হটী
মৌসুমী ঘোষ দাস
১৭৭৪ সালের এক সকাল। স্থান কাশীধাম, দুর্গামন্ডপের অনতিদূরে ‘কুরুক্ষেত্র তালাও’। দূরদূরান্তের মানুষ এসে ভিড় জমাতে শুরু করলো সেখানে। ওরা খবর পেয়েছে আজ একটা মস্ত বড় তামাশার আয়োজন হয়েছে। তামাশাটা হল বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় তর্কযুদ্ধ। যদিও ওই অং বং চং ভাষা জনসাধারনে বোঝে না, বোঝার আগ্রহও নেই। তবুও তারা উৎসাহিত এই তর্কযুদ্ধ দেখতে। কারণটা হল, পুরুষের বেশে একজন স্ত্রীলোক আজ অংশগ্রহণ করছেন। যিনি পুরুষের মতো কাছা দিয়ে ধুতি পরেন, উর্ধাঙ্গে পিরান( ঢিলেঢালা জামা) এবং নামাবলি, মুন্ডিত মস্তক, দীর্ঘ টিকি, হাতে কানে গলায় কোন অলঙ্কার নেই, কেবলমাত্র একটি রুদ্রাক্ষের মালা, কোন অবগন্ঠন বা পর্দার বালাই নেই – সর্বসমক্ষে পুরুষের সঙ্গে তর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন আজ। এ তামাশা নয় তো কি? মনে রাখতে হবে, সালটা ১৭৭৪। অর্থাৎ তখন রাজা রামমোহন রায়ের বয়স মাত্র দুই বছর। বাংলাদেশে তখন রমরমিয়ে চলছে গৌরীদান, সহমরণ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন,অন্তর্জলীযাত্রা, মন্ত্র-তন্ত্র, ওঝা-ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি ইত্যাদি কুসংস্কার। মেয়েদের লেখাপড়া করা তখন এক গর্হিত অপরাধ।
কাশীর নব্য পণ্ডিতেরা এবং কবিরাজেরা দলবদ্ধ ভাবে এই স্ত্রীলোকের বিরুদ্ধে নাকি অভিযোগ জানিয়েছে। অভিযোগটা গুরুতর। একজন বালবিধবা, কুলীন বামুনের মেয়ে হয়ে যে সহমরণে যায়নি, কাশীতে চতুষ্পাঠী (টোল) খুলে বসেছে! দশ ,পনেরো, কুড়ি, বাইশের সব ছোকরা বিদ্যার্থি তাঁর চতুষ্পাঠীতে বিদ্যাগ্রহন করতে যায়! সেই অনন্যসাধারণ মেধাবিনী নাকি বেত্রদণ্ড ছাড়াই এমন শিক্ষাদান করছেন, যে দিনে দিনে তাঁর চতুষ্পাঠীর ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েই চলেছে! এ ঘোর অনাচার নয়তো কি? যেখানে মনুর বিধানে আছে, স্ত্রীলোকের বেদ পাঠের কোন অধিকার নাই, স্ত্রিলোক শুধু সন্তানের জন্ম দেবে, সন্তানকে স্তনদান করবে, লালন পালন করবে, স্বামীর পদসেবা করবে, স্বামীর ভুক্তাবশেষ খেয়ে দিনযাপন করবে! সেখানে এই ধাষ্টামোর কোন মানে আছে? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার! নইলে এই পাপে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে! তাই তাঁরা দলবদ্ধভাবে গেলেন মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের কাছে যিনি কাশীর সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত সমাজের অন্যতম।
যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এই আজন্ম ব্রহ্মচারী দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবেরই পালিতা কন্যা। শোনা যায় মাত্র কয়েক বছর আগে এই কন্যাটিকে অতি প্রত্যূষে একাকী গঙ্গা ঘাটে পেয়ে নিজের কুটিরে এনে আশ্রয় দেন। মেয়েটি এই বয়সেই ব্যাকরণ, স্মৃতি, কাব্য, নব্যন্যায় এবং চরক, সুশ্রুত, নিদান আয়ত্ত করে বসে আছে। শিকড় বাকড়, ঘাস-পাতা, জড়িবুটি খাইয়ে ( যাকে বর্তমানে আয়ুর্বেদ বলা হয়) সে নাকি আর্ত পীড়িতের সেবা করে চলেছে! কাশীর পণ্ডিত সমাজের কাছ থেকে ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছে! বিদ্যার্ণব এই কন্যাটির ওপরই নিজ চতুষ্পাঠীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব বিচার চাইতে আসা নব্য পণ্ডিতদের বলেছিলেন, “দেখো বাবারা, যদি তর্ক যুদ্ধে আমার কন্যাটিকে তোমরা পরাজিত করতে পারো তবে বিচারকেরা যা নিদান দেবেন, আমার কন্যা তাই মেনে নেবে”। আর সে কারণেই আজকের এই তর্ক সভার আয়োজন।
যাকে নিয়ে এতো আয়োজন, তাঁর নাম হটী। হটী শব্দের অর্থ বিদ্রোহবুদ্ধি, ক্রোধ। হবে নাই বা কেন? মেয়েটির জন্মদাতা পিতা তাঁর একরোখা জেদের জন্য গ্রামে একবজ্ঞা ঠাকুর নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর আদরিনী মেয়ের নাম হটী হবে না তো কি হবে? জন্মকালেই মাতৃহীন মেয়েটির শিক্ষাদীক্ষা বেড়ে ওঠা বর্ধমান জেলার সোঞাই গ্রামে পিতা বেদজ্ঞ রূপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। নারী শিক্ষার বিষয়ে উদারমনস্ক পিতা রূপেন্দ্র একজন দক্ষ কবিরাজও ছিলেন। কবিরাজিতেও হটী পিতার যোগ্য সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন।
গৌরীদানের ঘোরতর বিপক্ষে হওয়া সত্বেও সমাজপতিদের চাপে বাধ্য হয়ে দশ বছর বয়সে হটীর বিবাহ দেন পাশের গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে। উপযুক্ত বয়স হলে তবে সংসার করতে স্বামীগৃহে যাবে, এই মর্মে বিয়ের পর হটী পিতার কাছেই থাকেন। সেখানে পড়াশুনা, কবিরাজি চিকিৎসা, নিজে হাতে ছোটোখাটো অস্ত্রপচার করা শেখেন পিতার সাহচর্যে। মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর স্বামীর মৃত্যুর খবর আসে। হটীর বয়স তখন মাত্র তেরো। সেদিনই শ্বশুরবাড়ি থেকে পাইক বরকন্দাজ বাহিনী এসে হাজির, বধূকে তুলে নিয়ে যেতে। তার কারণ, সেখানে ঘটা করে সহমরণের আয়োজন করা হয়েছে। এবং সতিদাহ দেখতে আসেপাশের গ্রামের লোক ভিড় জমিয়েছে। এই খবর শুনে শোকে মুহ্যমান পিতা প্রস্তরমুর্তিতে পরিণত হলেন।
অবশেষে ধন্বন্তরি কবিরাজের কাছে উপকৃত গ্রামের নিচুজাতের লাঠিয়াল বাহিনীর সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে মুর্ছিতা হটীকে নিয়ে যেতে পারেনি শ্বশুরবাড়ির বরকন্দাজ বাহিনী। এর ফলস্বরুপ গ্রামের সমাজপতিরা সকন্যা রূপেন্দ্রনাথকে “একঘরে” ঘোষণা করেন। এইভাবেই দিন কাটছিল বাবা এবং মেয়ের। কিন্তু একদিন পিতা রূপেন্দ্রনাথও চলে গেলেন কন্যা হটীকে একা ফেলে। হটী তখন শান্ত ভাবে পিতার মুখাগ্নি এবং সৎকার করে যাত্রিবোঝাই এক নৌকায় উঠে বসেন। এই গ্রামের সমাজপতিরা ভদ্রভাবে তাঁকে যে টিকতে দেবে না আর, তা হাবেভাবে বুঝতে পেরেছিল অনাথা হটী। গন্তব্য কাশী।
