১.
শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। বঙ্গবন্ধুর পিতা যেদিন মারা যান সেদিন মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর পিতার কবরে নেমে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, এখন আমার কি হবে?
বিব্রত মুজিব মোস্তাককে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, শান্ত হও মোস্তাক। পিতা-মাতা আজীবন কারো বেঁচে থাকে না।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠবন্ধু ছিলেন খন্দকার মোস্তাক। হত্যার মাত্র একদিন পূর্বেই বাড়ি বয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হাঁসের মাংস খাইয়ে এসেছিলেন মোস্তাক। খন্দকার মোস্তাকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস এতটাই অটল ছিল যে সন্তানদের বলেছিলেন, আমার যদি কখনো কিছু হয়ে যায়, তোমরা মোশতাক কাকার কাছে চলে যেও।
২.
স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির মূল ফটিক দিয়ে ঢুকে সোজা চলে গেলেন বসবার ঘরে। শেখ মুজিব এলে সুভাষ বললেন,
এ কেমন ব্যবস্থা? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলাম অথচ কোন সিকিউরিটি নাই,আমার ব্যাগও চেক করল না কেউ, ওতে পিস্তলও তো থাকতে পারত।
শেখ মুজিব হেসে উত্তর দিলেন, কি যে বলেন, আমার দেশের মানুষ আমাকে মারবে না।
৩.
১৯৭৫ সালের কোনও একদিন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে এসেছেন ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থা- রিসার্চ ও অ্যানালাইসিস উইংয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
তিনি শেখ সাহেবকে সাবধান করার জন্য বললেন, আপনাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মেজর রশীদ, ফারুক,লে.কর্নেল ওসমানীসহ অনেকে এই নিয়ে আলোচনায় বসেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়।
শেখ সাহেব নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন, যাদের কথা আপনি বলছেন তারা আমার সন্তানসম।
৪.
শেখ মুজিব সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পেছনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্য করে শেখ মুজিব দৃঢ় কন্ঠে বললেন, তোমরা কি চাও?
সেনাবাহিনীর এক মেজর বিব্রত ভঙ্গিতে আমতা-আমতা করতে লাগল। শেখ মুজিবের কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিল৷
শেখ মুজিব আবার বললেন, তোমরা চাও কী?
মেজর মহিউদ্দিন বললো, স্যার, একটু আসুন।
শেখ মুজিব বললেন, কোথায় আসব?
মেজর আবারো বললো, স্যার একটু আসুন।
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে কাজ করতে পারে নি, সে কাজ তোমরা করবে?
এই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে এল মেজর নূর। শেখ মুজিব তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই সে ব্রাশ ফায়ার করল।
সময় ভোর পাঁচটা চল্লিশ। শেখ মুজিব সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়লেন। তখনো বঙ্গবন্ধুর হাতে শোভা পাচ্ছে তার প্রিয় পাইপ।
৫.
গোলাগুলির শব্দে তটস্থ দশ বছরের বালক শেখ রাসেল মার কাছে যাব বলে কান্নাকাটি করেছে৷ পি.এ. মহিতুল ইসলামকে ধরে বলছে, ভাই, আমাকে মারবে না তো?
এমন সময় একজন আর্মি তাকে বলল,চলো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।
শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ আর আর্তচিৎকারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় মুজিব পুত্র শেখ রাসেল।
৬.
১৫ই আগস্ট দুপুর৷ রাস্তায় মিছিল বের হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেই মিছিল হলো আনন্দ মিছিল।
বাংলামোটরের সবাই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে। সেখানে রাখা ট্যাংকের কামানে ফুলের মালা পরানো। কিছু অতি উৎসাহী মানুষ ট্যাংকের ওপর উঠে নাচের ভঙ্গি করছে।
রেডিওর ওপারে খন্দকার মোশতাক আহমেদের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। তিনি আবেগমথিত গলায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের 'সূর্যসন্তান' বলে আখ্যা দিলেন।
মোশতাকের ভাষণের পর বঙ্গভবনে শুরু হলো আনন্দ উল্লাস। এলাকার মোড়ে মোড়ে মিষ্টি বিতরণ করা হলো।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ তখনও তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে পড়ে আছে।
৭.
বঙ্গবন্ধুর শরীরে ২৪টি গুলির চিহ্ন ছিল। গুলিগুলো বুক ফুঁড়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তাঁর পরনের সাদা পাঞ্জাবী
রক্তে একাকার৷ বঙ্গবন্ধুর গোসলের জন্য এক দোকান থেকে সাবান কিনে আনা হয়৷ রেড ক্রিসেন্টের রিলিফ শাড়ির লাল ও কালো পাঁড় ছিঁড়ে বঙ্গবন্ধুর কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জানাযায় অংশগ্রহণকারী ছিল মাত্র ৩৫ জন।
জানাযা শেষে মা-বাবার কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
৮.
আমার চোখে বিশ্বসম্মোহনীদের নামের তালিকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাগ্রে। তিনি সগৌরবে বাংলার স্বাধীন আকাশে চিরঞ্জিব উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি দল-মত নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার প্রস্ফুটিত গোলাপ। শেখ মুজিব একটি ত্যাগ,বিদ্রোহ আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের নাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে বাঙালির বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতার। তাঁর সমগ্র জীবন জুড়েই ছিল বাঙালির কল্যাণ এবং মঙ্গল চিন্তা। অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব সমাজ পরিবর্তন ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে ত্যাগ,সাহস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন আজ তা নিখাদ শিল্পে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শকে অনুসরণ করতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। প্রয়াণ দিবসে বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক, আপনাকে জানাই অন্তরের বিনম্র শ্রদ্ধা।
[ তথ্যগুলো বিভিন্ন বই ও সংবাদপত্র হতে সংগ্রহীত ]
~ আল শাহরিয়ার মাহী।