এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গল্পঃ চিৎকার 

    Muradul islam লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ নভেম্বর ২০২১ | ৭৮১ বার পঠিত
  • আবছা অন্ধকারে, রূপালী জ্যোৎস্নায় স্নাত বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন দমকা এক ঠাণ্ডা বাতাস এসে প্রবেশ করল গোলাম নবীর ভেতরে, সে বাতাসের তেজে গোলাম নবী স্থির থাকতে পারল না, তার পা টলে গেল, মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সে দু হাত দিয়ে মাথার দু'পাশে চাপ দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল এবং প্রায় এক মিনিটের মত চোখ বন্ধ করে রইল ধাতস্থ হতে। 
     
    এক বছরের শিশুপুত্র বিকাশকে কোলে নিয়ে পাশে তার স্ত্রী রাহেলা, স্বামীর এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? 
     
    গোলাম নবী উত্তর দিল, কিছু না। 
     
    সে চারিদিকে তাকিয়ে বাড়িটাকে দেখতে লাগল। তিনদিকেই চৌচালা ঘর, মাঝখানে উঠান। 
     
    অন্ধকারের ভেতরেই বাড়ির মলিনতা গোলাম নবী অনুভব করতে পারল। কিন্তু সেদিকে তার লক্ষ নেই। তার মনে পড়ছে কত শত স্মৃতি। কত সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা রোমাঞ্চের স্মৃতি তার এই বাড়িকে ঘিরে। এতদিন আমেরিকায় থাকার কালে এতো তীব্রভাবে পুরনো দিনের কথা মনে হয় নি, এখন যেমন মনে হচ্ছে গোলাম নবী সরাসরি এসে দাঁড়িয়েছে তার অতীতের সামনে। অতীতের ঝাপসা আয়নালোকের ভেতর থেকে হাত নেড়ে তাকে ডাকছে আরেক গোলাম নবী, যে দাঁড়িয়ে আছে এক কালো নৌকার গলুইয়ে, আর নৌকা ধীরে ধীরে ঝাপসা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। গোলাম নবী অতীতের আহবান, উপস্থিতির ঘোষণা, ধরেও পুরোটা ধরতে পারছে না। 
     
    রাহেলা বলল, দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাউকে ডাকো। 
     
    গোলাম নবী ডাকল, বাড়িতে কেউ আছেন? 
     
    কোন সাড়াশব্দ নেই। 
     
    কয়েকবার ডাকলো সে। 
     
    কিন্তু ডাকগুলো যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, কেউ প্রতিউত্তর করল না। 
     
    রাহেলা তখন বলল, ঠিকঠাক চিনে এসেছ তো? আশপাশে কাউকে তো দেখছি না। 
     
    গোলাম নবীর শিশুপুত্র বিকাশ মায়ের কোলে কেঁদে উঠল। সেই কান্নার শব্দে বা অন্য কোন কারণে এক ঝাঁক পাখি বা পাখির মত কিছু একটা উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে, গোলাম নবী ও রাহেলা দুজনই টের পেলো। 
     
    গোলাম নবী হাত ঘড়িতে সময় দেখল আট টা বাজে। রাত বেশি না, কিন্তু গ্রামে এই রাতই অনেক রাত।
     
    কিছুটা ভয় ভয় অবস্থা নেমে আসছে বুঝতে পেরে গোলাম নবী সবকিছু ঝেড়ে ফেলার মত করে বলল, চিন্তার কিছু নাই। বাড়িতে জয়েনুদ্দিন চাচা আছেন আমি খোঁজ নিয়ে এসেছি। বুড়া মানুষ হয়ত শুনতে পাচ্ছেন না। 
     
    এই কথা শেষ হবার পরেই দেখা গেল এক কোনের ঘরের দরজা খুলে গেছে, এবং একজন কুঁজো লোক হারিকেন হাতে বেরিয়ে এসেছেন। 
     
    গোলাম নবী তার দিকে এগিয়ে গেল।
     
    বুড়ো লোকটি জিজ্ঞেস করল, কেডা? আপনেরা কেডা? 
     
