছেন সাহিত্যের ওপর, তাঁর স্বামী পাকিস্তানি; অন্য জন মীরা, তিনি নিজে ডাক্তারি পাশ করে গবেষণারত। মীরার স্বামীও ডাক্তারিতে গবেষণা করছেন, বাংলাদেশি মুসলমান, নাম সামদানি। এই দুজনের কাছে যেতে রঞ্জনের সঙ্কোচ। ঠিক সঙ্কোচ নয়, ভয়। মিস্টার খান কি ইন্ডিয়ান ছোকরাদের ঘরে ঢুকতে দেবে? কাশ্মীরের মানচিত্র নিয়ে কদিন আগেই একুশ নম্বর হস্টেলে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান মারপিট হয়ে গেছে, প্রচুর বোতল ভাঙা হয়েছিল সেখানে। এমতাবস্থায় মাথা নীচু করে মিসেস খানের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়া, যে মেয়ে অবিশ্বাসী ‘গদ্দার’, যে কিনা পাকিস্তানি ছেলেকে বিয়ে করবার মত জঘন্য কাজ করেছে, শেষে তার কাছে একটা ভোটের জন্য হাত পাততে হবে? দীপুদা রঞ্জনকে আরেকটু মদ ঢেলে দেন, সে এক চুমুকে সেটুকু সাবাড় করে ঘোলা চোখে দীপুদার দিকে তাকায়, ক্রমশ সেই চোখ দুটো ভরে ওঠে জলে। বেশ কিছক্ষণ সবাই চুপ। সিচুয়েশন খুব সিরিয়াস। দীপুদা ধীরে ধীরে বলেন, পোলিটিক্সে ইমোশানকে দূরে সরিয়ে রেখে কাজ করতে হয় রঞ্জন, চেষ্টা কর, তুমি পারবে, পারতে তোমাকে হবেই, তুমি বাঘের বাচ্চা, তোমার চেয়ে বেটার এলিজিবল ক্যান্ডিডেট কে আছে আমাকে দেখাও, আমি মেনে নেব।
রাত বাড়ছে। কিন্তু গোপন আলোচনাসভা ভাঙবার কোন লক্ষন তখনও দেখা যাচ্ছে না। মাঝখানে ইন্দিরাকে ঘুম থেকে তুলে কৌটোর বেবিফুড খাইয়ে দিলেন দীপুদা। ইতোমধ্যে আরেকজন কন্ট্রোভার্শিয়াল ভোটারের নাম উঠে এসেছে লিস্টিতে, সে মেয়ে নয়, সে নাসির। ডাক্তারির ছাত্র, সেকেন্ড ইয়ার। নাসিরের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব বারবার দেখা গেছে, যে কোন অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হলে সে নাকি নতুনদের কাছে নিজের পরিচয় দেয় এরকমভাবে— আই অ্যাম নাসির, ফ্রম কাশ্মীর। ওর এই ঔদ্ধত্ব মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। ব্যাটা এদেশে এসেছিস ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে, আর পরিচয় দিচ্ছিস নিজেকে কাশ্মীরি বলে?
আবার মেজাজ গরম হয়ে যায় সবার। ১৯৮৫ সাল। কী এমন সমস্যা হচ্ছে কাশ্মীরে? আমি বুঝতে পারি না, তাই বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলেছি। সকলেই কটমটিয়ে তাকায় আমার দিকে। আমি ঘাবড়াই না এবার, শান্ত ভাবে যুক্তি দিয়ে বলি,— দেখুন রঞ্জন ইজ ফ্রম বিহার, আই অ্যাম ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল, কামরুজ্জমান ইজ অলসো ফ্রম বিহার —
আমায় বাক্য শেষ করতে দেয় না রঞ্জন, সে চেঁচিয়ে ওঠে— নো! উই অল আর ইন্ডিয়ানস, দ্যাট ইজ আওয়ার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আইডেন্টিটি, ম্যায় বিহারি, তুম বাংগালি, ও মাদ্রাসি, অ্যায়সা নেহি চলেগা। নাসির যদি নিজেকে কাশ্মীরি বলে চালাতে চায়, তবে চলে যাক না সালা পাকিস্তান। সালা পাকিস্তানিরা আমাদের লেড়কিদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঐ বাংলাদেশির পয়সা দেখে ইন্ডিয়ান লেড়কি ভেগে যাচ্ছে, এরা সাচ্চা ইন্ডিয়ান? রঞ্জন নড়বড়ে টেবিলটার ওপর চাপড় মারায় গ্লাসগুলো কেঁপে ওঠে।
—আমাদের লেড়কি মানে! হোয়াট ডু ইয়ু মীন?
এরকম প্রশ্নের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না, যেন একটা স্বতঃসিদ্ধের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি। ওদের মধ্যে একজন শান্ত ভাবে বলে, তুমি নতুন এসেছ এখানে, কাল যদি একটা পাকিস্তানি কি বাংলাদেশি তোমাকে লোভ দেখায়, দারু পিলায়, তুমি কি তার সঙ্গে চলে যাবে? যাবে না তো? কারণ তুমি আচ্ছি লেড়কি, মনে প্রাণে একজন ইন্ডিয়ান। কিন্তু এরকম মেয়েও আছে যারা নিজের দেশকে রেসপেক্ট করে না। যে নিজের দেশকে রেসপেক্ট করে না, সে রেসপেক্ট পাবে কীকরে? বুঝেছ এবার?
