- দাদা, দুটো নবান্ন থেকে ধর্মতলা -
- (কুড়ি টাকা হাতে ধরিয়ে দিতে বাস কনডাক্টর বলল...) আরও ১০ টাকা দিন
- মানে! (পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড় আমার)
- হ্যাঁ দাদা, মিনিমাম ভাড়া ১২ টাকা, আর ধর্মতলা পর্যন্ত ১৫ টাকা
- কিন্তু কবে থেকে? এই তো লকডাউনের আগে ১০ টাকা ছিল
- লকডাউনের আগে অনেক কিছুই ছিল দাদা, এখন আর নেই। লকডাউনের আগে আমার এক মাথা চুল ছিল, এখন ন্যাড়া। বুঝতেই পারছেন!
- তা বলে বলা নেই কওয়া নেই একধাক্কায় এত টাকা বাড়িয়ে দিলে
-বলা নেই কওয়া নেই ডিজেলের দামও তো বাড়ছে। কথা না বাড়িয়ে ১০ টাকা বার করে রাখুন
এই বলে হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে চলে গেল কনডাক্টর। শিয়ালদা-চিংড়িহাটা হাঁকতে শুরু করে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ঝাপসা জানালা। ঘষা জানালায় ভেসে ওঠে কলকাতার জলছবি। দু'মাস পর রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম, কলকাতা যেন একটু পাল্টে গিয়েছে। বিষন্নতার ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছে মহানগর। পেটের টানে রাস্তায় মানুষের জটলা আছে, উত্তাপ নেই। কনডাক্টরের ভাষা তেতো হলেও সত্যি। আজ অনেক কিছুই নেই। আবার অনেক না থাকার ক্ষতে, নুনের ছিটের মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি। এ সব ভাবতে ভাবতে শুনতে পেলাম, আমার মতো কোনও এক আঁতেলকে কনডাক্টার দেহাতি ভাষায় বোঝাচ্ছে...
- দাদা, কীভাবে পারব আমরা বলুন তো! আর কত জনকে বোঝাবো, এই ভাড়ায় রাস্তায় বাস নামানো যাচ্ছে না।
- ও সব শুনে আমরা কী করব? মিনিমাম ভাড়াটা যা বাড়িয়েছেন, গায়ে লাগে
- যদি আপনি না দেন, আমার কিছু করার নেই। এখানে নেমে পড়তে পারেন।
- কেন, এখানে নামব। যা ভাড়া তাই দিচ্ছি। সরকার বাড়াল না, আর আপনাদের খেয়াল খুশি যা ইচ্ছা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
- ওই তো না! সরকার উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে আছে।
- রাস্তায় বাস নামাচ্ছেন কেন?
- পেটের দায়ে দাদা! ডিজেলের দামটা দেখেছেন? সরকার বাসভাড়া বাড়াবে না বলেই তো খালাস, মালিকও কড়া-গন্ডায় বুঝে নিচ্ছে। মাঝখান থেকে পিষে মরছি আমরা।
প্রথম জন গোঁ হয়ে বসে আছে পুরনো ভাড়াই দেবেন। তা দেখাদেখি আরও দুই একজন ওই ব্যক্তির সুরেই সুর মেলালেন। বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কনডাক্টর বেচারা। যেন কারোর ঝেড়ে ফেলা দায় কৃচ্ছ্রসাধন করছে সে। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে যাওয়ায় হাতে ১০ টাকা নিয়ে এগিয়ে গেলাম গেটের কাছে। আর তর্কে গেলাম না
- এই নিন ১০ টাকা।
টাকাটা আঙুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে দু'খান টিকিট দিয়ে দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বললাম...
- আচ্ছা, এই যে ভাড়া বাড়িয়েছো, তাতে কি পুষিয়ে যাবে?
- (বুঝিয়ে বুঝিয়ে গলাটা তখন খাদে) কোথায় দাদা? দুটো অতিরিক্ত প্যাসেঞ্জার তুলতে যাব, সার্জেন্ট হাঁ করে বসে থাকে। এক পিঠের লাভটাই নিয়ে নেয়। সার্ভিসিং আছে। মালিক কিন্তু এসব বুঝবে না।
- সরকার কী বলছে?
চুপ করে থাকে কনডাক্টর। বুঝতে পারি উত্তরটা। কিছু বলতে যাব, জুলজুল চোখে কনডাক্টর বলে
- এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে চাইছে সরকার। একটা আমরা আর একটা...
তার কথা শেষ না হতেই ধর্মতলা এসে পড়ে। নেমে পড়ি। বৃষ্টিতে পিছল রাস্তা। ওয়াইফের জুতো গেল ছিঁড়ে। মাথায় বাজ পড়া অবস্থা। এখন মুচি পাই কোথায়। আমার দুরাবস্থা দেখে কনডাক্টরের তৃপ্ত হাসি। শিয়ালদা-চিংড়িহাটা হাঁকাতে হাঁকতে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল সে।
ভাল লাগলো।