আজ রামনবমী। নিবেদিতা ইস্কুলে তখন আমি প্রাইমারি বিভাগে মানে নিবেদিতা লেনের ছোটোবাড়িতে পড়ি। মনে হয় তখন একটু বড় হয়েছি, মানে এই ক্লাস টু হবে। রামনবমীর একটি স্মৃতি আজও মনের মণিকোঠায় অমলিন। বড়বাড়িতে মানে সেকেন্ডারি কবে যাব এমন একটা ইচ্ছে মনের মধ্যে বেশ জোরালো হয়েছে তখন। আমার বন্ধুরা বড়বাড়ির ভিতরটা কেমন তখন হয়তো সকলে জানতোনা। আমি ছোটো থেকে জানতাম। কারণ আমি ছিলাম কৃষ্ণকুমারীর মেয়ে। সেই ওয়ানে পড়া থেকেই মাঝে মাঝে বড়বাড়িতে আমার ডাক পড়ত। ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে কোনো শিক্ষিকা কৃষ্ণকুমারীর মেয়েকে এখনো দেখেননি একথা জানাজানি হলেই মনে হয় আমার ডাক পড়ে যেত। আমি বেণুমাসির পিছন পিছন বড়বাড়িতে স্টাফরুমে যেতাম। সেখানে দেখতাম গম্ভীর হয়ে মায়ের শিক্ষিকারা বসে আছেন। আমি গেলেই যিনি দেখেননি, তাঁর সঙ্গে পরিচয় সারা হত। তারপরে বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। কয়েকটি উদাহরণ দিই। বাংলা কবিতা বল একটা। আজ কি দিয়ে ভাত খেয়েছ? কে রান্না করেছিল? বাবা বেশি বকে না মা? কে বেশি ভালোবাসে? ইস্কুলে কিভাবে এলে আজ? বোনের সঙ্গে ঝগড়া করো? কে বেশি দুষ্টু? ছুটির দিন কি করো? কটা গল্পের বই পড়া হয়েছে? বইগুলো কী নাম বলো। আমাদের পড়তে দেবে? একটা গল্প বলো। আমি ভয় পেতাম না। সাধ্যমতো উত্তর দিতাম। কেবল গল্পের বই দিতে সম্মত হতামনা। ওঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা অন্তত বই চাইতেন। আর একটা কমন প্রশ্ন ছিল, তুমি কি মা সারদা? আমি প্রবল বেগে মাথা নেড়ে প্রমাণ করতাম, মোটেই না। আমি তালব্য শ এ শারদা। দিদিরা মুখ ঘুরিয়ে নিতেন, বা বই খাতা দেখতেন। আজ নিজের বয়স অর্ধশতক পার। আমার ছাত্রীরাও ছেলেমেয়ে নিয়ে কলেজে আসে। সেদিনের দৃশ্যটি কল্পনা করি। স্নেহের ছাত্রীর কন্যা - বেঁটেখাটো বাচ্ছা, মুরুব্বির মতো উত্তর দিচ্ছে - এটা ছিল ক্লাসের ফাঁকে অনাবিল আনন্দ। দিদিদের গম্ভীর মুখ আসলে ছিল ছদ্ম গাম্ভীর্য। প্রবল হাসির দমক চাপতে গেলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়া ছাড়া উপায়ই বা কী? এমন সুযোগ এখন পেলে আমিই কি ছাড়ব?