দীপুদা সামলে নিতে চান পরিস্থিতি, বলেন — যাইহোক, রঞ্জনের মত ভাল ছেলে হয় না, তবে উঠে পড়ে লাগতে হবে। কামরুজ্জমান বলে দেয় যে নাসির যদি ফারদার ঝামেলা করে, যদি রঞ্জনকে ভোট না দেয়, তবে “ইৎনা মারুঙ্গা না সালেকো পাকড়কে”…। মোট কথা সভা ভেঙে যায়। রাত এগারোটা। সেই দুপুরের পর কেউই মদ ছাড়া কিছু খায় নি, আমি তো মদ খাবার যোগ্য গন্য হই নি। যে যার হস্টেলে চলে গেল টলতে টলতে। আমি কী করে ফিরব জানি না। দীপুদা বলল, এত রাতে তুমি একা একা যেও না, আজকের রাতটা আমার এখানে থেকে যাও, কাল ভোরে ট্রলিবাস পেয়ে যাবে মোড়ের মাথা থেকে, চিনে গেছ তো এখন।
আমি থেকে যেতে রাজি হয়ে যাই। তারপর আমরা অস্থায়ী ডাইনিং রুমটা পরিস্কার করে ফেলি। বাসন কোসন উচ্ছিষ্ট ইত্যাদি দীপুদা সরাসরি চালান করে দেন স্টোর রুমের সেই টেবিলটার তলায়। বাচ্চাসহ বৌদিকে কাল পরশুর মধ্যেই ছেড়ে দেবে হাসপাতাল থেকে। ঘরদোরের যা অগোছালো অবস্থা হয়েছে বৌদি হাসপাতালে থাকাকালীন সে অবর্ণনীয়। দীপুদাকে কাল সারাটা দিন ধরে ঘর গোছাতে হবে, সব নোংরা পরিস্কার করে না ফেললে ছোট ছোট দুটো শিশু নিয়ে বাস করা স্বাস্থ্যকর নয়। ঘরটায় ঢুকলাম, মস্ত একটা খাট, মেঝেয় কার্পেট পাতা, কার্পেটের ওপর হরেকরকম জিনিস ছড়িয়ে রয়েছে। দীপুদা বললেন, তুমি দেয়ালের দিকটায় শুয়ে পড়, আমি ধারের দিকে শুচ্ছি, মাঝখানে অয়েল ক্লথ পেতে ইন্দিরাকে শুইয়ে দিচ্ছি, কোন অসুবিধা নেই তো? অসুবিধা হবার প্রশ্নই নেই, ঘুমে প্রায় ঢলে পড়ছি, একটা লেপ টেনে নিয়ে শুতে না শুতেই এক ঘুমে রাত কাবার। ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছে, প্রায় সাতটা বাজছে রিস্টওয়াচে, দীপুদার নাক ডাকছে শুনতে পেলাম। আর ডাকলাম না, বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। এক ঘন্টার মধ্যে হস্টেলে পৌঁছে দাঁত মেজে চুল আঁচড়ে খাতাবই সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে যেতে হবে। দীপুদার হস্টেলের নীচে গেটের কাছে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে রয়েছে বুড়ি চৌকিদার। সে আমার দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে, তাকে দায়সারা গুড মর্নিং বলেই আমি দৌড়তে লেগেছি ট্রলিবাস ধরতে।
ভুজগারাদোক থেকে আট নম্বর ট্রলিবাসে করে পাখতাকোর-এ নেমে ফের আরেকটা ট্রলিবাস নিয়ে তবে পৌঁছব আমার এলাকায়, এলাকাটার নাম বিশাগাচ। ভোরের আলো যত বাড়ছে, ট্রলিবাসের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে গুনগুন করছি সিনেমার গানের সুর। যাক বাবা একটা বাঙালি ফ্যামিলির দেখা মিলল অবশেষে। আর চিন্তা নেই, দীপুদাতো বলেই দিয়েছে যখন খুশি যেতে পারি ওখানে। বৌদি হাসপাতাল থেকে ফিরুক আগে তারপর যাব একদিন, বাচ্চা ছেলেটার কী নাম দিয়েছে জানাই হলো না কাল। ঘরদোর নোংরা হলেও দীপুদার মধ্যে কিন্তু আন্তরিকতার অভাব ছিল না। উনি অবশ্য আর বেশিদিন থাকবেন না এদেশে, ডিসার্টেশন প্রায় রেডি হয়ে গেছে, যে কোন দিন পিএইচডি থিসিস ডিফেন্ড করে ডক্টরেট হয়ে ফিরে যাবেন ইন্ডিয়াতে। তখন একটা ইন্ডিয়ান কমে যাবে এই শহর থেকে, ছাপ্পান্ন থেকে কমে পঞ্চান্ন হয়ে যাবে, নাকি চুয়ান্ন? যদি দীপুদার বৌকে ধরি হিসেবের মধ্যে তাহলে তো চুয়ান্ন হওয়াই উচিত। ওরা যখন গোনে, তখন কি ডিপেন্ডেন্টদেরো গোনে? না বোধহয়, বৌদিতো স্টুডেন্ট নয়, বৌদি হচ্ছে হাউজওয়াইফ, বৌদির ভোটাধিকার নেই। বৌদির নামটা জেনে নিয়েছি, সাগরিকা। ফোটোও দেখলাম ঘরে রাখা ছিল ফ্রেমে বাঁধানো, অপূর্ব সুন্দর মুখটা, অনেকটা প্রিয়ম হাজারিকার মুখটা যেমন, সেই “তেরো নদীর পারে” সিনেমার প্রিয়মের মত, বৌদি শ্যামবর্ণা। আমারতো বিকেলের দিকে কিছু করবার থাকে না, যদি দরকার পড়ে বিকেলের দিকে এসে বৌদিকে কাজকর্মে সাহায্য করে যাব আমি, ছুটির দিনগুলোয় তো যাবোই। ট্রলিবাস থেমেছে পাখতাকোরে। এবার চার অথবা ছ নম্বর ট্রলিবাসের স্টপের দিকটায় যেতে হবে, অল্প একটু হাঁটা। আমি আনন্দে উড়ে উড়ে চলছি আর গাইছি, — সে কোন রূপকথারই দেশ, ফাগুন যেথায় হয় না কভু শেষ, হুঁহুঁ হুঁহুঁ হুঁহুঁ হুঁহুঁ ( কথা মনে পড়ছে না, শুধু সুরটুকু আছে) রেখে এলেম তারে, সাত সাগরের পারে, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে—
ক্লাসে আমার পাশে যে ছেলেটা বসে তার নাম মহম্মদ আবদুর রজ্জাক। আফগান। পড়াশোনা খুব একটা ভাল এগোচ্ছে না ওর। ওকে আবদুর বলে ডাকলে ও শুধরে দেয়, আবদুর নয় আবদুল। আবার আবদুল বলে ডাকলে ক্লাসের অন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে। একজনকে তার নাম ধরে ডাকলে এত হাসবার কী আছে! পরে আমজাদ বুঝিয়ে দেয় যে রজ্জাক বলে ডাকতে হবে বা আবদুররজ্জাক বলে, শুধু আবদুল বলতে নেই, আবদুল মানে চাকর, গোলাম। যেমন কারো নাম গোলাম নবী হলে তাকে শুধু গোলাম বলা যাবে না, হয় নবী বলে ডাকতে হবে, নয় গোলাম নবী। এসমস্ত দেশে থাকতে শেখা হয় নি, এখানে এসে শেখা হয়ে যাচ্ছে।
