ঠিক ১১ টা বাজলেই শব্দটা ছাদের দিকে থেকে আসে। কখনো কখনো ধুপ ধুপ, কেউ যেনো হাঁটছে। আবার কখনো দেওয়ালে খস খস শব্দ। কোনো কোনো দিন জানালার কাঁচে খুট খুট শব্দ। প্রথম প্রথম ছাদে কেউ মদ বিয়ার খাচ্ছে ভেবে রাকেশ ইগনোর করে যেত। কিন্তু কয়েকদিন ছাড়া ছাড়া একই ঘটনা। রাকেশ জানলা খুলে জোরে চেঁচালো- ছাদে কে রে? রোজ রোজ পুরো টাউনশিপ এর মধ্যে আমাদের ছাদটাই পাও পার্টি করার জন্য।
সব চুপ.. কারো কোনো সাড়া নেই।
- কী হলো কে ছাদে?
আর কোনো আওয়াজ হলো না।
দিন দুয়েক পরে আবার সেই ধুপ ধুপ দিয়ে শুরু, রাকেশ বলতেই চুপ, খানিক পরে ঠুক ঠুক শব্দ। এবার রাকেশ আর থাকতে না পেরে বাড়িতে থাকা শিলিগুড়ি থেকে নিয়ে আসা লম্বা ছাতা দরজা খুলে বলে।
- সালা কোন হারামী ছাদে পার্টি করবে। বাবার ছাদ পেয়েছিস রোজ রাত্রে।
বলতে বলতে পৌঁছে যায় সোজা ছাদে। দেখে ছাদের দরজা বন্ধ।
- এত স্মার্ট তোরা! ভেবেছিস একজন ছাদ থেকে এসে দরজা বন্ধ করে পালাবি। আমি শব্দ পাচ্ছি।
তারপর দরজা খুলে ছাদে যায়। গোটা ছাদে কেউ নেই। বোতল টোতল পড়ে আছে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে যেনো পুরনো বোতল। ইতি উতি এদিক ওদিক চিপস এর প্যাকেট পড়ে। রাকেশ একপ্রকার নিশ্চিত। সোসাইটির বখাটে ছেলেরা এসে ওর ফ্ল্যাট এর উপরে পার্টি করে।
পরদিন সকালে রাকেশ সোসাইটির সেক্রেটারি অলক বাবুকে কল করে। পুরো ঘটনাটা বলতে বলতে অলক বাবুর সাথে একচোট বাওয়ালও হয়ে গেলো। শেষমেষ ঠিক হলো, বিকালে সোসাইটির মিটিং বসবে।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রপে শেয়ার করে দেওয়া হলো আজ বিকালে মিটিং হবে। মোটামুটি ভাবে এখানে মিটিং মানেই সন্ধ্যার স্ন্যাকস টা ফ্রী হয়ে যায়। তাই মিটিং এ লোকের অভাব হয় না। আর সব সেক্রেটারি ই মোটামুটি চায় তার সময়কালে খাওয়া দাওয়া যেনো ভালো হয়, টাকা তো আর নিজের পকেট থেকে যাচ্ছে না।
সন্ধ্যাবেলার মিটিং, মোটামুটি ঘর ভর্তি লোক। অলোক বাবু এখন অফিস থেকে ফেরেননি আর এর মধ্যে লোকজন পিএনপিসি করছে। মিটিং হলটা তিন নম্বর টাওয়ার এর নিচে গ্যারেজ স্পেস ঘিরে দিয়ে বানানো। পাশেই বাউন্ডারি ওয়াল, ঐদিকে যে তেলে ভাজার দোকান আছে ওখানের নিতাই দা ব্যাগ নিয়ে ঢুকেছে সাথে চায়ের বড়ো ফ্লাস্ক, আজ বোধহয় কফি আছে, গন্ধ তাই বলছে।
মিটিং যে কারণে ডাকা সেই কারণটি ছাড়াও আরও নানাবিধ এসেনশিয়াল টপিক নিয়ে আলোচনা হলো। যেমন মাসিদের গেট পাস থাকবে কিনা, ৬ তলার ফ্ল্যাট থেকে নোংরা ছুড়ে বাইরে কে ফেলে দিচ্ছে, ৪ নম্বর টাওয়ার আর ৬ নম্বর টাওয়ার মাঝে কুকুরে বোস বাবুর কুকুর হেগে দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি...