ক্লাস টুতে পড়ি যখন, একদিন মা ইস্কুল ছুটির পরে বাড়ি না গিয়ে কাজ করছিল। ছোটোবাড়ির ছুটি আগে হয়ে যেত। বড়বাড়িতে দেরি করে হত। আমি মাকে বললাম, বাড়ি যাবেনা? মা খাতা থেকে মুখ না তুলে ছোট্ট উত্তর দিল, 'দেরি হবে। আজ রামনবমী'। ছুটির পরে মায়ের জন্য অপেক্ষা করা আমার কাছে ছিল সাধারণ ব্যাপার। কারণ আমার ছুটি মার অনেক আগেই হয়ে যেত। কিন্তু মার কাজ থাকত বলে আমি বসে থাকতাম। কোনো কোনোদিন খুব দেরি হলে, বড় গীতাদি মানে ত্যাগপ্রাণা মাতাজী বেণু মাসিকে বলতেন ওকে ছাদে নিয়ে যাও। তিনতলার ছাদ ছিল একমানুষ সমান দেওয়াল, সরু থাম আর জাল দিয়ে ঘেরা। আর মাথায় টিনের চাল। ওখানে রোজ সকালে আমাদের প্রার্থনা হত। বেনু মাসি ছাদের এক কোণে দুই হাঁটু মুড়ে, হাঁটুর দুপাশে দুই হাত বেড় দিয়ে বসে থাকত। কখনো মাথাটা দুই হাঁটুর মাঝে ডুবিয়ে রাখতো। মনে হত কীযেন আকাশ পাতাল ভাবছে। আর আমি একা একাই সেখানে ছুটোছুটি করতাম। ছাদের ভিতরের থামগুলো নিয়ে আমরা বন্ধুরা একটা খেলা বানিয়েছিলাম - থাম থাম খেলা। চারটে থাম ছুঁয়ে আমরা কজন থাকতাম আর একজন চোর মাঝখানে থাকতো। আমরা কেবলই এথাম থেকে ওথাম ছুটে বেড়াতাম। ঐসময়ে চোর যাকে ছুঁয়ে দেবে সে চোর। কিন্তু থাম ছুঁয়ে ফেললে আর চোর হবনা। আমি একটু নিটির পিটির ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ে পারতাম না, তাই এথাম ওথাম বেশি করতামনা। সাহস সঞ্চয় করতে করতে টিফিনের ঘন্টা পড়ে যেত। কিন্তু একা একা ছাদে তো আর চোর হবার ভয় নেই। তাই কেবলই ছুটতাম। ছাদের জাল দিয়ে বড়বাড়ির জানলা দিয়ে ক্লাস দেখার চেষ্টা করতাম। বড়বাড়ির পাশেই ছিল পদ্মাদের বাড়ি। আমার মামারা আর পদ্মার বাবা কাকা সব ছোটোবেলার পাড়ার বন্ধু ছিল। পদ্মার চেহারা বড়সড় ছিল। সে ঘোষণা করত যে অন্য স্কুলে ফোর অবধি পড়ে নাকি এখানে ভর্তি হয়েছে। তাই আমরা যেন তার কথা সব মেনে চলি। আমি বিশ্বাস করে তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলাম। নিজে এতটাই ছোটোখাটো ছিলাম, সে এক ক্লাসে পড়লেও অবলীলায় আমায় কোলে তুলত। আমি একাএকা ছাদের জাল দিয়ে পদ্মার বাড়িতে কে কি করছে, পদ্মা তার বড় চুলে শ্যাম্পু মাখছে, এসব লক্ষ্য করতাম। বেণুমাসি দুই হাঁটুতে থুতনি ডুবিয়ে বসে আছে দেখলে মাঝে মাঝে ও বেণুমাসি বলে চমকে দিতাম। কখনও ছোটোছাদ খুলে দাও না, বলে বায়না করতাম। ছোটোবাড়ির ছাদের যে ধারটা নিবেদিতা লেনের দিকে, তার উল্টো দিকে, মানে বাড়ির পিছনের ধারে ছাদের কোণে লাগোয়া একটা ছোট বারান্দা ছিল। সেটায় টিনের চাল, ঘেরা জাল কিচ্ছু ছিলনা। রোদ পড়ত। দু চারটে ফুলের টব ছিল। ফুল ফুটতো। কিন্তু সেখানে আমাদের ছাত্রীদের যাওয়ার উপায় ছিলনা। একটা জালের দরজা দিয়ে আলাদা করা ছিল। তালা দেওয়া থাকত। আমরা বলতাম ছোটো ছাদ। স্কুলের সময়ে ওখানে যাওয়া মানা ছিল। কিন্তু স্কুলের পরে? খুব বায়না করলে কখনো সখনো বেণুমাসি ছোটোছাদ খুলে দিত। সেই নিষিদ্ধ এক চিলতে জায়গায় পা রাখা ছিল, একটা সাম্রাজ্য পাওয়ার সমান। আমি যে ছোটোছাদে গেছি, একথা বন্ধুদের কখনো বলিনি।