সেই রজ্জাকের সঙ্গে একদিন সন্ধেবেলায় চলেছি দোমব্রাবাদ, এক নম্বর মেডিকেল ইন্সটিটিউটের স্টুডেন্টদের হস্টেলে। জায়গাটা চিনি না বললে ভুল হবে, একবার গেছি আগে, দুতিনবার বাস বদল করে করে যেতে হয়, সবটা সন্ধের অন্ধকারে ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারব না। আসলে এই যাওয়াটা আগে থেকে প্ল্যান করে যাওয়া নয়, অথচ খুব জরুরি।
হয়েছে কি, দীপুদার হস্টেলের সেই পার্টির পর দুটো দিন মহানন্দে কাটল মনটা খুশি ছিল বলে। তারপর ভাবছি যে বৌদি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে ফিরল কিনা, তাদের শরীর কেমন আছে একটু খোঁজ খবর নেওয়া উচিত। তারপর ভাবি যে বুধবারে গেলে যদি ভাবে খাবার লোভে এসেছে, তাই একটু রাশ টানি নিজের আবেগে, ঠিক করি যে বেস্পতিবার যাব, তাহলে নিশ্চয় আমাকে হ্যাংলা ভাববে না ওরা। সেদিন ছিল বেস্পতিবার। ক্লাসের পর যাব ভেবে রেখেছি ষোলো নম্বর হস্টেলের দিকে, কিন্তু যাওয়া হল না, দুই অতিথি এসে উপস্থিত। এরাও ভারতীয় ছাত্র, মেডিক্যালের। দোমব্রাবাদে থাকে। কেউ এলে খুব ভাল লাগে, আনন্দ হয়। এরা আজ ভোটের প্রচার করবে না, তা সহজেই অনুমেয়। এরা মস্ত বড়ো একটা টাটকা মাছ নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে — বাঙালি মেয়েকে ইমপ্রেস করবে বলে। সর্বনাশ করেছে! দেশে থাকতে মাছ রান্না করতে শিখিনি। শুধু মাছ কেন, কোন রান্নাই জানি না। কষ্টে সৃষ্টে নিয়মিত হাত পুড়িয়ে যাহোক তাহোক করে রান্না শিখে নিচ্ছি নিজে নিজেই। অতিথিদ্বয় ডিম্যান্ড করল তারা বাঙালির হাতের রান্না করা মাছ খাবে। ঐ মাছ কীকরে রাঁধে আমি জানি না, কোন মশলা দেয়, কীকরে সমস্ত আঁশ ছাড়াব, কীভাবে কুটব, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তারপরে খেয়াল হল আমার কাছে তো কোনরকম মশলাই নেই। এসব জানাতেই ওরা প্রথমে অবিশ্বাস করলেও, পরে হতাশ এবং অসন্তুষ্ট হল। যেন ধরেই রেখেছে যে প্রত্যেকটা বাঙালি মাছ রান্না করাটা জানবেই। তারপর সামান্য কথা কাটাকাটি, মাছ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলায় আরেক দফা মান অপমান হবার পরে ব্যাপারটা আর আয়ত্বের মধ্যে থাকে নি।
তারা মাছ ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করল এবং মেয়ে হয়েও রান্না না জেনে এতগুলো বছর কীকরে কাটিয়ে দিয়েছি ইত্যাদি নিয়ে তাদের অবাক হবার শেষ নেই। অ্যাইসা রাগ হল যে, মাছটা নিয়ে চারতলার জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি বাইরে। তারাও দাঁড়ায় নি, সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। একটু পরে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি চওড়া ফুটপাথের ওপর মাছটা পড়ে আছে, দুয়েকজন লোক যারা হেঁটে যাচ্ছে একবার করে ঝুঁকে দেখে নিচ্ছে মাছটা। কেউ সাহস করে ওটা ধরছে না। একটু পরে একটা বড়ো ঠোঙা নিয়ে নীচে গিয়ে মাছটা ঠোঙায় ভরে ওপরে নিয়ে এলাম, তারপর ভাবলাম যাদের মাছ তাদেরকেই ফিরিয়ে দিয়ে আসি, তখনই রজ্জাকের সঙ্গে বাসস্টপে দেখা হয়ে গেল। রজ্জাকও দোমব্রাবাদ যাচ্ছে। চারতলার ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলায় মাছটা সামান্য ক্ষত বিক্ষত হয়েছে কিন্তু ধুয়ে টুয়ে নিলে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে নিশ্চয়ই। অতটা রেগে যাওয়া আমার উচিত হয় নি, মাথাটা গরম হয়ে গেছল ওদের কথাবার্তার ধরণ দেখে। হালকা করে একটু সরি বলে নেব, ব্যস। বেশি মাথা নোয়ানোর প্রয়োজন নেই।
মেডিকেলের এক নম্বর হস্টেলেই ঐ অতিথিযুগলের বাস। রজ্জাক চলে গেল দুনম্বর হস্টেলে কার সঙ্গে যেন দেখা করতে। এক নম্বরের বুড়ি চৌকিদার ভেতরে খবর পাঠাল যাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি তারা আছে কিনা জানতে। রিসেপশনের সোফায় বসে আছি এমন সময় একটা ছোটখাট অসম্ভব রোগা ফর্সা ছেলের আবির্ভাব। পরিস্কার ইংরিজিতে জানতে চাইল কার জন্য অপেক্ষা করছি ইত্যাদি, তারপর বলল, চলো আমার ঘরে এসে বসো। চৌকিদারকে বলে দিল যে আমি তার ঘরে আছি। ঘরটা একতলায় চৌকিদারের টেবিল থেকে তিন পা দূরত্বে। ছেলেটা নিজের পরিচয় দিচ্ছে, আমার নাম নাসির, নাসির আহমেদ শাহ। আরিব্বাস! এই সেই বহু চর্চিত কাশ্মীরি রেবেল নাকি? নামটুকু শুনেই আমি খপ করে বলি, ফ্রম কাশ্মীর? ও অবাক হয়ে বলে, কী করে বুঝতে পারলে, আমায় দেখলেই বোঝা যায়, তাই না? যেমন তোমায় দেখেই আন্দাজ করছি, তুমি বাঙালি, ঠিক না?