    গোলাম নবী বলল, চাচা আমি। আমি গোলাম নবী। 
     
    বুড়ো লোকটি হারিকেন সূতা উঠিয়ে উঁচিয়ে ধরল গোলাম নবীর মুখের দিকে। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। 
     
    এরপর বলল,  ছোটমিয়া, আপনে এতদিন পরে কই থেকে আসলেন? 
     
    বুড়ো লোকটির মুখে যুগপৎ হাসি এবং বিস্ময়ের খেলা দেখা গেল হারিকেনের আলোতে। 
     
    গোলাম নবী বলল, চাচা আমি তো আমেরিকা গেছিলাম, এর পরে আর আসি নাই। এইবার বাড়ি দেখতে আসলাম। আপনে কেমন আছেন? 
     
    বুড়ো জয়েনুদ্দিন বললেন, আছি বাবা, ভালো আছি। 
     
    রাহেলা এগিয়ে আসল। 
     
    গোলাম নবী পরিচয় করিয়ে দিল, চাচা, এই আমার বউ, আর এইটা আমার পোলা। বিকাশ। 
     
    জয়েনুদ্দিন দুজনকেই দেখলেন। হারিকেন উঁচিয়ে বাচ্চাটার মুখ দেখে বললেন, বড় মিয়ার মত হইছে দেখতে। 
     
    জয়েনুদ্দিন গোলাম নবী ও রাহেলাকে একদিকের একটা ঘর খুলে দিলেন। ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে দিলেন। অনেকদিন বন্ধ থাকায় জায়গায় জায়গায় ধুলা জমেছে। 
     
    মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, ছোটমিয়া, ঘরবাড়ি ঠিকমত দেইখা রাখতে পারি না আগের মত। বয়েস হইছে। মাফ কইরা দিও। 
     
    গোলাম নবী তাকে আশ্বস্থ করল, না চাচা, এইটা তো আমি বুঝি। এত বড় বাড়ি আপনে এখন দেইখা রাখবেন কেমনে। আমরা ঝাইড়া মুইছা থাকার ব্যবস্থা কইরা নিব। একসময় এই বাড়ি যখন ভইরা আছিল মানুষে, তখন কিন্তু আপনেই সব দেইখা রাখছিলেন। কিছুই ভুলি নাই চাচা। 
     
    কথা শুনে জয়েনুদ্দিনের চোখ চক চক করে উঠে। 
     
    জয়েনুদ্দিন বলেন, তোমরা এইখানে আরাম করো, এত রাস্তা বাইয়া আইছো। আমি পানি আইনা রাখতেছি, হাত মুখ ধুইয়া আরাম করো। আমি ভাত চুলায় দেই গিয়া। 
     
    রাহেলা বলল, চাচা আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিন, আমি রান্না করে নিতে পারব। 
     
    জয়েনুদ্দিন হাসলেন, সেইটা কালকে হবে আম্মা। আপনেরা এই ঘরের পিছেই রানতে পারবেন। আমি রান্ধি আমার ঘরের পিছের ঘরে। আইজ দুইটা ডিম ভাইজা, গরম ভাত দিতে পারব না, এত বুড়া হইয়া যাই নাই। 
     
    জয়েনুদ্দিন চলে গেলেন। 
     
    তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে গোলাম নবী এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। 
     
    বলল, এই লোক একসময় মারাত্মক ছিল। আমার বাবার সব ভালো খারাপ কাজের প্রধান ছিল সে। আজ দেখো, কীরকম নুয়ে পড়েছে। এই বাড়িটার মত। একসময় মানুষে গম গম করত এই বাড়ি। বাবার প্রকাণ্ড চিৎকারে সকাল বিকাল প্রকম্পিত হত। কিন্তু আজ সকলই নিস্তব্দ। বাড়ির লোকেরা একেকজন একেক দেশে। বাবা মা মারা গেছেন তাও প্রায় বিশ বছর। মানুষ, প্রভাব প্রতিপত্তি চিরদিন থাকে না। 
     