সেই রামনবমীর দিন কিন্তু আমার ছাদে যাওয়া হলনা। বদলে বড় গীতাদি, আমাদের বড়দি ওনার কাঠের দেরাজ থেকে একটা বই বার করে আমাকে বললেন 'পড়'। দেখলাম সেটা ছোটোদের রামায়ণ। আমি পড়তে বসে গেলাম। এটাও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কেন বলি। এই স্কুলে ক্লাস ওয়ানে আমি কিছুটা পরে ভর্তি হয়েছিলাম। কারণ কিন্ডারগার্টেন থেকে আমি আসলে বাগবাজার মাল্টিপারপাস স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। ওয়ান থেকে ওখানে মর্নিং স্কুল। মর্নিং স্কুল ছুটি হলে, মা আমাকে নিয়ে নিবেদিতায় আসত। বিকেলে মার সঙ্গে বাড়ি যেতাম। সারাটা দিন বড় গীতাদি আমাকে নানা রকম বই দিতেন। কখনো কী পড়লাম জিজ্ঞাসা করতেন, গল্পের কোনো ঘটনা বা চরিত্র ভালো না মন্দ সেবিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন। কখনো রিডিং পড়তে দিতেন। আবার কখনো কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে বলতেন। এক একদিন এক একরকম। একদিন আমাকে শ্রদ্ধাপ্রাণা মাতাজী ডেকেছিলেন। বড়বাড়ির তিনতলায়। স্কুলে ভর্তির আগে। তাঁর সাধনজগতের নাম আমি জানতাম না। মা নিজের ক্লাসের ফাঁকে বলে গিয়েছিল, লক্ষ্মীদি তোকে ডেকেছেন। খুব সাবধান, উনি গুণী মানুষ, প্রণাম করবি। সামনে যেতেই গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমিই কৃষ্ণকুমারীর মেয়ে? ফর্সা পায়ে জুতোর বেল্টের দাগ হয়ে গেছে, মোজা পরবে। ছোটো মানুষ হলেও, জলদ স্বরের পিছনে একটা স্নেহের ফল্গু অনুভব করতে পেরেছিলাম। তিনি আমায় গল্পের ছলে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লিখতে পারি দেখাতে বললেন। তারপরেতো চলে এসেছি। সপ্তাখানেক পর একদিন মা আমাকে সকালে ঘুম থেকে ওঠায়নি। বেলায় উঠে আমি তো অবাক। মা বলল আজ থেকে আমার সঙ্গে বেরোবি। আমার ইস্কুলেই পড়বি। আমি বললাম পরীক্ষা দিতে হবে? মা চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, তোর পরীক্ষা দুজন নিয়ে নিয়েছেন। তোর অনেক ভাগ্য, লক্ষ্মীদি মর্নিং স্কুল করে সারাদিন বসে থাকিস বলে নিজে তোর পরীক্ষা নিয়েছেন, বলে দিয়েছেন, যে আর মাল্টিপারপাসে যেতে হবেনা। শারদা তালব্য শ হলেও নিবেদিতাতেই পড়বে। যাই হোক ছুটির পরে বসে বসে বই পড়াটা স্বাভাবিক ছিল। সেদিন খুব একটা মন বসছিলনা। ওয়ানে আমাদের ছড়া ও ছবিতে রামায়ণ ছিল। সেই সূত্রে রাম লক্ষ্মণ, তাড়কা রাক্ষসী হনুমান সবার সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেদিন বইয়ে মন বসছিলনা কারণ, ঐ যে মা বলল আজ রামনবমী। দেরি হবে। মানে কিছু ঘটবে। সেটা কী? রামনবমী কী? - বসে বসে এসব ভাবনার জাল বুনছিলাম। একসময়ে বড়বাড়ির ছুটির ঘন্টা শোনা গেল। মাও ব্যাগ গুছিয়ে বলল, ওবাড়ি চল। ওবাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে প্রশস্ত ঠাকুরদালান। মাঝখানে দন্ত্য স- এ সারদা মায়ের সিংহাসন। বুদ্ধমূর্তির সামনে কিছুটা এগিয়ে একটি চেয়ারে বসে আছেন লক্ষ্মীদি। সামনে প্রশস্ত সতরঞ্চিতে হোস্টেলের মেয়েরা, দিদিরা বসে আছে। সময় কিভাবে কেটেছে জানিনা, মাতাজী রাম লক্ষ্মণের গল্প বলছেন। আজ শ্রীরামের জন্মদিন। আমি দেখছি অযোধ্যার রাজবাড়িতে কত তোড়জোড়। বিশ্বামিত্রের সঙ্গে দুই ভাই বেরিয়ে পড়েছেন, দশরথের চোখে জল। তিন মাতা বিলাপ করছেন। রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করে বীরপুরুষেরা ফিরবে তো? পাশে দেখি বেণুমাসি বসে কাঁদছে। একটু বড় হলে পরে মা বলেছিল, একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে বেণুমাসি আর তার ছেলেকে শেয়ালদা স্টেশনে বসিয়ে দিয়ে আসছি বলে, বেণুমাসির বর আর ফিরে আসেনি। লক্ষ্মীদি আশ্রয় দিয়েছেন। ১৯৭৮ এর রামনবমী আর আজ ২০২১। এরপর জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি আরো তিন। মোট তেতাল্লিশ বছরের পার। শ্রদ্ধাপ্রাণাজীর করুণা আমি পেয়েছিলাম। আজকের 'জয় শ্রীরাম' এর যুগে সেই স্নিগ্ধ রামনবমী স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ভেসে ভেসে আসে।
ডঃ শারদা মন্ডল