তর্ক সভা শুরু হয়ে গেছে। বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করে আছেন কাশীর পণ্ডিত সমাজের অগ্রগণ্য তিন মহামহোপাধ্যায়। বিচারকের আসনের সামনে ডানদিকে নব্য পণ্ডিত সমাজের পক্ষ থেকে পাঁচ পণ্ডিত, আর বামদিকে হটী একা। শুরু হল তর্ক। যুক্তি তর্ক, বিপ্রতীপ তর্ক, উদ্ধৃতি, অনুজ্ঞা, নির্দেশ। পঞ্চ পণ্ডিত এবং তাঁদের সহযোগীরা স্তুপাকারে সাজিয়ে রেখেছেন নানান পুঁথি। যাতে চট করে পাতা উলটে দেখে নেওয়া যায়। যেভাবেই হোক এই স্ত্রিলোকের স্পর্ধা চুর্ণ করতেই হবে। হটীর অবশ্য কোন পুস্তক সঙ্গে আনার প্রয়োজন পড়ে নি। পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, চতুর্বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ থেকে ব্যাখ্যা সহ পঞ্চ পণ্ডিতের প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে হটী বিজয়ী হলেন। সভার সমাপ্তি ঘোষণা হল। কিন্তু কবিরাজের দল এবং নব্য পণ্ডিতেরা একজন সামান্য স্ত্রীলোকের কাছে এই পরাজয় কিছুতেই মেনে নিলেন না। এই ঘটনা গিয়ে পৌঁছালো রাজার কানে।
“কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা সহমরণে যেতে ভয় পেলে তার পরিণাম ভয়াবহ” বলেছিলেন পুরন্দর ক্ষেত্রী। কাশীর শাসন কর্তা। অত্যন্ত অত্যাচারী, ব্যাভিচারী, কামুক। সব শুনে তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন, “আমার রাজত্বে এমন বেলেল্লাপনা? বামুনের বিধবা- কোথায় সহমরণে স্বর্গে যাবি, তা নয় পুরুষের সঙ্গে মোকাবিলা? এমন শাস্তি দিতে হবে এই স্ত্রীলোককে, যেন আর কোন মহিলা কোনদিন এমন উচ্ছন্নে যাওয়ার স্পর্ধা দেখাতে না পারে”।
একদিন কিছু রক্ষী সহ ঘোড়ায় চেপে হটীর চতুষ্পাঠীতে এসে হাজির। কিন্তু প্রথম দেখাতেই হটিকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন! কি রূপ! কি ব্যক্তিত্ব এই মেয়ের! কামের আগুনে পুড়তে পুড়তে মুখে বললেন, “আমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত করতে না পারলে তুমি টোল চালাতে পারবে না। আজ থেকে উনিশ দিন পর তোমাকে একা তুলে নিয়ে যেতে আসবে আমার রক্ষী। স্থান আমার বাগানবাড়ি। কোন দর্শক- শ্রোতা থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি- বুঝলে সুন্দরী!! তৈরী থেকো।” একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করে চলে গেলেন পুরন্দর।
এই ছিল সেসময় সমাজের বিধান। একটি মেয়ে কেবলমাত্র লেখাপড়া করে সাবলম্বী হতে চাইলে চতুর্দিক থেকে বাধা, অসম্মান, অপমান, হেনস্থা করা হত, এবং তাতে প্রশাসনেরও মদত থাকতো। কুলমর্যাদা রক্ষা করতে সাত, আট, দশ বছরের শিশু কন্যাকে ঘাটের মড়া বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দাও। তারপর স্বামী মরলে সঙ্গে মেয়েটিকেও পুড়িয়ে মারো। জ্যান্ত একটি মেয়ে