সন্ধেবেলায় একজন ডাক্তারির ছাত্রর সাধারণত যা করা দরকার, নাসির সেটাই করছিল, পড়াশোনা। তবু আমাকে আপ্যায়ন করে চা খাওয়াল, কথা বলল। মাছ কোলে নিয়ে বসে নাসিরের কথা শুনছিলাম। সে শ্রীনগরের বাসিন্দা নয়, শ্রীনগর থেকে অনেক দূরে তার গ্রাম। তার গ্রামে এবং আশেপাশের আরো বেশ কয়েকটা গ্রাম মিলিয়ে একজনও ডাক্তার নেই। তাই সে ডাক্তারি পড়তে এসেছে। ফার্স্ট ইয়ারের পড়া শেষ করে যখন গ্রামে গেছল, তখন গোটা তিন চার গ্রাম থেকে অনেক রোগী এসেছিল তার কাছে চিকিৎসা করাতে। সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে। বারণ করে দিয়েছে এভাবে আসতে। বলে দিয়েছে, আর পাঁচ বছর পরে এসো। ততদিনে আমি ডাক্তারি শিখে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসব গ্রামে। ঊনিনশো নব্বই সালের গ্রীষ্মে নাসিরের গ্রাম আর চিকিৎসক শূণ্য থাকবে না, সবাই পথ চেয়ে বসে থাকবে তার। আমি চা খেতে খেতে নাসিরের গ্রামের গল্প শুনি, অধিকাংশই অসম্ভব গরীব মানুষ। জমিতে চাষ হয় জাফরানের। জাফরান শুকোয়, বাছে, কখনও জাফরান খায় চায়ের মত। শীতকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে জোব্বার মধ্যে একটা পাত্রে অল্প করে কয়লার আগুন নিয়ে বেড়ায় বুকের কাছে ধরে। এই সব শুনতে শুনতে জানতে চাইলাম সামনের রোববারে ভোটে দিতে যাচ্ছে কিনা। নাসির জানালো সে অবশ্যই যাবে, রবিবারে তো আর ক্লাস কামাই করতে হবে না। এর মধ্যে খবর আসে যে সে দুজন তখনো হস্টেলে ফেরেনি। কী আর করা, মাছটা আরেকজনের হাতে সঁপে দিই। কী মাছ, কেন মাছ, মাছের ইতিহাস একটুও বলি না। তার পর টুক করে কেটে পড়ি ঐ চত্বর থেকে।
শনিবারে হাফছুটির পর সোজা চলে গেলাম ষোলোনম্বর হস্টেল। চারতলাটা নিঝুম নিঃস্তব্ধ, বেলা তখন আড়াইটে তিনটে মত। সেদিনের পার্টি অ্যাটমসফেয়ারের সঙ্গে আকাশ পাতাল প্রভেদ। সব বেশ গুছোনো পরিচ্ছন্ন। রান্নাঘরটার উল্টোদিকে সেই সংকীর্ণ বৈঠকখানার দরজাটা আলগা করে ভেজানো, রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম কেউ নেই, এমনকি ইন্দিরার কমোডটা পর্যন্ত নেই। তবে কি ভুল তলায় চলে এলাম? ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই দেখি বৌদি এসে দাঁড়িয়ে আছেন। নিঃশব্দে কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাই নি। ফটোতে যেমন দেখেছিলাম তেমনি রূপ, কেবল মুখটা বিষন্ন, হাসি নেই। তবে কি শরীর এখনো সারে নি ছেলের? আমি নিজের পরিচয় দিই, বৌদি শুনে বলেন, চিনতে পেরেছি। তারপর ঘরে ডেকে নেন, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। ঘরে ঢুকে দেখলাম, ইন্দিরা ঘুমোচ্ছে খাটে, বাচ্চা ছেলেটা ছোট বেবিকটের মধ্যে কাপড়ে মোড়া, মুখটুকু দেখাই যায় না। ঘরের চেহারা ফিরে গেছে, সব গুছোনো, একটা বেবি বেবি গন্ধ ভরে রয়েছে। কার্পেটের একধারে পরিস্কার কাঁথা নেংটি ইত্যাদি গুছিয়ে রাখছিলেন বৌদি, সম্ভবত তখনই বাইরে আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিলেন।
—হ্যাঁ বৌদি বলুন কী বলবেন বলছিলেন? আমি হেল্প করব আপনাকে কোন কাজে?
অসম্ভব রেগে যান বৌদি, দুচোখ দিয়ে যেন আগুন বেরিয়ে আসে, বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে তাই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন আমাকে নিয়ে। রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে মুখ খোলেন।
—আমি যখন হাসপাতালে আমার অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে রাতের পর রাত জেগে কাটাচ্ছি, আমার স্বামী কবার দেখা করতে এসেছেন জানো? তিন সপ্তাহে পাঁচবারও নয়। আবার ঢঙ করে এক বোতল দই নিয়ে গেছে লোক দেখিয়ে। সেই সময় তুমি এখানে থাকতে তাই না? দিনের পর দিন তুমি এখানে থেকেছ, আমি সব জানি। একতলার চৌকিদার থুত্থুড়ে বুড়ি হলে কী হবে, সে সব দেখেছে, আমাকে সব বলেছে, আমি ফিরে আসব জেনে তুমি ভোরবেলা চোরের মত পালিয়ে গেছলে। ছিঃ, তোমার লজ্জা করে না আমার স্বামীর সঙ্গে শুতে? দুদুটো সন্তান আছে তার, একজন বিবাহিত মানুষের সংসারে তুমি ঢুকলে কী বলে? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে!
একটা কথা উত্তর দিতে পারিনি, এতটাই আশ্চর্য হয়ে গেছলাম বৌদির কথা শুনে। কোথা থেকে শুরু করব, কী বলব, মাথায় খেলছিল না। কীভাবে প্রতিবাদ করব?
—আপনি যা বলছেন ভাবছেন সমস্ত ভুল।
বৌদি আরও রেগে গেলেন।
— ভুল? প্রমাণ আছে আমার কাছে, প্রমাণ দেখাব?