    রাহেলা বলল, দেখো, বাইরে কেমন জ্যোস্না। 
     
    গোলাম নবী বাইরে তাকাল, মনে হচ্ছে জ্যোস্না বেড়েছে। 
     
    সে রাহেলাকে বলল, তুমি বিশ্রাম নাও, আমি বাড়িটা ঘুরে দেখে আসি। 
     
    গোলাম নবী বাড়ি দেখতে বের হল জ্যোস্নালোকিত নিরালা রাতে। যে বাড়ি সে ছেড়ে গিয়েছিল ত্রিশ বছর আগে। ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জের ধরে বাবা তাকে বাইরে পাঠিয়ে দেন। 
     
    অনেক কিছুই তার আজ মনে নেই। 
     
    উঠানে হাঁটতে হাঁটতে এক কোণে থাকা কুয়োতলার দিকে গেল সে। ওখানে একজন মানুষের ছায়ার মত দেখা গেল। 
     
    দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল গোলাম নবী। কুয়োতলা আগের মত নেই। পুরনো কুয়ার পাশে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। সেখানে পানি নিতে এসেছে যে, তার অবয়ব দেখে গোলাম নবীর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। 
     
    হাসনাবানু গোলাম নবীকে দেখে ফিক করে হেসে দিল। 
     
    বলল, ছোটমিয়া এতদিন পরে আইছেন শুনলাম? আছেন কেমন? 
     
    গোলাম নবী বলল, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বানু? 
     
    হাসনাবানু হেসেই উত্তর দিল, আছি, ভালোই আছি। 
     
    হাসনাবানু চেহারায় বড় কোন পরিবর্তন দেখতে পেল না গোলাম নবী। ত্রিশ বছর আগের চেহারার সাথে কি মিল। তবে বয়স হয়েছে বুঝা যাচ্ছে শরীরের গড়ন গাড়নে। 
     
    গোলাম নবী এরপর কী বলবে ভেবে পেল না। যে অপরাধবোধকে সে ভুলে থেকেছে, সচেতনে কোনভাবেই মনে করতে চায় নি, সেই অপরাধবোধ আজ তার সামনে ডানা বিস্তারি ড্রাগনের মত এসে দাঁড়াল। গোলাম নবীর একসময় ইচ্ছা হল দৌড়ে চলে যাবার, কিন্তু সে পারল না। তার পা যেন অবশ হয়ে আছে, হাসনাবানু স্থিরভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। 
     
    হাসনাবানু জিজ্ঞেস করল, চুপ হইয়া গেলেন যে? কী করতে আইছেন? 
     
    গোলাম নবী বলল, কী করতে আবার, এই বাড়ি গ্রাম দেখতে আসলাম। 
     
    হাসনাবানু ফিক করে হাসল। বলল, আপনে এখনো মিছা কথা কন ছোটমিয়া। তয় পারেন না কইতে। মিছা কতা কইবেন জোর দিয়া, নাইলে কি মানুষ মানব? 
     
    গোলাম নবী বলল, মিথ্যা কেন হবে? গ্রাম দেখতে আসা যায় না? 
     
    হাসনাবানু স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল, আপনে আইছেন বাড়ি বেঁচতে। 
     
    গোলাম নবী প্রসঙ্গ পালটাতে বলল, চাচার কি শরীর ভালো? অনেক বুড়া হয়ে গেছেন। 
     
    হাসনাবানু বলল, হইবেন না, দিন তো বইসা নাই ছোটমিয়া। 
     
    রাহেলা যে ঘরে ছিল শিশুপুত্র বিকাশকে নিয়ে, সেখান থেকে বিকাশের কান্নার শব্দ শোনা গেল। 
     
    এই সুযোগে গোলাম নবী ভাবছিল হাসনাবানুর সামনে থেকে সরে যাবে, কিন্তু হাসনাবানু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, আপনের পোলারে দেখাইবেন না? আপনের পোলা কি আপনের মতই সুন্দর? 
     