আগুনে পুড়ে মরছে, তা ভিড় করে দেখো, উল্লাস করো। মেয়েগুলোর অবস্থা? হয় সসম্মানে সতী হও। নয়তো আমৃত্যু দগ্ধে দগ্ধে মরো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাম চরিতার্থ করতে করতে। চিতাভ্রস্টা স্ত্রীলোকের যে স্থান নেই ভদ্র সমাজে। যেখানে পন্ডিত, কবিরাজ এবং রাজা সবাই সমান! কেউই চায় না মাথা উঁচু করে একটি মেয়ে লেখাপড়া করুক, অধ্যাপনা করুক, আর্ত পীড়িতের চিকিৎসা করুক। এখনো কান পাতলে সমাজে পুরন্দর ক্ষেত্রীর মতো কথা শুনতে পাওয়া যায় নেতা মন্ত্রীদের মুখে, “ঘরের বাইরে বেরুলে তো মেয়েদের ধর্ষিতা হতেই হবে” ঠিক যেন "কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা সহমরণে যেতে ভয় পেলে তার পরিণাম ভয়াবহ” কথাটির সমার্থক।
পুরন্দর কাশীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। হটীকে নিয়ে তাঁর ঘৃণ্য পরিকল্পনা ছিল। নিজে কিছুদিন ভোগ করবেন, তারপর হত্যা করে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন গঙ্গায়। নয়তো ক্রীতদাসী করে বজরায় চাপিয়ে পাঠিয়ে দেবেন এলাহাবাদে ইংরেজদের ক্যান্টনমেন্টে। এমন শিক্ষিত সুন্দরী সেবাদাসী উপহার পেলে ইংরেজ সেনা খুশীই হবে! যদিও পুরন্দরের সেই ঘৃণ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।
হটী আমৃত্যু সসম্মানে অধ্যাপনা করে গেছেন। প্রকাশ্য বিচারসভায় বা তর্কসভায় আমন্ত্রিত হয়ে পুরুষ পন্ডিতদের সঙ্গেই বিচারকার্য সমাধা করেছেন এবং বিচার শেষে সাম্মানিকও গ্রহণ করতেন। যে রক্ষণশীল সমাজে অবহেলিত, উপেক্ষিত নারীজাতির না ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা, না ছিল সামাজিক মর্যাদা, সেখানে অল্পবয়সী বিধবা মেয়ের জীবন কি নিদারুণ যন্ত্রণায় কাটতো- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কেউ যদি চায় জ্ঞানার্জন করতে? তবে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ভোগ করো, নয় মেরে ফেলো। তবুও সেই সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই হাতে গোনা দুই একজন মহিলা তাঁদের প্রখর ব্যক্তিত্ব ও অসামান্য প্রতিভায় নিজস্ব স্বতন্ত্রতার পরিচয় রেখেছিলেন। হটী বিদ্যালঙ্কার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সঠিক সুযোগ পেলে স্ত্রীলোকেরাও যে উচ্চতর জ্ঞানার্জনে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারেন হটী বিদ্যালঙ্কার তার জলন্ত দৃষ্টান্ত। স্ত্রীশিক্ষার ইতিহাসে হটী বিদ্যালঙ্কারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যুগ যুগ ধরে।
তথ্য ঋণঃ নারায়ণ সান্যালের রূপমঞ্জরী
এ তো নারায়ণ সান্যালের বই থেকে পুরো লাইন টু লাইন টুকে দিয়েছেন!
বইটা পড়ত হচ্ছে।
তাই নাকি?? লাইন টু লাইন টোকা হয়েছে? ১০৯৮ পাতার তিনটি খন্ডের উপন্যাস ১৩০০ শব্দে লাইন টু লাইন টোকা হয়ে গেল?? বেশ বলেছেন তো!!!!