শেষমেষ ঠিক হলো কয়েকদিন এর জন্য গেট এর দুজন সিকিউরিটির একজন রাকেশ এর বিল্ডিং এর সামনে রাত্রে থাকবে।
-আজ রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারা যাবে।
এই ভেবে রাকেশ বিছানা টিছানা ঝাড়ছে, এমন সময় আবার ছাদে ধুপ ধুপ। রাকেশ রেগে বোম, নিচে গিয়ে দেখে সিকিউরিটি ঘুমাচ্ছে। মনের সুখে হেব্বি ঝাড় দিয়ে দিল। তারপর সিকিউরিটি কে শুদ্ধু ছাদে গিয়ে দেখে কেউ নেই। সিকিউরিটি নিচে চলে গেলো, আর রাকেশ তার ফ্ল্যাটে। ওই রাত্রে তারপর আর কোনো শব্দ নেই।
পরদিন সকালে দোকানে গিয়ে ২ টা তালা কিনে ব্রিজের নিচের দোকান থেকে আরো সাতটা করে চাবি বানিয়ে সব ফ্ল্যাটে দুটো করে চাবি দিয়ে দিল। একটা চাবি নিচের গেটের আর আরেকটা ছাদের দরজার।
- যাক আর চাপ নেই। এবার ঘুমাবো।
সেদিন রাত্রে আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। তারপর দিনও তাই। গোল বাঁধলো দুদিন পরে।
আবারও সেই ধুপ ধুপ আর খস খস শব্দ। রাকেশ চুপ করে শুনে যাচ্ছে।
- একবার কি ছাদে গিয়ে দেখে আসবো!
বলে চাবি নিয়ে ছাদের দরজা খুলে এদিক ওদিক তাকাতেই কার্নিশ এর ধারে একজন কে দেখা যায়। ছাদের ল্যাম্পটা বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। মোবাইল এর আলো জ্বেলে বোঝার চেষ্টা করে এটা কে? -নিচের গ্রিল এ তো তালা বাইরের কেউ তো ঢুকতে পারবে না। তাহলে কি বিল্ডিং এর কি কেউ আমার সাথে বদমাইশি করছে?? দেখি তো কে।
আস্তে আস্তে সামনে পৌঁছায় রাকেশ। হঠাৎ লোডশেডিং। মোবাইল এর ফ্ল্যাশ লাইট টাও কিরকম আসতে করে কমে আসছে। কি যেনো একটা ধাক্কা লাগল। রাকেশ পরে গেলো ছাদের উপরে। মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। নাকে নতুন রঙের মিষ্টি গন্ধ। ঝুপ করে একটা শব্দ কানে এলো। দেখে পাশে এক ছেলে বসে আছে। মাথার খুলির পাস দিয়ে রক্ত বইছে। চোখ লাল, আর জামাকাপড় যা পরে আছে তাতে বিভিন্ন রং লেগে আছে। রাকেশ এর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
রাকেশ এর গলা শুকিয়ে আসছে। জ্ঞান হারাবে হারাবে এমন সময় ছেলেটা বলে ওঠে
- বাবু সেদিন তুমি বলেছিলে সেফটি বেল্ট পরার কথা। আমরা তোমার কথা শুনে হেসেছিলাম। বলেছিলাম ওরকম কত বড় বড় বিল্ডিং রং করে দিলাম, কিছু হয়নি। তোমাদের ওই পুঁচকে বিল্ডিংয়ে কি হবে!! তখন কিছুই হয়নি। কিন্তু হপ্তা দুয়েক আগে তোমাদের মত একটা বিল্ডিং এ রঙ করতে গিয়ে দড়ি ছিড়ে পড়ে আমি মারা গেছি। তোমাকে Thank You বলতে এসেছিলাম।
*সৌরভ মাজি*
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।