রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা হালকা পোড়াদাগওয়ালা কটি হাতরুটি, তাতে রক্তের ছিটে, এই ছবি আমাদের অনেককেই তাড়া করে ফিরেছে গত বছরের বেশ কিছুদিন। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’, ওই যারা শতেকে হাজারে হেঁটে চলে মাইলের পর মাইল হাতে পিঠে বোঁচকা আর ঘাড়ের উপর বাচ্চাকে বসিয়ে। এমনিতে এ রাজ্যে আন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক আমরা দেখে আসছি বরাবরই, কিন্তু লকডাউন বোধহয় আমাদের প্রথম দেখায় এঁদের সংখ্যার ব্যপ্তি, দুর্দশার বিস্তার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এঁরা অন্যত্র যাচ্ছেন বহুদিন। মালদা থেকে দিল্লিগামী ট্রেন ফরাক্কা এক্সপ্রেস, যাকে মালদার লোক বলেন ‘লেবার ট্রেন’, লোকবোঝাই হয়ে চলে যায় দিল্লিতে শ্রমিকের যোগান দিতে। ওইরকম আরো ট্রেন চলে যায় মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, কেরালা মায় উত্তরাখন্ড পর্যন্ত। পেটের দায়ে।
হেডলাইন হবার বহু আগে থেকে চলে আসা শ্রমিকদের এই বহমান ধারা কবে থেকে শুরু হয়েছে বলা মুশকিল। ফরাক্কা স্টেশান থেকে আরো বহু ট্রেনই ছাড়ে, ছাড়ে আন্যান্য স্টেশান থেকেও। শতাব্দী, দুরন্ত, রাজধানী পূর্বা নামের ট্রেনগুলোয় চেপে লোকে বেড়াতে, ইন্টারভিউ দিতে, চিকিৎসা করাতে, ব্যবসার প্রয়োজনে, আরো নানা কাজে যায়। সেসব ট্রেনের নাম কেউ ‘লেবার ট্রেন’ না দিলেও সেসব ট্রেনের আনরিজার্ভড কামরায় গাদা ভর্তি হয়ে মানুষ যায় ‘দাদনে’ বা ‘জন খাটতে। যারা যায় তাদের সকলেই ফেরে না। কেউ ফেরে লাশ হয়ে, আধমরা হয়ে, কারোর হয়ত কোনও খবরই পাওয়া যায় না। ২৪শে মার্চ ২০২০ সারাদেশের সমস্ত ট্রেন থেমে যাবার পর থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই লেবাররা পরিচিত হতে শুরু করলেন ‘পারিযায়ী শ্রমিক’ নামে।
ব্রেকিং নিউজ হবার বহু আগে থেকেই মঞ্জীরা সাহা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে যোগাড় করে ফিরেছেন লেবারদের যাওয়া আসার ছেঁড়াফাটা কাহিনী। তারই সংকলন ‘লেবার ট্রেন’। বইটার দুটো অংশ – ‘ট্রেন যখন থামল’ আর ‘ট্রেন যখন চলছিল’। প্রথম অংশে ছয়টা আর দ্বিতীয় অংশে ষোলোটা নিবন্ধ। প্রথম অংশের অধিকাংশ খবর ও নিবন্ধগুলো উৎসাহী পাঠক লকডাউনকালে নিশ্চয় পড়েছেন দেখেছেন, তবু এক জায়গায় সংগ্রহ করে রাখা দরকার ছিল। দ্বিতীয় অংশটি এই বইয়ের আসল গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মূলত ওরাল হিস্ট্রি। এই অংশে রয়েছে সেইসব গল্প যেগুলো লেখিকা শুনেছেন মালদার চরে, দিনাজপুরের ঝাপড়াগছির বটতলায় বা গমর নদীর ধারে। ক্যাসেটবন্দী করা, খাতায় নোট করা বা শুধুই কানে শোনা সেসব কিস্যা বলেছে কখনো শ্রমিক নিজেই, কখনো মরা ছেলের মা, কখনো কবে যেন হারিয়ে যাওয়া কারো প্রতিবেশী।
গুপীর প্রতিবেশীরা যেমন মঞ্জিরা কে শুনিয়েছিলেন গুপীর মার্ডারের গল্প। প্রথমে মার্ডার মনে হলেও আসলে তো দাদনের টাকা পেয়ে আকন্ঠ মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়া জিয়ন্ত গুপীকে খুবলে খেয়েছিল ‘শৃগালে’। ঘটনার আকস্মিক বীভৎস মোচড়, মালদার গ্রামের লোকের মুখে সাধুভাষায় ‘শৃগাল’ শব্দের ব্যবহার সব মিলিয়ে এই পাঠককে বাধ্য করে হাতের বই নামিয়ে চুপ করে বসে থাকতে। দিনাজপুরের কুষুমুন্ডি ব্লক থেকে হরিয়ানার কেশর (ক্রাশার) মিলে কাজ করতে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ দেবশর্মা নির্বিকার বলে যান কেশর মিলের ওখানাকার ধুলোয় সবার টিবি হয়ে যেত, ডাক্তার দেখানোর চল তো ছিল না, চুপচাপ অকাতরে মরে যেত, নয়ত পালাত অন্যত্র। মৃত লোকের বাড়িতেও যে সবসময় খবর পৌঁছায় তা নয়। কখনো তা মানুষটার পোকামাকড়তুল্য গুরুত্বহীনতায় কখনো আবার প্রাপ্য টাকাপয়সা না দেবার অসৎ উদ্দেশ্যে।
লেবাররা পাড়ি দেয় গ্রামের ঠিকাদারের হাত ধরে সেখান থেকে দায়িত্ব নেয় জেলা শহরের ঠিকাদার, ট্রেনে চেপে অন্য রাজ্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব আরেক ঠিকাদারের, তারপর হয়ত আরেকজন নিয়ে কেশর মিলে কি সোনার দোকানে কি কোনও বাড়িঘর বানানোর কাজে, পাহাড় কাটার কাজে লাগাবে। রিলেরেসের ব্যাটনের মত হাত বদল হয়ে যাওয়া এই লেবারদের কিস্যা দুই মলাটে ধরে রাখার জন্য লেখক ও প্রকাশকের সাধুবাদ প্রাপ্য।
বই – লেবার ট্রেন
লেখক – মঞ্জীরা সাহা
প্রকাশক – বইওয়ালা বুক ক্যাফে
দাম – ৩৫০/- পৃষ্ঠা - ২১১
* লেখাটি ২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০২১ ‘এই সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত।
আরে এটাও মিস করে গেছিলাম। খেরোর খাতার বহু লেখাই মিস হয়ে যায়!
আমার নোটিফিকেশন বাক্স থেকে খুঁজে পেলাম!