এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পরিযায়ী শ্রমিকদের ছেঁড়াফাটা তালিদেওয়া কিস্যা  

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ মে ২০২১ | ১৯২৭ বার পঠিত
  • রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা হালকা পোড়াদাগওয়ালা  কটি হাতরুটি, তাতে  রক্তের ছিটে, এই  ছবি আমাদের অনেককেই তাড়া করে ফিরেছে গত বছরের বেশ কিছুদিন। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’, ওই যারা শতেকে হাজারে হেঁটে চলে মাইলের পর  মাইল হাতে পিঠে বোঁচকা আর ঘাড়ের উপর বাচ্চাকে বসিয়ে। এমনিতে এ রাজ্যে আন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক আমরা দেখে আসছি বরাবরই, কিন্তু লকডাউন বোধহয়  আমাদের প্রথম দেখায় এঁদের সংখ্যার ব্যপ্তি,  দুর্দশার বিস্তার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এঁরা অন্যত্র  যাচ্ছেন বহুদিন। মালদা থেকে দিল্লিগামী ট্রেন ফরাক্কা এক্সপ্রেস, যাকে মালদার লোক বলেন ‘লেবার ট্রেন’, লোকবোঝাই  হয়ে চলে যায় দিল্লিতে শ্রমিকের যোগান দিতে। ওইরকম আরো ট্রেন চলে যায় মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, কেরালা মায় উত্তরাখন্ড পর্যন্ত। পেটের দায়ে। 


    হেডলাইন হবার বহু আগে থেকে চলে আসা শ্রমিকদের  এই বহমান ধারা   কবে থেকে শুরু হয়েছে বলা মুশকিল। ফরাক্কা স্টেশান থেকে আরো বহু ট্রেনই ছাড়ে, ছাড়ে আন্যান্য স্টেশান থেকেও। শতাব্দী, দুরন্ত, রাজধানী পূর্বা নামের ট্রেনগুলোয় চেপে লোকে বেড়াতে, ইন্টারভিউ দিতে, চিকিৎসা করাতে, ব্যবসার প্রয়োজনে, আরো নানা কাজে যায়। সেসব ট্রেনের নাম কেউ ‘লেবার ট্রেন’ না দিলেও সেসব ট্রেনের  আনরিজার্ভড কামরায় গাদা ভর্তি হয়ে মানুষ যায়  ‘দাদনে’ বা ‘জন খাটতে। যারা যায় তাদের সকলেই ফেরে না। কেউ ফেরে লাশ হয়ে, আধমরা হয়ে, কারোর হয়ত কোনও খবরই পাওয়া যায় না। ২৪শে মার্চ ২০২০  সারাদেশের সমস্ত ট্রেন থেমে যাবার পর থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই লেবাররা পরিচিত হতে শুরু করলেন ‘পারিযায়ী শ্রমিক’ নামে।   


    ব্রেকিং নিউজ হবার বহু আগে থেকেই মঞ্জীরা সাহা পশ্চিমবঙ্গের  গ্রামেগঞ্জে ঘুরে যোগাড় করে ফিরেছেন লেবারদের যাওয়া আসার ছেঁড়াফাটা কাহিনী। তারই সংকলন ‘লেবার ট্রেন’। বইটার দুটো অংশ – ‘ট্রেন যখন থামল’ আর ‘ট্রেন যখন চলছিল’। প্রথম অংশে ছয়টা আর দ্বিতীয় অংশে ষোলোটা নিবন্ধ। প্রথম অংশের অধিকাংশ খবর ও নিবন্ধগুলো উৎসাহী পাঠক লকডাউনকালে নিশ্চয় পড়েছেন দেখেছেন, তবু এক জায়গায় সংগ্রহ করে রাখা দরকার ছিল। দ্বিতীয় অংশটি এই বইয়ের আসল গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মূলত ওরাল হিস্ট্রি।  এই অংশে রয়েছে সেইসব গল্প যেগুলো লেখিকা শুনেছেন মালদার চরে, দিনাজপুরের ঝাপড়াগছির বটতলায় বা গমর নদীর ধারে।  ক্যাসেটবন্দী করা, খাতায় নোট করা বা শুধুই কানে শোনা সেসব কিস্যা বলেছে কখনো শ্রমিক নিজেই, কখনো মরা ছেলের মা, কখনো কবে যেন হারিয়ে যাওয়া কারো প্রতিবেশী।  


    গুপীর প্রতিবেশীরা যেমন  মঞ্জিরা কে শুনিয়েছিলেন গুপীর মার্ডারের গল্প। প্রথমে মার্ডার মনে হলেও  আসলে তো  দাদনের টাকা পেয়ে আকন্ঠ মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়া জিয়ন্ত  গুপীকে খুবলে খেয়েছিল ‘শৃগালে’। ঘটনার আকস্মিক বীভৎস মোচড়,  মালদার গ্রামের লোকের মুখে  সাধুভাষায়  ‘শৃগাল’  শব্দের ব্যবহার  সব মিলিয়ে এই পাঠককে বাধ্য করে হাতের বই নামিয়ে চুপ করে বসে থাকতে। দিনাজপুরের কুষুমুন্ডি ব্লক থেকে  হরিয়ানার কেশর (ক্রাশার)  মিলে কাজ করতে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ দেবশর্মা নির্বিকার বলে যান কেশর মিলের ওখানাকার ধুলোয় সবার টিবি হয়ে যেত, ডাক্তার দেখানোর চল তো ছিল না, চুপচাপ  অকাতরে মরে যেত, নয়ত পালাত অন্যত্র। মৃত লোকের বাড়িতেও যে সবসময় খবর পৌঁছায় তা নয়। কখনো তা মানুষটার পোকামাকড়তুল্য গুরুত্বহীনতায় কখনো আবার প্রাপ্য টাকাপয়সা না দেবার অসৎ উদ্দেশ্যে।  


    লেবাররা পাড়ি দেয় গ্রামের ঠিকাদারের হাত ধরে  সেখান থেকে দায়িত্ব নেয়  জেলা শহরের ঠিকাদার, ট্রেনে চেপে অন্য রাজ্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব আরেক ঠিকাদারের,  তারপর হয়ত  আরেকজন  নিয়ে কেশর মিলে কি সোনার দোকানে  কি কোনও  বাড়িঘর বানানোর কাজে, পাহাড় কাটার কাজে লাগাবে।  রিলেরেসের ব্যাটনের মত হাত বদল হয়ে যাওয়া এই লেবারদের কিস্যা দুই মলাটে ধরে রাখার জন্য লেখক ও প্রকাশকের সাধুবাদ প্রাপ্য।  


    বই – লেবার ট্রেন


    লেখক – মঞ্জীরা সাহা


    প্রকাশক – বইওয়ালা বুক ক্যাফে


    দাম – ৩৫০/-  পৃষ্ঠা - ২১১ 


    * লেখাটি ২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০২১ এই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত। 


     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • π | ০২ জুন ২০২১ ২২:৪৩494490
  • আরে এটাও মিস করে গেছিলাম। খেরোর খাতার বহু লেখাই মিস হয়ে যায়! 

  • π | ০২ জুন ২০২১ ২২:৪৬494491
  • আমার নোটিফিকেশন বাক্স থেকে খুঁজে পেলাম! 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন