স্কুল যাওয়ার সময় খড় বাঁধা থেকে শুরু করে দেখতে পেতাম। কিংবা বাইরে বেরুলেই দেখতাম পুজোর মাস দেড়-দুই আগে থেকে— একমেটে, দু’মেটে...।
বাড়ির পাশেই বারোয়ারী দুর্গাদালান। অথচ কখন যেন মৃৎশিল্পীরা খড়ি মাখিয়ে চলে যেতেন! তারপর থেকে রোজ অপেক্ষা করে থাকতাম কবে রং করতে আসবেন। রং এর দিন থেকে শুরু হতো আমাদের হৈ চৈ খেলা। সেদিন থেকে শুরু করে আমরা পাড়ার ছোটরা সবাই সারাক্ষণ দুর্গাদালানেই হৈ চৈ করতাম। শুধু পাড়াই নয়, গ্রামে একটাই পুজো। বড়োরাও থাকতেন। আমরা ছোটরা কত রকম নতুন নতুন খেলা আবিস্কার করে খেলতাম। কখনো কখনো পাড়ার বড়োদের বকাও খেতাম।
রং করা থেকে শুরু করে মূর্তি সাজানো দেখা, সে এক অন্য রকম মজা! আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম— এইবারে কার্তিকের ময়ুর সাজানো হবে, এই অসুরের গোঁফ লাগানো হচ্ছে। দুর্গার হাত থেকে সাপটা অসুরের গায়ে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা রং হচ্ছে। ওটা কি সাপ? এই নিয়ে চলতো নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক। সবার তর্কাতর্কি হৈ চৈ এর মাঝে আমি কখনো কখনো চুপচাপ আগ্রহ নিয়ে দেখতাম কিভাবে সাজানো হচ্ছে। বাড়িতে এসে আঁকতাম। আবার অনেক সময় পাড়ার দু-একজন বন্ধুকে ডেকে নিয়ে মাটির মূর্তিও বানাতাম।
পুজোর প্রায় এক সপ্তাহ আগেই আমাদের ঠাকুর রেডি হয়ে যেত। শিল্পীরা রেডি করে চাপাচুপি দিয়ে চলে যেতেন। এরপর আর পড়াশোনায় মন থাকতো না। তারপরেই একদিন সকালে স্কুল হয়ে ছুটি পরে যেত। পুজোর ছুটি! মহানন্দে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতাম। একটা মুশকিল ছিল— পুজোর ছুটির তিরিশ পাতা হাতের লেখা আর একগাদা অঙ্ক পড়া নিয়ে। যাই হোক পুজোর কটা দিন বইপত্র ছোঁয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। সেই যে ষষ্ঠীর দিন সকালে বইপত্র নিয়ে নাম মাত্র বসতাম বড়োদের সম্মানার্থে, তারপর ব্যাস এক্কেবারে দশমী পর্যন্ত পড়াশোনা বন্ধ। বড়োরা কেউ পড়তে বসার কথা পুজোর চারদিন বলতেনও না।
ষষ্ঠীর রাতে পাড়ার বড়োদের মধ্যে কারা যেন দুর্গাদালানটা সাজিয়ে ফেলতেন। কারা সাজাতেন কিছুতেই জানতে পারতাম না সেই সময়। সপ্তমীর ভোরে ঘুম ভেঙে যেত। তারপর দাঁত মেজেই আগে একবার দেখে আসতাম দুর্গাদালানটায় কে কে আছেন। চমকে যেতাম দালানটা সাজানো দেখেই।
তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। পুজোয় জেনারেটরের আলো জ্বলতো। মণ্ডপের সামনেটাই ইঁটের রাস্তা, তিন মাথা মোড়। তিনটে রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত শুধু টিউব লাইটের আলো। আলোকিত হয়ে থাকতো সন্ধে থেকে। বারোয়ারী থেকে প্রতি বছর আমাদের সদরদুয়ারে একটা ল্যাম্প লাগিয়ে দিতেন। সেখানে বড়োরা ক্যারাম খেলতেন। কখনো বড়োদের একজন কম থাকলে আমাকেও খেলতে বলতেন কেউ না কেউ। খেলতে না পারলেও ভাল্লাগতো। গ্রামের কেউ পর ছিলেন না, সবাই আপন। পুরো গ্রামটাই একটা পরিবার হয়ে একসঙ্গে মেতে থাকতেন পুজোর ক'টা দিন। অষ্টমীর দিন ভীষণ রকম ভিড় হতো। সবাই অঞ্জলি দিতেন আমি কখনো অঞ্জলি দিইনি। আমার হৈ চৈ আনন্দটাই ভাল্লাগে। ক্যাপ আর বন্দুক নিয়ে কিভাবে যেন চারটে দিন কেটে যেত! নবমীর রাত থেকেই মন খারাপ হয়ে আসতো। এইদিন রাতে মাতিয়ে রাখতেন ঢাকিরা। তাঁরা ঢাকের সঙ্গে অসামান্য নৃত্য করতেন। এই ভাবেই কেটে যেত নবমীর রাত।
সেই গ্রাম ছেড়ে কবেই চলে এলাম নতুন বাড়িতে। কিন্তু পুজো এলে সবকিছু ছেড়ে এখনো ইচ্ছে করে একবার বেড়িয়ে আসি আমার সেই মন খারাপ করা গ্রামটায়। ছোটবেলার পুজোই ভাল ছিল। তখন থিম ছিল না, এখন থিম হয়। থিম, নতুন নতুন শিল্প ভাবনা ভীষণ রকম ভাল্লাগে। কিন্তু সেই আনন্দ হারিয়ে গেছে! এখন মনে হয় পুজো এলে একলা একলা নির্জন কোনো জায়গায় বেড়াতে। কিন্তু কোথায় সেই নির্জন! আর কোথাতেই বা যাব?
—সুবিমল
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।