উনি ব্যালকনিতে আমায় নিয়ে গিয়ে দেখালেন একটা ডেচকি। ঢাকনা বন্ধ করা। ঢাকনা খুলতেই ভকভক করে পচা গন্ধ। সেই শিপ্রাদির বানানো ভ্যানিলা কাস্টার্ড এতদিনে পচে বীভৎস চেহারা নিয়েছে। সেদিন পার্টির শেষে সবাই ভুলে গেছলাম কাস্টার্ডের কথা। বৌদি চেঁচান, তুমি অস্বীকার করতে পারো যে এটা তুমি বানাও নি? বুঝলাম, এখানে যুক্তি তর্ক সব বৃথা। কত আশা নিয়ে এসেছিলাম, বৌদিকে নিয়ে কত কিছু করব ভেবে রেখেছিলাম, সমস্ত স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে শেষ। এই মহিলার সঙ্গে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। তিনি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, চৌকিদারকে ডেকে আনবো? সে সব দেখেছে, সে সব জানে, দিনের পর দিন এখানে লীলাখেলা হয়েছে।
ঐ বিষাক্ত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। যাবার আগে বললাম, বৌদি আপনি নিজের স্বামীকে চেনেন না? এই কথা বলেও অবশ্য কোন লাভ হল না, তিনি তখনও বলে যাচ্ছেন, চিনি না আবার? চিনি বলেই তো বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয়নি আমার, ইত্যাদি ইত্যাদি।
লিফটের জন্য দাঁড়ানো মানে ঐ মহিলার কথা আরও কিছুক্ষণ শুনতে বাধ্য হওয়া। তাই তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই একতলায়। দেখি বুড়ি চৌকিদার তখনও পিটপিট করে দেখছে আমাকে। মনে মনে বলি, দেখ, ভালো করে দেখ, ছিঃ, এত নোংরা মন যে দুজন মানুষের সম্পর্কে শুধু সেক্স ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না?
রাস্তায় বেরিয়ে হু হু করে কান্না পেয়ে যায় আমার। মানুষ এরকমও হয়? এ কোথায় এলাম আমি! এদেশে সামনের এতগুলো বছর বাঁচব কীকরে? মনে হয় তখুনি দেশে ফিরে যাই। ভয়ঙ্কর হোমসিকনেস আমাকে গ্রাস করতে থাকে।
হস্টেলে ফিরে খবর পেলাম দেশ থেকে আমার জন্য চিঠি এসেছে। প্রথম চিঠি। প্রায় একমাস হল আমি দেশ ছেড়েছি, প্রথম চিঠি পাঠিয়েছিলাম সেই সময়েই, সে চিঠি পৌঁছেছে এবং অবশেষে এসেছে উত্তর। তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছলাম তো ক্লাস শেষ হবার পরে, চিঠি দেবার জন্য আমার খোঁজ করেছিল লাইব্রেরিয়ান, আমায় খুঁজে পায় নি। সোমবারে লাইব্রেরী খুললে সে চিঠি আমি হাতে পাব। ভারতবর্ষ থেকে চিঠি পৌঁছতে পনের দিন মত লাগে। আরেকটা জিনিস হয়ে গেছে যখন ছিলাম না, দেয়ালে ঝোলানো কাচের দরজা লাগানো শেলফটা পড়ে গিয়ে চুরমার হয়ে গেছে। যখন পড়ে গেছল, তখন ফেরার পথে হয়ত হাঁটছিলাম কি ট্রলিবাসে ছিলাম, এতবড় একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে টেরই পাই নি। ভূমিকম্প রোজই প্রায় হয় অল্প বিস্তর। আজ বেশ জোরে হয়েছিল বোঝা যাচ্ছে। আজকাল আর ভূমিকম্পে বাড়ি ধ্বসে গিয়ে চাপা পড়ে মরবার ভয় নেই। ঊনিশশো ছেষট্টির ভূমিকম্পে যখন গোটা তাশখন্দ প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল, তারপর থেকে সমস্ত বাড়িই এমন করে বানানো হয়েছে যাতে সহজে না ভাঙে। পুরোনো বাড়িগুলোকে বিশেষভাবে সারানো হয়েছে যাতে ঐরকম দুর্যোগেও যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। মোটামুটি সব বাড়িই ৯ ম্যাগনিটিউডের ভূমিকম্পেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু ভূমিকম্পে যখন বাড়িগুলো দোলে বা থরথরিয়ে কাঁপে, তখন আলগা জিনিসপত্র টুপটাপ ধুমধাম পড়েই যেতে পারে, কি ইলেকট্রিকের লাইনে ধরে যেতে পারে আগুন। সেজন্য পইপই করে সাবধান করে দেয় বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি সুইচ অফ করতে না ভোলে যেন কেউ। আমার রুমমেট দুজন ইতিমধ্যেই কাচ টাচ সরিয়ে সব পরিস্কার করে ফেলেছে। ঘর গুছোতে গুছোতে প্রায় ভুলেই গেলাম প্রায় বিকেলের সেই অপমান। চিঠিতে দেশের খবর পাব ভেবেও মনে উত্তেজনা। তার ওপর কাল তো ইলেকশান। এখনো মনস্থির করতে পারছি না কাকে ভোট দেব। এরা এই ইলেকশান নিয়ে এত মেতেছে, এতটাই বাড়াবাড়ি করছে যেন জিততে পারলে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নয়, একেবারে ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট বনে যাবে। কী লাভ এসব করে? এদেশে ছাত্র ইউনিয়ন নেই, যেটা আছে সেটা হচ্ছে কমসামোল। আমরা তো বিদেশি— ফরেনার। ফরেনাররা তো আর দেশের অভ্যন্তরীণ পোলিটিক্সে ঢুকতে পারবে না, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে। যে জিতবে, মানে যে ছেলেটা প্রেসিডেন্ট হবে সে নিশ্চয় বাকি ইন্ডিয়ানদের ওপর খুব ফোপরদালালি করবে, মেয়েদের ওপর গার্জেনি ফলাবে। একটা মাসও কাটেনি তারই মধ্যে যা তিক্ত অভিজ্ঞতা হল। আবার মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে সাগরিকা বৌদির দুর্ব্যবহার। উনি কি সন্দেহ বাতিক গ্রস্থ? ভাবতে পারল কী করে যে আমার খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই ওর ঘরে গিয়ে দিনের পর দিন কাটানো ছাড়া? কি জানি, দিনের পর দিন সারাক্ষণ একটা ঘরে মধ্যে থাকতে থাকতে বাচ্চা কাচ্চার কাঁথা কাচতে কাচতে বাইরের জগতের সঙ্গে সেরকম কোন যোগাযোগ না থাকায় ওরকম হয়ে গেছে। ওর তো কথা বলবার লোক বলতে স্বামী এবং বুড়ি চৌকিদার। ক্লাসে যায় না, ছোটখাট চাকরি করবারও কোন স্কোপ নেই বিদেশিদের, সারাটা দিন বন্দি হয়ে রয়েছে ষোলো নম্বর হস্টেলের চারতলার কোণের একটা ঘরে। বৌদির ওপর রেগে যেতে পারি না, কেমন একটা মায়া হয়। মনে মনে ওকে ক্ষমা করে দিই। দেশে থাকতে সত্যিই সমাজটাকে চিনিনি। বিদেশে এসে চিনছি।
