আমার বন্ধু প্রতীক সাইফুল। কবিতা লিখত। গল্পও লিখেছে বেশ কিছু। কোনো বই নেই।
ঢাকার চারুকলা থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী পাশ করেছিল। আমাদের মধ্যে প্রতীকই প্রকৃত লেখক হয়ে উঠেছিল। ওর বাবা ছিল কবি। নাট্যকার। কালিবাড়ির পুকুরের উপর ছিল ওদের বাসা। সামনে ছিল কবির চেম্বার। ছিল মৌমাছির চাক। বাবুই পাখির ঘর। পাখির পালক। কয়েকটা মানিপ্লান্ট। আর বিড়াল। কয়েকটি ক্যাশ বই। তাতে লেখা নাক্সভমিকা আর নানারকম পদ্য।
ওদের বাড়ির বারান্দা থেকে বড়শি পেতে মাঝে মাঝে পুকুর থেকে মাছ ধরেছি।।
এই চেম্বারে বর্ণির বাওড় থেকে আবুল হাসান এসে বসে থাকতেন। সদ্য লেখা কবিতা শোনাতেন। পরে রাজা যায় আসে, পৃথক পালঙ্ক, যে তুমি হরণ করো নামে তাঁর তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়।তিনি আমার প্রিয় কবি।
প্রতীক আর আমি হেঁটে হেঁটে সারা শহরটা ঘুরে বেড়াতাম। শহরের প্রতিটি বাড়িঘর গাছপালা মানুষজনকেই চিনতাম। প্রতীক কবিতা পড়ে শোনাত। পরে রূপোলী ফিতে নামে কবিতার একটি ভাঁজপত্রও বের করি দুজনে। ছাপা খরচ ছিল দশ টাকা। এই দশ টাকা দিতেন স্বপন চৌধুরী। জনতা ব্যাংকে চাকরি করতেন। বিনিময়ে তার কবিতাও ছাপাতে হতো। আমরা দেশের নানা কবিদের কাছে ডাকে পাঠাতাম।
মীরাপিসির কাছ থেকে নিয়ে দুজনে ভাগ করে পড়ছি মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে। ভিক্টর হুগোর দি হ্যাঞ্চ অব নতরদ্যাম। দুজনে গ্রীঞ্জোরি হয়ে ঘুরে বেড়াই সে সময়ে। দুজনে আবিষ্কার করি, আমাদের ছোট্ট শহরটা জলের তলা থেকে ভেসে উঠেছে। থেকে থেকে শ্যাওলার গন্ধ ভাসে। আবার কোনো একদিন জলের নিচে চলে যাবে।
আমি যখন 1983 সালে সেই শহরটা ছেড়ে আসি, তারপরও প্রতীক রূপোলী ফিতের কয়েকটি সংখ্যা বের করেছে।
মাঝে মাঝে প্রতীক ময়মনসিংহ গেছে আমার কাছে। আমি না থাকলেও আমার বন্ধুদের কাছে গিয়ে থেকেছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে ছবিও এঁকেছে। আধো অন্ধকারে আধো আলোতে শালগাছের ছায়া দেখে বলেছে, হট হট। হট যা।
কোনো একদিন খুব গোপনে বলেছে, গাছগুলোও মাঝে মাঝে হাটে।
1993 সালে বরিশালে চলে যাই। একদিন আমার মা আমার কাছে আসে। অনেক রাতে আমার ঘুম ভাঙ্গে। দেখি জানালার বাইরে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। বাগানে গন্ধরাজ ফুটেছে। তার ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। মা আমার দিকে ঝুঁকে বসে আছে। তাঁর চোখ থেকে জল পড়ছে। আমাকে ফিসফিস করে বলছে, প্রতীক চলে গেছে। .....কবি প্রতীক। ...তোর বন্ধু। ...আর কখনো আসবে না।
শুনে আমি চোখ বন্ধ করি। আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারি, মা এই কথাটি বলেনি। বলতেই পারে না। আরো ঘুম গভীর হলে মনে হয়, মা আমার বাড়িতে সেদিন আসেনি। আমি দু:স্বপ্ন দেখেছি। দেশের বাড়িতে মা'র কতো কাজ। সেসব ছেড়ে আসে কীভাবে-- এই রাতে। এই জোৎস্নায়। এই মৃত্যু-অমৃত্যুর ঘটনাকালে।
প্রকৃত কবির কখনো মৃত্যু হয় না। ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।