    গোলাম নবী হ্যাঁ এবং না এর মাঝামাঝি একটা শব্দ করে বলল, আমি এখন যাই, এবং সে চলে যেতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই হাসনাবানু বেশ জোরালো কণ্ঠে বলল, খাড়ান, শুইনা যান। 
     
    গোলাম নবী দাঁড়াল। 
     
    হাসনাবানু বলল, আপনেরে এই কতাগুলা কোনদিন বলা হয় নাই। আইজ বইলা নেই। পোলা মাইয়া হওনের সময় যে চিক্কর পাড়ে হুনছেন? 
     
    গোলাম নবী বলল, হ্যাঁ। 
     
    হাসনাবানু বলল, সেই চিক্করে সে জানান দেয় দুইন্যাতে আসছে। মারে জানান দেয় আইছি আমি। আপনের বউরেও এইভাবে জানান দিছে আপনের পোলা। জানেন? 
     
    গোলাম নবী বলল, হ্যাঁ। 
     
    হাসনাবানু বলে, তয় কিছু মা পোলা মাইয়ার জায়গায় খালি চিক্কর জন্ম দেয়। তারা চিক্করটা হুনে, কিন্তু পোলা মাইয়ারে দেখে না। পরে, পুরা জীবন ধইরা এই চিক্কর মায়ের লগে লগে থাকে। এই যে আপনার পোলা কাইন্দা উঠল, এইটা আমার জনম দেয়া চিক্করটার মত। এত মিল। আপনের পোলার বয়েস কত? 
     
    গোলাম নবী আর দাঁড়িয়ে থাকল না। হন হন করে হেঁটে সরে পড়ল। যেতে যেতে শুনল পেছনে হাসনাবানু ফিক করে  হাসছে। 
     
    গোলাম নবী বাড়িটাকে একবার ঘুরে দেখার পর ঘরে গেল। বিকাশ ঘুমিয়ে গেছে, তার মুখে নিঃশব্দ হাসি খেলা করছে, শিশুর দেয়ালা। উঠানে, ঘরের সামনে বালতিতে করে পানি রেখে দেয়া হয়েছে। 
     
    গোলাম নবী হাতমুখ ধুয়ে ভেতরে গেল। 
     
    সে ভেতরে ঢুকলে রাহেলা বলল, জয়েনুদ্দিন চাচা এসেছিল, ভাত নিয়ে আসছে। 
     
    একটু পরে জয়েনুদ্দিন ভাত ও ডিম ভাজি নিয়ে এলেন। 
     
    গোলাম নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল তখন। তার মনে হচ্ছিল রাহেলাকে এখানে নিয়ে আসা ঠিক হয় নি। হাসনাবানু যেরকম কথাবার্তা বলেছে, তার ভাবভঙ্গী বিশেষ সুবিধার না। রাহেলার সাথে কথা হলে কখন কী বলে ফেলে তার ঠিক নেই। 
     
    এই বিষয়ে গোলাম নবী যে আগে ভাবে নি তা নয়। কিন্তু তার মনে হয়েছিল, হাসনাবানু এতোটা সাহসী হয়ে উঠবে না। অন্যদিকে রাহেলাকে না নিয়ে আসার কোন উপায়ও ছিল না। রাহেলা নিজের কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছে সংসার করার জন্য, এবং এ নিয়ে গোলাম নবী প্রত্যক্ষ পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করেছিল। ফলশ্রুতিতে এখন রাহেলার অনেক আবদারই রাখতে হয়। 
     
    খাওয়ার সময় জয়েনুদ্দিন পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন। গোলাম নবী তাকে হাসনাবানু বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না। রাহেলার সামনে এ নিয়ে কথা বলা যাবে না।  পরে জয়েনুদ্দিনকে বলে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে রাহেলার সাথে হাসনাবানুর কথা না হয়। 
     
    খাওয়া শেষ হলে, যখন এঁটো প্লেটগুলি জয়েনুদ্দিন একা নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন রাহেলা গোলাম নবীকে বলল, তুমি একটু সাহায্য করো না। 
     