নাঃ, কালকে ইলেকশানে যেতেই হবে। মীনাক্ষি বলে মেয়েটা নিশ্চয় আসবে কাল। সবকটা ইন্ডিয়ানকে একসাথে দেখবার জন্য এর চেয়ে সহজ উপায় আর হতেই পারে না। কাল আমি যাবোই। ভুজগারাদোকের পঁচাশি নম্বর হস্টেলের একটা হলঘরে নির্বাচন কেন্দ্র। সেজেগুজে যাব।
রোববার দুপুরে দুজন ছাত্র আলাপ করতে এল আমার ঘরে। প্রথমে দেখে ভেবেছি বুঝি ইন্ডিয়ান, কিন্তু তারা পরিস্কার বাংলায় নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমার ভুল ভাঙালো। এরা বাংলাদেশি, একজন বলল, — আমার নাম দেবেশ, আমি হিন্দু, দেবেশ হালদার। অন্য জন্য বলে, —আমি নেসার খান। দেবেশ ভুজগারাদোকে থাকে, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, চোখে চশমা, হিন্দু হলেও সে পানি খেতে চায়। নেসার খান খুব জোরে জোরে হাসে, বাজখাঁই গলা, লম্বা ফর্সা, ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে। তার হস্টেল নাকি আমার এই হস্টেল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, ট্রলিবাসে মাত্র একটা স্টপ, হেঁটেও যাওয়া যায়। আমার কাছে বাংলা গল্পের বই টই কিছু আছে কিনা খোঁজ নেয় নেসার, আমি বই এনে দেখালে সে বেছে বেছে “শেষের কবিতা” টা ধার নিতে চায় যত শীঘ্র সম্ভব ফেরৎ দেবার অঙ্গীকার করে। দিয়ে দিই। এইটুকু কমিউনিটি, এ বই হারাবে না। বইটার মধ্যে আমার বাবার স্মৃতি রয়েছে, বাবা কিনেছিল বইটা তার কিশোর বয়সে। তবু দিলাম। নেসার বই নিয়ে চলে গেল, যাবার আগে নিজের নাম ঠিকানা লিখে দিল কাগজে, দেখি নামের বানান নেছার। ছ কেন? ওরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বলে, কেন ভুল কোথায়, ছ ই তো হবে। ওঃ আপনারা ক্যালকাটার বাঙালিরা এত কষ্ট করে করে বাংলা বলেন! দেবেশ আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে। আমার রুমমেট দুজনকে দেখে বলে, এরা ভিয়েতনামি নাকি? না, এরা লাওসের মেয়ে, ভিয়েতনামের কোনও মেয়ে নেই এই হস্টেলে অনেকগুলো ছেলে আছে। দেবেশ ভিয়েতনামিদের রাশিয়ান উচ্চারণ নকল করে করে শোনায়, কয়েকটা জোক বলে, সেসমস্ত জোক ব্যাকডেটেড, আজকের দিনে একদম রুচিসম্মত নয়। তাতে চেহারা উচ্চারণ নিয়ে বিদ্রূপ আছে, যৌন গন্ধও আছে যেমনটা চলত আশির দশকে। আমি বলেছিলাম যে সব ভিয়েতনামিরা কিন্তু একই রকম দেখতে নয়, কয়েকজন বেশ লম্বা চওড়া গায়ের রঙেরও তারতম্য আছে। দেবেশ জানায় তা তো হবেই, যুদ্ধের সময় জন্মেছে যারা তাদের কারও কারও শরীরে বইছে অ্যামেরিকান রক্ত। আরেকটু থেকে সে চলে যায়, যাবার আগে হাসিমুখে বলে, ভগবান হাফেজ।
আমার মনে পড়ে ছোটবেলা বাবা শিখিয়েছিল, আমার নাম তোমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। আমার প্রথম শেখা ছড়াগুলোর একটা এইটাই। কিছু বুঝতাম না তখন যুদ্ধ বিষয়ে, মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গল্প শুনে ভাবতাম একটা মাঠের মধ্যে গিয়ে সারাদিন সবাই খুব মারপিট করে, তাকেই বলে যুদ্ধ। ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হলে বাবা দেখিয়েছিল নারকেলের ফালির মত দেশটার ম্যাপ। একবার একজন জ্যাঠাগোছের ভদ্রলোক বেড়াতে এসেছিল বাড়িতে, তাকে ঐ “আমার নাম তোমার নাম”টা শুনিয়েছিলাম, সে আমায় শুধরে দিয়েছিল, —বলব নাকো বাপের নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।
তারপর খ্যা খ্যা করে খুব হেসেছিল। সেটা কি এই সব কারনেই? এখন তো বড় হয়েছি, কত কিছু শিখছি জানছি, কত দেশের মানুষজন চারপাশে। আজ জানলাম কিছু ভিয়েতনামির ধমনীতে বইছে অ্যামেরিকানের রক্ত। বাঃ। তার শরীরে আর এতটুকুও ভিয়েতনামের রক্ত অবশিষ্ট রইল না? তাদের মায়েদের রক্ত সব শুষে নিঙড়ে বের করে নেওয়া হয়ে গেছে? আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি। টের পাচ্ছি যে বড় হয়ে যাচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি, মেয়ে থেকে মহিলা বনে যাওয়া সম্ভবত একেই বলে।
ভোটের দিন বিকেলে একা একাই যাচ্ছিলাম নির্বাচন কেন্দ্রে, কিন্তু হস্টেলের বাকি দুজন ইন্ডিয়ান প্রায় জোর করেই তাদের সঙ্গে তুলে নিল আমায় ট্যাক্সিতে। ওরা সম্ভবত খবর পেয়ে গেছে যে আমি রঞ্জন কুমারের ভোটার। চাপা উত্তেজনায় কথা বেশি হয় না, ট্যাক্সি ড্রাইভাররা খুব আলাপি হয়, ড্রাইভারের নানা প্রশ্ন ও কৌতুহল নিরসন করতে করতে আমরা পৌঁছই গন্তব্যে। ট্যাক্সি থেকে নামবার সময় আমার সহযাত্রী অনিল অরোরা অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, স্কার্ট কিঁউ পহেনতি হো, সাড়ি নেহি হ্যায় ক্যা?
বিয়েবাড়ির মত সাজগোজ করে এসেছে সব, কেবল গয়নাগাটি বাদ। ভুরভুর করছে সেন্টের গন্ধ। বিকেল তিনটেয় ভোট শুরু হবার কথা। পঁচাশি নম্বর হস্টেলের একতলার হলঘরটায় প্রচুর চেয়ার পাতা। একদিকে ছোট একটা স্টেজের মত বানিয়েছে, নীচু স্টেজ। অধিকাংশ লোকজনই হস্টেলের বাইরে উঠোনে বাগানে ছোট ছোট জটলা করে রোদ পোয়াচ্ছে। আমি তো নতুন লোক, এরা সব কত বছর ধরে পরিচিত, বন্ধুত্ব শত্রুতা সমস্ত মিলিয়েই এরা নিজেদের মুখগুলো চেনে। কয়েকটা জটলার পাশ ঘেঁষে গিয়ে আবহাওয়াটা বুঝতে চেষ্টা করলাম, ভোট নিয়ে কথাই বলছে না কেউ, নভেম্বরে দিওয়ালি উৎসব হবে, সেই সব নিয়ে প্ল্যানিং চলছে। নভেম্বরে দিওয়ালি? তারমানে দুর্গাপুজো তো এসে গেল! মহালয়া হয়ে গেছে? নাকি দুর্গাপুজো চলছে এখন? এই প্রথম দুর্গাপুজো দেখা হল না, এরকম আরও কত বছর সামনে আছে কে জানে। দিওয়ালি মানে কালিপুজো, বাজিটাজি ফাটানো হয় কি এখানে? কোত্থেকেই বা পাবে এখানে বাজি। সাড়ে তিনটে বেজে গেল তা ও ভোট শুরু হয় না। প্রত্যেক প্রার্থীই নিজ নিজ দলের ভোটারদের জন্য আরও একটু অপেক্ষা করতে চায়। আরেকটু অপেক্ষা করবার পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট সবাইকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে হলঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। এক ফাঁকে রঞ্জন কুমার আমার কানে কানে বলে গেছে ভোটের পর যেন চলে না যাই, আজ সন্ধেবেলা পার্টি আছে। সবাই বসে পড়লে পরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রশান্ত নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে দেওয়ালির পার্টির দিনটা ঘোষণা করে দিল, তারপরে তিন ক্যান্ডিডেটের নাম ঘোষণা করা, একজন নাম প্রপোজ করছে, আরেকজন সেটা সেকেন্ড করছে, এইভাবে তিন প্রার্থীর নাম ঘোষিত হয়ে গেল, যথাক্রমে রঞ্জন কুমার, রবিশংকর ভেঙ্কটরমন এবং বলবন্ত সিং। বলবন্ত সিং এত মদ খেয়ে এসেছে যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, তাকে দুপাশ থেকে দুজন ধরে রেখেছে। সেরেছে! এ কোনও গোপন ভোট নয়, ওপেন সিস্টেম! নো ব্যালট পেপার, হাত তুলে ভোট দাও। আমার পাশে বসে আছে কামরুজ্জমান, সে ফিসফিস করে বলে দিল, রঞ্জনের নাম অ্যানাউন্স করলেই যেন হাত তুলি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রঞ্জনের নাম অ্যানাউন্স হয়ে গেছে, স্টেজে রঞ্জন দাঁড়িয়ে। অনেকেই হাত তুলল, আমি কোলের ওপর হাত জড়ো করে রেখেছি, কামরুজ্জমান দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করছে পাশে, —হাথ উঠাও, উঠাও!
যেন কিছু শুনতে পাইনি এমন মুখ করে অন্য দিকে চেয়ে আছি, সেদিকেও রঞ্জনের ভোটাররা হাত তুলে আমার দিকে তাকিয়ে। কোন দিকে তাকাবো? কয়েক মুহূর্তের জন্য সব দর্শক তাকিয়ে আছে এদিকেই, তাদের কারও হাত তোলা, কারও হাত নামানো, কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখছে। মনে হল যেন থিয়েটারের স্টেজের ওপর আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আছি, চোখের সামনে এই সব দর্শকদের আর দেখতে পাচ্ছি না, নাটক শুরু হয়ে গেছে, আশেপাশে লোকজন চেয়ার দেওয়াল সমস্তটাই অন্ধকার, সেই অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে নিজের রোলটা শুধু অভিনয় করে যেতে হবে, বাদবাকি পরে দেখা যাবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর ওরা হাত গুনতে শুরু করে দিল, এক দো তিন… তেইস, চৌবিস। আবার গোনা হল, …এক্কিস বাইস তেইস চৌবিস। রঞ্জনকুমার চব্বিশটি ভোট পেয়েছে, নাসির ও ভোট দিয়েছে তাকে। দ্বিতীয় ক্যান্ডিডেট রবিশংকর। আমি হাত তুললাম। সারা ঘরে সম্মিলিত আশ্চর্য হবার নিঃশ্বাস। একটু অপেক্ষা, আবার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অভিনয় করবার মত একটা মিনিট। মোট ভোট মাত্র চার। রবিশংকর নিজে এবং তার দুই সঙ্গী বাদ দিলে আমি একমাত্র যে তাকে ভোট দিয়েছি। তারপর তৃতীয় ক্যান্ডিডেট বলবন্ত সিং। বাকি হাতগুলো উঠল, আবার গণনা, এক দো তিন চার… বাইস তেইস চৌবিস পচ্চিস। আবার গোনা হল, পঁচিশ। মোট ভোটার সংখ্যা ছাপ্পান্ন, তিনজন অনুপস্থিত, ভোট দিয়েছে তিপ্পান্ন জন, রবিশংকর চার ভোট, রঞ্জন কুমার চব্বিশ ভোট, এবং বলবন্ত সিং পঁচিশ ভোট পেয়ে জয়ী। তাকে পাঁজাকোলা করে