    গোলাম নবী প্লেট ইত্যাদি নিয়ে জয়েনুদ্দিনের আগে আগেই রান্না ঘরে গেল। 
     
    গিয়ে দেখল হাসনাবানু কিছু একটা কুটছে। গোলাম নবী তাকে দেখে কিছু বলল না, দ্রুত ফিরে চলে যাচ্ছিল। 
     
    পেছন থেকে হাসনাবানু ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ছোটমিয়া, আপনের পোলারে দেখাইবেন না? 
     
    ওই ঘরের সামনে বুড়ো জয়েনুদ্দিনের সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল গোলাম নবী। গোলাম নবী তাকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল, লোকটার চোখ লাল হয়ে আছে। 
     
    গোলাম নবী গাম্ভীর্য রেখে প্রশ্ন করল, চাচা বানুর কি বিয়া দিছিলেন? 
     
    জয়েনুদ্দিন জ্বলজ্বলে চোখে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন গোলাম নবীর দিকে। শান্তভাবে বললেন, ঘরে যাও, বাপ। 
     
    গোলাম নবী ফিরে গেল ও রাহেলার সাথে ঘরে বসে গল্প করতে শুরু করল। এই বাড়ি নিয়ে গল্প। 
     
    রাত যখন গভীর হয়ে উঠল তখন থইথই জ্যোৎস্না নামল বাড়ির উঠানে। থেমে থেমে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, সাথে হালকা বাতাস। 
     
    রাহেলা বলল, চলো বাইরে থেকে হেঁটে আসি। 
     
    গোলাম নবী বলল, কিন্তু বিকাশ? 
     
    রাহেলা বলল, আরে আমরা তো উঠানেই যাচ্ছি। দরজা খোলা রেখে যাব। বিকাশ উঠলে এমনিতেই কান্না করবে। 
     
    হাতে হাত রেখে গোলাম নবী ও রাহেলা যখন চাঁদের রুপালী আলোর ভেতরে হাঁটছিল, এক অসাধারণ প্রেমঘন চিত্রের অবতারণা হলো তখন। তারা বাড়ির গল্প থেকে তাদের প্রথম দেখা হওয়া, প্রেম, অভিমান ইত্যাদি গল্পের মধ্যে ডুবে যেতে থাকল। 
     
    কুয়োতলা থেকে তাদের দেখছিল এক ছায়ামূর্তি, তারা দেখে নি। 
     
    হাঁটতে হাঁটতে কুয়োতলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তারা, ওদিকের কোনায় জবা ফুল গাছ। রাহেলা ফুল গাছের দিকে এগিয়ে গেল যখন, গোলাম নবী স্পষ্ট শুনলো, কুয়োতলা থেকে হাসনাবানু বলছে ফিসফিস করে, আপনার পোলাটা সুন্দর আছে। 
     
    গোলাম নবীর রক্ত হিম হয়ে এলো। 
     
    সে সচকিত হয়ে কুয়োতলার দিকে তাকাল। কেউ নেই। সে ভাবল, এ কি তবে তার মনের ভুল? 
     
    কিন্তু গোলাম নবী দেরী করল না। একরকম টেনে রাহেলাকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসল। 
     
    এবং দেখল বিছানায় বিকাশ নেই। 
     
    রাহেলা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল। 
     
    গোলাম নবী জয়েনুদ্দিনকে ডাকতে শুরু করল। 
     
    বুড়ো জয়েনুদ্দিন বের হয়ে আসলেন ঘর থেকে। 
     
    কী হইছে ছোট মিয়া? 
     
    ভকভক করে গন্ধ বের হল তার মুখ থেকে। চোখ দুটি লাল। 
     
    গোলাম নবী নিজেকে সামলে বলল, বিকাশ নেই। ঘরে রাইখা গেছিলাম আমরা, এখন আইসা দেখি নাই।
     
    জয়েনুদ্দিন বুকে ফু দিলেন। 
     
    আস্তাগফিরুল্লাহ, এইটা কী কন ছোটমিয়া? 
     