অভিষিক্ত করা হল। রঞ্জনের দল আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। চ্যাংদোলা করে বলবন্তকে হলের বাইরে নিয়ে যেতে না যেতেই চেয়ার ভাঙা শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি রবিশংকর আমার সামনে এসে হাসি মুখে ঝুঁকে বলছে, থ্যাংকিউ ভেরি মাচ, লেটস গো টু সেলিব্রেট। তাকে ইংরিজি বলতে শুনে একজন তারস্বরে চেঁচালো, — হিন্দি মে বোল সালে মাদার চোদ, রাষ্ট্রভাষা মে বোল! এরপর দুই দলে চিৎকার চেঁচামিচি, অনেক নতুন নতুন খিস্তি শেখা হল। আমাকে গার্ড করে সেখান থেকে বের করে নিয়ে, রবিশংকর ও আরো দুজন সোজা একুশ নম্বর হস্টেল।
এই হস্টেল যেমন রঞ্জনের তেমনি রবিশংকরেরও। দুজনেই হেরেছে, কিন্তু রবিশংকরের ঘরে তখন ক্রেটের পর ক্রেট ভোদকা ও পেপসি। পার্টি হবে। এর নাম পোলিটিক্স। রঞ্জন জিতে যেতে পারে জেনে বলবন্ত সিং এর উপদেষ্টা কমিটিও গোপন বৈঠক করে। সেখানে ঠিক হয় যে রবিশংকর তার ভোটারদের বুঝিয়ে বাঝিয়ে বলবন্তকে ভোট দিতে বলবে। এসব লাস্ট মোমেন্ট ডিসিশান, ভোটের আগের দিন এই সমস্ত ষড়যন্ত্র হচ্ছিল। রবিশংকর যে জিতবে না তা আগেই বোঝা গেছল, ও পেতে পারত শুধু সাউথ ইন্ডিয়ানদের ভোট, সেটা খুব বেশি নয়। কিন্তু বলবন্ত সেগুলো শিওর শট পেয়ে গেলে তার জয়ের পথ সহজ হয়। রবিশংকরের পক্ষে শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তাহলে রঞ্জনের দল সব জেনে যেতে পারত, শেষ মুহূর্তে মারপিট হয়ে গিয়ে ইলেকশানটাই ভণ্ডুল হয়ে যেত। বরঞ্চ এটাই ভাল, বলবন্ত প্রেসিডেন্ট এবং রবিশংকর ভাইস প্রেসিডেন্ট। বলবন্ত অধিকাংশ সময়েই মদ্যপান এবং আনুষঙ্গিক কাজে ব্যস্ত থাকে, ফলে মূল ক্ষমতা থাকবে রবিশংকরের হাতে।
রবিশংকরের ঘরে ভিড় হতে থাকে, সন্ধে হয়ে গেছে। ওরা আমাকেও অফার করে। স্ট্রং মদ ভোদকা, নীট। হাসি ঠাট্টা হৈ চৈ হচ্ছে, কিন্তু বলবন্তকে দেখা যায় না কেন? অনেকেই জানতে চায় বলবন্ত কোথায়? প্রশান্ত এসে খবর দেয়, বলবন্ত মত্ত অবস্থায় হস্টেলের সামনে থেকে একজন রাশিয়ান মেয়েকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছে। ওকে এখন ডিস্টার্ব করাটা কোন কাজের কাজ নয়। বিকেলের দিকে বিদেশিদের হস্টেলের গেটের সামনে সেজেগুজে মুখে রং মেখে অনেক মেয়েকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বুঝতে অসুবিধে হয় না প্রশান্তের কথা। আমি নর্থ ক্যালকাটার মেয়ে, সন্ধেবেলা খান্না সিনেমার উল্টো দিকে হরিসা’র বাজারের অন্ধকারে অমন রংমাখা মেয়ে ছোটবেলা অনেক দেখেছি।
একটু পরেই বোতল ভাঙার আওয়াজ। জয়ী ও পরাজিত দলের মধ্যে বোঝাপড়া, পেপসি ও ভোদকার বোতল যেই খালি হচ্ছে, অমনি সেগুলো ছুঁড়ে মারা হচ্ছে শত্রুপক্ষের দিকে। রঞ্জন কুমার একুশ নম্বরে ফেরেনি, সে রয়েছে অন্য কোথাও ঘাপটি মেরে, এবং সেখান থেকেই মেঘনাদের মত বোতল টোতল ছুঁড়ছে। রবিশংকরের দুই রুমমেট রামলিঙ্গম ও রামনারায়ন আমাকে এগিয়ে দিতে চলল ট্রলিবাস স্ট্যান্ড অবধি, বলা যায় না রঞ্জন যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, বডিগার্ড থাকলে ঝুঁকিটা কম। হস্টেল এলাকায় তুমুল বোতল বৃষ্টি চলছে। আমি আবারো মনে করি নর্থ ক্যালকাটার কথা, পাড়ায় পাড়ায় বোমাবাজি দেখে বড়ো হয়েছি, এরা বোতল ভেঙে আর নতুন কী দেখাবে। এক চুমুক ভোদকায় নেশা হয় না, কিন্তু মেজাজটা সব মিলিয়ে ফুরফুরে। দুই রামকে বডিগার্ড হিসেবে পেয়ে আমি মনে মনে বলছি, ক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম্, ক্ষিপ্ত তেজে মারো বোম্, ক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম্, লেফ্ট রাইট লেফ্ট রাইট, … মোট কথা ওরা যা আরম্ভ করেছে, তাতে আজ মিলিৎসিয়া** আসবেই।
টীকা:
* ডে-লাইট সেভিং: বছরের ঐ সময়ে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবারে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হতো। আবার মার্চের শেষ রবিবারে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে আনা হতো। শীতের মরশুমে রাতের অন্ধকার বেশিক্ষণ থাকে সেসব ভেবেই হিসেব টিশেব করে এই নিয়ম চালু হয়েছিল, কিন্তু ১৯৯১ এ দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পরে উজবেকিস্তান আর সময় পাল্টানোর ঝামেলায় যেত না।
** মিলিৎসিয়া: সোভিয়েত ইউনিয়নের পুলিশ।
চলবে…