    রাগ ধরে রাখতে পারে না গোলাম নবী। 
     
    সে চিৎকার করে বলে, দেখো চাচা, এইটা বানু করছে। সে আমারে বার বার কইছে আজ আমার পোলারে দেখতে চায়, আমি ঐসময়ই বুঝছিলাম কিছু একটা করতে পারে। আর তোমার যদি এইখানে কোন হাত থাকে, ভালো হইব না কিছু! 
     
    বুড়ো জয়েনুদ্দিন বলেন, এইডা কী কন ছোটমিয়া? 
     
    তেড়ে এগিয়ে যায় গোলাম নবী, বানু আমার ছেলেরে নিয়া গেছে। 
     
    জয়েনুদ্দিন বলেন, মাথা ঠাণ্ডা করেন ছোটমিয়া। 
     
    গোলাম নবী মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে না। ঠাশ করে চড় কষিয়ে দেয় বুড়ো জয়েনুদ্দিনের গালে। জয়েনুদ্দিন ছিটকে পড়েন। 
     
    গোলাম নবী চিৎকার করে বলে, আমার ছেলে কই বল? খুন করে ফেলব শুয়ারের বাচ্চা। 
     
    বুড়ো জয়েনুদ্দিনের লাল লাল চোখের  স্থির দৃষ্টি গোলাম নবীর দিকে। আগুন যেন ঠিকরে বের হচ্ছে তার চোখ থেকে। 
     
    বাম গালে ডান হাত ঘষে, মুখে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ফুটিয়ে বুড়ো জয়েনুদ্দিন বলেন, কোন ছেলের কথা কন ছোটমিয়া? আপনের কোন ছেলের খবরই আমি জানি না। আর আমার মেয়ে বানু? মইরা গেছে ৭ বছর আগেই। সে চিক্কর শুনতো, আপনের প্রথম পোলার চিক্কর। বানুর সাথে কি আপনের দেখা হইছে? হা হা হা। 
     
    উন্মাদের মত হাসিতে ফেঁটে পড়ে বুড়ো জয়েনুদ্দিন। মাটিতে গড়াগড়ি খায়, হাসে আর কাঁদে। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একক | ১৯ নভেম্বর ২০২১ ০০:৪০501295
  • বাহ!!  
  • কেলে কাত্তিক | 2401:4900:1047:66dc:0:6a:7b5:***:*** | ১৯ নভেম্বর ২০২১ ০১:২২501296
  • লেখনী ভালো। তবে খুবই পেডিক্টেবল। শেষের দিকে 'মইরা গেছে সাত বছর আগে' এসব আন্ডারলাইন করে না বললেও চলত। তাতে সূক্ষ্মতা বজায় থাকত।
    কিন্তু 'ঘুমিয়ে গেছে' কী! গাঁ গঞ্জের লোকেরাও ইদানিং হিন্দিতে বাংলা বলছে নাকি! 
    আর তাড়না ও অবতারণায় কোনও সরাসরি যোগ নেই। 
     
  • :|: | 174.255.***.*** | ১৯ নভেম্বর ২০২১ ০১:৩৫501297
  • জ্যোৎস্না। এইটুকু ঠিক করে দিলে ভালো হয়। শব্দটা এতো বেশীবার ব্যবহার হয়েছে যে বানানটা খুবই চোখে লাগছে। বাকিটা মন্দনা! 
  • Muradul islam | ১৯ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৩৭501298
  • কেলে কাত্তিক এবং :|: | 
     
    >>
    বানানোগুলি ঠিক করলাম। ধন্যবাদ। 
  • কেলে কাত্তিক | 2401:4900:1046:660:0:48:9a09:***:*** | ২০ নভেম্বর ২০২১ ১৪:৩২501334
  • প্রেডিক্টেবল*
     
    জ্যোস্না তো কনসাসলি লেখা হয়েছে ভেবেছিলুম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন